বকুলতলার স্থানীয় ভাষায় পলিথিন বা প্লাস্টিকের প্যাকেটকে বলে ‘চিকচিকা’। সুদাম ঝোলা থেকে বার করেছে শসা, পেঁয়াজ আর ছুরি। নিপুণ হাতে শসা আর পেঁয়াজ কেটে চিকচিকায় ঢেলে দিল। তৈরি হয়ে গেল সুস্বাদু মুড়িমাখা।
খাওয়া শেষে ঢকঢক করে অনেকটা জল খেয়ে বিহান বলল, “টিকিয়াপাড়া পেরিয়ে গেলাম। সামনেই হাওড়া স্টেশন। এ দিকে কোনও গন্ডগোল দেখছি না।”
“জয়গুরু!” চোখ বন্ধ করে কপালে হাত ঠেকাল সুদাম। ঠিক তখনই ট্রেন দাঁড়িয়ে গেল।
“কী হল?” চোখ খুলে জিজ্ঞেস করল সুদাম।
কিশোর আসন থেকে উঠে ট্রেনের দরজা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে সামনে তাকিয়ে বললেন, “কয়েক জন লোক রেল লাইন অবরোধ করছে।”
“এইখানে অবরোধ?” বিহান মেঝে থেকে উঠে দরজা দিয়ে মুখ বাড়াল। তারা রয়েছে ট্রেনের প্রথম কামরায়। সেই কারণেই পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে সামনে কী হচ্ছে। তাদের ট্রেন যে লাইনের ওপর দিয়ে যাবে, সেই লাইনেই শোওয়ানো হচ্ছে প্যান্টশার্ট পরা বছর তিরিশের একটি ছেলের মৃতদেহ। ছেলেটির জামাপ্যান্ট পুড়ে গেছে। শরীরময় পুড়ে যাওয়ার লালচে দাগ। শরীরের নানা জায়গা থেকে রক্ত বেরিয়ে জমাট বেঁধে আছে। ছেলেটি রেল লাইনের উপরে মারা যায়নি। তার লাশ এখানে আনা হয়েছে ট্রেন অবরোধ করার জন্য। লাশের পাশে বসে বেঁটেখাটো একটা মেয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে।
অবরোধ করছে খরাজ পার্টির ক্যাডাররা। এক জন মৃতদেহের হাতে পার্টির ঝান্ডা গুঁজে দিচ্ছে। এক জন মোবাইলে টিভি নিউজ় চ্যানেলের স্থানীয় সংবাদদাতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করছে। এক জন স্মার্টফোনে ভিডিয়ো তুলছে। চার-পাঁচ জন স্লোগান দিচ্ছে, “খরাজ পার্টি জিন্দাবাদ। গণতান্ত্রিক মোর্চা মুর্দাবাদ।”
সুবীর চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “কী করে হল দাদা?”
ভিডিয়ো তোলা কর্মী বলল, “গণতান্ত্রিক মোর্চার কুত্তাগুলো আমাদের দলের সদস্যদের তাক করে বোম মেরেছে। বিধান স্পট ডেড। বাকিদের বঙ্গবাসী হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।”
সুবীর বললেন, “মেরে শালাদের পাট করে দিন। আজ যেন ওদের এক জন মেম্বারও বেঁচে বাড়ি না ফেরে।”
ট্রেনের কামরা থেকে কয়েক জন নিচু গলায় বললেন, “আহ! সুবীর! তুমি আবার পাগলদের সাঁকো নাড়া দিচ্ছ কেন?”
সুবীরের কথা শুনে কিশোরের মুখ গম্ভীর। তিনি চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “বোমাবাজিটা কোথায় হল?”
সদ্য বিধবা মেয়েটি কাঁদতে কাঁদতে উত্তর দিল, “হাওড়া কোর্টের সামনে।”
কিশোর নিচু গলায় বললেন, “সুবীর! খরাজ পার্টির অবস্থা দেখো। অন্য জায়গা থেকে লাশ এনে ট্রেন অবরোধ করছে। আমার সন্দেহ হচ্ছে, ছেলেটা খরাজ পার্টির সদস্যই নয়। বোমাবাজিতে মরেছে আর তোমার দল ‘ক্যাডার’ বলে দেগে দিচ্ছে। একটা শহিদ পাওয়া গেলে খেলাটা ভাল জমে!”
গলা খাদে নামিয়ে সুবীর বললেন, “মানুষ খুন করে অন্যের ঘাড়ে দোষ চাপাচ্ছেন? জনগণ এই অন্যায় মেনে নেবে?”
ট্রেনের বাকি যাত্রীরা কিশোর আর সুবীরকে টেনে সিটে বসিয়ে দিল। বিহান দরজা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে বলল, “বিধানবাবু মারা গেছেন হাওড়া কোর্টের সামনে। আপনারা রেল লাইনে অবরোধ করছেন কেন? সব ট্রেন আটকে যাবে তো!”
“ট্রেন আটকানোর জন্যই তো অবরোধ করা হচ্ছে! মানুষের প্রাণের কোনও দাম নেই না কি?” হুঙ্কার দিল এক কর্মী। বিহান দেখল, টুকটুক করে রেলের পুলিশরা আসতে আরম্ভ করেছে। ক্যামেরা কাঁধে দৌড়ে আসছে মিডিয়ার ছেলেরা। রেল লাইনের পাশের বস্তি থেকে চলে এসেছে চ্যাংড়া ছেলের দল। পরনে জিন্স আর রংচঙে টি-শার্ট। চুলে বিচিত্র রং করা। এক কানে দুল। মুখে গুটখা বা খৈনি। এই জায়গাটা এখন ঘুমন্ত আগ্নেয়গিরির মতো। লাভা তো বেরোবেই। কখন হবে সেটা কেউ জানে না।
ট্রেনের কামরা থেকে অনেক যাত্রী লাফিয়ে নামছে। বড় বড় খোয়ার উপর দিয়ে হেঁটে চলে যাচ্ছে হাওড়া স্টেশনের দিকে। স্টেশন সিকি কিলোমিটারের মধ্যে। ট্রেন চলাচল শুরু হওয়ার জন্য অপেক্ষা না করে হেঁটে যাওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ। সুদাম আপনমনে বলল, “আপ আর ডাউনে অনেক ট্রেন দাঁড়িয়ে গেছে। তার মধ্যে মেল ট্রেনও আছে। পুলিশ এ বার লাঠিচার্জ শুরু করবে।”
“এক বার ওদের রিকোয়েস্ট করে দেখি। যদি ছেড়ে দেয়!” বলল বিহান। দরজা থেকে অনেকটা শরীর বার করে চেঁচাল, “দাদারা! আমার বৌয়ের খুব শরীর খারাপ। বঙ্গবাসী হাসপাতালে ভর্তি আছে। আপনারা প্লিজ় এই ট্রেনটা ছেড়ে দিন।”
“কে বে?” জিজ্ঞেস করল এক পার্টি কর্মী। চ্যাংড়া ছেলেগুলো লাইন থেকে পাথর তুলতে শুরু করেছে। সদ্য বিধবা মেয়েটা লাশের পাশ থেকে লাফিয়ে উঠে একটা খোয়া তুলে নিয়ে ট্রেনের দিকে ছুড়ে গলা ফাটিয়ে বলল, “আমি আমার মরা বরকে নিয়ে এখানেই বসে থাকব। যা পারিস করে নে।”
খোয়াটা ট্রেনের বডিতে লেগে ‘টং’ করে শব্দ হল। সুদাম পিছন থেকে বিহানকে চেপে ধরে ট্রেনের কামরার মধ্যে ঢুকিয়ে নিয়েছে। সুবীর বললেন, “এই ভাই! তুমি চুপ করো তো!” কিশোর বললেন, ‘‘তোমার জন্যে আমরা সবাই এখানে মুশকিলে পড়ব।”
মেয়েটির কথা শেষ হওয়া মাত্র শুরু হয়ে গেল পাথর আর খোয়া বৃষ্টি। রেলবস্তির ছেলেগুলো ট্রেন তাক করে ছুড়ছে। ট্রেনের কামরায় এসে পড়ছে একের পর এক। পুরো কামরা থরথর করে কাঁপছে। পাথর লাগার ঢংঢং শব্দ শুনে মনে হচ্ছে জেলখানায় পাগলা ঘণ্টি বাজছে। কিশোর আর সুবীর মিলে কামরার জানলা বন্ধ করে দিচ্ছেন। যাত্রীরা ট্রেনের কামরা থেকে লাফ মারছে। বয়স্ক মানুষরা হুমড়ি খেয়ে পড়ে যাচ্ছে। কোনও রকমে উঠে খোঁড়াতে খোঁড়াতে পালাচ্ছে। যে ক’জন মহিলা ছিল, তারাও লাফ মেরেছে। কিশোর আর সুবীর একসঙ্গে বিহানকে বললেন, “তোমার জন্য এই ঝামেলায় পড়লাম।” তার পরে ট্রেন থেকে লাফ মারলেন।
সেই দেখে সুদাম বিহানের কানের কাছে মুখ এনে চিৎকার করল, “ট্রেন থেকে নামো। জলদি।”
সুদাম আর বিহান একসঙ্গে কামরা থেকে লাফ দিল। সামনে থেকে সদ্য বিধবা মেয়েটি চিৎকার করল। “ওই যে! ওই ছেলেটা! ছাড়িস না শালাকে!”
বিহান আর সুদামের দিকে ধেয়ে আসছে ইট, পাথর আর খোয়ার বৃষ্টি। তারই মধ্যে রেলের পুলিশ লাঠিচার্জ শুরু করল। পুলিশরা সংখ্যায় নেহাতই কম। রেলবস্তির ছেলেগুলো আর খরাজ পার্টির ক্যাডাররা পতাকার ডান্ডা দিয়ে তাদের সঙ্গে লাঠালাঠি করছে। তারই মধ্যে এক ছোকরা বিহানের দিকে একটা পাথর ছুড়ে চিৎকার করে বলল, “ইয়ে লে শালা!”
পাথরটা লাগল বিহানের ডান রগে। মুহূর্তের জন্য বিহানের মনে হল গরম একটা শিক তার রগ দিয়ে ঢুকে মাথার ঘিলু নেড়ে দিল। তার চোখে অন্ধকার নেমে আসছে। যন্ত্রণায় পা থরথর করে কাঁপছে। দু’হাত দিয়ে রগ চেপে ধরে সে লাইনে বসে পড়ল। তার আর নড়ার ক্ষমতা নেই। সেই অবস্থায় সুদাম তার হাত ধরে টেনে তুলে বলল, “স্টেশনে গিয়ে বসবে। এখন দৌড়োও।” বিহানের এখন একটাই মুখ চোখের সামনে, তা হল দরিয়া। ওদের প্রথম সন্তানের জন্মের সময় বিহান দরিয়ার পাশে থাকতে না পারলে সে অভিমান করবে। মুখে না বললেও, মনের মধ্যে সেই অভিমান চেপে রাখবে দরিয়া। বিহান সেটা জানে।
বিহানের মনে পড়ল, দরিয়ার সঙ্গে ওর প্রথম মান-অভিমান হয় ‘ডিডিএলজে’ দেখা নিয়ে। সিনেমাটা অনেক দিন আগে রিলিজ় করেছিল। বিহান যখন ফার্স্ট ইয়ারে পড়ে, তখন আবার মুক্তি পেয়েছিল রিভারসাইড শপিং মলের মাল্টিপ্লেক্সে।
দরিয়ার কলেজে অ্যাটেন্ডেন্সের ব্যাপারে খুব কড়াকড়ি। প্রক্সি দিতে গিয়ে ধরা পড়লে প্রিন্সি ম্যাডাম ডেকে পাঠান। বাড়িতে খবর দেওয়ার হুমকি দেন। মণিদীপা মাসখানেক আগে ধরা পড়েছিল। গার্জেন কল হয়েছিল। মণিদীপা তার ক্লাস ফাইভ পাস মা আর ক্লাস টেন ফেল বাবাকে প্রিন্সির সামনে দাঁড় করিতে দিয়েছিল।
মণিদীপাদের পারিবারিক হোটেল ব্যবসা। ওর বাবা দেখেন দার্জিলিংয়ের হোটেল, জ্যাঠা দেখেন মন্দারমণির হোটেল। কাকারা সামলান দিঘা আর পুরির হোটেল। দার্জিলিং থেকে ফিরতে হয়েছে বলে মণিদীপার বাবা বেজায় বিরক্ত। তিনি প্রিন্সি ম্যাডামকে বলেছিলেন, “আমাদের ডাকার ‘পয়োজন’ নেই। কলেজে গন্ডগোল পাকালে কানের নীচে দেবেন এক টিক। শুধু দেখবেন যেন মরে না যায়!”
সেই ঘটনার পরে মণিদীপার গার্জেন কল বন্ধ হলেও বাকিদের ক্ষেত্রে বহাল আছে।
কিন্তু ‘ডিডিএলজে’ না দেখলেই নয়। টিভিতে বারকয়েক দেখেছে দরিয়া, মন ভরেনি। সরষেখেতের মধ্যে দিয়ে ট্রেন ছুটে যাচ্ছে। ব্যাকগ্রাউন্ডে গান হচ্ছে, ‘ঘর আ জা পরদেশি তেরে দেশ বুলায়ে রে’। শাহরুখ দু’হাত বাড়িয়ে ট্রেডমার্ক রমণীমোহন হাসিটা দিচ্ছে। উফ! পারা যায় না। দৃশ্যটা টিভিতে যত বার দেখে দরিয়া, তত বার উত্তেজিত হয়ে রিমোট আঁকড়ে ধরে। সাম্যব্রত বিরক্ত হয়ে বলেন, “ট্রেনের দৃশ্য দেখতে হলে ‘পথের পাঁচালি’ দেখ। অপু আর দুর্গা, কাশের ঝাড় আর ট্রেনের চলে যাওয়া। ওই জিনিস আর হবে না।” দরিয়া চুপ করে থাকে। সাম্যব্রতর মুখের উপরে কথা বলে না। কিন্তু সাদা-কালো আর্ট ফিল্মের প্রতি তার কোনও ভক্তি নেই।
বড়পর্দায় ‘ডিডিএলজে’ দেখার জন্য কলেজ কাটার রিস্কটা দরিয়া নিয়েই ফেলেছে। গতকাল বিহানের সঙ্গে কথাও হয়ে গিয়েছে। বিহান তো কলেজের কোনও ক্লাসই করে না। দিনরাত সনতের পিছন পিছন ঘোরে আর রাজনীতি করে। তবে সিনেমা দেখার ব্যাপারে এক পায়ে খাড়া। দু’জনে মিলে প্ল্যান করে ফেলেছে। ঠিক হয়েছে, দরিয়া আগে রিভারসাইড মলে এসে সিনেমার টিকিট কেটে রাখবে। ‘ডিডিএলজে’ দেখার পরে দু’জনে পিৎজা খাবে। উইন্ডো শপিং করবে। সবচেয়ে বড় কথা, দরিয়া আজ পর্যন্ত কোনও শপিং মলে ঢোকেনি। মাল্টিপ্লেক্সে সিনেমাও দেখেনি। বন্ধুদের কাছে প্রেস্টিজ পাংচার! আজ থেকে সে আর ‘মল ভার্জিন’ থাকবে না।
ডিসেম্বর মাসের মাঝামাঝি। জমিয়ে শীত পড়েছে। সীমার গায়ে শাল উঠেছে। সাম্যব্রতর গায়ে নস্যি রঙের চাদর। দরিয়াও নিয়মিত চাদর গায়ে দিয়ে কলেজে যাচ্ছে।
আজ বিশেষ দিন। দরিয়া সামান্য সাজগোজ করেছে। তার স্টকে একটাই জিন্স ছিল। সেইটা পরেছে। সঙ্গে সবেধন নীলমণি পোলো নেক সোয়েটার। পায়ে স্নিকার্স। চুলে টপ নট। বাড়ি থেকে বেরোনোর সময়ে সীমা জিজ্ঞেস করলেন, “কোথাও যাবি না কি? সেজেছিস কেন?”
“সেজেছি? আমি?” দরিয়া আকাশ থেকে পড়ল, “জিন্সটা পড়ে পড়ে নষ্ট হচ্ছিল। তাই আজ পরে নিলাম। আর এই কনকনে শীতে সোয়েটার না পরলে কবে পরব? বাবাকে বলে দিও এই রকম সোয়েটার আর না কিনতে। এগুলো পরার মতো শীত এ দিকে পড়ে না।”
“এত কথা বলছিস কেন?” বিরক্তি নিয়ে চোঁয়া ঢেকুর তুললেন সীমা। “ফেরার সময়ে অ্যান্টাসিড নিয়ে আসিস তো! বড্ড অম্বল হচ্ছে।”
দরিয়ার বয়েই গিয়েছে মায়ের জন্য ওষুধ কিনতে। সে অনেক বার সীমাকে বলেছে, “এগুলো মানসিক রোগ। তোমার ডাক্তার দেখানো উচিত।” সীমা রেগে বলেছেন, “আমাকে পাগল প্রমাণ করলে তোদের কী সুবিধে হয়? আমি তো তোদের কোনও কাজেই আপত্তি করি না।”