সে যেতে চাইবে না, কিন্তু তোমায় তাকে ফেরত পাঠাতে হবে। ভরদুপুরে অফিসে নিজের টেবিলে বসে ফাইলে সই করতে গিয়ে নীহারবাবু দেখলেন, তাঁর নিজের হাতের লেখাটা তাঁর আপ্রাণ চেষ্টা সত্ত্বেও বেঁকে যাচ্ছে। সামান্য একটা সই, তবে তাতে নীহারবাবু নিজের পদবি-সহ পুরো নামটাই লেখেন। নীহাররঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়। সেটা লিখতে গিয়েই নীহারবাবু হঠাৎ খেয়াল করলেন, এক টানে সইটা করতে গিয়ে তাঁর লেখাটা কী করে যেন বেঁকেটেরে যাচ্ছে।
অবশ্য অসুবিধে নেই। ইশকুলে পড়ার দিন বহু বছর হল পিছনে ফেলে এসেছেন নীহারবাবু। সাদা খাতায় রুল টেনে সোজা-সোজা লাইনে লেখার পাট চুকেছে কবেই। আজকাল অফিসের কাজের ৯০ শতাংশও মিটে যায় কম্পিউটারেই। লেখার তেমন দরকার পড়ে কই? তবে কি দীর্ঘ অনভ্যাসের ফলেই এই দশা? লেখার অভ্যেস ছেড়ে যাওয়ার পর থেকে ক্রমশ খারাপ হয়েছে তাঁর হাতের লেখা, ঠিকই। তা বলে লাইনটা দুম করে বেঁকে যাবে? পান থেকে চুন খসলেও খুঁতখুঁত করার মানুষ নীহারবাবু বুঝে গেলেন, এ অশান্তিটা সহজে ছেড়ে যাবে না তাঁকে।
******
অফিস থেকে বাড়ি ফিরে আর এক বিপত্তি। ছেলে নিরুপম চাকরি নিয়ে দেশত্যাগী হওয়ার পর স্ত্রী অনুপমাও যখন নীহারবাবুকে ছেড়ে গেলেন, তার পর থেকে ফ্ল্যাটে একা-একাই রাজত্ব করেন নীহারবাবু। বড় সুন্দর, ছবির মতো হাতের লেখা ছিল অনুপমার। ছেলেকে পড়াতে বসে সাদা খাতায় যখন কিছু লিখতেন, সে হাতের লেখার দিকে এক বার তাকালেই মন ভরে যেত অনাবিল শান্তিতে। সেই হাতের লেখার মতো করেই যেন, যত্ন নিয়ে পটে আঁকা ছবির মতো করে অনুপমা তিলে-তিলে সাজিয়েছিলেন তাঁর আর নীহারবাবুর সতেরো তলার তিন কামরার ফ্ল্যাটবাড়িটাকে। গত বছর ঠিক আজকের দিনেই সেই মেয়ে ভরা সংসার পিছনে ফেলে রেখে পাড়ি দিয়েছিল অন্য এক লোকে। আত্মীয়স্বজন সবাইকে অবাক করে দিয়ে অনুপমা নিজের তেইশ বছরের সংসারজীবনে দাঁড়ি টেনেছিলেন হঠাৎ। সতেরো তলার ফ্ল্যাটের ব্যালকনি থেকে অভিকর্ষের টানে সোজা নীচে এসে পড়ার আগে সানশেডে ধাক্কা খেয়ে মাথার খুলি দু’ভাগ হয়ে গিয়েছিল তাঁর। পুলিশি ময়নাতদন্তের পর অন্তিম সৎকারের জন্য বেশি দিন অপেক্ষা করতে হয়নি, কারণ বাপ-মায়ের জন্য স্বর্গে বাতি দেওয়ার ঐকান্তিক ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও মায়ের শেষকৃত্যে উপস্থিত থাকার জন্য নিরুপম কিছুতেই ছুটি জোগাড় করতে পারেনি।
কিন্তু আজ একটা কিছু গোলমাল হচ্ছে। অফিস থেকে ফিরে কলিং বেলটা বাজানোর দরকার পড়ে না নীহারবাবুর, যেহেতু তালা দেওয়া কোলাপসিবল গেটটা খুলে ভিতরে ঢুকতে হয় তাঁকেই। আজ এমনিতেই দুপুরের পর থেকে মনটা অশান্ত হয়ে ছিল। হয়তো সে জন্যই আরও বাড়ি ঢোকার আগে চোখ পড়ল কলিংবেলটার দিকে, আর অমনি মনটা গেল বিচ্ছিরি বিতৃষ্ণায় ভরে। কী মুশকিল! কলিং বেলের সুইচটা এ ভাবে ফেটে যায় কী করে? খুব ভারী কিছু দিয়ে কেউ জোরে-জোরে ঘা-কতক না লাগালে সুইচের এই দশা হয় না। কিন্তু বাড়ির নিরীহ কলিংবেলের উপর কার এত আক্রোশ? নির্ঘাত তাঁদেরই অ্যাপার্টমেন্টের কোনও খুদে শয়তানের কাজ।
সে যেতে চাইবে না, কিন্তু তোমায় তাকে ফেরত পাঠাতে হবে। নাহ, সোসাইটির পরের মিটিংয়ে প্রসঙ্গটা তোলা দরকার। আপাতত দরজার তালাটালা খুলে ফ্ল্যাটের ভিতরে ঢুকলেন নীহারবাবু। সারা দিন বদ্ধ পড়ে থাকা ফ্ল্যাটে অযত্নের ছাপ স্পষ্ট। চাকরিজীবনে মোটে আর একটি বছর বাকি আছে নীহারবাবুর। স্ত্রীর আকস্মিক মৃত্যুর পর থেকে একা-একা খুব একটা খারাপ নেই তিনি। কথায় বলে, ভাগ্যবানের বউ মরে। নীহারবাবু কি ভাগ্যবান? তাঁর মনে আছে, আজ অনুপমার প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী। ফেরার পথে এক গোছা রজনীগন্ধা নিয়ে বাড়ি ফিরেছেন তাই। হাতমুখ ধুয়ে শোওয়ার ঘরে বেডসাইড টেবিলে রাখা অনুপমার ছবিটার সামনে ফুলগুলো রাখলেন নীহারবাবু। ঘরে ধূপকাঠি আছে কি? বেশি খুঁজতে হল না। ঘরের এক কোণে অযত্নে ধুলো পড়ে ধূসর হতে চলা ঠাকুরের সিংহাসনেই পাওয়া গেল। অনুপমার ছবির সামনে এক সঙ্গে চারটে কাঠি ধরিয়ে দিয়ে বাইরের ডাইনিংয়ে এলেন নীহার। এ বার একটু পানাহারের আয়োজন একা-একাই। সহধর্মিণী বেঁচে থাকতে এটুকুর জন্যও কখনও নিজেকে নড়ে বসতে হয়নি। কিন্তু ওই, চিরকাল কাহারও সমান নাহি যায় না কী যেন? নিষ্ঠুর বাস্তবকে মাথা পেতে মেনে নিয়ে নীহারবাবু নিজেই পেয়ালায় পানীয় ঢালেন। একটা কাচের বাটিতে একটু চানাচুর ঢেলে নিতে হবে এ বার, এই যাহ... ব্যস! তড়াক করে পায়ের রক্ত এক লাফে মাথায় উঠে যায় নীহারবাবুর।
আধো অন্ধকারে রান্নাঘর থেকে বাটিটা বের করতে গিয়ে হাত ফসকে সেটা মুহূর্তে আছড়ে পড়ে মাটিতে। মুহূর্তে খানখান হয়ে সারা ঘরের মেঝেয় ছড়িয়ে পড়ে ভাঙা কাচ। বিরক্তিতে ভরে ওঠে নীহারবাবুর মন। ‘চুলোয় যাক’ ভেবে সাবধানে মেঝেয় বিছানো কাচের শয্যা পেরিয়ে ডাইনিংয়ে ফিরে আসেন তিনি। ঠান্ডা কাচের পেয়ালায় হালকা একটা চুমুক মেরে টিভিটা খুলে বসতে যাবেন, তাঁর চোখ গেল টিভির ঠিক উপরে দেওয়ালে লাগানো ঘড়িটার দিকে। আশ্চর্য তো!
******
এক ঝলক দেখে বোঝার উপায় নেই যে গোল দেওয়ালঘড়িটা আসলে উল্টো করে লাগানো আছে। ডাইনিং টেবিলের উপর খুলে রাখা হাতঘড়িতে সময় রাত ন’টা। অথচ দেওয়ালঘড়িটা উল্টে থাকায় দৃষ্টির ভ্রমে মনে হচ্ছে যেন বেলা সাড়ে তিনটে বাজে। বুকটা আচমকা একটু ছ্যাঁৎ করে উঠল নীহারবাবুর। তিনি এখন বাড়িতে একা মানুষ। সকালে বাড়ির কাজের মেয়েটি রান্না করে, বাসনপত্র মেজে একটু ঝাড়পোঁছও করে দিয়ে যায়। স্নান-খাওয়া সেরে অফিস যাওয়ার সময় নিজের হাতে তিনটে তালা মেরে যান নীহারবাবু কোলাপসিবলে। ফ্ল্যাটের দরজা টেনে বন্ধ করলেই লক হয়ে যায়। তাঁর অনুপস্থিতির সুযোগে ঘরের তালাচাবি খোলা হয়েছে, তেমন কিছুও তো ঘরে ঢোকার সময় মনে হল না। তা হলে ঘরের দেওয়ালে টাঙানো ঘড়ির এই দশা হয় কী করে? তালা যখন খোলা হয়নি... অন্য কোনও উপায়ে ঘরে ঢুকে বসে নেই তো কেউ?
ফের এক বার বুকটা ধক করে ওঠে নীহারবাবুর। পরিমিত আহার আর নিয়মিত হালকা ব্যায়ামের জোরে শরীর-স্বাস্থ্য তাঁর এই উনষাট বছরেও দিব্যি টগবগে। কিন্তু যতই হোক, বছর একুশের তারুণ্যের দাপট তাঁকে ছেড়ে গিয়েছে বহু দিন। একা বাড়িতে এই প্রথম বার সামান্য হলেও ভয় এসে গ্রাস করল তাঁকে। পরক্ষণেই অবশ্য গা ঝাড়া দিয়ে সেই ভয়কে দূরে সরালেন নীহারবাবু। ছেলেমানুষি ভাবনা মাথায় এলেই তো আর হল না! সতেরো তলার উপরের ফ্ল্যাটে দরজা ছাড়া আর কোন দিক দিয়েই বা ঢুকবে কেউ? কথায় বলে, সাবধানের মার নেই। নীহারবাবু এক-এক করে সব ঘরের আলো জ্বেলে দেখলেন। এমনকি বাথরুম দুটোতেও আলো জ্বেলে দেখে এলেন। নিজের আচরণে নিজেরই হাসি পেল তাঁর। হয়তো কাজের মেয়েটাই ঝুলটুল ঝাড়তে গিয়ে ভুল করে ঘড়িটা উল্টো করে দেওয়ালে লাগিয়ে থাকবে। নীহারবাবু বেশ বুঝতে পারলেন, বেশি ভাবতে গিয়েই যত গোলমাল। অতএব ভাবনাকে তাড়াতে হবে। সে যেতে চাইবে না, কিন্তু তোমায় তাকে ফেরত পাঠাতে হবে।
******
দাওয়ায় বসে মাটির উনুনে রুটি সেঁকছে মা আর ছেলেকে পাখিপড়া করে শেখাচ্ছে, ‘‘তোমাকে সাহসী হতে হবে বেটা। শুধু রাগ করতে শিখলে বিটুয়া আমার সাহসী
হবে কবে? দুষ্ট কেউ তোমার ক্ষতি করতে চাইলে তোমাকে শক্ত হতে হবে। মনে থাকবে তো বিটুয়া আমার? সে যেতে চাইবে না, কিন্তু তোমায় তাকে ফেরত পাঠাতে হবে। ঠিক আছে? মনে থাকবে তো বিটুয়া? আমার সঙ্গে বলো, সে যেতে চাইবে না, কিন্তু তোমায় তাকে ফেরত পাঠাতে হবে...’’
পূর্ণিমার রাতে এক চিলতে ঘরের ফাঁকফোকর দিয়ে জোরজবরদস্তি ঢুকে পড়ে চাঁদের আলো ভাসিয়ে দিচ্ছে ঘরখানা। অপরিসর ঘরের মেঝেয় পাতা চাদরের উপর ছেলের গায়ে ধুম জ্বর, কপালে দ্রুত হাতে জলপট্টি দিচ্ছে মা। মুখে তার এক রব, ‘‘এত রাগ করলে হবে বিটুয়া? দুষ্ট কেউ তোমার ক্ষতি করতে চাইলে তোমাকে শক্ত হতে হবে। সে যেতে চাইবে না, কিন্তু তোমায় তাকে ফেরত পাঠাতে হবে বিটুয়া...’’
গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে ঘুমটা ভাঙার পর নীহারবাবু বুঝতে পারলেন এত ক্ষণ তিনি স্বপ্নে নিজের ছেলেবেলাকে দেখতে পাচ্ছিলেন। ছোট থেকেই খুনে রাগ ছিল ছেলের। রাগের মাথায় নিজের অজান্তেই ছোট-বড় সর্বনাশ ঘটিয়ে ছেলে বাড়ি ফিরত যখন, কী করে কে জানে, মা বুঝে ফেলত সব! তার অবর্তমানে ছেলে যেন রাগের বশে গুরুতর কিছু ঘটিয়ে না ফেলে, সেই চিন্তা সর্বক্ষণ কুরে-কুরে খেত মাকে। স্মৃতি এমন অদ্ভুত, তার জাদুতেই মায়ের বলা কথাগুলো এত বছর পরেও চুপটি করে অপেক্ষায় রয়েছে নীহারবাবুর মনের কোণে। কিন্তু না, এর বেশি কিছু ভাবার আগে একটু জল খাওয়া প্রয়োজন। আচ্ছা, তাই তো! কী ব্যাপার, ঘরে এত ধোঁয়া এল কোত্থেকে? ভিতরের ঘরে চারটে ধূপকাঠি এক সঙ্গে জ্বালানোর ফল? কিন্তু তাতে এত ধোঁয়া আর সেই ধোঁয়া এত মিষ্টি? জলের বোতলটাই বা কই? আহ! নীহারবাবু মনে-মনে খুবই বিরক্ত হলেন।
******
পেগের হিসেব গুলিয়ে গেলে নীহারবাবু অনেক দিন সোফায় বসেই বেঘোরে ঘুমিয়ে পড়েন। মাঝরাতে এ ভাবেই ঘুম ভেঙে গেলে কোনও রকমে নিজেকে টেনে নিয়ে যান শোওয়ার ঘরে। কিন্তু আজ জলের বোতলটা সঙ্গে রাখা হয়নি। বিরক্তিটা মনে চেপে রেখে টলোমলো পায়ে বছর উনষাটের নীহারবাবুকে ফের এক বার রান্নাঘরে ঢুকতে হল। ঘরের ভিতর তিনি দু’পা এগোতেই কুচ করে এক টুকরো কাচ ঢোকার শব্দ হল মানুষের শরীরে...
প্রতিবর্ত ক্রিয়ার বশবর্তী হয়ে নীহারবাবু আহত পায়ের পাতাটা মাটি থেকে তুললেন বটে, তবে টাল সামলাতে না পেরে সঙ্গে-সঙ্গেই হুমড়ি খেয়ে উপুড় হয়ে পড়লেন রান্নাঘরের মেঝের উপর। এক সঙ্গে অনেকগুলো ‘কুচ’ আওয়াজ চাপা পড়ে গেল বছর উনষাটের মানুষটার মেঝেয় আছড়ে পড়ার শব্দের নীচে। না না না, এই শব্দের রেশটা নীহারবাবুর জন্য একটুও ভাল নয়। একে অবিলম্বে দূরে ছেড়ে আসতে হবে। সে যেতে চাইবে না, কিন্তু তোমায় তাকে ফেরত পাঠাতে হবে।
******
একটু পরে শরীরের জ্বালাগুলো খানিকটা সয়ে এলে চোখ খোলার চেষ্টা করলেন নীহারবাবু। বাঁ চোখের উপর তখনও কাচের একটা বড় টুকরো আটকে থাকায় একটামাত্র চোখই খোলা গেল। নীহারবাবু বুঝতে পারলেন যে তিনি রান্নাঘরের মেঝেয় উপুড় হয়ে পড়ে আছেন। ডাইনিংয়ের দিকে মুখ করেই পড়েছেন। মাথাটা কোনও রকমে তুলে এক বার ডাইনিংয়ের দিকে তাকাতেই ভীষণ জোরে বুকটা ধড়াস করে উঠল তাঁর! ডাইনিংয়ের যে সোফাটায় এত ক্ষণ তিনি বসেছিলেন, তাতে অনুপমা এল কোত্থেকে? আর ওর মাথায় অত মোটা করে সিঁদুর কেন? না-না, ওটা সিঁদুর তো নয়! রক্তের শুকনো ধারা কি? আর অনুপমা ও ভাবে হাসছে কেন? ডাইনিংয়ের হালকা আলোয় ঘরে-পরা শাড়িতে অনুপমা ও ভাবে হাসছে কেন?
হাসত এর চেয়েও বেশি সে, তার শেষ দিনগুলোয়। অনেক কিছু বুঝেও কিচ্ছু না বোঝার ভান করতেন স্ত্রীর চেয়ে বয়সে অনেকটাই বড় নীহারবাবু। কিন্তু যে দিন কৌতূহলের বশে অনুপমার ফোনের মেসেজ বক্স খুলে এত দিনের সন্দেহটাকে চোখের সামনে অনেকটাই সত্যি হতে দেখলেন, সে দিন সব কেমন যেন গোলমাল হয়ে গেল। কোনটা সত্যি, কোনটা মিথ্যে, নীহারবাবুর গুলিয়ে গেল সব। এক মুহূর্তেই মাথায়
চড়ে গেল খুনে রাগ। অনুপমাকে আত্মপক্ষ পেশ করার ফুরসত দেওয়াও মনে হল অর্থহীন।
মনস্থির করে নিয়ে সেই ছুটির দুপুরে নীহারবাবু বিছানা থেকে নামলেন। বিড়ালপায়ে এগিয়ে গেলেন খোলা ব্যালকনির দিকে। ঘড়িতে তখন সাড়ে তিনটে বাজে। দুপুরের স্নান সেরে বেরিয়ে ভেজা কাপড়গুলো মেলতে অনুপমা ও দিকেই গিয়েছে দু’মিনিট আগে। সে যেতে চাইবে না, কিন্তু তোমায় তাকে ফেরত পাঠাতে হবে। কাপড়ের আড়াল থেকে জোরে একটা ধাক্কা। একটা অস্ফুট আর্ত চিৎকার। ধুপ, দুম। দু’বার আওয়াজ কেন হল জানা নেই, নীহারবাবু ব্যালকনি থেকে ঝুঁকে পড়ে নীচটা দেখে নিশ্চিন্ত হলেন। অনুপমার নিষ্প্রাণ দেহটা ভেসে যাচ্ছে রক্তে। এক্ষুনি সরে যেতে হবে ব্যালকনি থেকে। কেউ তাকে এ সময় এখানে দেখে ফেললে আত্মহত্যার ধাপ্পাটা নেহাত মাঠে মারা যাবে। ইতিমধ্যেই সম্ভবত প্রতিবেশীদের কেউ এসে সমানে বাজিয়ে চলেছেন বাড়ির কলিং বেলটা! না না না, নীহারবাবুকে ঘরে যেতে হবে এক্ষুনি, কুইক!
******
অনুপমার সঙ্গে তাঁদের ছেলের স্কুলের সেই অঙ্কের মাস্টারের সত্যিই কোনও সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল কি না, সে তদন্ত আর নীহারবাবুর করা হয়নি। সেই প্রবৃত্তিও, সত্যি বলতে কী, হয়নি গত এক বছরে। এক বার অনুপমাকে সবটা জিজ্ঞেস করে নিতে বড্ড দেরি করে ফেললেন কি নীহারবাবু? কিন্তু অনুপমা তো কাছেই আছেন। এই মুহূর্তে আলুথালু বেশে তিনি বসে আছেন নীহারবাবুর ঠিক মাথার কাছটায়। মৃত্যু আর জীবনের মাঝে অনুপমার এই অশরীরী অস্তিত্বের গলা দিয়ে ঘড়ঘড় করে একটা শব্দ বেরোচ্ছে। প্রতিহিংসার আগুন ঝলসাচ্ছে দু’চোখে, মুখে লেগে আছে আকর্ণবিস্তৃত পৈশাচিক এক হাসি। রক্তচক্ষু অনুপমা তার লম্বা ফ্যাকাশে আঙুলগুলো দিয়ে হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন নীহারবাবুর মাথায়। খুলির ফাটা দাগটা এত কাছ থেকে বোঝা যাচ্ছে স্পষ্ট! নিজের গলা থেকে বেরোনো ঘড়ঘড় আওয়াজের ফাঁকে অনুপমা কিছু বলতে চাইছেন হয়তো, কিন্তু তা বোধগম্য হচ্ছে না একটুও। প্রতিশোধস্পৃহায় পাগলিনী এই অনুপমা কী বলতে চান নীহারবাবুকে?
ঠান্ডা মেঝেটা ক্রমশ অবশ করে দিতে থাকে নীহারবাবুর সমস্ত চেতনা। আজ এতগুলো দিন পরে এই অসহায় অবস্থায় ক্রমশ তলিয়ে যেতে যেতে তাঁর মনে হতে থাকে, সে দিন সত্যিই এমন কিছুও ছিল কি অনুপমার মেসেজ বক্সের গোপন অন্তরালে? ছেলের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত মায়ের সঙ্গে ছেলের স্কুলবেলার মাস্টারের কথাবার্তাই তো ছিল কেবল! অনুপমার দুশ্চিন্তা দূর করতে চেয়ে তৃতীয় সেই
ব্যক্তি আশ্বাস দিয়েছিল ঠিকই, কিন্তু তাতে অস্বাভাবিকতা ছিল কি কিছু? যুক্তি বুদ্ধি হারিয়ে আতঙ্কে নীল হতে-হতে নীহারবাবু খেয়াল করেন, তাঁর গলা শুকিয়ে গিয়েছে খুব। তাঁকে এখান থেকে বেরোতে হবে। না না না, ভুলে গেলে চলবে না, সে যেতে চাইবে না, কিন্তু তোমায় তাকে ফেরত পাঠাতে হবে! অনুপমাকে ফেরত পাঠাতে হবে!
শরীরের সর্বশক্তি এক করে নীহারবাবু অনুপমার প্রেতাত্মার উদ্দেশে কিছু বলবেন, তার আগেই ঝুপ করে সারা ফ্ল্যাটের সব আলো নিভে গেল। কয়েক মুহূর্তের দমবন্ধ করা একটা নিস্তব্ধতা। তার পর রক্ত জল-করা কর্কশ একটা হাসিতে খানখান হয়ে গেল নীহার-অনুপমার সতেরো তলার তিন কামরার ফ্ল্যাটটা...