একরত্তি বাচ্চাটা কখন যেন নিজের সিট ছেড়ে চলে গিয়েছে চলন্ত বাসের খোলা দরজার দিকে। গাল দুটো ফুলে আছে ওর। যেন মুখের ভিতরে জোর করে কিছু চেপে রাখা। দ্রুতগতিতে ছুটছে বাস। শীতল হাওয়ার হাত থেকে বাঁচতে বন্ধ করা আছে সমস্ত জানলার কাচের পাল্লা। বাসে লোকজন বেশি নেই। কন্ডাক্টর ঘাড় হেঁট করে ভাড়া গোনায় ব্যস্ত। বাচ্চাটার দিকে নজর যায়নি কারওই। ওর লক্ষ্য স্থির। দরজার কাছে তিনটে ধাপ সিঁড়ি নেমে গিয়েছে। শেষ ধাপ অবধি পৌঁছে ওকে শুধু মুখটা বাড়িয়ে দিতে হবে বাইরের দিকে। শূন্যে।
তীক্ষ্ণ চিৎকারটা কানে ভেসে এল দিঘির। তার পরই আচমকা ঘ্যাঁচ করে ব্রেক কষার এক বিশ্রী আওয়াজ। শব্দটা যেন ওকে ফালাফালা করে দিল। চটকা ভেঙে তাকাল সামনের দিকে। কিছুই ঠাহর হল না প্রথমে। দু’চোখে এখনও আঠার মতো লেগে আছে ঘুম। পাশের সিটটায় হাত ঠেকাতেই চমকে গেল। দোয়েল নেই!
“ধরুন ধরুন, আমার বাচ্চাটাকে একটু ধরুন…” ওর শরীর ঝাঁকিয়ে আর্ত স্বরটুকু কোনও রকমে বেরিয়ে এল। দরজার কাছটা এখনও কেন এত ঝাপসা? কে ও? কার হাত শক্ত করে ধরে দাঁড়িয়ে আছে কন্ডাক্টর? দোয়েল না? হ্যাঁ, তাই তো! থেমে যাওয়া বাসের দরজার কাছে দাঁড়িয়ে মাথা ঝুঁকিয়ে নিজেকে উগরে দিচ্ছে মেয়েটা। যিশু আর ওর একমাত্র সন্তান, দোয়েল। এত কাণ্ড ঘটে যাওয়া সত্ত্বেও নিজের জায়গা ছেড়ে উঠতে পারছিল না দিঘি। পা দুটো যেন নড়াচড়া করতে অক্ষম।
“কার বাচ্চা এটা? কে আছেন এর সঙ্গে? আপনি? বাচ্চাটাকে এ ভাবে ছেড়ে দিয়েছেন? আশ্চর্য!” প্যাসেঞ্জারদের দিকে সালিশি মানার ভঙ্গিতে তাকিয়ে ওর উদ্দেশে দাঁত খিঁচিয়ে উঠে দোয়েলের হাত ছেড়ে দিল কন্ডাক্টর। ছোট্ট একটা ঠেলা দিয়ে সরিয়েও দিল বাসের পাদানি থেকে।
“আজব মা তো আপনি! আমি সময়মতো গাড়ি না থামালে বাচ্চাটা সিধে চলে যেত চাকার তলায়!” ড্রাইভারও চেঁচাচ্ছে গাঁকগাঁক করে। দৃষ্টি দিয়ে বিঁধছে দিঘিকে।
দিঘি জায়গা ছেড়ে উঠল কখন যেন। ভাবলেশহীন মুখ। আশপাশের মানুষজনের কটূক্তি ওকে স্পর্শ করল না তেমন। সব কিছু ছাপিয়ে হঠাৎ ইচ্ছে হল দোয়েলের গালে ঠাস করে একটা চড় বসাতে। বমি পেয়েছে, সেটা বলতে কী হয়েছিল মুখ ফুটে? এঁটে থাকা জানলাটা খুলে দিতে পারতাম না আমি? কেন এত ভয় নিজের মা-কে? তার পরই দিঘির ইচ্ছে হল সোজা বাড়ি গিয়ে শাশুড়ির গলাটা টিপে ধরতে। বারবার বলেছে, “নাতনিকে স্কুলে যাওয়ার আগে খাওয়াবেন না এমন গান্ডেপিন্ডে।” কত বার বলেছে, “অসুস্থ শরীরে আপনাকে বিছানা ছেড়ে উঠতে হবে না। রেস্ট নিন।” কিন্তু সে কথা ভদ্রমহিলা শুনলে তো! হুইলচেয়ার ঠেলে ঠেলে ঠিক চলে আসবেন ডাইনিং রুমে। আগড়ম বাগড়ম গল্প শোনাবেন দোয়েলকে। ব্যস। রোজ লেট। প্রায়শই আজকের মতো স্কুলবাস মিস। হয়রানির চূড়ান্ত।
আজব মা! আজব মা! মনের মধ্যে শব্দদু’টির অনুরণন বার বার ঢেউয়ের মতো জেগে উঠল। জানলাটা ও সামান্য খুলে দিয়েছে। পাশে বসা বমির ধকলে ক্লান্ত ছ’বছরের শিশুটি এখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। মেয়ের দিকে তাকিয়ে রাতজাগা চোখদুটো জ্বালা করে উঠল দিঘির।
মা হতে তো সে চায়নি। সত্যিই চায়নি। একটা সময় অবশ্য চেয়েছিল। বিয়ের দু’বছরের মাথায় যিশুর হাতে-পায়ে ধরে সে রীতিমতো কাকুতি মিনতি করেছে একটি সন্তানের প্রার্থনায়। কিন্তু তার কর্মব্যস্ত স্বামী তখন মোটে নিতে চায়নি পিতা হওয়ার দায়িত্ব। বিটকেল সব অজুহাত দেখিয়েছিল যিশু। কাজের চাপ, পয়সাকড়ির টানাটানি, এই সব নানা হাবিজাবি। ঝগড়া করেছে দিঘি। কান্নাকাটি, মান-অভিমান, সবই করেছে সাধ্যমতো। রাগ দেখিয়ে না খেয়ে, জেগে কাটিয়েছে বহু রাত। তাতে কিচ্ছু হয়নি। সংসারের ছন্দ একটুও টলমলায়নি। যিশু কঠিন স্বরে বলেছে, “ইমপ্র্যাকটিকাল মেয়ে একটা! চাকরি-বাকরি তো করোনি, বুঝবে কী করে দেশের অবস্থা? যা খুশি আবদার করলেই হল?”
কত দিন আর শুকনো মুখে বসে থাকবে দিঘি? কাঁহাতক ঘরবন্দি হয়ে চোখের জল ফেলবে ও? তাই এক সময় উঠে দাঁড়িয়েছে। ফের পুরনো বন্ধুদের সঙ্গে মাল্টিপ্লেক্সে মুভি দেখতে গিয়েছে। বন্ধুদের পরামর্শে আবার পড়াশোনা আরম্ভ করেছে ডিসট্যান্সে। শপিং, পার্টি, বইমেলায় নিজেকে ব্যস্ত রেখেছে। মা হওয়ার স্বপ্নটা ফিকে হলেও পুরোপুরি মিলিয়ে যায়নি।
ওর ফাইনালের ছ’মাস আগে হঠাৎ সকলেরই মনে হতে শুরু করে যে, সংসারে একটি বাচ্চার বড্ড অভাব। বড়দের তরফ থেকে চাপ বাড়তে থাকল সেই সময়, যখন যিশুর পর পর দু’খানা প্রমোশন হল। স্যালারি এক লাফে বেড়ে গেল অনেকটা। ওরা ভাড়াবাড়ি ছেড়ে নতুন ফ্ল্যাটে চলে এল। ঠিক তখনই কানপুরের দিদির কাছ থেকে মা-কে নিয়ে চলে এল যিশু। একা দিঘি বাচ্চাকে সামলাতে পারবে না, তাই। দিঘি তখন পরীক্ষা নিয়ে হাবুডুবু খাচ্ছে। এ রকম প্রস্তাবের জন্য একেবারেই প্রস্তুত ছিল না ও। অস্ফুটে দু’-এক বার প্রতিবাদ করতে গিয়ে মনে হল যেন যিশুর চোখদুটো বিস্ময়ের ঠেলায় খুলে এখনই বাইরে বেরিয়ে আসবে। কাকে কাকে ফোন করলেন শাশুড়ি তা জানে না, কিন্তু পরদিনই মা-বাপি চলে এল গুয়াহাটি থেকে। চলল একটানা উপদেশ পর্ব। ওর মনে হচ্ছিল, যেন চুলের মুঠি ধরে কেউ ওকে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে একটা দরজার সামনে। দরজার হাতল ঘুরিয়ে খুলতে হবে ওকেই। ও-পাশের জীবনটা কোন খাতে বইবে তা ও জানে না। তবুও দিঘি কনসিভ করল।
মনের গভীরে ওঠা তরঙ্গ হয়তো কখনও কখনও জীবনের উপরেও রেখাপাত করে। মাসচারেক যেতেই এক দিন কাকভোরে একটা অস্বস্তি নিয়ে জেগে উঠল ও। টয়লেট থেকে ফেরার কিছু ক্ষণ পর তলপেটে তীব্র ব্যথা নিয়ে কোনও মতে পাশে ঘুমন্ত যিশুকে ধরে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে জ্ঞান হারাল দিঘি। শিশুটির আর জন্ম নেওয়া হয়নি। আপাতত কয়েক বছর সেই চেষ্টা থেকে বিরত থাকতেও বললেন ডাক্তার। ও দিকে তালেগোলে পরীক্ষার ফর্ম ফিল আপ করার কথাও কারও মনে নেই। ওর পড়াশোনার সেখানেই ইতি।
দিঘি কেঁদেছিল আকুল হয়ে। যতটা না শারীরিক বেদনায়, তার চেয়েও বেশি মানসিক আঘাতে সে প্রায় মিশে গেল বিছানায়। ঘটনাটা এমনই সময় ঘটেছে, যখন সে ভালবাসতে আরম্ভ করেছিল তার প্রথম মাতৃত্বের মধুর অনুভূতিকে। এখন সে রিক্ত। কোথায় যাবে? কাকে আঁকড়ে ধরবে? এই বিপন্ন সময়ে ওর জীবনে এল ‘উন্মেষ’। বাপির বন্ধু অরুণকাকুদের এই বেসরকারি সংগঠনটি দীর্ঘ দিন ধরেই পরিবেশ রক্ষায় ও পরিবেশ সচেতনতায় নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করে চলেছে ওই এলাকায়। দিঘিকে দেখতে এসে ওর উস্কোখুস্কো চুল, এলোমেলো দৃষ্টি, ঝরে যাওয়া চেহারা অরুণকাকুকে ব্যথিত করল। তিনি ওকে সাদরে ডেকে নিলেন নিজের সংস্থায়। শুরু হল প্রতিদিন নিয়ম করে উন্মেষ-এর অফিসে যাওয়া। আরম্ভ হল মিটিং, মিছিল, ছুটির দিনে নানা সাফাই অভিযান, সচেতনতা ক্যাম্পিং, বিট প্লাস্টিক ক্যাম্প, স্লোগান তৈরি, পরিবেশ সংক্রান্ত অসংখ্য সেমিনার, আরও অজস্র কর্মকাণ্ড।
দিঘি মা-পাখির মতো আগলে ধরল উন্মেষকে। কী করেনি সে ওই সাত বছরে? কোমরে আঁচল গুঁজে বালতি হাতে নেমে পড়েছে বুজে যাওয়া পুকুর পরিষ্কার করতে, বাজার এলাকায় গিয়ে দোকানদারদের বুঝিয়েছে প্লাস্টিক দূষণের যাবতীয় গুরুত্বপূর্ণ তথ্য, লিফলেট বিলি করেছে রাস্তায়, সেমিনারের সব দায়িত্ব হাসিমুখে কাঁধে নিয়েছে। সবার মুখে শুধু তার প্রশংসা। শাশুড়ি আগেই কানপুরে ফিরে গিয়েছেন। শূন্য বাড়িতে তাঁর দম আটকে আসত। যিশু ডুবে থাকত অফিসের ঝামেলায়। দিঘিকে মুক্ত বাতাসে শ্বাস নিতে শিখিয়েছিল উন্মেষ। তিন বার দলের সঙ্গে দিল্লি ঘুরে এল। এক বার গেল সান্দাকফু। ওই সাত বছর তার জীবনের সেরা সময়।
বুক নিংড়ে একটা শ্বাস পড়ল দিঘির। এখন আর সে কেউ নয় উন্মেষের। নতুন ছেলেমেয়েরা তো চেনেই না তাকে। নিজের গরজেই বছরে এক বার কী দু’বার যায়। বেশি ক্ষণ বসতে পারে না, দায়িত্ব নেওয়া তো দূরের কথা। মাসতিনেক আগে শেষ বারের মতো উন্মেষের একটা সেমিনারে গিয়েছিল। ভালচার কনজ়ারভেশন নিয়ে আলোচনা। ভাল লাগার কথা। কিন্তু ওখানে গিয়ে আরও যেন অসহ্য লেগেছে ওর। ক’বছরে এতখানি পালটে যেতে পারে সব কিছু? দলটায় যেন কোনও প্রাণ নেই। পুরনো লোকেরা তেমন আর আসেন না। অরুণকাকু রেটিনা অপারেশনের পর দল ছেড়েছেন। নতুনেরা যেন বড় বেশি পেশাদার। মাপা কথার বাইরে অপ্রয়োজনীয় একটি বাক্যও খরচ করতে নারাজ। খুব সূক্ষ্মতার সঙ্গে নিজেদের বডি ল্যাংগোয়েজেই ওরা বুঝিয়ে দিচ্ছিল যে, অযোগ্য লোকজনের উপস্থিতি সেখানে বাঞ্ছনীয় নয়। কিছু ক্ষণ পর এক ছুটে হল ছেড়ে বেরিয়ে এসেছিল দিঘি। প্রোজেক্টরের স্লাইডের মধ্য থেকে শকুনগুলো বেরিয়ে এসে যেন ওর হৃৎপিণ্ডটাকে উপড়ে নিচ্ছিল। অপমানে দপদপ করছিল মাথা। আর সে রাতেই নার্সারি রাইম্সে সামান্য ভুলের জন্য চড় মেরেছিল ও দোয়েলকে। জীবনে প্রথম বার।
দোয়েল এসেছিল আচমকাই। হতবাক সে যখন নিশ্চিত হল দ্বিতীয় বার মা হওয়া সম্পর্কে, তখন বেশি বয়সে প্রেগন্যান্সির রিস্ক নিয়ে ভাবনা নয়, গত বারের মিসক্যারেজের ভয়ও নয়, ওকে গ্রাস করেছিল চরম আতঙ্ক। উন্মেষ! ওকে ছাড়া উন্মেষের কী হবে? না না, চাই না আমি! বাথরুম থেকে বেরিয়ে প্রবল চেঁচিয়ে উঠে ছুড়ে ফেলেছিল সে হাতে ধরা প্রেগন্যান্সি কিট। কেন করলে এমন? সে খামচে ধরেছিল যিশুর টি-শার্টের কলার। আর যিশু, অদূর ভবিষ্যতে বাবা হওয়ার গর্বে গর্বিত সেই
পুরুষটি নিদারুণ রাগে হাত মুচড়ে দিয়েছিল ওর।
“কী ছেলেমানুষি করছিস? বাচ্চাটা জন্মাক। বড় হোক একটু। আবার নাহয় করিস তোর ও সব এনজিও-ফেঞ্জিওর কাজ। মেয়েদের জীবনে পূর্ণতা কিসে জানিস? মা হওয়ায়। সে বারের মিসহ্যাপের পর তো আমরা আশাই হারিয়ে ফেলেছিলাম। বেশি বয়সেই হোক না, তবু তো বংশে কেউ আসছে। সবাই কত খুশি। যিশুকে দ্যাখ। মনে হচ্ছে যেন দশ বছর বয়স কমে গেছে ওর!” মাথায় আলতো হাত রেখে বলছিল মা। শাশুড়ি এসে বেডসাইড টেবিলে রেখে গেলেন দুধের গ্লাস।
এ সব পুরুষের সৃষ্টি। এ ভাবেই চিরকাল মেয়েদের মধ্যে দেবীত্ব আরোপ করে তাদের গৃহবন্দি করতে চেয়েছে ওরা। শুধু মাতৃত্বই একটি মেয়ের পরিচয় হতে পারে না। সব মেয়েকেই গদগদ হয়ে মা হতে হবে? কারও ইচ্ছে না করলেই সে অলক্ষ্মী? সমাজের চোখে ঘৃণ্য? ভাবল দিঘি। ‘উন্মেষ’-এর কাজ তখনও চলছে। কিন্তু আর ক’দিন? ভাবতেই বুকের মধ্যে খিমচে ধরছিল কেউ।
“সব সময় মেয়েদেরই কেন স্যাক্রিফাইস করতে হয় বলতে পারো?” ক্লান্ত স্বরে বলেছিল সে, “আমার দুধ খেতে ইচ্ছে করছে না। নিয়ে যাও।”
সেই যে সেমিনারে গিয়েছিল, তার পর থেকেই আরও খিটখিটে হয়ে আছে মনটা। সর্বগ্রাসী এই মনখারাপ। রাতে ঘুমোতে পারে না। কিচ্ছু ভাল লাগে না দিঘির। গলা ফাটিয়ে অকারণে ঝগড়া করে যিশুর সঙ্গে। দুর্ব্যবহার করে অসুস্থ শাশুড়ির সঙ্গেও। টের পাচ্ছে ওর বুকের ভিতরে জাঁকিয়ে বসেছে রুখু শীতের মতো হিমেল অবসাদ।
‘…মা তুমি ভুল বলেছ। কারও অভাবে কিচ্ছু থেমে থাকে না। সব জায়গা পূরণ হয়ে যায়। উন্মেষ-এও হয়েছে। সেখানে আমার হারিয়ে ফেলা জায়গাটা আর কোনও দিন ফিরে পাব না আমি। গ্রিক পুরাণের সেই অভিশপ্ত চরিত্রটির বার বার পাহাড়ের চুড়োয় পাথর বয়ে নিয়ে যাওয়ার কষ্টকর প্রক্রিয়ার মতো আমাকেও দিনের পর দিন প্রাণহীন সংসার যাপন করতে হবে। কী পেলাম এই জীবনে? ভবিষ্যতে কী-ই বা পাওয়ার আশায় বেঁচে আছি? উফ্!’
হঠাৎ বাসের ঝাঁকুনিতে ঘুম ভেঙে গেল দোয়েলের। ঠোঁট ফুলিয়ে কেঁদে উঠেই আগের মতো কচি হাতে প্রাণপণে আঁকড়ে ধরল সে তার মায়ের হাত। তার পরই ভয়ে ভয়ে তাকাল মায়ের দিকে। মা বকবে না তো? মা যে আর আগের মতো হাসে না। ওকে আদরও করে না। তা হলে কি মা ওর উপর রাগ করেছে? সে কি কোনও অন্যায় করেছে? ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল দোয়েল, “স্যরি মা…”
কোমল স্পর্শে চমকে গেল দিঘি। যেন নতুন চোখে তাকাল আত্মজার দিকে। এ কী করছে সে! গত কয়েক দিনেই যে অনেকটা দূরে সরিয়ে দিয়েছে ও এই নিষ্পাপ শিশুটিকে। কাকে শাস্তি দিচ্ছে? যার কোনও দোষই নেই! দিঘির গাল বেয়ে টপটপ করে ঝরে পড়ল জলবিন্দু। টের পেল ওর বুকের ভিতর দিয়েও জলের স্রোতে একটা পাথর সশব্দে গড়িয়ে গড়িয়ে নীচে নামছে। কেমন যেন হালকা লাগছে ভিতরটা। মুখে বলল, “চল, ফিরে যাই। আজ আর স্কুলে গিয়ে কাজ নেই, কী বলিস?”
অমনি চোখ মুছে সম্মতির হাসি হাসল দোয়েল। বলল, “তা হলে বিকেলে পার্কে নিয়ে যাবে তো?”
“যাব সোনাই!” মেঘমেদুর স্বরে বলল দিঘি, “ওখানে অনেক বাচ্চা আসে, না রে? খেলা হয়ে গেলে সবাইকে আজ অনেক গল্প শোনাব। ছবিও দেখাব, যেখানে নেচারকে ভালবাসার কথা বলা আছে। দুপুরের মধ্যে ক’টা পোস্টার এঁকে ফেলতে পারব না দু’জনে মিলে?”
ঢালু পথ বেয়ে মেয়ের হাত ধরে নামছে দিঘি। সে জানে, আর সকলের মতো ওকেও আবার নীচে গিয়ে পাথরটা বয়ে আনতে হবে। এর হাত থেকে হয়তো কারওই মুক্তি নেই।
তবুও নামতে নামতে দিঘির ঠোঁটের কোণে জেগে ওঠে রাঙা আলোর মতো এক টুকরো হাসি।