Abosar

হিমসুন্দরী

সুব্রত নাগ

ঝগড়াটা আরম্ভ হয়েছিল বাঁধা গতেই। স্কুল থেকে সৌমিত্র ফিরে আসার পর চা পর্ব পর্যন্ত কোনও মতে ফ্লাড গেটটা আটকেছিল। তার পরেই এক সঙ্গে হাজার পাঁচেক কিউসেক জল ছাড়ার স্পিডে ছুটেছিল নীপার প্রশ্ন, “বিয়ের পর এই পনেরো বছরে তুমি আমাকে কী কী দিয়েছ?”

ইউনিভার্সাল এই প্রশ্নর ডিফেন্ড করার জন্য মধ্য চল্লিশের স্বামীর কিছু উত্তর তৈরি থাকে, “গুণতে বসলে ক্যালকুলেটর লাগবে।”

স্ত্রী রত্নটি এর পর গলায় বিশুদ্ধ সর্ষের তেলের ঝাঁঝ নিয়ে বলবে, “ক্যালকুলেটর কেন? হাতে গুণে হবে না?”

সৌমিত্রর মতো স্বামীরা স্বাভাবিক হার মানতে চাইবে না। বলবে,“যা দিয়েছি তার লিস্ট তো আর মেমারি ব্যাঙ্কে তুলে রাখিনি, ”

কটাক্ষ হেনে নীপা বলবে, “পাশ কাটালে তো চলবে না সোনা; যা দিয়েছ তার দু’চার পিস স্যাম্পেল ছাড়,”

শিলাবৃষ্টির মতো মুখ ছোটে সৌমিত্র’র, “টিভি, ফ্রিজ, আলমারি, ড্রেসিং টেবিল, ওয়াশিং মেশিন, টু হুইলার, বেনারসি, বালুচরী , গয়না...”

“অবজেকশন, অবজেকশনস,’’ নীপা হাত তুলে থামায়, “যা মনে আসবে বলে গেলেই হল? অর্ধেক জিনিস তো সেন্সরেই আটকে যাবে,”

“আটকালেই হল? যেগুলো বললাম সেগুলো দিইনি তোমায়?”

“বাঙালকে হাইকোর্ট দেখিও না। অর্ধেক জিনিস তো বিয়ের আগে থেকেই এ বাড়িতে ছিল। ডিভান খাট আর ড্রেসিং টেবিলটা বিয়েতে তোমার শ্বশুরের উপহার। কাজেই তুমি নিজে কী কী দিয়েছ সেই হিসেবটা করে দেখো! ”

‘অফেন্স ইজ দ্য বেস্ট ডিফেন্স’— এই তত্ত্বে বিশ্বাসী সৌমিত্র বলে, “বলছি, মিলিয়ে নাও। প্রথম বিবাহবার্ষিকীতে আংটি আর কাঞ্জিভরম, দ্বিতীয়বার ওয়াশিং মেশিন, থার্ড টাইম ডিজিটাল ক্যামেরা। পরের বার...’’ মুখের কথা কেড়ে নিয়ে নীপা বলে, “মাইক্রোওভেন, তার পরের বার মিক্সি, তার পর ইলেট্রিক আয়রন— একের পর এক ঘরকন্নার জিনিস এনে এক ঢিলে দুই পাখি মেরেছ। লজ্জা করে না তোমার? এক বার সেকেন্ড হ্যান্ড ক্যারম বোর্ড অবধি গিফট করেছ,”

বিবাহবার্ষিকীতে ক্যারম বোর্ড উপহার দেওয়াটা যে নেহাতই কাঁচা কাজ হয়েছিল সেটা স্বীকার না করে উপায় নেই। আসলে সাত হাজারি ম্যাচ বোর্ডটা কপালগুণে হাফ দামে পেয়ে যাওয়ার লোভটা আর সামলাতে পারেনি।

“কী হল?” নীপা আবার হুল ফোটায়, “এক্সক্লুসিভলি আমার জন্য কী এনেছ তুমি?”

দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়ায় ইস্কাবনের টেক্কাটা ফেলল সৌমিত্র, “আলমারি ঠাসা সিল্ক-তাঁত- জামদানি- কাঁথা স্টিচ! সেগুলো কে ব্যবহার করে? কার জন্য কেনা ওই জাঙ্গল অব শাড়ি’স?”

পাক্কা স্যাডিস্টের মতো হাসল নীপা, “ওই জাঙ্গল অব শাড়ি’সের মাত্র তিরিশ শতাংশ তোমার দান। বেশির ভাগ আমার বিয়ের আর বাকিটা হয় তোমার কিংবা আমার আত্মীয়দের দেওয়া।”

গলার পর্দা বেশ কয়েক ধাপ নেমে যায় সৌমিত্র’র। চিঁ চিঁ করে বলে “স্বামী হিসাবে বেশি নম্বর তা হলে তোমার কাছ থেকে পাচ্ছি না?”

নীপা ঠোঁট উল্টে বলে, “ওই টেনেটুনে পাসমার্ক। সে জন্যই তো বলছি, একটা ভাল সুযোগ তোমার সামনে আছে। লেটার মার্কস পেতে পার যদি কামিং এইট্টিনথ ঝক্কাস কিছু একটা প্রেজেন্ট করো।”

“বেশ তো,” সৌমিত্র মান রাখার চেষ্টায় গা ঝাড়া দিয়ে ওঠে, “বাজারে হাল ফ্যাশনের শাড়ি-গয়না কী আছে খোঁজ নাও।”

শঙ্খমালার মতো এই প্রথম নির্ভেজাল হেসে নীপা বলে, “শাড়ি -গয়না তো অনেক হল। সেই থোড় -বড়ি-খাড়া আর খাড়া-বড়ি- থোড়।”

কথার ধরনটা বিশেষ সুবিধের ঠেকল না সৌমিত্রর। আসলে ঘরপোড়া গরু সিঁদুরে মেঘে চমকাবেই। আমতা আমতা করে বলে, “থোড় বড়ি খাড়ার বাইরে কী ভাবছ?”

চেহারায় ভাবভঙ্গীতে একটা রাসায়নিক পরিবর্তন এনে নীপা একেবারে বরের গা ঘেঁষে বসে পড়ল। পাখির নীড়ের মতো চোখ তুলে বলল, “এমন একটা জিনিস যা সারাজীবনের অ্যাসেট।”

জল কোনদিকে গড়াচ্ছে বুঝতে না পারলেও সারা জীবনের অ্যাসেটের ধাক্কা যে ক’হাজারে দাঁড়াবে সেটা নিয়ে বুকে ধুকপুকানি শুরু হয়ে যায়।

বরাভয় মূর্তিতে বরকে আশ্বস্ত করতে চায় নীপা, “ভয় পাচ্ছ কেন? তুমি কি ভাবছ আমি চার চাকার কথা বলব?”

সৌমিত্র’র হার্টটা একবার চড়াক করে ঝাঁকুনি দিল। বলে কি নীপা? স্কুল মাস্টারি করে চার চাকা? প্রবল দুঃস্বপ্নেও ভাবা যাবে না।

নীপা কাবলি বেড়ালির মতো আদুরে গলায় বলল, “আমি বলছিলাম এই গরমে তুমি যদি আমাকে একটা হিমসুন্দরী উপহার দাও, তা হলে কেমন হয়?”

হিমসুন্দরী! খায় না গায়ে মাখে? ক্যাবলার মতো ওকে তাকিয়ে থাকতে দেখে নীপা বলে, “একটা ভাল বাংলা বললে তো র‌্যাডারে ধরা পড়ে না তোমার। হিমসুন্দরী মানে এসি গো এসি।”

চার চাকার মতো না হলেও এবারেও হার্টের ঝাঁকুনিটা নেহাত মন্দ হল না। এসি! কলাই-এর ডাল, বাটিচচ্চড়ি আর পোনা মাছের ঝোলওয়ালা মধ্যবিত্ত স্কুল মাস্টারের ঘরে এসি! সে তো থাকে বড়লোকি ফ্ল্যাটে, নয়তো ঝাঁ চকচকে দোকান, মল, রেস্তোরাঁয়।

সৌমিত্রর চোখমুখের চেহারা দেখে নীপাও বোধ হয় থতমত খেয়ে যায়। বরের কাঁধে আলতো ঝাঁকুনি মেরে জিজ্ঞেস করে, “এই যে শুনছ? ঘাবড়ে গেলে নাকি?”

“ঘাবড়াব না? এসব ঊনপাঁজুরে বুদ্ধি ঢোকাল কে মাথায়?’’

“ঊনপাঁজুরে বুদ্ধি আবার কী? ছেচল্লিশ ডিগ্রি তাপমাত্রা চলছে।”

“চললেই বা, তাই বলে এসি? ও সব বিলাসিতা আমাদের ফ্যামিলিতে চলে না।”

“ঠাকুরদার মতো কথা বোলো না,” নীপা গলার স্কেল চড়ায়, “রেডিও, টিভিও এক সময় বিলাসিতা ছিল। ফোনও ছিল স্ট্যাটাস সিম্বল। এখন বাড়ির কাজের মাসিও স্মার্ট ফোন নিয়ে ঘুরছে। তার পর ছেলেটা গরমের ছুটিতে হস্টেল থেকে ফিরবে, তখন কত খুশি হবে বলো তো?”

“খরচ জানো এসি লাগানোর?”

নীপা নিশ্চিন্ত করে সৌমিত্রকে, “আমি সব খবর নিয়ে রেখেছি। দেড় টন যদি নাও, পঞ্চাশ বাহান্নতে কমপ্লিট।”

“পঞ্চান্ন-বাহান্ন হাজার কি হাতের ময়লা? ভাল দেখে একটা কুলার না হয় কিনে দিচ্ছি। দশ-বারো হাজারে হয়ে যাবে।”

“কিপটেমি করো কেন? একটা এসি কিনে দিতে পারবে না।”

“পারা না পারার প্রশ্ন পরে। আগে তো দেখতে হবে, যে ইনভেস্টমেন্টটা করছ, সেটার আদৌ কোনও দরকার আছে কিনা।”

নীপা মুখ ঝামরে ওঠে, “গোটা পাড়া ঘুরে এস। প্রায় সব বাড়িতেই এসি আছে।”

“মাসে মাসে বিদ্যুৎ বিলের কথাটাও ভেবো। শেষে হাতি পোষা হয়ে না যায়।”

“অত সব হাতি-ঘোড়া জানি না। কিনে দেবে তো ভালই নইলে...” ধুপধাপ পা কাঁপিয়ে চলে যায় নীপা। বহু অভিজ্ঞতার পর সৌমিত্র জানে নীপার পরের চাল সংসারে অসহযোগ আন্দোলন। সৌমিত্র বোঝে সবই। অত্যধিক গরম, দিনে রাতে ঘুম না হওয়া। এসব সাবেকী অজুহাতের আড়ালে রয়েছে এক তীব্র নেশা। সামনের বাড়িতে এসি আছে, পিছনের বাড়িতে আছে, বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন সবার বাড়িতেই আছে। তা হলে আমাদের বাড়িতেই বা থাকবে না কেন? এখন যে ভাবে উষ্ণতা বাড়ছে তাতে গরম কমাতে শুধু ফ্যান এখন শিশু।

সৌমিত্র দ্রুত ওদের তিন ভাই বোনের ছেলেবেলার গরমের দিনগুলোকে ছুঁয়ে আসতে চায়। আম-জাম-বেল-কাঁঠালগাছে ছাওয়ায় ঘেরা ওদের দিনহাটার একতলা বাড়িটা। দুটো মাত্র শোওয়ার ঘরে দুটো সেই পুরনো আমলের সিলিং ফ্যান ছিল ভরসা। জীর্ন, হতশ্রী ডানাগুলো ঘষটাতে ঘষটাতে হাওয়ার চেয়ে শব্দ উড়াত বেশি। পড়ার ঘরে টেবিল ফ্যান কিংবা রান্নাঘরে এগজস্ট ফ্যান তখন অকল্পনীয়।

তবু স্কুল-কলেজের দিনগুলো দিব্যি কেটে গিয়েছিল তো। ছাতা, কালো সানগ্লাস আর সানক্রিম লোশন ছাড়াই তো মা-কাকিমা-দিদি-বৌদির দল দিব্যি বাইরে বেরত। নীপাকে এসব কথা বলা বৃথা। মুখ বেঁকিয়ে বলবে, “আদিখ্যেতা! ছোটবেলাকে পাশবালিশের মতো জড়িয়ে শুয়ে থাকো গে।” আশ্চর্য লাগে সৌমিত্রর।

বাল্য বা কৈশোর নিয়ে নীপা মোটেও নস্টালজিক নয়। ঠা ঠা রোদে আম কুড়ানো কিংবা টিনের চালে রাতভর বৃষ্টি পড়ার অপার্থিব শব্দ, কোনওটাই কি নীপার মেয়েবেলার কোঁচড়ে জমা পড়েনি?

 

******

 

অবশেষে হিমসুন্দরী এল ঘরে। ঠিক আঠারোতেই। এসি-র নাম শুনে বরের অবস্থা দেখে নীপার আদৌও ভরসা হয় নি। তাই লাগাতার নন কোঅপারেশন, ছেলের সেন্টিমেন্ট ইত্যাদি আক্রমণে সৌমিত্রকে ব্যাকফুটে ফেলে দিয়েছে। সকাল থেকে জল ভরা হাঁড়িতে রাখা কইমাছের মতো খলবল করে বেড়াচ্ছে নীপা। দোষের মধ্যে হাসি হাসি মুখে বরকে বলতে গিয়েছিল, “কোম্পানিগুলো এই একটা নিয়ম ভাল করেছে, ইনস্টলেশন চার্জ ফ্রি।”

মনটা তেতো হয়েই ছিল সৌমিত্রর। কাজেই হুল ফোটাতে দেরি করল না, “অনেকটা পাঁচ হাজারি শাড়ির সঙ্গে একশো টাকার ব্লাউজ পিস ফ্রি দেওয়ার মতো।”

লাগসই জবাবটা ঠোঁটের ডগাতে এলেও সেটাকে গিলে নেয় নীপা। দু’চারদিন একটু সহ্য করতেই হবে। হাজার হোক দোকান থেকে ঘরে এনে ঢুকিয়েছে। কৃতজ্ঞতা বলেও তো একটা জিনিস আছে। মুখে এক দফা হাসি ছড়িয়ে নীপা বলল, ‘‘এই গনগনে গরমে যখন ঠান্ডা ঘরে আরামে ঘুমোবে, তখন দেখবে খরচের কথাটা মনেই পড়বে না। এই তো একটু আগেই তাতানের সঙ্গে কথা বললাম। ও তো শুনেই লাফাচ্ছে।”

ধেয়ে এল সেকেন্ড হুলটাও, “তোমাদের গরম বেশি। তোমরা মায়ে-পোয়ে এসিতে ঘুমিও। আমাকে অন্য ঘরে বিছানা করে দেবে।”

বরের হাতটা খামচে ধরে নীপা, “অন্য ঘরে শুলে কিন্তু কোনও প্রাইজ পাবে না।”

হাতটা ছাড়িয়ে সৌমিত্র অন্তিম হুলটা ফুটিয়ে যায়, “গরু মেরে জুতো দান। আমার অন্তত পোষায় না।”

সৌমিত্র চলে গেলেও নীপার খুব একটা ভাবান্তর হল না। পনেরো বছর ঘর করা হয়ে গেল মানুষটার সঙ্গে। নীপা জানে পরম রমণীয় অস্ত্র দু-চারটে অ্যাপ্লাই করলেই বাবুর ব্যাঁকা মুখ সোজা হয়ে যাবে।

রাত সাড়ে এগারোটা নাগাদ এক দফা গা ধুয়ে, পাউডার ছড়িয়ে শিফনের সিওর সাকসেস নাইটিটা পরে বেড রুমে ঢুকতেই চমক খায় নীপা।

আঠারো পয়েন্টে শোঁ শোঁ করে হিমসুন্দরী চলছে। ঠান্ডা হাওয়ার স্রোত উথলাচ্ছে ঘর জুড়ে। তার চেয়েও বড় চমক বিছানায় বুক অবধি চাদর টেনে দিব্যি ঘুম দিচ্ছে সৌমিত্র। ভণ্ড চূড়ামণি কোথাকার! সাত তাড়াতাড়ি এসি-র হাওয়া খাওয়ার যদি অতই শখ, তা হলে ‘অন্য ঘরে শোব, এ ঘরে ঢুকবই না’, এসব ডায়লগ ঝেড়ে সকালে হাওয়া গরম করার কী দরকার ছিল? তবে ঠান্ডা মাথায় ভেবে দেখলে ব্যাপারটা ফেভারেই গিয়েছে নীপার। বরটা নিজে থেকেই যখন এ ঘরে এসে শুয়েছে, তখন বাগে আনার যুদ্ধ অর্ধেকটা জেতা হয়েই গিয়েছে। বরকে মৃদু ঠেলা দেয়, “এই শুনছ?”

ঘুমের দেশে সে ডাক পৌঁছায় না। পরের ধাক্কাটা একটু জোরে। যদিও নিট ফল শূন্য। এবারে রীতিমতো হ্যাঁচকা টান মারে নীপা। কাজ হয়, সৌমিত্র চোখ খুলে জিজ্ঞেস করে, “কী হল? ধাক্কা মারছ কেন?”

নীপা জানে পরম রমণীয় অস্ত্র প্রয়োগের মাহেন্দ্রক্ষণ এটাই। একপ্রস্থ খোলস ছেড়ে ফিসফিস করে বলে, “তোমার প্রাইজটা নেবে না?”

হিমসুন্দরীর সৌজন্যে বেডরুম জুড়ে হিমযুগের দাপটে জড়তার আলস্য সৌমিত্রকে আচ্ছন্ন করে রাখে। নীপার যাবতীয় অস্ত্রসম্ভারকে অকেজো, অপ্রয়োজনীয় মনে হয়। শুধু বলে, “ওই প্রাইজের কোনও দরকার নেই।” তার পর আবার চোখ বোজে।

অবাক হয়ে যায় নীপা। চাপাসুরে গর্জে ওঠে, “কী বললে? নেবে না!”

“না।”  সৌমিত্র এবার চাদরটা দিয়ে মাথাটাও ঢেকে নেয়।

অপমান! অসহ্য অপমান! মাথায় খুন চড়ে যায় নীপার। এত যত্নে সাজিয়ে রাখা অমোঘ রমণীয় অস্ত্রসম্ভারে এত সহজে মরচে ধরতে পারে না।

সন্দেহ মেটাতে একের পর এক খোলস ছাড়তে থাকে আর হিসহিসিয়ে বলতে থাকে, “নেবে না মানে? নিতেই হবে প্রাইজ তোমায়; নিতেই হবে।” কিছুক্ষণ পর সৌমিত্র গৌণ হয়ে যায়। প্রাগৈতিহাসিক নীপা হিংস্র আক্রোশে তার যাবতীয় উষ্ণতা নিয়ে আঠারো ডিগ্রির হিমসুন্দরীকে চ্যালেঞ্জ করে বসে। দাঁতে দাঁত চেপে বলে, “কুড়ি-বাইশ-চব্বিশ- ছাব্বিশ” তাপ মাত্রা এক ডিগ্রিও বাড়ে না। বড় অবহেলায় হিমসুন্দরী নীপার অমোঘ অস্ত্রকে ফিরিয়ে দেয়। নীপা শুনতে পায় হিমসুন্দরী খিলখিল করে হাসছে আর প্রতিবার হাসির সঙ্গে একরাশ বরফ ঠান্ডা হাওয়া উগড়ে দিচ্ছে।

ক্রমশঃ কুঁকড়ে যাচ্ছে নীপা; ষোল বাই চোদ্দ ঘরে হিমযুগে এখন ঠকঠক করে কাঁপছে। শূন্য দৃষ্টিতে একবার বেডরুমের এপাশে ওপাশে তাকায় নীপা। দামি বাহারি পেন্ট করা দেওয়াল, ঘড়ি, আলমারি, ড্রেসিং টেবিল, ওয়ার্ডরোব ...সব কিছু হিম কুয়াশায় আবছা হয়ে আছে।

গত পনেরো বছর ধরে এই ঘরে তিল তিল করে যতটুকু উষ্ণতা জমা হয়েছিল, হিমসুন্দরী মাত্র এক ঘণ্টায় তা বেমালুম শুষে নিয়েছে। ব্যর্থ খোলসের চাদরে নিজেকে ঢাকতে ঢাকতে নীপা বিড়বিড় করে, “থাকা যায় না, এত ঠাণ্ডায় থাকা যায় না।” সৌমিত্রকে ডাকে “উঠে এসো, এই শুনছ। ফিরে এসো।” সাড়া দেয় না সৌমিত্র।  আপাদমস্তক চাদরে মুড়ি দেওয়া টানটান শরীরটাকে মমির মতো নিষ্প্রাণ মনে হয়। তবু নীপা শেষ ডাক পাঠায়, “শুনছ, চলে এসো।” এক মুহূর্ত অপেক্ষা করে নীপা। তার পর নিঃসাড়ে বেরিয়ে আসে হিমঘর থেকে। একাই।