Abosar

স্বার্থপর

সায়ন্তনী পূততুন্ড

আপনি কী শুরু করেছেনটা কী? রোজ আপনার ওই হুমদোটার জ্বালায় আমার ছানাপোনারা অতিষ্ঠ! এক নম্বরের স্বার্থপর ও শয়তান। এর পর ওটাকে আমি ঘাড় ধরে বাড়ি থেকে বের করে দেব।”

“ইল্লি আর কী! বললেই হল! আমার কম্প্যানিয়নের গায়ে হাত দিয়ে দেখুন— আপনার নামে মেন্টাল অ্যান্ড ফিজ়িক্যাল টর্চারের কেস ফাইল করব!”

“কেস কি যখন ইচ্ছে করা যায় নাকি! এভিডেন্স কী?”

“সারা পাড়া শুনেছে, আপনি আমার কম্প্যানিয়নকে ঘাড় ধরে বের করে দেওয়ার থ্রেট দিচ্ছেন।”

সারা পাড়া সত্যিই শুনেছে। মানে শুনতেই হচ্ছে তাদের। রোজই শুনতে হয়। সবাই জানে এ বাড়ির ছাদে কাক-চিল বসার উপায় নেই। সকাল হতে না হতেই দুই বুড়োর মারপিট শুরু হয়ে যায়। বাড়িওয়ালা ভার্সাস ভাড়াটে। দু’জনেই সত্তর পেরিয়েছেন। কিন্তু বয়স হলেও ঝগড়ার এনার্জিটা যায়নি। অগত্যা কুরুক্ষেত্র আনপ্লাগড…

“বে-এ-শ করেছি! নেহাত ভদ্রলোক বলে ঘাড় ধরে বলেছি। নয়তো লাথি মেরে…”

“আপনি গদাইকে লাথি মারার কথা বলছেন! হা-উ ডেয়ার ই-উ!”

“ডেয়ার! অনেক দিন ধরেই ডেয়ার করছি, কিন্তু আপনার কোনও কেয়ার আছে? ওই ভোঁতকামুখো যে আমার মারুতির পেছনে জিব বের করে সর্বক্ষণ ছোঁক ছোঁক করছে সেটা বুঝি আমি জানি না!”

বেশ চলছিল দু’জনের মধ্যে গলাবাজির কম্পিটিশন। হঠাৎই উল্টো দিকের মেসের এক চ্যাংড়া ছোঁড়া আড়াল থেকে চেঁচিয়ে উঠে বলল, “দুশো ডেসিবেল ছাড়াল!”

দুই মূর্তিমানের এক জন প্রায় তিনখানা প্রোদুনোভা ভল্ট খেয়ে বললেন, “তোদের মাথায় দেশি বেল ফাটাব হতভাগা অলপ্পেয়ে! গুরুজনদের মধ্যে কথা হচ্ছে, তার মধ্যে গরুর মতো কমেন্ট?”

এই বার দ্বিতীয় জনও একমত হলেন, “ঠিক বলেছেন। কাল রাতে চিৎকার করে হাম্বা হাম্বাও বলছিল! আমি স্বকর্ণে শুনেছি।”

ছোকরা মুচকি হেসে বলল, “হাম্বা নয় দাদু— হাম্মা হাম্মা। ওটা গান।”

“দাদু তোর বাপ!” প্রথম জনের পেল্লায় ভুরু শুঁয়োপোকার মতো পাকিয়ে উঠল, “হাম্মা! এমন থাপ্পড় মারব যে, নিজের মা-আম্মা সবাইকে ভুলে যাবি! আধার কার্ড দেখে চোদ্দো গুষ্টির নাম মনে করতে হবে।”

দ্বিতীয় জন কিছু বলতে গিয়েও থমকে গেলেন। প্রথম জনকে উদ্দেশ্য করে বললেন, “আপনি তো টেররিস্ট দেখছি। এর ঘাড় ধরছেন, তাকে লাথি মারছেন, ওকে থাপ্পড়! সব সময় এ রকম হিংসাত্মক কেন? মিষ্টি করে বকতে পারেন না?”

প্রথম বৃদ্ধের মুখের এক্সপ্রেশন এমন হল যেন, ওঁর কাছে মধু দিয়ে তৈরি অ্যাটম বোমার ফর্মুলা জানতে চাওয়া হয়েছে। কিছু ক্ষণ দ্বিতীয় জনের দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, “না। পারি না! আমার শুগার নেই।”

বলেই গটগট করে চলে গেলেন। সারা পাড়ার প্রাণ, মানে কান জুড়োল।

এই দুই বুড়োর ঝগড়া পাড়ার নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। এমনিতেই বাড়িওয়ালা আর ভাড়াটের সম্পর্ক শাশুড়ি-বৌয়ের মতোই। কিন্তু এ ক্ষেত্রে তেমন হওয়ার কথা ছিল না। বাড়িওয়ালা জগৎবাবু ও ভাড়াটে মাধববাবু দু’জনেই একা। জগৎবাবুর স্ত্রী সন্তানের জন্ম দিতে গিয়ে মারা যান। তিনি আর বিয়ে করেননি। একাই বুকে করে একমাত্র ছেলে বিশ্বজিৎকে বড় করেছেন। সে মুম্বইয়ে থাকে। স্ত্রীর নাম ঐন্দ্রিলা। চাকরি-বাকরি, স্ত্রী-সন্তান-সংসার সব ওখানেই। কলকাতায় কালেভদ্রে আসে। আর মাধববাবুর স্ত্রী-বিয়োগ হয়েছে বছরদশেক। তাঁর সুপুত্র দিল্লির নামজাদা উকিল। যদিও সে বাপের খোঁজটুকুও নেয় না, তবু সেই সূত্রেই তিনি কথায় কথায় কেস করার হুমকি দেন। তার হুমকি শুনে জগৎবাবু খেপচুরিয়াস হয়ে ওঠেন, “আপনার ছেলে শামলা আঁটে বলে সব সময় মামলা করার হুমকি দিতে হবে?”

মাধববাবুর উত্তর, “আমি তো মামলা করব বলেছি। কিন্তু আপনি তো হামলা করেন! সেটার কী হবে?”

সচরাচর একা মানুষরা শান্তিপ্রিয় হন। কিন্তু এঁরা ব্যতিক্রম। যত নষ্টের গোড়া মাধববাবুর পোষা হুলো গদাই এবং জগৎবাবুর প্রিয় সাদা ধবধবে বোখারা কবুতর মারুতি। জগৎবাবুর পায়রা পোষার ভারী শখ। সকাল বিকেল ছাদে উঠে পায়রাদের উড়িয়ে সৌন্দর্য দেখেন। জগৎবাবু পায়রার নাম মারুতি শুনে মাধববাবু হাঁ, “এই পায়রার নাম মারুতি! তা হলে বাকিগুলোর নাম কী? হুন্ডাই, লিমুজিন, মিৎসুবিশি…”

“চারশো বিশি করার জায়গা পাননি?” পায়রাপ্রেমী খ্যাঁক করে ওঠেন, “বাংলা ভাষাটাও তো জানেন না! মরুৎ থেকে মারুতি। বুঝেছেন?”

এই অবধি সবই ঠিকই ছিল। কিন্তু মাধববাবুর হুলো গদাই জগৎবাবুর পায়রা মারুতিকে দেখলেই নুলো বাগিয়ে, নোলা শানিয়ে হাঁউমাউখাঁউ তাড়া করে! গদাইয়ের জ্বালায় পায়রাপ্রেমিক জগৎবাবুর প্রাণ ওষ্ঠাগত। ও দিকে পায়রার অত্যাচারে মাধববাবু তিতিবিরক্ত। পাখিগুলো তার শুকোতে দেওয়া জামাকাপড়ের ওপর প্রায়ই ববিপ্রিন্ট বা বাটিকপ্রিন্ট করে রাখে। এমনকি মাথায় শ্যাম্পু করেও শান্তি নেই। যেই ছাদে গিয়ে বসেছেন, অমনই ওপর থেকে একেবারে অভ্রান্ত লক্ষ্যে মিসাইল বর্ষণ। জগৎবাবুকে বলতেই হাজির জবাব, “কই? আমার মাথায় তো করে না! আপনার অমন চাঁদমারির মতো মাথা দেখেই গোলমাল করে ফেলে।”

চাঁদমারি শুনে মাধববাবু এই মারেন তো সেই মারেন, “আমার টাকটা পাবলিক টয়লেট নয়! আপনিই ওদের লেলিয়ে দিয়েছেন।”

কুকুর লেলিয়ে দেওয়া যায়, কিন্তু পায়রাও যে লেলিয়ে দেওয়া যায়, তা প্রথম বার সবাই জানল! আজকাল যেই দু’জনের মধ্যে ঝামেলা শুরু হয় অমনি সুরসিক জনগণ বলে, “ওই জগাই-মাধাইয়ের প্রেমপর্ব শুরু হল!”



**

“দ্য নাম্বার ইউ হ্যাভ ডায়ালড ইজ় কারেন্টলি বিজ়ি…”

তিক্ত মুখে ছেলের লাইনটা কেটে দিলেন জগৎবাবু। এই নিয়ে বারো বার ফোন করলেন। দু’বার বেজে বেজে কেটে গেল। আর দশ বারই বিজ়ি! তিনি উদাস দৃষ্টিতে স্ত্রী মল্লিকার ছবির দিকে তাকান। আজ বিশ্বজিতের জন্মদিন আর মল্লিকার মৃত্যুদিন। বোধহয় বিশ্বজিতের মনে নেই। জগৎবাবু বরাবর নিজে হাতে পায়েস করতেন ছেলের জন্য। আজও করেছেন। কিন্তু খাবে কে!

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে কিচেনের দিকে পা বাড়ালেন জগৎ। দু’চোখে অভিমানের বাষ্প। গত বছরই বিশ্ব বলেছিল, “এ সব সিলি ইমোশনের কোনও মানে হয়? মা-কে আমি জীবনে দেখিনি। তাঁর মৃত্যুদিনে হঠাৎ শোক উথলে ওঠারও কোনও কারণ নেই। আর পায়েস আজকাল কেউ খায় না। এখন কেক কাটা হয়, ককটেল পার্টি হয়— তুমি বুঝবে না।”

প্রতি বারই জগৎ ছেলের মঙ্গল কামনায় কোনও গরিব-দুঃখীকে পায়েসটা খাইয়ে দেন।

কিন্তু আজ কিচেনে ঢুকতেই তাঁর চক্ষুস্থির! মাধববাবুর হুমদো বিড়ালটা মহানন্দে তার সাধের পায়েস চাখতে ব্যস্ত! সম্ভবত রান্নাঘরের খোলা জানলা পেয়ে ঢুকে মাছ খাওয়ার তালে ছিল, এখন পায়েস খাচ্ছে!

দেখে জগৎবাবুর হাড়পিত্তি জ্বলে গেল। তিনি একেবারে বিড়ালটার ঘেঁটি ধরে নিয়ে গিয়ে হাজির হলেন এক তলায়, মাধববাবুর ঘরে। মাধববাবু তাকে দেখেই প্রায় লাফিয়ে উঠলেন, “এ কী! আপনি গদাইকে বাজারের ব্যাগ পেয়েছেন? অমন ঝুলিয়ে আনছেন কেন?”

“আপনার কপাল ভাল যে ওটাকে ফাঁসিকাঠে ঝোলাইনি! আমার কিচেনে বসে হারামজাদা পায়েস খাচ্ছিল! হি ইজ় আ ড্যাম ক্রিমিনাল!” জগৎবাবু গলায় আগুনের উত্তাপ।

“প্রথমত ওর একটা নাম আছে, গদাই। বিড়াল বলে ইনসাল্ট করবেন না। আমি আপনাকে ‘মানুষ’ ‘মানুষ’ বলে ডাকলে ভাল লাগবে? দ্বিতীয়ত, ও যে আপনার পায়েস খেয়েছে, তার প্রমাণ কী?” মাধববাবু গম্ভীর।

“নিকুচি করেছে প্রমাণের!” জগৎ তেলে-বেগুনে, “দেখতে পাচ্ছেন না, ওর গোঁফে পায়েস লেগে?”

“সে তো আপনি নিজেই ওর গোঁফে পায়েসটা লাগাতে পারেন! আপনি কি আরও সাক্ষী জড়ো করে সর্বসমক্ষে ওর গোঁফটাকে এভিডেন্স হিসেবে সিল করেছেন? আদারওয়াইজ় ওটা প্রমাণ হিসাবে গ্রাহ্য নয়,” মাধব চোখ সরু করলেন।

জগৎবাবু বুঝলেন, এ লোকের সঙ্গে তর্ক বৃথা। তিনি গদাইকে ছুড়ে ফেলে দিয়ে বললেন, “যেমন মালিক, তেমন বিড়াল। শুনুন, বিড়ালের থেকে বজ্জাত আর স্বার্থপর প্রাণী দুনিয়ায় নেই! এ ব্যাটারা দুধ খেয়ে মুখ মুছে চলে যায়! ওই দেখুন, অলরেডি গোঁফ চেটে পরিষ্কার করছে!”

গদাই তখন সত্যিই মুখ হাঁড়ি করে গোঁফের পায়েস চেটে পরিষ্কার করছিল। তাকে নিয়ে যে পানিপথের যুদ্ধ হচ্ছে, তা নিয়ে তার মাথাব্যথা নেই। সে করুণ মুখ করে বলল, মিঁউ। অর্থাৎ, আমি তো কিছুই করিনি!

“দেখেছেন!” জগৎ দন্তবাদ্য করে বললেন, “এক বাটি পায়েস নষ্ট করে কোনও অপরাধবোধ নেই। যেন কিচ্ছু জানে না। সেলফিশ জায়ান্ট! আপনি লাই দিয়ে দিয়ে মাথায় তুলেছেন!”

“আচ্ছা? আমার বিড়াল স্বার্থপর, আর আপনার পায়রা রাজা হরিশ্চন্দ্র!” মাধববাবুও গর্জন করে ওঠেন, “এক-দু’দিন খেতে না দিয়ে দেখুন, সব ভেগে যাবে। কথায়ই আছে, সুখের পায়রা। আপনি আবার বিড়াল দেখাচ্ছেন! আমি তো আপনার পায়রাদের লাই দিইনি। তবে তারা আমার মাথায় ইয়ে করে কেন?”

“মাথায় যা-ই করুক, অন্যের হেঁশেলে গিয়ে তো ডাকাতি করে না! আমার পায়েস কি ওর বাপের সম্পত্তি যে চেটেপুটে খাবে!”

মাধববাবু গদাইকে কোলে তুলে আদর করতে করতে বললেন, “তা হলে যার বাপের সম্পত্তি, তাকেই বলুন না চেটেপুটে খেতে!”

জগৎ স্তম্ভিত! এই প্রথম বড্ড অসহায় বোধ করছেন। একটা কঠিন কথা বলতে গিয়েও থেমে গেলেন। তার মনে হল, গদাই তার দিকে পরম কৌতুকে তাকিয়ে যেন জিজ্ঞেস করছে, ‘এই বার?’





“বাবা, এ কী! সারা দিনে আটচল্লিশটা কল! আমার কি কোনও কাজ নেই?”

“তুই এ বার আমায় তোর কাছে নিয়ে যা বিশ্ব। আমার এখানে একা একা ভাল লাগে না।”

বিশ্ব বিরক্তিসূচক আওয়াজ করে, “ট্রাই টু আন্ডারস্ট্যান্ড, মম-ড্যাড…আই মিন ঐন্দ্রিলার বাবা-মা এখানে আছেন। আমি তাদের নিয়েই এখন খুব বিজ়ি। পরে কথা বলব।”

বিশ্ব ফোন রেখে দিল। ভারাক্রান্ত হৃদয়ে জগৎবাবু গুম মেরে বসে রইলেন খাটের ওপর।

কিন্তু শান্তিতে থাকার জো আছে! কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই মাধববাবুর আয়লা-এন্ট্রি। তার সারা গায়ে সাদা কালো ছোপ ছোপ! জগতের সামনে এসে প্রায় চিৎকার করেই বললেন, “আমার গদাই ভিলেন? আর আপনার মারুতি কী? এই দেখুন তার কাণ্ড!”

জগৎবাবু আজ আর ঝগড়ার মুডে নেই। কিন্তু তাঁর নীরবতায় আরও খেপে গেলেন মাধববাবু, “আগে তবু মাথা টার্গেট করত। এখন সারা গায়ে! খাবে আপনার হাতে, আর স্বচ্ছ ভারত অভিযানের বেলায় আমি! একেই বলে স্বার্থপর! সব শালা স্বার্থপরের বাচ্চা!”

এত ক্ষণে জগতের ধৈর্যচ্যুতি ঘটল। তিনিও রেগে গিয়ে বলেন, “পায়রা স্বার্থপর মানছি, কিন্তু আপনার বিড়ালের চেয়ে কম! রোজ ছাদে উঠে ছাল ছাড়িয়ে নুন মাখিয়ে আমার মারুতিকে খাওয়ার তাল করে। এই যে আমার বাড়িতে মহা আরামে রয়েছে, ওকে যে আমি আশ্রয় দিয়েছি, তার জন্য কোনও কৃতজ্ঞতা আছে? আমারই রান্না করা পায়েস খেয়ে, আমারই পাপোশ নোংরা করেছে। একে কী বলবেন?”

“শুনুন, পাপোশের বেলায় তবু আপস চলে। কিন্তু আমি এখন কী করব? এই কনকনে শীতে কত বার স্নান করা যায়!” মাধববাবু আঙুল তুলে হুমকি দিলেন, “এর পর যদি একটা পায়রাও আমার গায়ে প্রাতঃকৃত্য করে, গদাইকে ছাড়ুন, আমিই সব ক’টার ছাল ছাড়িয়ে নুন মাখিয়ে খেয়ে নেব।”

জগৎবাবু গরগর করে ওঠেন, “আপনি কে মশাই? শসাওয়ালা?”

মাধববাবু উত্তর দিলেন না। ঠিক যেমন ড্রামাটিক টেম্পোয় এসেছিলেন, তেমনই চলে গেলেন।

সারা দিনটা কোনও মতে কাটল। জগৎবাবুর শরীরটা ভাল ঠেকছে না। দুপুরে খাওয়াদাওয়া করেননি। বুকে কেমন চাপ-চাপ ব্যথা। মনে হচ্ছে বুকের ওপর যেন অসম্ভব একটা ভার চেপে রয়েছে, যার থেকে মুক্তি নেই!

বিকেল হতে না হতেই এক অদ্ভুত বিবেকের তাড়নায় ছাদের দিকে চললেন তিনি। মারুতিদের আজ সকালে রেগেমেগে খেতে দেননি। বিকেলে অন্তত খেতে দেওয়া জরুরি। অবোলা জীবগুলো মুখ ফুটে খিদের কথা বলতেও পারে না! তাই অতিকষ্টে সিঁড়ি ভেঙে ছাদে উঠলেন জগৎ। গম ছড়িয়ে দিয়ে আস্তে আস্তে খুলে দিলেন পায়রার খোপের দরজাগুলো। মুক্তোর মতো সাদা মারুতি গর্বিত ভঙ্গিতে বেরিয়ে এল। বাকিরাও টুকটুক করে গমের দানা খাচ্ছে। খেতে খেতেই ডানা ঝাপটে এ দিক-ও দিক উড়ে বেড়াচ্ছে। মারুতি খাওয়া শেষ হতেই বোঁ করে পাক খেয়ে একটা চমৎকার উড়ান দিল! বিকেলের নরম সূর্যরশ্মি তার সাদা ডানায় পড়ে একেবারে সোনালি!

অন্যান্য দিন এই সৌন্দর্য দু’চোখ ভরে উপভোগ করেন জগৎ। কিন্তু আজ মন ভাল নেই। বড় কষ্ট। বুকের মধ্যে যন্ত্রণা। এখন নিঃশ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছে। চোখে যেন অন্ধকার নেমে আসছে। তবু শেষ বারের মতো মারুতির দিকে তাকালেন জগৎ। মনে মনে বললেন, ‘সবাই বলে পায়রাও স্বার্থপর! যা, উড়ে যা অন্য কোথাও! আর আমি খেতে দিতে পারব না।’

পরক্ষণেই সব অন্ধকার!





“আর একটু হলেই তো টেঁসে যাচ্ছিলেন! বুড়ো বয়েসে এ সব হাঙ্গামা পোষায়? নেহাৎ মেসের ছোঁড়াগুলো ছিল, তাই আপনাকে…”

বেচারি জগৎবাবু হসপিটালের বেডে শুয়ে চোখ খুলতে না খুলতেই শুনতে পেলেন মাধববাবুর কড়া ধমক, “আপনার কি কোনও দিন আক্কেল হবে না! সারা দিন না খেয়েদেয়ে ছিলেন কোন আনন্দে? পায়রা সম্পর্কে পাঁচটা কথা শুনিয়েছি বলে প্রেশার বাড়িয়ে, অনশন করে একটা স্ট্রোক না ঘটালেই হচ্ছিল না! আপনার মারুতি আর আমার গদাই না থাকলে আপনাকে বাঁচাত কে!”

জগৎ অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকেন। মারুতি আর গদাই এর মধ্যে এল কোথা থেকে!

মাধববাবু হাসছেন, “আমিই কি জানতাম কী অনাসৃষ্টি হয়েছে! হঠাৎ দেখি আপনার মারুতি আমার জানলায় এসে ডানা ঝাপটাচ্ছে। গদাই যত তেড়ে যায়, সে কিছুতেই নড়ে না! খালি জানলায় এসে গোঁত্তা মারে। হতচ্ছাড়া গদাই মারুতির নাগাল না পেয়ে সোজা ছাদে দৌড়েছিল। তার পরই ফিরে এসে খালি অদ্ভুত স্বরে ম্যাঁও ম্যাঁও করে ডাকছে, আর আমার লুঙ্গি কামড়ে টানছে। তখনই মনে হল, নির্ঘাত কিছু গোলমাল। তাই…”

এর পরের ঘটনা পরিষ্কার। কিন্তু পাড়ার লোক একটা রহস্য কিছুতেই ভেদ করতে পারল না। জগাই-মাধাইয়ের নিত্যকালীন প্রেম হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেল কী করে!

হাসপাতাল থেকে ফেরার পরই জগৎবাবু আজকাল গদাইকে দু’বেলা দুধভাত খাওয়াচ্ছেন, মাঝে মাঝে মাছও বরাদ্দ হচ্ছে। মাধববাবুও ছাতে উঠে পায়রাদের গম খাওয়াচ্ছেন। জগৎবাবু যত দিন হসপিটালে ছিলেন, তত দিন নিয়ম করে পায়রাদের খেতে দিয়েছেন তিনিই। গদাইয়ের স্বভাব পাল্টায়নি। সে এখনও মারুতিকে দেখলেই দাঁত খিঁচিয়ে তাড়া করছে। বিড়াল আর পায়রা সম্পর্কেও মনোভাব পাল্টায়নি দুই বুড়োর। দু’জনেই জানেন, দুটো প্রাণীই চরম স্বার্থপর। কিন্তু তার পরও মাধব পায়রার যত্ন নেন, এবং গদাইকে আদর করে খেতে দেন জগৎ।

কত স্বার্থপরকেই তো জীবনে খাইয়ে-দাইয়ে মানুষ করেছেন দু’জনে। বিড়াল আর পায়রা কি তাদের চেয়েও দোষী?



ছবি: রৌদ্র মিত্র

আপনি কী শুরু করেছেনটা কী? রোজ আপনার ওই হুমদোটার জ্বালায় আমার ছানাপোনারা অতিষ্ঠ! এক নম্বরের স্বার্থপর ও শয়তান। এর পর ওটাকে আমি ঘাড় ধরে বাড়ি থেকে বের করে দেব।”

“ইল্লি আর কী! বললেই হল! আমার কম্প্যানিয়নের গায়ে হাত দিয়ে দেখুন— আপনার নামে মেন্টাল অ্যান্ড ফিজ়িক্যাল টর্চারের কেস ফাইল করব!”

“কেস কি যখন ইচ্ছে করা যায় নাকি! এভিডেন্স কী?”

“সারা পাড়া শুনেছে, আপনি আমার কম্প্যানিয়নকে ঘাড় ধরে বের করে দেওয়ার থ্রেট দিচ্ছেন।”

সারা পাড়া সত্যিই শুনেছে। মানে শুনতেই হচ্ছে তাদের। রোজই শুনতে হয়। সবাই জানে এ বাড়ির ছাদে কাক-চিল বসার উপায় নেই। সকাল হতে না হতেই দুই বুড়োর মারপিট শুরু হয়ে যায়। বাড়িওয়ালা ভার্সাস ভাড়াটে। দু’জনেই সত্তর পেরিয়েছেন। কিন্তু বয়স হলেও ঝগড়ার এনার্জিটা যায়নি। অগত্যা কুরুক্ষেত্র আনপ্লাগড…

“বে-এ-শ করেছি! নেহাত ভদ্রলোক বলে ঘাড় ধরে বলেছি। নয়তো লাথি মেরে…”

“আপনি গদাইকে লাথি মারার কথা বলছেন! হা-উ ডেয়ার ই-উ!”

“ডেয়ার! অনেক দিন ধরেই ডেয়ার করছি, কিন্তু আপনার কোনও কেয়ার আছে? ওই ভোঁতকামুখো যে আমার মারুতির পেছনে জিব বের করে সর্বক্ষণ ছোঁক ছোঁক করছে সেটা বুঝি আমি জানি না!”

বেশ চলছিল দু’জনের মধ্যে গলাবাজির কম্পিটিশন। হঠাৎই উল্টো দিকের মেসের এক চ্যাংড়া ছোঁড়া আড়াল থেকে চেঁচিয়ে উঠে বলল, “দুশো ডেসিবেল ছাড়াল!”

দুই মূর্তিমানের এক জন প্রায় তিনখানা প্রোদুনোভা ভল্ট খেয়ে বললেন, “তোদের মাথায় দেশি বেল ফাটাব হতভাগা অলপ্পেয়ে! গুরুজনদের মধ্যে কথা হচ্ছে, তার মধ্যে গরুর মতো কমেন্ট?”

এই বার দ্বিতীয় জনও একমত হলেন, “ঠিক বলেছেন। কাল রাতে চিৎকার করে হাম্বা হাম্বাও বলছিল! আমি স্বকর্ণে শুনেছি।”

ছোকরা মুচকি হেসে বলল, “হাম্বা নয় দাদু— হাম্মা হাম্মা। ওটা গান।”

“দাদু তোর বাপ!” প্রথম জনের পেল্লায় ভুরু শুঁয়োপোকার মতো পাকিয়ে উঠল, “হাম্মা! এমন থাপ্পড় মারব যে, নিজের মা-আম্মা সবাইকে ভুলে যাবি! আধার কার্ড দেখে চোদ্দো গুষ্টির নাম মনে করতে হবে।”

দ্বিতীয় জন কিছু বলতে গিয়েও থমকে গেলেন। প্রথম জনকে উদ্দেশ্য করে বললেন, “আপনি তো টেররিস্ট দেখছি। এর ঘাড় ধরছেন, তাকে লাথি মারছেন, ওকে থাপ্পড়! সব সময় এ রকম হিংসাত্মক কেন? মিষ্টি করে বকতে পারেন না?”

প্রথম বৃদ্ধের মুখের এক্সপ্রেশন এমন হল যেন, ওঁর কাছে মধু দিয়ে তৈরি অ্যাটম বোমার ফর্মুলা জানতে চাওয়া হয়েছে। কিছু ক্ষণ দ্বিতীয় জনের দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, “না। পারি না! আমার শুগার নেই।”

বলেই গটগট করে চলে গেলেন। সারা পাড়ার প্রাণ, মানে কান জুড়োল।

এই দুই বুড়োর ঝগড়া পাড়ার নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। এমনিতেই বাড়িওয়ালা আর ভাড়াটের সম্পর্ক শাশুড়ি-বৌয়ের মতোই। কিন্তু এ ক্ষেত্রে তেমন হওয়ার কথা ছিল না। বাড়িওয়ালা জগৎবাবু ও ভাড়াটে মাধববাবু দু’জনেই একা। জগৎবাবুর স্ত্রী সন্তানের জন্ম দিতে গিয়ে মারা যান। তিনি আর বিয়ে করেননি। একাই বুকে করে একমাত্র ছেলে বিশ্বজিৎকে বড় করেছেন। সে মুম্বইয়ে থাকে। স্ত্রীর নাম ঐন্দ্রিলা। চাকরি-বাকরি, স্ত্রী-সন্তান-সংসার সব ওখানেই। কলকাতায় কালেভদ্রে আসে। আর মাধববাবুর স্ত্রী-বিয়োগ হয়েছে বছরদশেক। তাঁর সুপুত্র দিল্লির নামজাদা উকিল। যদিও সে বাপের খোঁজটুকুও নেয় না, তবু সেই সূত্রেই তিনি কথায় কথায় কেস করার হুমকি দেন। তার হুমকি শুনে জগৎবাবু খেপচুরিয়াস হয়ে ওঠেন, “আপনার ছেলে শামলা আঁটে বলে সব সময় মামলা করার হুমকি দিতে হবে?”

মাধববাবুর উত্তর, “আমি তো মামলা করব বলেছি। কিন্তু আপনি তো হামলা করেন! সেটার কী হবে?”

সচরাচর একা মানুষরা শান্তিপ্রিয় হন। কিন্তু এঁরা ব্যতিক্রম। যত নষ্টের গোড়া মাধববাবুর পোষা হুলো গদাই এবং জগৎবাবুর প্রিয় সাদা ধবধবে বোখারা কবুতর মারুতি। জগৎবাবুর পায়রা পোষার ভারী শখ। সকাল বিকেল ছাদে উঠে পায়রাদের উড়িয়ে সৌন্দর্য দেখেন। জগৎবাবু পায়রার নাম মারুতি শুনে মাধববাবু হাঁ, “এই পায়রার নাম মারুতি! তা হলে বাকিগুলোর নাম কী? হুন্ডাই, লিমুজিন, মিৎসুবিশি…”

“চারশো বিশি করার জায়গা পাননি?” পায়রাপ্রেমী খ্যাঁক করে ওঠেন, “বাংলা ভাষাটাও তো জানেন না! মরুৎ থেকে মারুতি। বুঝেছেন?”

এই অবধি সবই ঠিকই ছিল। কিন্তু মাধববাবুর হুলো গদাই জগৎবাবুর পায়রা মারুতিকে দেখলেই নুলো বাগিয়ে, নোলা শানিয়ে হাঁউমাউখাঁউ তাড়া করে! গদাইয়ের জ্বালায় পায়রাপ্রেমিক জগৎবাবুর প্রাণ ওষ্ঠাগত। ও দিকে পায়রার অত্যাচারে মাধববাবু তিতিবিরক্ত। পাখিগুলো তার শুকোতে দেওয়া জামাকাপড়ের ওপর প্রায়ই ববিপ্রিন্ট বা বাটিকপ্রিন্ট করে রাখে। এমনকি মাথায় শ্যাম্পু করেও শান্তি নেই। যেই ছাদে গিয়ে বসেছেন, অমনই ওপর থেকে একেবারে অভ্রান্ত লক্ষ্যে মিসাইল বর্ষণ। জগৎবাবুকে বলতেই হাজির জবাব, “কই? আমার মাথায় তো করে না! আপনার অমন চাঁদমারির মতো মাথা দেখেই গোলমাল করে ফেলে।”

চাঁদমারি শুনে মাধববাবু এই মারেন তো সেই মারেন, “আমার টাকটা পাবলিক টয়লেট নয়! আপনিই ওদের লেলিয়ে দিয়েছেন।”

কুকুর লেলিয়ে দেওয়া যায়, কিন্তু পায়রাও যে লেলিয়ে দেওয়া যায়, তা প্রথম বার সবাই জানল! আজকাল যেই দু’জনের মধ্যে ঝামেলা শুরু হয় অমনি সুরসিক জনগণ বলে, “ওই জগাই-মাধাইয়ের প্রেমপর্ব শুরু হল!”





“দ্য নাম্বার ইউ হ্যাভ ডায়ালড ইজ় কারেন্টলি বিজ়ি…”

তিক্ত মুখে ছেলের লাইনটা কেটে দিলেন জগৎবাবু। এই নিয়ে বারো বার ফোন করলেন। দু’বার বেজে বেজে কেটে গেল। আর দশ বারই বিজ়ি! তিনি উদাস দৃষ্টিতে স্ত্রী মল্লিকার ছবির দিকে তাকান। আজ বিশ্বজিতের জন্মদিন আর মল্লিকার মৃত্যুদিন। বোধহয় বিশ্বজিতের মনে নেই। জগৎবাবু বরাবর নিজে হাতে পায়েস করতেন ছেলের জন্য। আজও করেছেন। কিন্তু খাবে কে!

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে কিচেনের দিকে পা বাড়ালেন জগৎ। দু’চোখে অভিমানের বাষ্প। গত বছরই বিশ্ব বলেছিল, “এ সব সিলি ইমোশনের কোনও মানে হয়? মা-কে আমি জীবনে দেখিনি। তাঁর মৃত্যুদিনে হঠাৎ শোক উথলে ওঠারও কোনও কারণ নেই। আর পায়েস আজকাল কেউ খায় না। এখন কেক কাটা হয়, ককটেল পার্টি হয়— তুমি বুঝবে না।”

প্রতি বারই জগৎ ছেলের মঙ্গল কামনায় কোনও গরিব-দুঃখীকে পায়েসটা খাইয়ে দেন।

কিন্তু আজ কিচেনে ঢুকতেই তাঁর চক্ষুস্থির! মাধববাবুর হুমদো বিড়ালটা মহানন্দে তার সাধের পায়েস চাখতে ব্যস্ত! সম্ভবত রান্নাঘরের খোলা জানলা পেয়ে ঢুকে মাছ খাওয়ার তালে ছিল, এখন পায়েস খাচ্ছে!

দেখে জগৎবাবুর হাড়পিত্তি জ্বলে গেল। তিনি একেবারে বিড়ালটার ঘেঁটি ধরে নিয়ে গিয়ে হাজির হলেন এক তলায়, মাধববাবুর ঘরে। মাধববাবু তাকে দেখেই প্রায় লাফিয়ে উঠলেন, “এ কী! আপনি গদাইকে বাজারের ব্যাগ পেয়েছেন? অমন ঝুলিয়ে আনছেন কেন?”

“আপনার কপাল ভাল যে ওটাকে ফাঁসিকাঠে ঝোলাইনি! আমার কিচেনে বসে হারামজাদা পায়েস খাচ্ছিল! হি ইজ় আ ড্যাম ক্রিমিনাল!” জগৎবাবু গলায় আগুনের উত্তাপ।

“প্রথমত ওর একটা নাম আছে, গদাই। বিড়াল বলে ইনসাল্ট করবেন না। আমি আপনাকে ‘মানুষ’ ‘মানুষ’ বলে ডাকলে ভাল লাগবে? দ্বিতীয়ত, ও যে আপনার পায়েস খেয়েছে, তার প্রমাণ কী?” মাধববাবু গম্ভীর।

“নিকুচি করেছে প্রমাণের!” জগৎ তেলে-বেগুনে, “দেখতে পাচ্ছেন না, ওর গোঁফে পায়েস লেগে?”

“সে তো আপনি নিজেই ওর গোঁফে পায়েসটা লাগাতে পারেন! আপনি কি আরও সাক্ষী জড়ো করে সর্বসমক্ষে ওর গোঁফটাকে এভিডেন্স হিসেবে সিল করেছেন? আদারওয়াইজ় ওটা প্রমাণ হিসাবে গ্রাহ্য নয়,” মাধব চোখ সরু করলেন।

জগৎবাবু বুঝলেন, এ লোকের সঙ্গে তর্ক বৃথা। তিনি গদাইকে ছুড়ে ফেলে দিয়ে বললেন, “যেমন মালিক, তেমন বিড়াল। শুনুন, বিড়ালের থেকে বজ্জাত আর স্বার্থপর প্রাণী দুনিয়ায় নেই! এ ব্যাটারা দুধ খেয়ে মুখ মুছে চলে যায়! ওই দেখুন, অলরেডি গোঁফ চেটে পরিষ্কার করছে!”

গদাই তখন সত্যিই মুখ হাঁড়ি করে গোঁফের পায়েস চেটে পরিষ্কার করছিল। তাকে নিয়ে যে পানিপথের যুদ্ধ হচ্ছে, তা নিয়ে তার মাথাব্যথা নেই। সে করুণ মুখ করে বলল, মিঁউ। অর্থাৎ, আমি তো কিছুই করিনি!

“দেখেছেন!” জগৎ দন্তবাদ্য করে বললেন, “এক বাটি পায়েস নষ্ট করে কোনও অপরাধবোধ নেই। যেন কিচ্ছু জানে না। সেলফিশ জায়ান্ট! আপনি লাই দিয়ে দিয়ে মাথায় তুলেছেন!”

“আচ্ছা? আমার বিড়াল স্বার্থপর, আর আপনার পায়রা রাজা হরিশ্চন্দ্র!” মাধববাবুও গর্জন করে ওঠেন, “এক-দু’দিন খেতে না দিয়ে দেখুন, সব ভেগে যাবে। কথায়ই আছে, সুখের পায়রা। আপনি আবার বিড়াল দেখাচ্ছেন! আমি তো আপনার পায়রাদের লাই দিইনি। তবে তারা আমার মাথায় ইয়ে করে কেন?”

“মাথায় যা-ই করুক, অন্যের হেঁশেলে গিয়ে তো ডাকাতি করে না! আমার পায়েস কি ওর বাপের সম্পত্তি যে চেটেপুটে খাবে!”

মাধববাবু গদাইকে কোলে তুলে আদর করতে করতে বললেন, “তা হলে যার বাপের সম্পত্তি, তাকেই বলুন না চেটেপুটে খেতে!”

জগৎ স্তম্ভিত! এই প্রথম বড্ড অসহায় বোধ করছেন। একটা কঠিন কথা বলতে গিয়েও থেমে গেলেন। তার মনে হল, গদাই তার দিকে পরম কৌতুকে তাকিয়ে যেন জিজ্ঞেস করছে, ‘এই বার?’



***

“বাবা, এ কী! সারা দিনে আটচল্লিশটা কল! আমার কি কোনও কাজ নেই?”

“তুই এ বার আমায় তোর কাছে নিয়ে যা বিশ্ব। আমার এখানে একা একা ভাল লাগে না।”

বিশ্ব বিরক্তিসূচক আওয়াজ করে, “ট্রাই টু আন্ডারস্ট্যান্ড, মম-ড্যাড…আই মিন ঐন্দ্রিলার বাবা-মা এখানে আছেন। আমি তাদের নিয়েই এখন খুব বিজ়ি। পরে কথা বলব।”

বিশ্ব ফোন রেখে দিল। ভারাক্রান্ত হৃদয়ে জগৎবাবু গুম মেরে বসে রইলেন খাটের ওপর।

কিন্তু শান্তিতে থাকার জো আছে! কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই মাধববাবুর আয়লা-এন্ট্রি। তার সারা গায়ে সাদা কালো ছোপ ছোপ! জগতের সামনে এসে প্রায় চিৎকার করেই বললেন, “আমার গদাই ভিলেন? আর আপনার মারুতি কী? এই দেখুন তার কাণ্ড!”

জগৎবাবু আজ আর ঝগড়ার মুডে নেই। কিন্তু তাঁর নীরবতায় আরও খেপে গেলেন মাধববাবু, “আগে তবু মাথা টার্গেট করত। এখন সারা গায়ে! খাবে আপনার হাতে, আর স্বচ্ছ ভারত অভিযানের বেলায় আমি! একেই বলে স্বার্থপর! সব শালা স্বার্থপরের বাচ্চা!”

এত ক্ষণে জগতের ধৈর্যচ্যুতি ঘটল। তিনিও রেগে গিয়ে বলেন, “পায়রা স্বার্থপর মানছি, কিন্তু আপনার বিড়ালের চেয়ে কম! রোজ ছাদে উঠে ছাল ছাড়িয়ে নুন মাখিয়ে আমার মারুতিকে খাওয়ার তাল করে। এই যে আমার বাড়িতে মহা আরামে রয়েছে, ওকে যে আমি আশ্রয় দিয়েছি, তার জন্য কোনও কৃতজ্ঞতা আছে? আমারই রান্না করা পায়েস খেয়ে, আমারই পাপোশ নোংরা করেছে। একে কী বলবেন?”

“শুনুন, পাপোশের বেলায় তবু আপস চলে। কিন্তু আমি এখন কী করব? এই কনকনে শীতে কত বার স্নান করা যায়!” মাধববাবু আঙুল তুলে হুমকি দিলেন, “এর পর যদি একটা পায়রাও আমার গায়ে প্রাতঃকৃত্য করে, গদাইকে ছাড়ুন, আমিই সব ক’টার ছাল ছাড়িয়ে নুন মাখিয়ে খেয়ে নেব।”

জগৎবাবু গরগর করে ওঠেন, “আপনি কে মশাই? শসাওয়ালা?”

মাধববাবু উত্তর দিলেন না। ঠিক যেমন ড্রামাটিক টেম্পোয় এসেছিলেন, তেমনই চলে গেলেন।

সারা দিনটা কোনও মতে কাটল। জগৎবাবুর শরীরটা ভাল ঠেকছে না। দুপুরে খাওয়াদাওয়া করেননি। বুকে কেমন চাপ-চাপ ব্যথা। মনে হচ্ছে বুকের ওপর যেন অসম্ভব একটা ভার চেপে রয়েছে, যার থেকে মুক্তি নেই!

বিকেল হতে না হতেই এক অদ্ভুত বিবেকের তাড়নায় ছাদের দিকে চললেন তিনি। মারুতিদের আজ সকালে রেগেমেগে খেতে দেননি। বিকেলে অন্তত খেতে দেওয়া জরুরি। অবোলা জীবগুলো মুখ ফুটে খিদের কথা বলতেও পারে না! তাই অতিকষ্টে সিঁড়ি ভেঙে ছাদে উঠলেন জগৎ। গম ছড়িয়ে দিয়ে আস্তে আস্তে খুলে দিলেন পায়রার খোপের দরজাগুলো। মুক্তোর মতো সাদা মারুতি গর্বিত ভঙ্গিতে বেরিয়ে এল। বাকিরাও টুকটুক করে গমের দানা খাচ্ছে। খেতে খেতেই ডানা ঝাপটে এ দিক-ও দিক উড়ে বেড়াচ্ছে। মারুতি খাওয়া শেষ হতেই বোঁ করে পাক খেয়ে একটা চমৎকার উড়ান দিল! বিকেলের নরম সূর্যরশ্মি তার সাদা ডানায় পড়ে একেবারে সোনালি!

অন্যান্য দিন এই সৌন্দর্য দু’চোখ ভরে উপভোগ করেন জগৎ। কিন্তু আজ মন ভাল নেই। বড় কষ্ট। বুকের মধ্যে যন্ত্রণা। এখন নিঃশ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছে। চোখে যেন অন্ধকার নেমে আসছে। তবু শেষ বারের মতো মারুতির দিকে তাকালেন জগৎ। মনে মনে বললেন, ‘সবাই বলে পায়রাও স্বার্থপর! যা, উড়ে যা অন্য কোথাও! আর আমি খেতে দিতে পারব না।’

পরক্ষণেই সব অন্ধকার!

“আর একটু হলেই তো টেঁসে যাচ্ছিলেন! বুড়ো বয়েসে এ সব হাঙ্গামা পোষায়? নেহাৎ মেসের ছোঁড়াগুলো ছিল, তাই আপনাকে…”

বেচারি জগৎবাবু হসপিটালের বেডে শুয়ে চোখ খুলতে না খুলতেই শুনতে পেলেন মাধববাবুর কড়া ধমক, “আপনার কি কোনও দিন আক্কেল হবে না! সারা দিন না খেয়েদেয়ে ছিলেন কোন আনন্দে? পায়রা সম্পর্কে পাঁচটা কথা শুনিয়েছি বলে প্রেশার বাড়িয়ে, অনশন করে একটা স্ট্রোক না ঘটালেই হচ্ছিল না! আপনার মারুতি আর আমার গদাই না থাকলে আপনাকে বাঁচাত কে!”

জগৎ অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকেন। মারুতি আর গদাই এর মধ্যে এল কোথা থেকে!

মাধববাবু হাসছেন, “আমিই কি জানতাম কী অনাসৃষ্টি হয়েছে! হঠাৎ দেখি আপনার মারুতি আমার জানলায় এসে ডানা ঝাপটাচ্ছে। গদাই যত তেড়ে যায়, সে কিছুতেই নড়ে না! খালি জানলায় এসে গোঁত্তা মারে। হতচ্ছাড়া গদাই মারুতির নাগাল না পেয়ে সোজা ছাদে দৌড়েছিল। তার পরই ফিরে এসে খালি অদ্ভুত স্বরে ম্যাঁও ম্যাঁও করে ডাকছে, আর আমার লুঙ্গি কামড়ে টানছে। তখনই মনে হল, নির্ঘাত কিছু গোলমাল। তাই…”

এর পরের ঘটনা পরিষ্কার। কিন্তু পাড়ার লোক একটা রহস্য কিছুতেই ভেদ করতে পারল না। জগাই-মাধাইয়ের নিত্যকালীন প্রেম হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেল কী করে!

হাসপাতাল থেকে ফেরার পরই জগৎবাবু আজকাল গদাইকে দু’বেলা দুধভাত খাওয়াচ্ছেন, মাঝে মাঝে মাছও বরাদ্দ হচ্ছে। মাধববাবুও ছাতে উঠে পায়রাদের গম খাওয়াচ্ছেন। জগৎবাবু যত দিন হসপিটালে ছিলেন, তত দিন নিয়ম করে পায়রাদের খেতে দিয়েছেন তিনিই। গদাইয়ের স্বভাব পাল্টায়নি। সে এখনও মারুতিকে দেখলেই দাঁত খিঁচিয়ে তাড়া করছে। বিড়াল আর পায়রা সম্পর্কেও মনোভাব পাল্টায়নি দুই বুড়োর। দু’জনেই জানেন, দুটো প্রাণীই চরম স্বার্থপর। কিন্তু তার পরও মাধব পায়রার যত্ন নেন, এবং গদাইকে আদর করে খেতে দেন জগৎ।

কত স্বার্থপরকেই তো জীবনে খাইয়ে-দাইয়ে মানুষ করেছেন দু’জনে। বিড়াল আর পায়রা কি তাদের চেয়েও দোষী?