আজ চাঁদুদের বাড়িতে সকলে ব্যস্ত। চাঁদুর দিদি জবাকে এই প্রথম দেখতে আসছে। খড়্গডাঙা থেকে ছেলে আর ছেলের মা আসছে। দুপুরে এখানেই খাওয়া-দাওয়া করবে। সকালে ট্রেন ধরার আগে ফোনে বলে দিয়েছে, ‘মেয়ে যদি পছন্দ হয়ে যায়, দুপুরের খাওয়া ওখানেই সারব। বিশেষ কিছু করার দরকার নেই।’
তাই বললে হয়! সেই ফোন আসা ইস্তক চাঁদুর মা খুবই ব্যস্ত। সব কিছুই যে ওলট-পালট হয়ে আছে।
চাঁদুর মাসির বাড়ি কোন্নগরে, সেখানে কথার অছিলায় কথা হয়েছিল মাত্র। ‘আপনার মেয়ের বিয়ে দেবেন?’
তার পর যে এত তাড়াতাড়ি জবার কপাল ফলে যাবে, তা মালাদেবী স্বপ্নেও ভাবেননি!
সকাল থেকেই শুরু কাজ। বট্ঠাকুরের আমলের সিন্দুক থেকে বড় বড় গোটাকতক বেলুঞ্চি থালা বের করে সেগুলো পুরনো কাঁটতেঁতুল দিয়ে কুয়োতলায় মাজতে বসে মালা। ঝকঝকে হওয়া চাই। এর পর রান্নাবান্না তো পড়েই আছে।
চাঁদুর বাবা শিশিরবাবুরও সকাল থেকে ছুটোছুটির শেষ নেই। মাহারাপাড়া থেকে মুনিষ এনে ঘরদোর উঠোন পরিষ্কার করে গোবর দিয়ে নিকিয়ে নিয়েছেন। কুয়োতলায় প্রচুর শ্যাওলা পড়েছে। ব্লিচিং খড়ের নুড়ো দিয়ে ঘষে-ঘষে সবজে ভাবটা তুলতে হবে। কেউ যদি পিছলে যায় তা হলেই সর্বনাশ। বিয়েটাও পিছলে যাবে। চাঁদুর মা বারবার বলে মাথায় ঢুকিয়ে দিয়েছে, ‘দেখো, কোনও রকম খুঁত না হয়। ছেলে রেলের অত বড় ইঞ্জিনিয়ার। খড়্গডাঙার মতো শহরে দোতলা বাড়ি। থাকার মধ্যে শুধু মা আর ছেলে। আমাদের জবার কপাল ভাল বলেই দেখতে আসছে। ছোটখাটো ব্যাপারে যেন জিনিসটা কেঁচে না যায়।’
বাগানে অনেক শুকনো পাতা পড়ে আছে। দেখতে বিচ্ছিরি লাগছে। কী কী করতে হবে সব কাজ বুঝিয়ে তবে বাগদিপাড়ার স্বপ্নার সঙ্গে দেখা করার ব্যাপার। পিছন দিকে পুকুর পাড়ে সে থাকে। ওর মাটির বাড়ির পিছনে ছাঁচানিতে জাল রাখা থাকে। পুকুরচুরিতে ও উস্তাদ। পাড়ার সকলে জানে ও মাছ চোর। তবু সকলের সঙ্গে সদ্ভাব রেখেই চলে স্বপ্না। মেয়েকে দেখতে আসার কথাটা বলতেই স্বপ্ন খানিক ক্ষণ পরই কিলো আড়াইয়ের গোটা দুই কাতলা ধড়াস করে কাঁঠালতলায় ফেলে দিল।
শুধু মাছে কী হবে! একটু বাটিভরা ছাগলের মাংস না হলে, চাঁদুর মা’র মনটা খুঁতখুঁত করে। কাজেই কচি পাঁঠার মাংস আনতে ক্রোশ খানেক দূরে মামুদবাজারে ছুটতে হয়। সঙ্গে রসগোল্লা আর পান্তুয়া, দইটা যেন না ভোলে। কেননা ফাল্গুনের শেষে গোলমরিচগুঁড়ো ছড়িয়ে দইয়ের শরবত চাই-ই চাই।
বাড়িতে এত দাপাদাপি, লোকজনের আনাগোনা দেখে চাঁদুর বেশ ভালই লাগে। সে এক বার উঠোনের এ দিক তো খানিক ক্ষণ পর বাগানে। কিছু ক্ষণ কুয়োতলায় কাজ দেখে চলে যায় কাঁঠালতলায়। স্বপনকাকু বেশ বড় বড় মাছের টুকরো করেছে। তার উপর মাংস আর মালসা-ভরা দই-মিষ্টি। এ যেন বিয়েবাড়ির ভোজ। পাশের বাড়ির খেনিপিসিও মায়ের সঙ্গে হাত লাগাতে এসে গিয়েছে। রান্নাঘরে দাঁড়াতেই খেনিপিসি ওর মাথার জমাট চুলে খলবলিয়ে দেয়। নতুন কলাপাতি রঙের টি-শার্ট আর ছাইরঙা প্যান্ট পরে উঠোনময় নেচে বেড়ায় চাঁদু।
হঠাৎ ওর কানে যায় প্যঁাক প্যঁাক শব্দ। প্রথমে বেখেয়ালে ঠাহর করেনি, আবার প্যঁাকপ্যঁাকানি শুরু হতেই দেখল, হাঁসগুলোকে মা বেরই করেনি। হুদরোর কপাটই বন্ধ। দৌড়ে মা’কে সে কথা বলতেই, মা বলে, ‘ওদেরকে আজ একটু দেখিস। আমার অবসর হবে না। দুপুরে এলে চাট্টি ধান দিবি আর সেই বিকেলে তি-তি করে ডেকে তুলে আনবি।’
গ্রামের টুরক-হাঁসদা নিম্নবুনিয়াদী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্র চাঁদু এই প্রথম একটা কাজের পুরো দায়িত্ব পেয়ে খুশিতে ডগমগ।
দরজার পাটা তুলতেই হুদরো থেকে বারোটা ছাই-সাদা হাঁস গা-ঝাড়া দিয়ে লিলির সবজে চাদর ঢাকা জলে ডুবুং করে ডুবকি দেয়। ডুবে-ডুবে গুগলি খাবে।
চাঁদু আজ স্কুলে যাবে না। তাই স্নানেরও তাড়া নেই। পুকুরপাড়ে দাঁড়িয়ে ওদের হাঁসগুলোর খেলা দেখতে দেখতে কখন বেলা হয়ে যায়। ওর লম্বা ছায়াটা ছোট হয়ে পায়ের কাছে হুমড়ি খায়। আচমকা এক ঝলক মেঠো বাতাস ওকে ছুঁয়ে পুকুর জল ডিঙিয়ে বাঁশবনে ঢুকে পড়ে। সঙ্গে সঙ্গে মাংস রান্নার চমৎকার গন্ধ নাকে লাগে। খেয়াল হয়, ওর বড্ড খিদে পেয়েছে।
বাড়িতে ঢুকতেই চাঁদুর চোখে পড়ে, দাওয়ায় বসে দুজন। ওকে দেখেই ওর মা বলে, ‘কোথায় গিয়েছিলি? এই দেখ তোর নতুন জেঠিমা, আর এই হল তোর রিন্টুদা...’ চাঁদু ভীষণ লজ্জা পায়। মায়ের আড়ালে নতুন মুখগুলোকে দেখে। ওদের সুন্দর গড়ন, কথা বলার ধরন। এমনকী ওদের বসে থাকার রকমসকমও। ওর কাছে কেমন নতুন নতুন লাগে। মা বলেছে, ‘ওরা তো আর তোদের মতো বাঁশবনের ধারে থাকে না। বড় শহরে বাস, বড় বড় ব্যাপার-স্যাপার। বুঝে-শুনে কথা বলিস। মেপে-ঝেপে চলিস।’ ওদের অবাক হয়ে দেখতে দেখতে চাঁদু তার মায়ের কথাগুলো ভাবে।
তার পর কুয়োয় ঠান্ডা জলে হাত মুখ ধোওয়া, মায়ের ড্রেসিং আয়নায় চুল আঁচড়ানো, পাটের আসন পেতে খাওয়া-দাওয়া, বেলুঞ্চি থালার গায়ে চাঁদমালার মতো বাটিতে বাটিতে তরকারি, মাছ মাংস মিষ্টি দই ক্ষীর এমনকী আইসক্রিম পর্যন্ত! চাঁদু টুকটুক করে সব দেখে। খেনিপিসি তাই দেখে চাঁদুকে ফিসফিসিয়ে বলে, ‘বড় হ, তোর বেলাও এ সব হবে।’
চাঁদু ফিক করে হেসে ফেলে। দিদিও হাসে। চাঁদু চোখ গোল গোল করে দিদিকে দেখে। কী সুন্দর দেখাচ্ছে ওকে! আজ দিদি মায়ের শাড়ি পরেছে। অল্প গয়নাও পরেছে। কপালে ছোট টিপ। ঠোঁটে হালকা লিপস্টিক। ওকে অনেক বড় মনে হচ্ছে। আজ দিদি ওকে একটুও বকুনি দেয়নি। ওর সারা মুখ জুড়ে আজ কেবল খুশি।
চাঁদুও যতটা পারে হাসি-হাসি মুখ করে থাকে। নইলে এত ভাল পাত্র ফসকে যাবে যে। কিছুতেই যেন কোনও গোলমাল না হয়ে যায়।
তবু সেই হয়েই গেল। জেঠিমা, মানে ছেলের মা তখন সবে খেয়ে নিমকাঠি দিয়ে দাঁত খুঁটছেন, আর খাবারের টুকরোগুলো থু-থু করে পাশেই ফেলছেন। ঠিক সেই সময়েই প্যঁাকপ্যঁাক করতে করতে হাঁসের দল নিকোনো উঠানে এসে পড়ে। মা রে-রে করে ওঠে। চাঁদু দ্রুত দু’হাত বাড়িয়ে তাড়াতে শুরু করে, ‘যা যা এই যা!’ এই বুঝি পায়খানা করে নোংরা করে দিল!
হাঁস তাড়ানোর ব্যস্ততার মধ্যেই রিন্টুদা চাঁদুর কাছে এসে বলে, ‘বাহ্! হাঁসগুলো বেশ হেল্দি তো! তেল চুকচুক করছে।’
রিন্টুদার কথাতে চাঁদু একটু সাহস পায়। যাক বাবা, সে রকম কিছু অঘটন ঘটেনি। ‘যা যা,’ সে আরও বেশি সতর্ক হয়ে হাঁসগুলোকে খিড়কি দিয়ে বের করতে এগিয়ে যায়।
‘অ্যায় ছেলে, অ্যায়...’
পিছন থেকে নতুন জেঠিমা ডাকে, ‘একটা পালক দে তো। কানটা বড্ড গুলগুল করছে।’
চাঁদু আঁকাবাঁকা চায়। কই পালক তো একটাও খসেনি।
‘হাঁ করে আছিস কেন? দে না একটা ছিঁড়ে।’ জেঠিমা উসখুস করে। যেন এই বোকার হদ্দ ছেলেটার জন্য পালক দিয়ে কান সুড়সুড়োনোর মজাটা হাতছাড়া হয়ে গেল।
চাঁদু ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল। এ রকম আবার হয় না কি! একটা জলজ্যান্ত হাঁসের গা থেকে পালক ছিঁড়ে আনা যায় না কি!
পালক না পেয়ে শহুরে জেঠিমার হাত-পা ছোড়ার সে কী অদ্ভুত অঙ্গভঙ্গি। একটু আগে যে মুখে আহ্লাদের মাখন মাখা ছিল, সেটা কেমন খরখরে অঙ্কখাতার কাটাকুটি দাগের মতো হয়ে গেল।
‘কী রে ক্যাবলা! তোর হাঁসগুলো যে পালিয়ে গেল!’
এই যা! জেঠিমার কর্কশ গলার শব্দে নিজেকে গুছিয়ে নিতেই চাঁদু লক্ষ করে, হাঁসগুলো কখন খিড়কি দরজা দিয়ে বেরিয়ে পড়েছে।
চাঁদু মা’কে এক বার খুঁজল। ধারেকাছে পেল না। মা যদি জানতে পারে যে চাঁদু জেঠিমার মেজাজ বিগড়ে দিয়েছে, তবে আর আস্ত রাখবে না। কথাটা ভেবেই গলা শুকিয়ে আসে চাঁদুর। সে ছোটে। যে করেই হোক আজ তাকে একটা হাঁস ধরতেই হবে। একটা অন্তত সাদা, নরম, হালকা পালক এনে দিতেই হবে নতুন জেঠিমাকে।
পুকুরের ধারে আসতেই ও দেখে, হাঁসগুলো কেমন গা দুলিয়ে পাঁক-জল পার হয়ে আরও গভীর জলের দিকে প্যঁাকপ্যঁাক করতে করতে এগিয়ে যাচ্ছে।
এই সুযোগ। পাঁকের মধ্যেই ধরতেই হবে। সে পুকুরপাড় থেকে জোর লাফ মারে জলে। লাফাতেই ঝপাং করে পড়ে জল-পাঁকের উপর। তার পর উরু-ডোবা জমাট পাঁক থেকে পা দুটো টেনে টেনে বের করে। ল্যাটপেটে পাঁকের ওপর হামাগুড়ি দিয়ে, কখনও বুক ঘষটে ঘষটে দু’হাতে পাঁক সরিয়ে পাঁকালমাছের মতো এগিয়ে যায় হাঁসেদের কাছে। নতুন টি-শার্ট প্যান্টের যে কী হাল হল, চোখেও দেখে না। সে তখন তারস্বরে ডাকছে ‘আয় তি তি তি তি তৈ তৈ তৈ তৈ...’
অথচ খানিক দূরে তখন হাঁসগুলো গলা উঁচু করে ডানা ঝেড়ে জল ছিটিয়ে ছুটোছুটি করে। পড়ে থাকে শুধু পাঁকের ওপর লম্বা সরু অগভীর দাগের সারি। সেই দাগ ধরে কোনও রকমে এগোতে থাকে চাঁদু।
কী আশ্চর্য! দাগের উপর ওটা কী? পালকই তো! অর্ধেকটা পাঁকে ডুবে আছে। হাত বাড়িয়ে পালকটা ছুঁতেই এক ঝলক খুশি বুকের মাঝে উছলে ওঠে। যাক, একটা অন্তত পাওয়া গিয়েছে!
কিন্তু চাঁদু আর নড়তে পারে না কেন! অতি আনন্দে কি শক্তি লোপ পায়? জল-পাঁকের মধ্যে সে হাঁকপাঁক করে। শরীর অবশ হতে থাকে। হাত-পা অচল হয়ে যায়। ঠান্ডা পাঁক-জলে ঝিমুনি আসে।
ঢলে পড়া চোখের সামনে তখন পুকুরজোড়া পাঁক, জল, জলে ভাসা হাঁস। আর তার গায়ে লম্বা লম্বা সুন্দর দেখতে পালক।
দুপুরটা বুঝি বাঁশবনের আড়ালে ওই পুরনো শিবমন্দিরের চুড়োর পাশে জিরোচ্ছে। জেঠিমা এখনও পালকের জন্য হাপিত্যেশ করছে। কখন কানে সুড়সুড়ি দেবে। পালক না পেয়ে ভিতর ভিতর গুমরে উঠছে।
দিদি সুন্দর সেজেগুজে ঘরময় উড়ে বেড়াচ্ছে। নিজেকে প্রজাপতি ভাবছে হয়তো। মা বলেছে, ছেলেটাকে কোনও মতেই হাতছাড়া করা যাবে না। মাথার মধ্যে ঝুলে থাকা চিন্তাগুলো সব মরা বাঁশপাতার মতো ঘুরে ঘুরে ঝরে ঝরে পড়ে।
ছটফটিয়ে ওঠে চাঁদু। শরীরের শেষ শক্তি এক করে পাঁকটান থেকে বেরতে চেষ্টা করে। চেষ্টা করেই যায়...
‘রবিবাসরীয়’ বিভাগে ছোটগল্প পাঠান, অনধিক ১৫০০ শব্দে।
ইমেল: rabibasariya@abp.in সাবজেক্ট: rabibasariya galpa
ডাকে পাঠানোর ঠিকানা:
‘রবিবাসরীয় গল্প’,
আনন্দবাজার পত্রিকা,
৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট,
কলকাতা ৭০০০০১
যে কোনও একটি মাধ্যমে গল্প পাঠান। একই গল্প ডাকে ও ইমেলে পাঠাবেন না। পাণ্ডুলিপিতে ফোন নম্বর বা ইমেল আইডি জানাবেন। ইউনিকোড ব্যবহার করা বাঞ্ছনীয়।