Abosar

স্পেশাল এফেক্ট

রাজশ্রী বসু অধিকারী

অনেক ভেবেচিন্তে একটা ভাল রকম প্ল্যান নামিয়েছেন নুটুবাবু। এ বার আর কোনও বাছাধনের ট্যাঁফো চলবে না। সব ক’টাকে মাথা মুড়িয়ে বসে থাকতে হবে এই ঘরের মেঝেতে। কথায় কথায় উইক-এন্ড টুর, জলসা, নাটক, সিনেমা, শপিং মল... সব বন্ধ। বাড়িতে বসে গেট-টুগেদার কর। বুড়ো বাবার সেবা কর। দেখি এই সংসারে কে আপন কে পর। যদিও নুটুবিহারী মল্লিক সারসত্যটি জানেন, এ জগতে কেউ আপন নয়, সবাই পর, তবু তাকে প্রমাণ ছাড়া মেনে নেওয়া কঠিন। তাই বহু বারের মতো আবার একটি মোক্ষম প্ল্যান দিয়ে সবাইকে হাতেনাতে পরীক্ষা করার মতলব করেছেন। এতে ওই একখানি শত্রু মহিলাও ঘায়েল হবে। দরজা ভেজিয়ে মেঝের উপর পজিশন নিয়ে নেন নুটু। ধারেকাছেই সবার গলা শোনা যাচ্ছে। বাঁ পায়ের হাঁটুর অনেকটা উপর পর্যন্ত ঢোলা পায়জামাটা তুলে দিয়ে চুন-হলুদের মতো কমলা প্রলেপের কারুকাজ সমন্বিত পা’খানা দৃশ্যমান করে মুখ থুবড়ে উল্টে পড়ে থাকেন নুটুবিহারী।

দুই-পাঁচ-দশ মিনিট কেটে যায়। ভেজানো দরজার কাছে কোনও পায়ের শব্দ থামে না। বেশ বোঝা যাচ্ছে, কলকণ্ঠ সৃষ্টিকারী দল সদর দিয়ে ঢুকে এসে একটুও না থেমে বারান্দা ধরে সোজা সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেল। নুটুবিহারী পড়ে যাওয়ার ভঙ্গিমা ছেড়ে ওঠেন না। তার মনে আশা আছে, আর কেউ না আসুক, অন্তত বড় ছেলে প্রণয় সবার আগে বাবাকেই দেখতে আসবে। তাই তো আসা উচিত। এই ছেলে মানুষ করতে কী না করেছেন তিনি। ছেলেও হয়েছে তেমনই। জনসমাজে মাথা উঁচু করে বলার মতো। পাঁচজনকে ডেকে দেখাবার মতো। মস্ত বড় সরকারি অফিসার। গাড়ি বাংলো ঠাকুর চাকর হোমগার্ড সিকিয়োরিটি... ব্যস বড় পুত্রটি এক বার এই ঘরে এলেই আর দেখতে হবে না। নুটুবিহারী নিশ্চিত, তার পরিকল্পনা একশো শতাংশ সফল হবে। কিন্তু তার তো কোনও সাড়াও পাওয়া গেল না এখনও। দেখাই যাক আরও কিছু ক্ষণ। মাটিতে উবু হয়ে পড়ে থেকে থেকেই নুটুবিহারী মাথা খেলান।

তিন পুত্র দুই কন্যার মধ্যে ছোট পুত্রটি ছাড়া বাকি সবগুলিই এক সময়ে গর্ব উদ্রেককারী ছিল। কিন্তু কালের অমোঘ নিয়মে আজ সবাইকে নিয়েই সংশয় এসেছে প্রাণে। সবাই যেন কেমন পাল্টে গিয়েছে। আর ছোটবেলার মতো শ্রদ্ধা সমীহ করে না, কথাবার্তায় একটা মাইডিয়ারি ভাব। ওদের মায়ের জন্যই হতে পেরেছে। তিনি তাতেই গদগদ। আর ছোট পুত্র প্রতিম তো তার সৃষ্টিছাড়া আচরণে আস্ত একটি দৃষ্টান্ত। চাকরির চেষ্টা নেই, সারাক্ষণ ট্যাংট্যাং করে গিটার বাজিয়ে গান গেয়ে বেড়াচ্ছেন। সে সব মনে করে নুটুবিহারী এই সাতসকালে মেজাজ হারাতে চান না। অনেক বড় চ্যালেঞ্জ তাঁর সামনে। একটি সাড়ে চার ফুট মহিলাকে উচিত জবাব না দেওয়া পর্যন্ত প্রাণে শান্তি নেই। ওই মহিলাটি তাঁর জীবনে অশান্তি ডেকে এনেছেন। শুধু আজ নয়, গত বেয়াল্লিশ বছর ধরেই নানা রকম তুষের আগুন জ্বলছে মনেপ্রাণে। জ্বালা বড়ই গভীর।

এত জ্ঞানী বিদ্বান সুচাকুরে স্বামীকে কোনও দিন সমাদর করলেন না অণিমা। প্রতি কথা নস্যাৎ করে দেওয়াটাই তাঁর স্বভাব। যেন তাবড় সাংসারিক ব্যাপারে নুটুবিহারী অজ্ঞ। যত জ্ঞান সব ওই অণিমাসুন্দরীর। বরাবর এই এক জনের কাছে হেরে এসে আজ সত্তর বছর বয়সে নুটুবিহারী ক্ষিপ্ত বাঘের মতো হয়ে আছেন। সুযোগ পেলেই শিকারের উপর লাফিয়ে পড়ে ঘাড় মটকাবেন। কিন্তু সে সুযোগ আর আসে না। আসি-আসি করেও বারে বারে হাত ফসকে কেবলই দান চলে যায় প্রতিপক্ষের হাতে। একে একে তিন ছেলে দুই মেয়ে জন্মাল। প্রথমে দুই ছেলে তার পর দুই মেয়ে, সব শেষে অপোগণ্ড ছোট ছেলেটা। ওটার কথা ভাবলেই আরও রাগ হয়। মায়ের আদরে এমন হয়েছে। এমনিই তখন থেকে একটু একটু করে রাগ চাপছে মাথায়। আজকাল এমন হয়েছে, সংসারের কথা, অণিমার কথা ভাবলেই তপ্ত কড়াইয়ে জলের ছিটে লাগে। জীবনজোড়া রাগ বিরক্তি হতাশার মরুভূমিতে বড় ছেলে প্রণয় ওরফে পুনুই এক মাত্র মরুদ্যান। সেই শান্তির জায়গাটুকুও ছিনিয়ে নেওয়ার জন্য ওই শত্রু মহিলাটির চেষ্টার অন্ত নেই। ছেলেকে রিসিভ করতে সাতসকালে স্টেশনে চলে গিয়েছেন বাড়ি ঘর ফেলে। যেন বাকিরা গেলে চলবে না। ওঁকেই যেতে হবে ভালবাসা দেখাতে। কিন্তু নুটুবাবুও শেষ পর্যন্ত ধরে রাখবেন তাঁর রাজ্যপাট। তার জন্য যদি এক ঘণ্টাও উপুড় হয়ে মাটিতে শুয়ে থাকতে হয়, সেও ঠিক।

শুয়ে শুয়েই নাকটা ফড়াৎ করে একটু ঝেড়ে নিলেন পাশের লাল কার্পেটের আসনের উপর। এমনিতেই ঠান্ডার ধাত। মেঝের সঙ্গে এত ক্ষণ সোজাসুজি যোগাযোগে নাকটা একটু সুড়সুড় করছে তখন থেকেই। ভেবেছিলেন ঘরে কেউ নেই, এই অপকর্মটুকু কেউ আর খেয়াল করবে না। কিন্তু কপাল যাবে কোথায়। এত ক্ষণ কেউ এল না এ ঘরে, আর যেই নাক থেকে গলিত পদার্থটুকু নিয়ে কার্পেটের আসন তাক করে ছুড়ে মেরেছেন অমনি ঘরে এসে ঢুকলেন সেই চিরশত্রু মহিলাটি। পিছনে এত ক্ষণের অপেক্ষার বড় পুত্রটি, সেই সঙ্গে মেজ ছেলে প্রকাশ, বড় মেয়ে প্রণতি, ছোট মেয়ে সুনীতি, সংক্ষেপে পুনু, পুকু, পুন্টি, সুন্টি। কে জানে, দুই জামাই বাবাজীবন, দুই বৌমা এবং ছোট ছেলে প্রতিম বা পুতুও তার পিছনে লাইনে আছে কি না। আপাতত অণিমা ব্রিগেড চার জনকে নিয়েই হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ে পরিত্রাহি চিৎকার জুড়ে দেয়।

“এ কীইইই? আবার তুমি ঘরের ভিতর নাক ঝাড়ছ? কী কাণ্ড! বাজে অভ্যেসগুলো জীবনে গেল না? ছি ছি ছি ছি... মা গোওওও ...কার হাতে দিয়ে গিয়েছিলে গো বাবা... জীবন জ্বলে গেল!”

হাতেনাতে ধরা পড়ে প্রথমটায় একটু ভেবলে গিয়েছিলেন নুটুবাবু। এখন ঘরে উপস্থিত জনতার দিকে আড়চোখে দেখে নিয়ে পূর্ব পরিকল্পিত চিত্রনাট্য অনুযায়ী চোখ বন্ধ করে ছদ্ম-যন্ত্রণার অভিনয় শুরু করেন। পুনুর গম্ভীর গলা শোনা যায়, “আহ্ মা... ছাড়ো ও সব, আগে দেখো বাবার কী হয়েছে...” নিজেই এগিয়ে আসে পুনু। বড় সহৃদয় ছেলে। মায়ের মতো একেবারেই হয়নি। অন্য ভাইবোনেদের সঙ্গেও মিল নেই কোনও। সাধে কি আর এই ছেলের উপর আশা-ভরসা নুটুবাবুর? বাকিগুলো তো মুখে হাত চাপা দিয়ে হাসতে শুরু করেছে, চোখ বন্ধ করেও টের পাচ্ছেন তিনি।

পুনু এসে বাবার হাত ধরে তোলার চেষ্টা করে, “কী হয়েছে বাবা? এ ভাবে পড়ে আছ কেন?’’

‘আ মরণ’! চিরশত্রুর বহু ব্যবহৃত শব্দটিই মনে এসে যায় নুটুবাবুর। অতখানি লম্বা পায়ের কমলারং লেপা অংশটা চোখে পড়ছে না কারও! তা পড়ছেই না যখন, তখন চোখে পড়াতে হবে। পুনুর হাতে ভর দিয়ে সামনে দাঁড়ানো অণিমার প্রায় মুখের উপর ঠ্যাং লম্বা করে দেন নুটুবাবু। গোঙানির মতো গলায় বলেন, “পড়ে গেলাম বাবা, বৃদ্ধবয়সে কর্মনাশ।
বড় যন্ত্রণা।’’

“সে কী! কী করে পড়লে বাবা? এইগুলো কী লাগিয়েছ? ভাঙেনি তো? এক্স-রে করতে হবে... পুকু...গাড়িটা বার কর...” স্বাভাবিকভাবেই ব্যস্ত হয় পুনু। মনে মনে আশ্বস্ত হন নুটুবাবু। এটাই তো চেয়েছিলেন তিনি। মুখ ব্যাজার করে ছেলের ঘাড়ে ভর দিয়ে লেংচে লেংচে খাটে এসে বসেন। মুখে যন্ত্রণার অভিনয়। অণিমার মুখখানা দেখার মতো হয়েছে। তিনি যেন বিশ্বাসই করতে পারছেন না এত বড় অঘটনটা। এই তো মাত্র ঘণ্টা দেড়েক তারা বাড়ি ছিল না। এই মানুষকে আম দুধ মুড়ি দিয়ে এক বড় জামবাটি ব্রেকফাস্ট খাইয়ে তবে বাড়িসুদ্ধ সবাই গিয়েছিল স্টেশনে। এখন তিন দিন ধরে হাজার মোচ্ছবের প্ল্যান-প্রোগ্রাম। এর মধ্যে কী এমন হল যে, উনি উল্টে পড়ে সব ভন্ডুল করতে বসেছেন! নানা কুটিল চিন্তায় অনিমার মুখে সাত রং খেলা করছে। নুটুবাবুর ভারী ইচ্ছে হয় একখানা বড়সড় ভেংচি কাটতে। অনেক কষ্টে দমন করেন নিজেকে।

পুনুর কথার মূল্য আছে এই সংসারে। সেই মূল্য বজায় রাখতে গাড়ি ডাক্তার ইত্যাদির জন্য মোটামুটি একটা হাঁকডাক শুরু হয়। যতটা ভেবেছিলেন ঠিক ততটা না হলেও ছেলেমেয়েরা সকলেই এক এক বার করে এসে জিজ্ঞেস করে যাচ্ছে ব্যথাটা কতটা রয়েছে, আর বাড়ল কি না ইত্যাদি। শুধু চিরশত্রু মহিলাটিই সেই থেকে কোমরে হাত দিয়ে চোখ কপাল কুঁচকে চুপ করে তাকিয়ে আছেন নুটুবাবুর দিকে। এই দৃষ্টি বেয়াল্লিশ বছর ধরেই চেনেন নুটুবাবু। অণিমা এখন মনে মনে বিশ্লেষণ করছেন ব্যাপারটা কতটা সিরিয়াস, কী করে হল। আদৌ হয়েছে কি না ইত্যাদি। ঘরে এরা না থাকলে, ওই খান্ডার মহিলা এত ক্ষণে নুটুবাবুর ঠ্যাং ধরে টেনে টেনে পরীক্ষা করে দেখে নিত সত্যিই কতখানি ব্যথা। আর সেই পরীক্ষায় নুটুবিহারী ডাহা ফেল করতেন এ কথা নিশ্চিত। সারা জীবনই করে এসেছেন। এখন তাই স্ত্রীর মুখের দিকেই তাকান না। পাশ থেকে উঠে যাচ্ছিল পুনু। ব্যাকুলভাবে তার হাতটা চেপে ধরেন। অস্পষ্ট গোঙানির স্বরে বলেন, “আমি আর বাঁচব না বাবা। তুই কোথাও যাস না বুড়ো বাবার পাশ থেকে।’’

পুনু বিব্রতমুখে তাকায় মায়ের দিকে। ছোট ভাই একটা ব্যান্ডে গান করে বহু দিন ধরে। ওরই তৈরি দল। বাবার প্রবল আপত্তি। কিন্তু বাড়ির সবাই, বিশেষ করে মা ওর সবচেয়ে বড় পৃষ্ঠপোষক। এই নিয়ে বাবা-মায়ের প্রবল বিরোধ। আজকাল  ছোট ভাই ডাক পাচ্ছে এ দিক-সে দিক। সেই ব্যান্ডের স্পেশাল অনুষ্ঠান আছে কাল দিঘায়। মায়ের প্ল্যানিং-এ বাড়ির সবাইকে নিয়ে আজ বিকেলে দিঘা যাওয়া হবে তিনখানা গাড়ি ভর্তি করে। কাল ওখানে থেকে প্রোগ্রাম দেখে, সমুদ্র দেখে পরশু ফেরা। আসানসোলের বড় বোন, বড় জামাই, দমদমের ছোট বোন ছোট জামাই, সবাই ছেলেমেয়ে নিয়ে হাজির এই উপলক্ষে। পুনুকেও ছুটি নিয়ে ফ্যামিলিশসুদ্ধ আসতে হয়েছে শিলিগুড়ি থেকে। আজ ওকেই রিসিভ করতে সবাই স্টেশন গিয়েছিল। অণিমার প্রোগ্রাম সব এই রকমই। সে বছরের মধ্যে অন্তত বার তিন-চার এই রকম হিড়িক তোলে। দল বেঁধে বাইরে গিয়ে ফ্যামিলি গেট-টুগেদার। উপলক্ষ কখনও কারও জন্মদিন, বিবাহবার্ষিকী বা অন্য কোনও অনুষ্ঠান। মায়ের সবেতেই উৎসাহ, আর বাবার সবেতেই আপত্তি। অনেক ঝগড়াঝাঁটির পর বাবার শোচনীয় পরাজয় আর মায়ের তুমুল জয়লাভ। ছেলেমেয়েরা বোঝে না, বাবা কেনই বা প্রতি বার হারার জন্য বিরোধিতা শুরু করে। শেষ পর্যন্ত তাঁকেও গুটিগুটি পায়ে দল ভারী করতেই হয় যখন, প্রথম থেকে খুশিমনে রা়জি হলেই পারেন। কিন্তু সেটি তো হওয়ার নয়। এমনকি জামাই এবং বৌমারাও অণিমার দলে। মাইডিয়ার শাশুড়িকেই ওরা ভোট দেয়। প্রবল প্রতিপক্ষ হিসেবে প্রাণপণ লড়েও বাবা শেষ পর্যন্ত পিছু হঠতে বাধ্য হন। এ বার পুনুর কাছে যত দূর খবর ছিল, বাবা-মা’র মধ্যে বিশেষ গোলাগুলি চলেনি। অতএব ওর আশা ছিল এ বারের প্রোগ্রামটা শান্তিপূর্ণ ভাবে হতে পারবে। কিন্তু এখন বাবার গোঙানি শুনে আট বছরের ছেলের মতো মায়ের দিকে তাকিয়ে থাকে আটত্রিশ বছরের পুনু। পুন্টি-সুন্টি মুখে চাপা দেওয়া হাত সরিয়ে হাঁ করে তাকিয়ে এক বার মাকে এক বার বাবাকে দেখে যাচ্ছে। মেজ ভাই পুকু গা়ড়ি বার করবে না কি নার্সিংহোমে ফোন করে ডাক্তারের খোঁজ নেবে, না কি আপাতত নাটকটাই দেখবে ঠিক করতে না পেরে দাঁড়িয়ে থাকে ঘর আর দরজার মাঝখানে।

“অ্যাই পুনু... পুকু... পুন্টি সুন্টিইইই... তোরা সব বাইরে যা তো! দেখি ওঁর কেমন লেগেছে। কোথায় লেগেছে... দেখি কী ভাবে না বাঁচে...খাওয়াব মাখাব আমি, যত্নআত্তি করব আমি...আর উনি যখন ইচ্ছে বাঁচব না বলে বায়নাক্কা করবেন? দাঁড়া দেখি আজকে কে বাঁচে আর কে মরে...” হুঙ্কার ছেড়ে নুটুবাবুর কাছে এসে দাঁড়ান অণিমা। খণ্ডযুদ্ধ আশঙ্কা করে প্রণয় মাকে থামাতে চেষ্টা করে। “মা... বলছিলাম কী অত বেশি রেগে যেও না, তোমার আবার প্রেশার বাড়বে...”

অণিমা কঠিন মুখে আঙুল তুলে চোখ পাকিয়ে তাকায়, “তোমরা সব বাইরে যাও,... ওঁর সঙ্গে আমার একটু দরকার আছে।’’

এর উপরে আর কথা চলে না। এ বাড়ির সকলেই সভ্য শিক্ষিত। একে একে ঘরের বাইরে লাইন পড়ে যায় ছেলে মেয়ে বৌমা জামাই নাতিপুতির। গোলমালের গন্ধে সব্বাই হাজির। সত্তর এবং বাষট্টি বছরের কুশীলবের ব্যক্তিগত কথার গন্ধ পেতে সবাই উৎসুক। কিন্তু সে কথা মুখে স্বীকার করা অসভ্যতা। তাই কেউ উদাসীন, কেউ আত্মবিস্মৃত, কেউ বা আছি কিন্তু নেই এমন মুখে ঊর্ধ্বনেত্র খাড়া-কান দাঁড়িয়ে থাকে বারান্দা জুড়ে।

ঘর থেকে সবাই বেরিয়ে যেতে মনে মনে প্রমাদ গোনেন নুটুবিহারী। এই মহিলাকে বিশ্বাস নেই। বলা যায় না, এখনই হয়তো নুটুবিহারীকে টেনে তুলে দাঁড় করিয়ে দেবেন।

দেওয়ালের দিকে মুখ করে শুয়ে থাকেন তিনি। অণিমা কোনও টানাটানির ধার দিয়ে যান না। খাটের পাশে এসে নুটুবাবুকে এক ধাক্কায় খানিকটা সরিয়ে দিয়ে পা ঝুলিয়ে বসেন। চুপ করে তাকিয়ে থাকেন অর্ধেক পাকাচুলের ঘেরাটোপে সাজানো তেল-চুকচুকে টাকের দিকে। পিছন ফিরে থেকেও সে দৃষ্টি অনুভব করতে পারেন নুটুবাবু। তিনি দুরুদুরু বুকে অপেক্ষা করেন ঝাঁঝালো সংলাপের জন্য। অণিমা এখনও কিছুই বলছেন না দেখে তাঁর অস্বস্তির মাত্রা বাড়তে থাকে। কেউ ঝগড়া করলে পাল্টা ঝগড়া করা যায়। কিন্তু নিশ্চুপ মানুষের সঙ্গে লড়ে ওঠা দুষ্কর। ঘরের হাওয়া বেশ খানিক ক্ষণ ধরে চুপচাপ। নুটুবাবু চুপিচুপি এক বার এ দিকে ফিরে দেখে নিতে চেষ্টা করেন অণিমা ঠিক কোন পজিশন থেকে আক্রমণের প্রস্তুতি নিচ্ছে। ঘাড় ঘুরিয়েই সামনে দুটো গোল গোল চোখ। কিন্তু সেই চোখ থেকে আগুন তো বেরোচ্ছে না? বরং যেন হাসছে অণিমাসুন্দরী? ভারী অবাক হয়ে তড়াক করে লাফিয়ে উঠে বসেন নুটুবাবু।

অনিমা দুলে দুলে হাসছেন কিশোরী মেয়ের মতো। “কত ঢং যে জানো মল্লিকবাবু...”

“ক... কেন? কী... করলাম আমি?” তোতলাতে থাকেন নুটুবিহারী।

“কী করেছ তুমি জানো না? সোজাসুজি বলতে কী হয়? এত রঙ্গর তো কোনও দরকার ছিল না... সবাই বড় হয়েছে! সব বোঝে।”

 “কী রঙ্গ করেছি শুনি? তুমি কি বলতে চাও আমার পায়ে কিছুই লাগেনি, আমি শুধু শুধু নাটক করছি?”

মুখে আঁচল গুঁজে খিকখিক করে হাসে অণিমা, “পাগল? তাই কি আমি বলতে পারি ? খুউউব লেগেছে তোমার। একেবারে ভেঙেই গিয়েছে পা, দেখেই বোঝা যাচ্ছে।’’

কথার গতি কোন দিকে, আন্দাজ করতে পারেন না নুটুবাবু। এই মহিলাকে বিশ্বাস করাই যায় না। হাসতে হাসতে ছুরি বিঁধিয়ে দিতে পারেন বুকে। শত্রুপক্ষের সামনে গাম্ভীর্য অবলম্বন করাই শ্রেয়। আর  এক বার মুখে ছদ্ম-যন্ত্রণার আওয়াজ করে শুয়ে পড়েন তিনি। অণিমা ডাক পাড়েন, “পুনু পুকু পুন্টি সুন্টি... এক বার ভিতরে শুনে যা তোরা।’’

সব বারান্দাতেই ছিল। ডাকার সঙ্গে সঙ্গে লাইন দিয়ে এসে ঘরে ঢুকে পড়ে। নুটুবাবু মনে মনে প্রমাদ গোনেন। ছেলে মেয়ে বৌমা জামাইদের সামনে এ বার কি বেইজ্জত হতে হবে?

“শোনো... তোমাদের বাবার পায়ের যা অবস্থা তাতে বাড়িসুদ্ধ তো যাওয়া চলে না। তোমরা বিকেল নাগাদ রওনা দাও। আমি ওঁর কাছে থাকছি। অবস্থার কিছু উন্নতি হলে হলে যাব।’’

বলতে দেরি মাত্র, সঙ্গে সঙ্গেই ঘরে বিভিন্ন মন্তব্যের স্রোত বইতে থাকে। ‘‘ও মা, ইসস, আহা... তাই আবার হয় না কি? না না তা হয় না... ধুউস সব জলে গেল, একটুউউউও ভাল্লাগেনা... ইত্যাদি। সবচেয়ে বেশি আপত্তি আবার দুই বৌমা এবং দুই জামাইয়ের। তাদের নাকি শাশুড়িমা ছাড়া একটুও জমবে না। সত্যি কী আদিখ্যেতাই জানে সাড়ে চার ফুটের এই মহিলা। বাড়িটা হাতের তালুর মধ্যে। বাবা কেউ নয় এদের। সব শুধু মা। রাগে গরগর নুটুবাবু আবার পিছন ফিরতে যান। কিন্তু পারেন না। অনিমা বাঁ পায়ের কমলা রং লেপা জায়গাটায় হাত বুলোচ্ছেন। সর্বনাশ... ওই হাত এ বার নাকে দিলেই তো সব ফাঁস। সাধের মুখে-মাখা ক্রিমের এই দশা টের পেলেই নেচে উঠবেন একেবারে। নেহাত ঘরের দঙ্গল ভিড় নানা রকম আলোচনায় ব্যস্ত, তাই কেউ খেয়াল করেনি।

পুকু মাথা নাড়ে, “মা, তুমি না গেলে পুতু গান গাইতেই পারবে না...”

পুন্টি বলে, “হ্যাঁ মা, দমদম থেকে সুন্টির পিসিশাশুড়িকে গাড়ি পাঠিয়ে আনিয়ে নাও... বাবার সঙ্গে ওঁর বেশ ভাল জমে... মেট্রন ছিলেন এক কালে, সেবাও করতে পারবেন...” দুই বোন চোখ টেপাটেপি করে হাসে। নুটুবিহারীর প্রতি সুন্টির পিসিশাশুড়ির পক্ষপাত কারও অজানা নয়।

“থামো... বড়দের নিয়ে ঠাট্টারসিকতা ভাল জিনিস নয়। তা ছাড়া ওঁকে এই অবস্থায় ছেড়ে আমি যেতে পারি না, সেটা অধর্ম হয়,” ধমক লাগান অণিমা। মনে মনে বিড়বিড় করেন নুটুবাবু, “এহ... কী আমার বকধার্মিক রে... তাও যদি   না জানতাম, আসলে সুন্টির পিসিশাশুড়ি লীলাকে আমার ধারেকাছে ঘেঁষতে দিতে চায় না... হিংসুটির ডিম তো একটি। নিজে সারা জীবন যা খুশি তাই করবেন যেখানে খুশি যাবেন, অথচ আমার বেলায় খোঁটায় বাঁধা জীবন।’’ এ সব নিঃশব্দ কথা স্বাভাবিকভাবেই কানে ঢোকে না অণিমার। “পুন্টি সুন্টি... যা সবাইকে খেতে দেওয়ার ব্যবস্থা কর। তাড়াতাড়ি যাত্রা করাই ভাল, এতটা পথ, ধীরেসুস্থে যেতে পারবি। আর পুনু, বাবা, পুতুকে বুঝিয়ে বলিস সব। সে যেন মায়ের উপর রাগ করে অনুষ্ঠান বন্ধ না করে। বলবি মা চেষ্টা করছে আসার...” শেষ কথাটা বলে দিয়ে উঠে পড়েন অণিমা। নুটুবিহারী প্রমাদ গোনেন। এ আবার কী উল্টো চাল দিয়ে বসল মহিলা! ওর খপ্পরে পড়ার চাইতে তো ওদের সবার সঙ্গে যাওয়া অথবা বাড়িতে একা থাকাই ভাল ছিল।

ছেলেমেয়েরা সব হইহই করে বেরিয়ে গিয়েছে। অণিমা দাঁড়িয়ে থেকে ওদের দুগ্গা-দুগ্গা করে যাত্রা করিয়ে দিয়েছেন অনেক ক্ষণ। বাড়ি এখন নিস্তব্ধ। নুটুবিহারী পড়েছেন মুশকিলে। এক বারও খাট থেকে নামতেই পারেননি। নামতে দেখলেই ছুটে আসছেন অণিমা।

“নেমোনি নেমোনি... মোট্টে খাট থেকে নেমোনি কো... পায়ে অতকানি ব্যতা... কত্তো লেগেছে... দেকেই বোজা যাচ্ছে,”ছেলে মেয়ে বৌ জামাইরা বেরিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অণিমা পোশাকি ভাষা ছেড়ে নিজের ভাষায় ফিরে এসেছে। নুটুবিহারী সারা সকাল দুপুর পার করেছেন খাটে শুয়ে। মানে, পার করতে হয়েছে। খাটে বসে বালিশের উপর পা তুলে দিয়ে খাদ্যগ্রহণ, সেখানে বসেই অনিমার এনে দেওয়া গামলায় হাত মুখ পরিষ্কার করা। এমনকি বেডপ্যানে রেচনত্যাগ সমাপন! সব মিলিয়ে অসহ্য অবস্থা। এক-এক বার মনে হচ্ছে হুঙ্কার দিয়ে লাফিয়ে উঠে সন্ধেবেলার বুড়োদের আড্ডায় চলে যান। কী ভেবেছিলেন আর কী হল।

এত দূর কল্পনাতেও ছিল না। শুয়ে শুয়ে অণিমাকে শাপশাপান্ত করতে করতে শেষ বিকেলের দিকে একটু ঘুমিয়েই পড়েছিলেন। হঠাৎ নাকে আসে পরিচিত একটি গন্ধ। হ্যাঁ এ তো সেই অণিমার ক্রিম! পায়ে লেপতে গিয়ে গন্ধটা মনে আছে। তাকিয়ে প্রথমটা কিছুই দেখতে পান না। ঘর অন্ধকার। বিরক্ত হয়ে এক লাফে সুইচবোর্ডের দিকে এগোন নুটুবাবু। কিন্তু আলো জ্বালার আগেই কে যেন তাঁর ছ’ফুট লম্বা শরীরের কাঠামো খুঁজে নিয়ে দুই হাতের মধ্যে ঢুকে পড়েছে। এ তো সেই সাড়ে চার ফুটের চিরশত্রু মহিলাটি ছাড়া আর কেউ নয়। কিন্তু তিনি সারা ক্ষণের রণমূর্তি ছেড়ে এমন রঙ্গই বা করবেন কেন হঠাৎ? চমকে উঠে আলো জ্বালেন নুটুবিহারী।

“মা গো মা... তলে তলে এত বুদ্দি তোমার? হ্যাঁ গো মল্লিকমশাই? আজকের দিনটা মনে করে রেকে দিইচো? অ্যাঁ? তাই বলি অমন সাতসকালে ভাল মানুষটা উল্টে পল্লো কী করে? সবাই নেগেচে নেগেচে কচ্চে... আমি বলি হু হু বাবাআআ... এ সব হল মারিজ আনিভাসসারির পোগগাম... সব্বাইকে বেড়াতে পাঠিয়ে রোমান্‌চ করবেন বাবু! মা গো মা...” অনর্গল বলে যান অণিমা। সে সব কথা নুটুবাবুর কিছু কানে যায়, কিছু যায় না। তিনি তখন বুকের কাছ ঘেঁষে থাকা, সাদা-লাল বেনারসি মোড়া, চুলে মোটা বেলফুলের মালা পেঁচানো সাড়ে চার ফুটের চিরশত্রুটিকে দেখছেন।

এ কথা মনে মনে অস্বীকার করার জায়গা নেই যে আজকের স্পেশাল দিনটি এতগুলো ছেলে মেয়ে, অণিমা বা নুটুবাবু কারওই মনে ছিল না। জীবনের চাকায় বাঁধা রেলগাড়ির মতো নির্দিষ্ট দিকে গড়িয়ে যেতে যেতে কখন নিজেদের কাছে নিজেদের প্রাধান্যটাই গৌণ হয়ে গিয়েছে। সবার জন্য ভাবতে ভাবতেই জীবন খরচ করে ফেলেছেন ওরা দু’জন। নুটুবাবুর পড়ে যাওয়ার নাটকটাও আত্মজনেদের জন্যই, সেখানে নিজেদের বিবাহবার্ষিকীর স্থান ছিল না। এখন ফাঁকা ঘরে, বুকের মাঝখানে পুটুলির মতো মুখ গুঁজে থাকা অণিমাসুন্দরীকে জড়িয়ে থেকে ওঁর মনে হয়, ভাগ্যিস ওই নাটকটা করেছিলেন। না হলে তো এই চিরশত্রুটিকে এত দিন পরে আবার নতুন করে পাওয়া হত না। জোরে নাক টানেন নুটুবাবু। অণিমার কুঞ্চিত গালে ক্রিমের গন্ধ। তার সঙ্গে মিশে যায় হঠাৎ ফিরে পাওয়া বেয়াল্লিশ বছর আগের সেই বিশেষ রাতটার গন্ধ। দুই বিবদমান প্রতিপক্ষের ওড়ানো সাদা পতাকায় ঘরের ভিতর বিজলি বাতির রং ঠিকরে গিয়ে তৈরি হয় স্পেশাল এফেক্ট।

 

ছবি: দীপঙ্কর ভৌমিক