Abosar

স্বীকারোক্তি

সিদ্ধার্থ মুখোপাধ্যায়

রাধা নিমগ্ন হয়ে প্রহর গুনছিল, তার সারা অঙ্গ কারও পায়ের শব্দ শোনার জন্য উন্মুখ হয়ে ছিল। প্যাঁচ-কাটা কল থেকে যেমন ফোঁটা ফোঁটা জল পড়ে, তেমনই এক-একটা মুহূর্ত খসে পড়ছিল তার কোলের উপর, উরুর উপর আলগোছে ফেলে রাখা হাতের আঙুলের ফাঁক গলে নীচে নেমে যাচ্ছিল। রাধার মনে হচ্ছিল আরও কিছু ক্ষণ এই ভাবে বসে থাকলে ঘরের মেঝে ভাসিয়ে মৃত সময় তার গোড়ালি বেয়ে উঠে আসবে। অথচ স্থাণু হয়ে বসে থাকা ছাড়া তার আর কোনও উপায় ছিল না। সন্ধে পেরতে এক বার কেবল উঠে গিয়ে ঘরের আলোটা জ্বালিয়ে দিয়ে এসেছিল। সদর দরজা অর্ধেক খুলে রেখেছিল, যাতে বোঝা যায় বাইরে করিডরে পড়ে থাকা যৎসামান্য আলোটুকুর দায় রাধারই। রাধাদের এই আড়াই কামরার ফ্ল্যাটটা আবাসনের সব থেকে উপরের তলায়। সামনের ফ্ল্যাটটা কয়েক মাস হল বন্ধ পড়ে আছে, ফলে ছাদে যাওয়ার সিঁড়ির মুখে ঘন অন্ধকার। রাধা জানে মধু ছাদের সিঁড়িতে লুকিয়ে আছে, অপেক্ষা করে বসে আছে কখন অয়ন ফিরবে, দরজা খোলা দেখে অবাক হবে, আর মধু ছায়ার মতো অয়নের পিছনে এসে দাঁড়াবে। 

মধু এসেছিল দুপুরবেলায়, আগে থেকে কোনও খবর দেয়নি। রাধা সবে স্নান করে বেরিয়েছে, দরজা খুলে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গিয়েছিল। মিলিটারি ইউনিফর্ম, মুখভর্তি দাড়ি গোঁফ, রোদে পোড়া চেহারা... মধু হেসে বলেছিল, “চোখ খারাপ হয়েছে না কি, চিনতে পারছ না?”  

রাধা তার মোহন হাসিটি দেখে চিনেছিল, বলেছিল, “ভিতরে এস, চোখের আর কী দোষ? রূপখানা যা খোলতাই হয়েছে!” 

মধু বলেছিল, “রাধে, এই রূপ দেখেই তো এক দিন মজেছিলে, মনে পড়ে?”

রাধা হাসতে হাসতে বলেছিল, “সত্যি মজেছিলাম না কি? কে জানে? কবেকার কথা... তামাদি হয়ে গিয়েছে সে সব।” 

মধু পিঠের ব্যাগ নামিয়ে বসার ঘরের সোফায় গা এলিয়েছিল, বলেছিল, “হঠাৎ এসে পড়ে উপদ্রব করছি না তো? কর্তা কোথায় তোমার?”

 আরও পড়ুন: ছোটগল্প ব্রজর দুঃখ 

রাধার মুখে মেঘ জমেছিল। মধু এত দিন পর এসেছে, রাধা এখনই অয়নের কথা, তার শয়তানির সাতকাহন মধুকে শোনাতে চাইছিল না। ঝাঁপি খুলে বসলে কোন কথা কোথায় গড়িয়ে যায়! মধু মুখেই অমন ঘর-জ্বালানি-পর-ভোলানি হাসি ঝুলিয়ে রাখে, ভিতরে ভিতরে সাংঘাতিক রগচটা! প্রসঙ্গ পাল্টাবার জন্য বলেছিল, “চা খাবে?” 

রাধার ম্লান মুখ মধুর চোখ এড়ায়নি। তবে সে চাপাচাপি করেনি, ভেবেছিল ইচ্ছে হলে রাধা নিজে থেকেই বলবে, নয়তো পরে জিজ্ঞেস করে নিলেই হবে, আছে তো কিছু ক্ষণ... হালকা গলায় বলেছিল, “সে কী গো রাধারানি, এই অবেলায় চা? ভাত খাওয়াবে না? খুব খিদে পেয়েছে, চা খেলে খিদে মরে যাবে যে।”

রাধা অপ্রস্তুত হয়ে বলেছিল, “দেখো কাণ্ড, আমিও যেমন!” 

রান্নাঘরে উঠে গিয়েছিল। নিজের খাবার বেড়ে এনে দিয়েছিল মধুকে। মধু যেন জানত, একটা প্লেটের খাবার দুটো প্লেটে ভাগ করে নিয়েছিল, রাধাকে জোর করে সঙ্গে বসিয়ে খাইয়েছিল। 

ভাতের শেষ দানাটি খুঁটে খাওয়ার পরে হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে একটা তৃপ্তির ঢেকুর আড়াল করে জিজ্ঞেস করেছিল, “এ বার বলো, কেমন আছ তুমি?” 

রাধা বলেছিল, “কেমন আর থাকব, যেমন দেখছ...”

মধু খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেছিল, রাধার চোখের নীচে কালি, গালে নীল হয়ে ফুটে থাকা আঙুলের দাগ, গলার পাশে কালশিটে... সকালে অনেক ক্ষণ বরফ ঘষেও গত রাতের নির্যাতনের ছাপ তুলতে পারেনি। গত কাল রাতে অয়ন রাক্ষস হয়ে গিয়েছিল। এমনিতেই মদ গিললে তার হিতাহিত জ্ঞান থাকে না, তার উপর ছানার ডালনায় তার নুন কম লেগেছিল। সত্যিই কি রান্নায় নুন কম হয়েছিল, না কি অয়ন ছুতো খুঁজছিল? রাধা যখন চুলের গোড়ার ব্যথা সহ্য করতে না পেরে ককিয়ে কেঁদে উঠেছিল, অয়ন তাকে ছেড়ে নিত্যদিনের অভ্যাস মতো একটা সিগারেট ধরিয়ে ছাদে উঠে গিয়েছিল, যেমন প্রতি রাতে যায়... মানে যে সব রাতে সময় মতো নিজের পায়ে হেঁটে বাড়ি ফিরতে পারে! যেন সত্যিই কিছু অসৈরণ ঘটেনি।

রাধার অস্বস্তি হচ্ছিল। বলেছিল, “কী দেখছ অমন করে?” 

মধু জবাব দেয়নি, মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল। রাধা তার চিবুক ধরে নিজের দিকে মুখ ফিরিয়ে দেখেছিল তার চোখ জ্বলছে, ধকধক করে। রাধা প্রমাদ গুনেছিল। মধুর রাগ বড় ভয়ঙ্কর। হাত ধরে অনুনয় করেছিল, “শান্ত হও, বেঁচে থাকতে গেলে ওটুকু সব মেয়েকেই সহ্য করতে হয়।”

মধু হাত ছাড়িয়ে নিয়েছিল, বলেছিল, “একে বেঁচে থাকা বলে?” 

রাধার চোখে জল এসেছিল। বলেছিল, “ছাড়ো ও সব কথা। এত দিন কোথায় ছিলে? এক বারও আমার কথা মনে পড়েনি?” 

মধু জানিয়েছিল, এত দিন অরুণাচলে ছিল, এ বার পোস্টিং হয়েছে ওয়াঘা বর্ডারে, পরের দিনই চলে যেতে হবে, মাঝখানে এক দিন ছুটি পেয়ে রাধার সঙ্গে দেখা করতে এসেছে। রাধা তো সর্বদাই তার চোখের ভিতর বসবাস করে... তার কথা মনে পড়বে না, তা কি হয়? 

আরও পড়ুন: ছোটগল্প পুতুল

রাধা বলেছিল, “সীমান্তে থাকো, গোলাগুলির মধ্যে... তোমার জন্য বড় ভয় করে, জানো! মাঝরাতে ঘুম ভেঙে জেগে বসে থাকি।”

মধু বলেছিল, “ভয় পাও কেন? আমি তো নিজে যুদ্ধ করি না। আমার কাজ হল আকাশে কান পেতে শত্রুপক্ষের কথাবার্তা শোনা, যারা ফ্রন্টে যায় তাদের বুদ্ধি জোগানো, কৌশল ঠিক করা... এই সব আর কী!” রাধা উৎসাহ দেখিয়ে শুনছিল, ভেবেছিল এ-কথা সে-কথায় মধুর রাগ পড়ে যাবে। কিন্তু অত সহজে কি ভবী ভোলে? শিকারি চিল যেমন অবধারিত ভাবে শস্যখেতে লুকিয়ে থাকা মেঠো ইঁদুরের উপর নেমে আসে, মধুও আসল কথায় ফিরে এসেছিল। বরফের মতো ঠান্ডা গলায় বলেছিল, “অয়নের মতো লোকেদের এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকার কোনও অধিকার নেই।”

রাধা এই ভয়টাই পাচ্ছিল। বলেছিল, “তোমার দুটি পায়ে পড়ি, রেহাই দাও।”

বলেছিল বটে, কিন্তু ঠিক জানত, মধুর কথার নড়চড় হয় না। মধু বুঝিয়েছিল, “দেখো রাধা, সুখের চেয়ে স্বস্তি ভাল। অয়নকে নিকেশ করার দায়দায়িত্ব সব আমার। বিশ্বাস রাখো, এক ফোঁটা রক্তপাত হবে না, কেউ কিছু জানবে না, সব যেমন চলছিল তেমনই চলবে, শুধু তুমি মুক্তি পাবে, অয়নও।” 

রাধা বলেছিল, “যদি ধরা পড়ে যাও! যদি অয়ন তোমার কোনও ক্ষতি করে দেয়! আমার জন্য কেন মিছিমিছি নিজের জীবনের ঝুঁকি নেবে?”

মধু বলেছিল, “চিন্তা কোরো না। খালি হাতে মানুষ মারার ট্রেনিং নিয়েছিলাম এক সময়। অয়ন আমার কিছু করতে পারবে না। বলছিলে না, অয়ন রোজ রাতে সিগারেট খেতে ছাদে যায়? কাল সকালে ওয়াচম্যান ওভারহেড ট্যাঙ্কের জল মাপতে গিয়ে দেখবে ওর ঘাড়-দোমড়ানো লাশটা ট্যাঙ্কের পিলারের আড়ালে পড়ে আছে। সবাই ভাববে, মদের নেশায় টাল সামলাতে না পেরে আলটপকা পড়ে গিয়ে ঘাড় মটকেছে। তুমি ভোর রাতে লোকাল থানায় গিয়ে একটা মিসিং কমপ্লেন লিখিয়ে দিও। বোলো মাঝরাতে গিয়েছিলে ছাদে খুঁজতে, দেখতে পাওনি, ভেবেছিলে অন্য কোথাও চলে গিেয়ছে। এমন তো সে প্রায়ই করে থাকে, সিগারেট ফুঁকতে যাচ্ছি বলে বেরিয়ে শুঁড়িখানা বা বেশ্যালয়ে গিয়ে বসে থাকে, প্রবৃত্তি মিটলে নিশ্চয়ই ফিরে আসবে।” 

রাধা বলেছিল, “আমার ভয় করছে মধু, ভীষণ ভয় করছে। তার চেয়ে বরং আমিই... এক চিমটে বিষ জোগাড় করে রেখেছি... তুমি তো জানো, কোবরেজ দাদু ছোটবেলায় হাতে ধরে জড়িবুটি বানানো শিখিয়েছিলেন, কোন ধাতু জিভে ছোঁয়ালে মুহূর্তে মরণ, কোন বিষ পান্তাভাতে মিশিয়ে খেলে নিজের অজান্তেই শ্বাসরোধ হয়ে আসে, আমার থেকে ভাল কে জানে?”

মধু রাধার মুখ চেপে ধরেছিল, কাছে টেনে কপালে ঠোঁট ঠেকিয়েছিল, বলেছিল, “সখি, ভয় পেয়ো না, আমি আছি, আমার ওপর ভরসা রাখো।”

রাধা মধুর বুকে মুখ লুকিয়ে অস্ফুটে বলেছিল, “পাপ লাগবে না তো? তুমি ঠিক জানো?”

মধু বলেছিল, “কিসের পাপ? অয়নের সময় ফুরিয়েছে, আমরা তো নিমিত্ত মাত্র, বাঁচতে চাও না?”

“চাই... চাই...”

“তুমি উদ্বিগ্ন না হয়ে, বাঁশি শোনো... মন ভাল হয়ে যাবে।”

পাশে নামিয়ে রাখা ব্যাগটা থেকে একটা আড়কাঠের বাঁশি বার করে ফুঁ দিয়েছিল মধু। সুরের মূর্ছনা ছড়িয়ে পড়েছিল রাধার বিষণ্ণ মধ্যবিত্ত সংসারের আনাচে কানাচে। আহা, কত দিন পর মধুর বাঁশি শুনল রাধা! তার সমস্ত অস্তিত্ব কখন যে সেই অপার্থিব সুরে ভর করে মধুর দুই ভুরুর মাঝখানে মিশে গেল, রাধা জানতেও পারল না। 

আলো পড়ে আসতে মধু উঠে দাঁড়িয়েছিল। বলেছিল, “তুমি নিশ্চিন্তে বসো এখানে, আমি ছাদের সিঁড়িতে লুকিয়ে থাকব, অয়ন এলে নেমে আসব।” 

অয়ন এখনও আসছে না, কোন চুলোয় গিয়ে বসে আছে কে জানে? ফিরবে তো রাতে? কোনও কোনও দিন দেরি হয় বটে, অটোরিকশাওলার কাঁধে ভর দিয়ে সিঁড়ি চড়ে, কিন্তু ফিরে আসে। না ফিরলে রাধার ওপর রোজকার জুলুম করায় ফাঁকি পড়ে যাবে যে! রাধা উঠে গিয়ে ঘরের লাগোয়া ঝুলবারান্দায় দাঁড়াল। রেলিঙে ঝুঁকে দেখল, রাত্রির নির্জন পিচ রাস্তা সাপের মতো নিজেকে গুটিয়ে নিচ্ছে, তার অমসৃণ ত্বকে হ্যালোজেন আলোর চারচৌকো নকশা। রাস্তা ফাঁকা দেখে উল্টো ফুটপাতে বন্ধ পানের দোকানটার পাশের আলো-আঁধারিতে এক ভিখারি দম্পতি খুনসুটি শুরু করেছে, আর কেউ নেই। রাধা বারান্দা থেকে ফিরে এল, এক বার গলা তুলে ডাকল, “মধু...”, সাড়া পেল না। ঠিক সেই সময় টেলিফোনটা ঝনঝন করে বেজে উঠল। রাধার বুকের ভিতরটা কেঁপে উঠল। টলোমলো পায়ে গিয়ে ধরল ফোনটা, অন্য দিক থেকে ঘড়ঘড়ে গলায় কেউ জিজ্ঞেস করল, “রাধিকা ঘোষ? অয়ন ঘোষের মিসেস?” 

রাধা বলল, “বলছি...”

অন্য দিকের গলাটা বলল, “আপনি এখনই এক বার ওরিয়েন্টাল নার্সিংহোমে চলে আসুন, আপনার হাজ়ব্যান্ড অ্যাডমিটেড, ক্রিটিক্যাল কন্ডিশন, দেরি করবেন না।”

লোকটা নার্সিংহোমের ঠিকানা দিল, যাওয়ার রাস্তা বাতলে দিল, রাধা জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে ওর? অ্যাক্সিডেন্ট? আপনি কে বলছেন?”

লোকটা বলল, “আমি লোকাল থানার ডিউটি অফিসার, অয়ন না কী যেন নাম আপনার স্বামীর... দেশি মদের আড্ডায় বেহুঁশ হয়ে পড়ে ছিল, সম্ভবত চোলাই মদ থেকে বিষক্রিয়া। বাসি পচা মদের চাট থেকেও হতে পারে। ইয়ার দোস্তরা তুলে এনে নার্সিংহোমে ফেলে দিয়ে পালিয়েছে, যাওয়ার আগে আপনার নাম আর ফোন নম্বর ছেড়ে গিয়েছিল, তাই আপনাকে ফোন করছি।” 

রাধা বলল, “আসছি...”

ফোন রেখে সদর দরজা খুলে ডাকল মধুকে, কেউ সাড়া দিল না। সিঁড়ি ভেঙে ছাদের দরজা পর্যন্ত দেখে এল, কেউ নেই। এমনকি মধু যে এসেছিল ধুলোসিঁড়িতে তার চিহ্ন মাত্র নেই। মধু কি তাকে না বলেই চলে গেল? যাওয়ার আগে এক বার জানান দিয়ে গেল না? অথচ একটু আগেই কত না মন ভুলানো কথা! রাধার হঠাৎ সন্দেহ হল, মধু সত্যিই এসেছিল তো, নাকি রাধা নিজের মনেই... কে জানে! নিশ্চিত হতে পারল না বটে, তবু অভিমান হল, ওই এক জনই তো বন্ধু রাধার!

রাধার অবশ্য এখন ঠোঁট ফুলিয়ে বসে থাকার সময় নেই। সামনে অনেক কাজ... নার্সিংহোম, থানা পুলিশ, শ্মশানঘাট। সব একা একা দৌড়োদৌড়ি করতে হবে। রাধা জানে অয়ন আর ফিরবে না। সকালে যখন লুচি আলু-চচ্চড়ি খেয়ে বেরোচ্ছিল, তখন থেকেই জানত অয়ন আর বাড়ি ফিরবে না। পোশাক বদলে বেরোবার আগে রাধা এক বার চট করে রান্নাঘরে উঁকি দিয়ে দেখে নিল, সকালের রান্নার বাসন, অয়নের শেষ খাওয়া থালা বাটি ঝকঝকে তকতকে করে মেজে তাকে তুলে রাখা আছে কি না। বলা কি যায়, কার কখন সন্দেহ হয়!

ছবি: দীপঙ্কর ভৌমিক