Abosar

হনন

শ্যামলী আচার্য

দরজা যিনি খুললেন তাঁকে চেনে না তিয়াসা। মাঝবয়েসি এক মহিলা। কপালের কাছে পাকা চুলের ভাগ বেশি। মুখে হালকা প্রশান্তি মাখানো। স্মিত মুখে প্রশ্নবোধক চিহ্নও। মা পিছন থেকে বলল, ‘ও তিয়াসা। আমার মেয়ে। কালকেই এখানে এসেছে অনেক রাতে। তাই তখন আর ওকে  নিয়ে আসতে পারিনি’।

চৌকাঠের ওপারে দাঁড়ানো মহিলাটি হাসলেন শুধু। তিয়াসার কেবল মনে হল, বহু যুগের ওপার হতে...      

চোখ পড়ল ব্যালকনিতে। ওখানে ভীষণ যেতে ইচ্ছে করছে তিয়াসার। দরজার ওপারেই ডাইনিং হল। কাঠের গোল টেবিল দেখা যায় বাইরে থেকে। দুটো চেয়ার। রঙ চটা। ঘষটানো পায়া। দেখেই বোঝা যায় সামান্য নড়বড়ে।

“ভিতরে যাব একটু,” তিয়াসা প্রশ্ন করে মহিলাকে।

মহিলা মুখে কিছু বলেন না। এক পাশে সরে দাঁড়ান। হাসিমুখে এবারও সম্মতির ছাপ।

মহিলার পাশ ঘেঁষে তিয়াসা ঢুকে পড়ে ঘরের ভিতর। ডাইনিং ছাড়ালেই দেখা যায় বারান্দার দরজা। সবুজ দরজা। কমলা ফুলছাপ সিনথেটিক পরদা অল্প উড়ছে হাওয়ায়। পরদা সরালেই বাগান।

বারান্দার রেলিঙে হাত রাখে তিয়াসা। এই রেলিঙে চিবুক ঠেকানোর দিনগুলো ছুটে আসে।

পড়ে থাকা বাগান। অযত্নের জাল জড়ানো।

এক ধারে সাবেক আমলের চুন-পলেস্তরা খসা বাড়ি। বয়সের ভার চেপে বসেছে। ফুটিফাটা দাগ চারিদিকে। চওড়া চাতালে সাপের খোলস।  ভর দুপুরের শুনশান নৈঃশব্দ থেকে গোপনে একা হতে চাওয়ার ইচ্ছেগুলো বুড়বুড়ি কেটে উঠে আসে। কোনার সেই পুরনো দিঘির ঠান্ডা গভীর কালো জলে রহস্যের বুদবুদ। গত রাতে বৃষ্টি হয়েছে। শ্যাওলাধরা দালানে লেগে আছে বৃষ্টির জল। ফনফনে পুঁইমাচা থেকে টুপটাপ বৃষ্টিভেজা পাতার আড়ালে  জংলা লাউডগার আলসেমি। সকাল না বিকেল, তার ঘোর লেগে থাকে মাথায়। তুলসীপাতার আড়ালে সন্ধে প্রদীপে কালির দাগ ধুয়ে যায়নি ধারাজলে। আকাশের দিকে তাকাতে যায় তিয়াসা। এই বারান্দা দিয়ে দেখা তার সেই ছেলেবেলার আকাশ। নাঃ! কোনও আকাশ তো নেই কোথাও। চারিদিক জমাট মোড়কে ঢাকা। সূর্য, চাঁদ, তারা, আলো, মেঘ, বৃষ্টি, কেউ নেই কিচ্ছু নেই।

এই অবধি দেখেই ঘুম ভেঙে গেল তিয়াসার।

জানালার ওদিকে পাশের বিল্ডিংয়ের দোতলার ফ্ল্যাটের রান্নাঘর। চিমনির আওয়াজ বুঝিয়ে দিচ্ছে সেখানে রোজকার ব্যস্ততা শুরু হয়ে গিয়েছে।

তিয়াসার আজ তাড়া নেই। ভেবেছিল সকালে অনেকক্ষণ ঘুমিয়ে পুষিয়ে নেবে অনেক না ঘুমোনো রাত। তা আর হল কই? স্বপ্নটাও শেষ হল না ওর। কোনও কালে বিক্রি হয়ে যাওয়া সেই ছেলেবেলার বাড়ির ঠান্ডা দেওয়ালের বারান্দায় গাল ঠেকিয়ে সবে ভাবছে আকাশ দেখবে... আধখানা স্বপ্নে না-দেখা আকাশ ওর মন আবার ভারী করে দেয়।

কলিংবেল বাজল। বিলাসী। ঘড়ি না দেখেই বলে দেওয়া যায় এখন সাতটা বাজে।

লেকের ধারের ঝুপড়িতে বিলাসী তার এক বছরের ছেলে, পাঁচ বছরের মেয়ে আর ছ-সাত বছরের পুরনো বরকে রেখে চলে এসেছে রোজগার করতে। প্রথম ফ্ল্যাটে ঢুকবে ঠিক সাতটায়। সেটা তিয়াসার ফ্ল্যাট। ওকে দেখে ঘড়ি মেলাবে তিয়াসা। তারপর ঠিক পঞ্চাশ মিনিট। ওয়াশ বেসিন, ওয়াশিং মেশিন, ঝাঁটা, ন্যাতা-বালতি, বাসন-পত্র, জামা-কাপড়, আধুনিক গ্যাজেট, প্রাচীন পদ্ধতি... সব কিছু তীব্র গতিতে ঘুরপাক খায় চারপাশে। ঠিক পঞ্চাশ মিনিটের মাথায় বিলাসী বলবে, ‘আসি বউদি।’ ততক্ষণে তিন কামরার বাসস্থান যাবতীয় বাসি মলিনতা কাটিয়ে সামাজিকভাবে বসবাসের উপযুক্ত হয়ে উঠেছে।                                   

 ছেঁড়া স্বপ্ন অস্বস্তিতে রাখে। গলা জ্বালা করছে তিয়াসার। বিলাসী এখনো তার রোজকার সিস্টেমে। একঘেয়ে রুটিনে ঘুরপাক খাচ্ছে। গত সন্ধের কালবৈশাখী রেশ বাইরে সমস্ত রাস্তা জুড়ে এদিক-ওদিক ছড়ানো। বেসিনের সামনে দাঁড়াতেই চোখে পড়ে যায় কপালের কাটা দাগ। আদরের ছাপ। যে আদরের চিহ্নে থাকে রক্ত। গভীর হয়ে গেঁথে যায় অস্তিত্বে। বিলাসী ঘর মুছতে শুরু করেছে দেখে আর দাঁড়ায় না তিয়াসা। সোফায় গিয়ে পা গুটিয়ে বসে।

সুজয় ফেরেনি কাল। ফিরবে না আরও দু’দিন। অনন্ত কাজ। অসীম ব্যস্ততা। তাই তিয়াসার একমুঠো অবসর। আনমনে তাকিয়ে দেখে, বিলাসীর গোল গলা ব্লাউজের ঘাড় বেয়ে সোজা নেমেছে গভীর কালশিটে কালো দাগ।

‘কী হয়েছে রে তোর পিঠে, কালো দাগটা কীসের?’

‘ও কিছু না,’ বিলাসী এড়িয়ে যায় তিয়াসার প্রশ্ন।

এড়িয়ে না গিয়ে ওর কোনও উপায় নেই বলেই মনে হল তিয়াসার। এইটা তিয়াসার দোষ। ও সব কিছু সোজাসাপটা জিজ্ঞেস করবে। করে ফেলবে। তারপর উত্তর না পেলে, বা ঠিক মনের মত উত্তর না পেলে তা নিয়ে শুরু করবে কল্পনাবুনোট। কত গল্প মাথায় ঘুরপাক খাবে। যেমন, এখনই বিলাসীর ঘাড়ের গভীর দাগ দেখেই ওর মনে হয়, ওটাও একটা অনাবশ্যক আদরের চিহ্ন। যে আদরের যোগ্যই নয় বিলাসী।

‘আমি যাচ্ছি বউদি।’ বিলাসীর এর মধ্যেই সব ঘর মোছা শেষ।

‘তোমার কপালের দাগটায় ওষুধ দিচ্ছো না কেন,’ আঁচলে ভেজা হাত মুছতে-মুছতে বিলাসী প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয় তিয়াসার দিকে। যে আসলে তার প্রভু বা মালকিন না হলেও আর্থিক সম্পর্কে তার চেয়ে অনেকটাই উচ্চপদে। পিঠের দাগের প্রশ্নচিহ্নে যতি টানতে পালটা কপাল ছাড়া আর কি-ই বা দেখাতে পারে বিলাসী?

‘ওষুধ দিচ্ছি তো। রোজই দিই।’ আনমনে বাঁদিকের ভুরুর পাশে চিরে যাওয়া দাগের ওপরে আঙ্গুল বোলাতে-বোলাতে বলে তিয়াসা। 

‘সেদিন আমার হাতেও কাচ ফুটেছে। এই দেখো’

 বিলাসী তার বাঁ হাতের খসখসে তালু মেলে ধরে তিয়াসার সামনে। ছোট্ট এক চিলতে রেখা, আবছা। খুব ভাল করে দেখলে তবে দাগ চোখে পড়ে।

‘তোর হাতে কাচ ফুটল কীভাবে?’

‘কেন? অতগুলো গ্লাস ভেঙেছে সেদিন! সব কটা কাচিয়ে তুললাম তো। সোফার তলায় একটা টুকরো পড়েছিল। দেখতে পাইনি। ঘর মুছতে গিয়েই লাগল তাতে। আর সঙ্গে-সঙ্গে কেটে গেল।’

তিয়াসার কপাল বা বিলাসীর পিঠ জানে, এগুলো রোজকার সোহাগ। এসব সইতে হয়। জীবন এমনভাবে গড়েছে তাদের, পেট-পিঠ-কপাল-কনুই এসব মেনে নিতে আর মানিয়ে নিতে শিখে গিয়েছে দিব্যি। কিন্তু এরা খুল্লমখুল্লা সব সইলেও বিলাসী বা তিয়াসারা এই সমস্ত সত্য পরস্পরের কাছে চমৎকার আড়ালে রাখতে জানে।

 

তিয়াসার সঙ্গে এই মুহূর্তে আর কথা বাড়ায় না বিলাসী। সময় নেই। অন্য আরও চারটে বাড়িতে তার আরও কাজ। সব মিটিয়ে বাজার। বেলা বারোটায় ঝড়তি-পড়তি কিছু কাঁচা আনাজপাতি। তাই কুড়িয়ে কাছিয়ে নিয়ে ছুটতে ছুটতে ঘরে যাওয়া। ‘ঘর’ নামেই ঘর। এক ফালি আঁধার। ইঁট-কাঠ-পাথর। নোংরা জল, জমা জঞ্জাল আর ভ্যাপসা বদ গন্ধ। সঙ্গে কতগুলো হাঘরে। অকথ্য গালমন্দ। খিস্তি খেউড়। আর এই সমস্ত কিছুর মধ্যে জেগে বসে থাকে দুটো ফুল। গোলাপ আর শিমুল। গোলাপ ওর চার বছরের মেয়ে। ছোটটি ছেলে। ‘শিমুল’ নাম দিল ওই তিয়াসাবউদি। জানালা দিয়ে ছেলেবেলার দেখা শিমুল ফুলের রক্তরং মনে পড়ে ওর রোজ। তাই বলেছিল, ‘গোলাপের ভাই হলে নাম দিস শিমুল।’ বিলাসীরও মনে ধরে যায় নামটা। যদিও ওর মতো মানুষেরা নামের মাহাত্ম্যে তেমন মজে ওঠে না কখনও। ডাকতে হয় তাই ডাকা। হুলো কিংবা পাঁচুর জায়গায় হঠাৎ ‘শিমুল’ শুনে চোখ কপালে তোলে অনেকেই। রঙ্গ-ব্যঙ্গে হেসে গড়িয়ে তারা ‘শিমুল’কে মুলো বলেই ডাকে বেশিরভাগ সময়।
রাঙা মুলোর মত ফরসা ধবধবে ছোট্ট ওই ফুলদুটোর টানেই বিলাসী ঘরে ফেরে। রোজ।

বিলাসী ফিরতে ফিরতে ভাবে, আজ শেষ দেখে ছাড়বে ও। একবার গায়ে হাত তুলুক, থান ইঁট তুলে নিয়ে থেঁতো করে দেবে মাথা। কিংবা বঁটি। ঠিকঠিক কোপ মারতে পারলে গলার নলি দু’খান করা যাবে না? দিব্যি যাবে। রোজ ভাবে। বাজারে ছাড়ানো মুরগির পালকস্তূপে জমে থাকা শুকনো রক্তে, মাছের দোকানে আঁশ ধুয়ে রাখা ধারালো বঁটিতে চলকে ওঠে ওর হিংস্র ইচ্ছে।

ওর জীবনে দুটো নিষ্পাপ ফুল এসে পৌঁছল ঠিকই, কিন্তু কী ভয়াবহ যন্ত্রণা বইতে হয়, বইতে হচ্ছে ওর রোজের বেঁচে থাকায়! ক্লাস এইট পাশ করে আর পড়তে পারেনি বিলাসী। বিলাসীবালা পরামানিক। দু’ফালি ইঁটের ওপর ক্ষুর-মগ-আয়না সাজিয়ে বসা গুরুপদ পরামানিকের মেয়ে বিলাসী। পড়ার ইচ্ছেটাই যার কাছে অবাস্তব স্বপ্ন। নিতান্তই বিলাসিতা। তাই ক্লাস এইটেই ইতি। বয়সের দাগ ষোলো পুরতে না পুরতেই টেনে হিঁচড়ে জুড়ে দেওয়া আর এক গোয়ালে। সেখানে নামমাত্র মূল্যে পেটের ভাত, পরনের কাপড়, মাথার উপর টিন বা টালি আর জৈবিক চাহিদা পূরণ করা যায়। অতএব ছিপি তৈরির কারখানায় কাজ করা বাচ্চুরা অনায়াসে দখল করে ফেলে বিলাসীদের।

গুরুপদ ফুটপাথে ইট সাজিয়ে বসে। বসেই থাকে। তার ঘরে আরও অনেক হাঁ-করা মুখ। অন্তত একটা মুখ তো কমলো।

বাচ্চু কেন ওকে রোজ মারে? বিলাসী ঠিকঠাক কারণ বোঝে না আজও। যেদিন বাংলা মদের গন্ধ ওর সারা শরীরে, সেদিন মারে। যেদিন মদ না খেয়ে ফেরে, সেদিনও মারে। হাতের সুখ যেন। আগে বিলাসী কাঁদত। পালটা শরীর দিয়ে ভোলাত। এখন কাঁদে না। দাঁতে দাঁত চেপে থাকে। কুঁকড়ে থাকে। গুটিয়ে একপাশে শুয়ে থাকে। আর ফুল দুটোকে আগলে রাখে। তাদের গায়ে যেন হাত না পড়ে। ওরা যেন এই আঁচে কোনওভাবে ঝলসে না যায়।

আজ তিয়াসা জিজ্ঞেস করল ওর পিঠের কালো দাগটার কথা। এমন প্রায়ই দেখে। কখনও জিজ্ঞেস করে, কখনও করে না। কিন্তু তিয়াসা নিজেও তো সেই একই অভ্যেসের দাস। চোরাগোপ্তা সেই দাগ ঢেকে রাখে অনেক দামি প্রসাধনে, আবরণে, আভরণে। বিলাসী ভাবে, একদিন তিয়াসাকেই জিজ্ঞেস করবে, পেটের ভাত, পরনের কাপড় না শরীরের আগুন, কোনওটার কমতি পড়ে ওদের সংসারে।        

 

বিলাসী চলে গেলে তিয়াসা ঘর গুছোয়। আলমারি থেকে সব জামা-কাপড় টেনে নামায়। ইস্ত্রি করতে হবে বলে কিছু কাপড় জড়ো করে। রং মিলিয়ে মিলিয়ে শাড়ি সাজায়। কোনওটা সিল্ক, কোনটা তাঁত, তারও দলাদলি চলে। কোন হ্যাঙারে কটা শাড়ি, কোন রং, কেমন সুতো, কেমন ডিজাইন, সব কিছু এলোমেলো করে ফেলে তাকে। গোছাতে বসেও গোছানো হয় না।

কমলা জমির কাঞ্জিভরম শাড়িটা দেখে মনে পড়ে পিউয়ের কথা। ওর বোন পিউ। বাবা ওর নামের সঙ্গে মিলিয়ে নাম রেখেছিল পিয়াসা। অনেক দূরে থাকে পিউ। সেই কানাডায়। ম্যানেজমেন্ট পাশ করে প্রথম চাকরি পেয়ে জন্মদিনে ওকে দিয়েছিল শাড়িটা। এই শাড়িটাতেই ফাঁস লাগাতে ইচ্ছে করে ওর। কালো পাড় থাকবে আড়াআড়ি। ঘরের কচি সবুজ ব্যাকগ্রাউন্ডে ভাল খুলবে। ঝুলতে থাকবে উঁচু সিলিং ফ্যান থেকে। প্রায় ছ’ফুট দু’ইঞ্চির একটা লোককে ফাঁস দিয়ে উপরে চড়িয়ে দিতে যে মিনিমাম শক্তি প্রয়োজন হবে, সেটুকুর জন্য ও জান লড়িয়ে দেবে। একবার ঘাড় তুলে দেখে নেয় ছাদে আটকানো গাঢ় কফি-রঙের ফ্যান। কল্পনা করে সিনেমায় দেখা ফাঁসি-লটকানো কোনও চরিত্র। কতটা হাঁ-করা মুখ, চোখ দুটো খোলা না বন্ধ, জিভ বেরিয়ে ঝুলে পড়েছে কিনা, সবটা খুঁটিয়ে আজ বুঝে নিতে চায় তিয়াসা। 

যদি ঘুমের মধ্যে গলার নলি কেটে দিতে পারে কুচ করে... তার কিচেন ক্যাবিনেটে অনেক রকম ছুরির ভিড়। তিন-চারটে বেছে রাখা আছে। পছন্দমতো তুলে নিলেই হল। অঘোর ঘুমে আচ্ছন্ন থাকা লোকটার গলা-চিবুকের মাঝের নরম জায়গায় ছুরিটা দু’হাতে চেপে ধরে ঠিকঠাক পজিশনে বসিয়ে দেওয়া। ব্যস। তেমন কষ্টও হবে না। আর কষ্ট হলেই বা কি! কাচের গ্লাস, পাথরের অ্যাশট্রে, গান-মেটালের শোপিস, ছবির ফ্রেম, এগুলোর বিঁধে যাওয়ার কষ্টের তুলনায় ধারালো ছুরির নিখুঁতভাবে বসে যাওয়াতে তেমন যন্ত্রণা হওয়ার কথা নয়।

তিয়াসা আলমারিতে কিছু জামা-কাপড় গুছিয়ে তোলে। কিছু দলামোচা করে ঢুকিয়ে দেয়। ভাল লাগে না আর গোছাতে। কিছু খাওয়া দরকার। সকাল থেকে মাথা ভার। কেন? স্বপ্নে আকাশ দেখতে পায়নি বলে? কালীঘাটের বাড়িতে আকাশ দেখা যেত ঝকঝকে। এখন সাদার্ন অ্যাভিনিউ-র ফ্ল্যাটের ব্যালকনিও আকাশ দেয় একফালি। সঙ্গে লেকের ধারে সবুজ গাছের মাথা। সারবাঁধা।

স্বপ্নে না-দেখা আকাশ ওকে ডাকে। সঙ্গে ছেলেবেলার বাড়ি। যে বাড়িতে দুপুরে কান পাতলে ডাহুক কিংবা কুবো পাখির ডাক শোনা যেত। সন্ধেয় ঝিঁঝির কোরাস। পিউর গুনগুন করে পড়া মুখস্থ। মায়ের লক্ষ্মীর পাঁচালি। জেঠিমার হালকা ভাঙা গলায় অতুলপ্রসাদ। ঠাম্মার ভূতের গল্প। অনেক শব্দের ভিড় সারাদিন। তবু সেখানে কাচের বাসন ভেঙে পড়েনি, মার্বেল মেঝেতে স্টিলের জগ আছড়ে পড়েনি, ফরসা চামড়ায় আদরের টুকরো বিঁধে যায়নি।

শুকনো পাঁউরুটি চিবোতে চিবোতে তিয়াসা ঠিক করে, ও বেরবে। বাইরে। রাস্তায়। তেমন বেলা গড়ায়নি এখনও।

 ড্রাইভারকে ডেকে নেবে কিনা ভাবে একবার। তারপর মনে হয়, থাক। একাই ঘুরবে। নিয়মহারা। বাস-ট্রাম-ট্যাক্সি-অটো, যা পাবে তাতে করেই। নিজের জন্য রান্না বাতিল। রোজকার একঘেয়ে কাজগুলো ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দেয় তিয়াসা। হঠাৎই ভিতর থেকে একটা তাড়াহুড়ো তৈরি হয়। বেরিয়ে পড়তে হবে। এখনই। কোথায় যেন দেরি হয়ে যাচ্ছে। কিসের যেন তাড়া!

মোবাইল বিছানার চাদরের ওপর আলতো করে শুইয়ে রেখে বেরিয়ে পড়ে তিয়াসা। কারও কোনও কথা শোনার কোনও দায় নেই ওর আজ।

ফোন নেই। অতএব কোনও পিছুটানও নেই। তিয়াসা রাস্তায় নেমে ঠিক করে, ও বাসে উঠবে। স্টপের পাশেই ওষুধের দোকানে ঢোকে একবার। তারপর শেডের তলায় এসে দাঁড়ায়। বেশ রোদ আজ। কুঁচকে যাওয়া ভুরুর ওপর আলতো করে হাত রাখে তিয়াসা। যাতে  রোদের কঠিন আঙুল চোখে ঢুকে যেতে না পারে।

পর পর দুটো বাস এল। দেখতে ভাল নয় তেমন। একটু যেন মলিন। ভিড় নেই। অথচ কেমন যেন বিষণ্ণ। মনখারাপের গন্ধ মাখানো। তিয়াসা দেখে, ওরা কেমন পা ঘষে ঘষে বড় অনিচ্ছায় এসে দাঁড়িয়ে আছে। কন্ডাক্টরের ডাকে একটা বাসে উঠে পড়ে তিয়াসা। মোটামুটি ফাঁকা বাসে জানালার কোনায় মাথা হেলিয়ে দিতে না পারলেও পাশে বসে দেখা যায় রাস্তার ব্যস্ততা।

বাস। বাস থেকে নেমে অটো। কিছু পথ হেঁটে চলা এলোমেলো। সঙ্গে মেশানো রইল কারও স্কুল যাওয়ার ছুটোছুটি। হইচই। উজ্জ্বল মুখে অজানা আলোয় ছটফটে বকবকানি। আবার একদলের ফিরে আসা পথে ক্লান্তি মাখানো গুজগুজ। বাসে ওঠা যাত্রী তার হেডফোনের জট ছাড়িয়ে নিয়ে কানে গুঁজে নেয় একলা চলার ছাড়পত্র। জ্যামে দাঁড়ানো বাসে অফিসে সম্ভাব্য লেটমার্কের উষ্মা। দুপুরের ঝাঁ ঝাঁ রোদে জানালায় ঢুলে পরা মধ্যবয়স। তিয়াসা দেখে বেড়ায় নেলপালিশের বেরঙিন আঁচড়, মাথার চুলে জিঘাংসার মতো আটকে থাকা নানা মাপের ক্লিপ। হরেক মোবাইলের ডিজাইন, ব্যাগের স্ট্রাপ, ব্লাউজের পট্টি, রেশম আঁচলের আলগা সুতো। ট্রামে বাসে অটোতে মেট্রোয় সদ্য কিশোরের আগলে চলা কচি বান্ধবীর গদগদ মুখ। দেখতে দেখতে ঝিম ধরে যায় তিয়াসার। কত কিছু দেখা বাকি তার।

সমস্ত দিন ধরে ঘুরে বেড়ায় তিয়াসা। এক রুট থেকে অন্য রুটে। হাতবদল হয়ে যায় যেন অনায়াসে। সন্ধে ছাড়িয়ে রাত নামলে বিলাসীরা যখন ঘরে ফেরে, তিয়াসা তখনও রাস্তায়। অনেক মুখের ভিড়ে কোনও একজন হয়ে।

সদ্য শান দিয়ে আনা কাটারিটা তেলচিটে বালিশের তলায় সাবধানে রাখে বিলাসী। আজ ঘুমোনোর সময় মুঠো করে ধরে থাকবে তার রক্ষাকবচ। ঠিক সেই সময় দমদম থেকে দক্ষিণে আসার সব মেট্রো বন্ধ হয়ে যায়। সমান্তরাল দুটো লোহার পাতের পাশে শুয়ে পড়ে তিয়াসা ফিরে যায় ভোরবেলার স্বপ্নে। আবার সেই বারান্দায়। সেই অস্পষ্ট আকাশের কাছে।

 

 

‘রবিবাসরীয়’ বিভাগে ছোটগল্প পাঠান, অনধিক ১৫০০ শব্দে।
ইমেল: rabibasariya@abp.in সাবজেক্ট: rabibasariya galpa

ডাকে পাঠানোর ঠিকানা:

‘রবিবাসরীয় গল্প’,

আনন্দবাজার পত্রিকা,

৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট,

কলকাতা ৭০০০০১

যে কোনও একটি মাধ্যমে গল্প  পাঠান। একই গল্প ডাকে ও ইমেলে পাঠাবেন না। পাণ্ডুলিপিতে ফোন নম্বর বা ইমেল আইডি জানাবেন। ইউনিকোড ব্যবহার করা বাঞ্ছনীয়।