ওরে দু’দিন এলেম এই যে ভবে, দু’দিন পরেই যেতে হবে।/ তোর সকল সাধের জমিবাড়ি, সময় হলে যাবি ছাড়ি॥
মেঘের কোলে লুকোলে রোদ, ভাবিস নে মনপ্রাণ।/ ওরে দে সঁপে সব, মাথার উপর আছে ভগবান…”
তেমাথার ঝাঁকড়া বটগাছটার নীচে বাঁশের খুঁটি পোঁতা হয়েছে। খেজুর, নারকেল, তালগাছের পাতা ফেলে তৈরি হয়েছে ছাউনি। সিমেন্টের বস্তা, ছেঁড়া পলিথিন সেলাই করে পেতে দেওয়া হয়েছে বাঁশের মঞ্চের ওপর। ঝুলে থাকা বাল্বগুলোর গায়ে রংবেরঙের প্লাস্টিক বাঁধা… হেব্বি রঙের ঝলকানি। রংচঙে মঞ্চের ওপর হাত-পা নাড়িয়ে সুর তুলে গান গেয়ে চলেছে মানুষটা। ‘গাজন প্রিয়া’! তামাটে, সুঠাম শরীরে কুঁচি দিয়ে পরা লালপাড় সাদা শাড়ি। পিঠ জুড়ে কোঁকড়ানো, চকচকে কালো চুলের ঢল। মুখে ধবধবে পাউডার। ইয়াব্বড় লাল টিপ। চোখে মোটা করে কাজল টানা, টকটকে লালরঙা ঠোঁট। গেল বারের মনসাদাঁড়ির মেলায় গিয়ে কেনা সস্তার চুড়ি, হার। গলার ফাঁক দিয়ে উঁকি মারছে সাদা উত্তরীয়। পাশে রুদ্রাক্ষর মালা পরে, ত্রিশূল হাতে শিবঠাকুরের বেশে নাইয়াপাড়ার হারাধনদা। হারমোনিয়াম, খোল, তবলার সঙ্গতে আকাশ-বাতাসে কান পাতা দায়…
জানলার পাশে দাঁড়িয়ে আঁচলের খুঁট দিয়ে চোখের কোণ মুছল পুতুল। চত্তিরের রোদ্দুর এর মধ্যেই ঢলে পড়েছে উঠোনে, ঘরের কোণে ঘুলি ঘুলি অন্ধকার। নেহাত চারবছুরে ছেলেটার শুকনো মুখের দিকে তাকিয়ে বুকটা ঢিপ করে উঠেছিল তাই, নইলে গতকাল রাতেই ঘাসমারা বিষের বোতলটা গলায় ঢেলে সব জ্বালার শেষ করে দিতে চেয়েছিল পুতুল। মানুষটা বড় একলষেঁড়ে হলেও কিন্তু এমনটি ছিল না! দেশের ভিটেয় সুখ না থাকলেও সোয়াস্তি ছিল। চাষের মরসুমে ভোর থাকতেই উঠে পরের জমিতে ধান রুইতে চলে যেত সুবল। কখনও ঘর ছাওনার কাজে লাগত। পুতুলও পাড়ার বৌ-ঝিদের সঙ্গে ধান কাটত, পালা দিত। টকমিষ্টি পাকা পিয়াল কোঁচড়ে ভরে সোঁদাল, সোনাঝুরির জঙ্গল পেরিয়ে, সবুজ ঘেমাঘাসের খেত পেরিয়ে, কচি শেওড়ার ডাল জোগাড় করে আনত। পোষা ছাগলটা খেত সেগুলো। বৈশাখের তেরো হলেই ঘরের খোড়ো চালে গুঁজে রাখত শেওড়ার ডাল। তাতে নাকি ঘরে বাজ পড়ে না। সকাল থেকেই রাঙামাটির ধুলো-ওড়া মেঠোপথে ঘুরে ঘুরে তালগাছের শুকনো খোঙা, কাঠকুটো জড়ো করত। দেখতে দেখতে দুপুরের রোদ্দুরটা উনুনের গনগনে আগুনের মতো চড়া হয়ে উঠত। আর কিছু না থাক, ঘরে মোটা চাল মজুত থাকত। পুকুরধারে বিছিয়ে থাকত শাকপাতা। পুকুরপাঁক ঘেঁটে ঠিলিতে পুরত গেঁড়িগুগলি, শামুক। সে সব রঙিন দিন এখানে আসার সময় দেশের মাটিতেই পুঁতে দিয়ে এসেছে পুতুল। ছোট ননদের বিয়ের সময় ভিটেটুকু বাঁধা পড়েছিল, ছাড়ানো যায়নি।
এ দিকে থাকত সুবলের এক মামা, তাঁর সঙ্গেই বছর কয়েক আগে দক্ষিণে, এই তল্লাটে এসে হাজির হয়েছিল দু’জনে। পুতুল তখন দু’মাসের পোয়াতি। মামার জমিজিরেত কিছু ছিল, চাষাবাদ হত। এখন সে মামাও নেই, জমিও নেই। ভাটায় কাজ শুরু করেছিল সুবল। বেশ কয়েক মাস যাবৎ ভাটার কাজ বন্ধ। দুগ্গাদির ঘরে বসে এখন শাড়িতে জরি-চুমকি বসানোর কাজ করে পুতুল। সে টাকাতেও হাত বসাতে শুরু করেছিল সুবল। যখন তখন অকারণে গায়ে হাত তোলা, চুলুট-মালুট ঝগড়া, চোলাইয়ে বুঁদ হয়ে থাকা। অন্য দিকে দলুইপাড়ার বৌটার সঙ্গে ফষ্টিনষ্টি, ঘরভাঙানি মন্তরতন্তর… তাতেই সর্বনাশ হয়ে গেল পুতুলের! অসহায় ছেলে-বৌকে অথৈ জলে ফেলে চলে যাওয়ার আগে এক বারও ভাবল না মানুষটা? এখন কী করবে ও? কোথায় যাবে? এক পাগল-করা ভয়, অজানা আশঙ্কা পাতকুয়োর আঁধারের মতো ওকে হাঁ করে গিলতে আসে। এট্টুসখানি ছেলেটাকে বুকে জড়িয়ে ধরে কেমন কেঁপে কেঁপে ওঠে পুতুল।
তেমাথা থেকে কালীপটকা ফাটার মতো হাততালির আওয়াজ আসছে। গাঁয়ের আশপাশে প্রায় সব গাঁয়েই অনেকগুলো করে গাজন দল আছে। চত্তির মাসের শেষ দিকে এই গাজন নিয়েই হইহই-রইরই বেধে যায়। প্রতি বছর এই সময় সন্ন্যাস নিত সুবল। পাঁচ দিনের মানত। বড়কাছারির পুরুতঠাকুর গলায় নতুন সুতোর ধবধবে সাদা উত্তরীয় বেঁধে দিত। সারা দিন না খেয়ে, সাদা থান পরে, গায়ে গামছা জড়িয়ে মাটির মালসা নিয়ে চাল-ডাল জোগাড় করত মানুষটা। সন্ধেবেলা শিবথানে বাতি দিয়ে কিছু ফলমূল খেয়ে রাতে সেই চাল-ডাল ফুটিয়ে নিত। এই সন্ন্যাসী-উপোসের সময়েও চলত পালার রিহাস্সাল, গাজন গান। এ গানে অবশ্য মেয়েদের বালাই নেই। ছেলেরাই মেয়ে সেজে গান করে। সুবল যেমন ছিল এ পাড়ার ‘গাজন প্রিয়া’! ওদের মেঠো ঘরের এক কোণে ডাঁই করা থাকত মেয়েদের সাজ, কালো চুল, এলো শাড়ির ঢিবি। মুখোশ। চত্তিরের এই ‘চৈতেগাবে’র সময়টা আগে চার পাশে সবাই সঙ সেজে ঘুরে বেড়াত। শিব, দুগ্গা, গণেশ। এখন এখানে চলে শিবগান, কৃষ্ণগান। পাশের গাঁয়ে সংক্রান্তির আগে গাজন দলগুলির মধ্যে প্রতিযোগিতাও চলে। পুতুলের মামাশ্বশুরের এ সবের বড় শখ ছিল। তাঁর কথাতেই সুবলের গাজন দলে নাম লেখানো। ওদের দেশবাড়িতেও গাজনের সময় দাঁড় বোলানের আসরে গান গাইত সুবল। সেই গান শুনেই তো তখন কচি পুতুলের বুকের মধ্যে কুলকুল বর্ষার বাঁওড়ের ঢেউ! তখন চনমনে যুবক সুবলের সুছাঁদ শরীর যেন ডোকরার ছাঁচ ঢালাইয়ে উঠে আসা মূর্তি। গলায় সুর ছিল। আর ছিল ছন্দের বোধ। চটজলদি গান তোলার অসাধারণ ক্ষমতা ছিল মানুষটার। মুগ্ধ হয়ে তার গান শুনতে শুনতে ঘোর লেগে যেত পুতুলের।
এক-এক দিন চত্তিরের ঠা-ঠা দুপুরে বুড়ো অশ্বত্থের তলায়, শিব-পার্বতীর মন্দিরের সাদা পাথরের চাতালে বসে বুড়ো পুরুতমশাই গাজনের গল্প বলেন। গল্প শুনতে শুনতে কোথায় যেন হারিয়ে যায় পুতুল। নিজের জীবনের রঙিন মুহূর্তগুলো টিভি সিরিয়ালের মতো চোখের সামনে ভেসে উঠতে থাকে। কাকা-জেঠাদের ঘরে আধপেটা খেয়ে বড় হওয়া বাপ-মা মরা মেয়েটার মাঝে কী দেখেছিল কে জানে মানুষটা! অবশ্য দেখতে-শুনতে মন্দ ছিল না পুতুলও। ঢলো ঢলো মুখ, পটল ফালি চোখ। শাওন মেঘের মতো ঘন চুলের রাশি। সেই মানুষটা আজ ওকে ফেলে ঘর বেঁধেছে গিয়ে বাসু দলুইয়ের বৌটার সঙ্গে। কানাঘুষোয় শুনেছে, আরও দক্ষিণে বিলাসচক গাঁয়ের ও দিকে নাকি গিয়ে উঠেছে ওরা। রাগে-ঘেন্নায় পুতুলের গাটা রি-রি করে ওঠে। অসহ্য জ্বলুনিতে শরীর কুঁকড়ে কুঁকড়ে ওঠে ওর! পাশের ডোবাটায় আসা শামুকখোলের মাংসের লোভে অনেক সময় পাড়ার ছেলেপুলেরা ছোট ছোট পুঁটি মাছের কানকোর মধ্যে বিষ ভরে দেয়। সে মাছ খেয়ে পাখিগুলো ডানা মেলতে না মেলতেই ধুপধাপ পড়ে যায়! ইশ, ও-ও যদি ও রকম একটা বিষভরা পুঁটিমাছ হয়ে উঠতে পারত…!
মাঝে মাঝে ঘরে ফিরতে সন্ধে হয়ে গেলে, রোগা পিংলে একটা লোককে মন্দিরে আসতে দেখত পুতুল। পুরুতমশাইয়ের ছেলের বৌ, লক্ষ্মীবৌদি ওকে বলল, ওই হল সেই হতভাগা বাসু দলুই! তার পর থেকে লোকটাকে দেখলেই বুকে দাউদাউ আগুন জ্বলে ওঠে ওর। কেমন পুরুষমানুষ রে তুই, ঘরের বৌকে আগলে রাখতে পারিস নে? নিজের বৌ পালিয়ে যায় পরপুরুষের সঙ্গে!
যে লোকটা আগে সারা দিন ভ্যান চালিয়ে ফিরে সন্ধেবেলা মন্দিরে এসে বসত, এখন সে প্রায় সারা দিনই মন্দিরের গাছতলায় পড়ে থাকে। মাঝে মাঝে এখন ঘোমটার আড়াল থেকে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখে পুতুল, লোকটা কেমন যেন একটু আপনভোলা গোছের। আলুথালু চেহারা। মুখভর্তি কাঁচাপাকা খোঁচা খোঁচা দাড়ি। বাপ-মা কেউ নেই তার… লক্ষ্মীবৌদির কাছে শুনেছে পুতুল, শিবভক্ত মানুষটার কোনও নেশাটেশাও নেই। মন্দিরের ও ধারে দলুইপাড়ায় একখানি টালির ঘর। বৌ পালিয়ে যাওয়ার পর থেকে আর ঘরের টানটাও নেই। লক্ষ্মীবৌদি ফিসফিস করে, “পুরুষমানুষকে এমনতরো ভেঙে পড়তে দেকিনি বাপু। বউয়ের সনে তো তেমন মাখো মাখো পিরিত ছিলনি কোনও কালে, পেরাই তো ঝগড়াঝাঁটি হত। বউটার এরম পেইলে যাওয়াটাই বোধকরি ও মানতে পারতেছে নে। বেশি বয়সের বিয়ে। বছরতিন আগে বাপটা জ্বরে ভুগে মরার পর হঠাৎ এক দিন মা-টা… আর এ বার বৌটাও গেল। বাচ্চাকাচ্চাও তো কিছু হলনি। আসলে মানুষের কখন কোথায় যে আঘাত লাগে কে জানে। সহ্যি করার খেমতাও তো সবার এক হয় নে…”
আজকাল একটা জিনিস দেখে অবাক হয় পুতুল। মন্দিরে পুজোর ফাঁকে খোকা একা একাই খেলে বেড়াত গাছতলায়। এখন দেখে গাছতলায় গা এলিয়ে শুয়ে-থাকা বাসু দলুইয়ের সঙ্গে বেশ খাতির হয়েছে ছেলের! খোকার পরিচয়টা কি বাসু দলুই জানে? ভেবে থই পায় না পুতুল। চাপা রাগে খোকাকে লোকটার আশপাশে দেখতে পেলেই তাকে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে ঘরের দিকে হাঁটা দেয় ও! সে দিন হঠাৎ… কী কাণ্ড! খোকার বুকফাটা কান্নার আওয়াজ শুনে ছুট্টে বাইরে এসে দেখে, একা একা খেলতে খেলতে শানবাঁধানো চাতাল থেকে কখন যেন নীচে পড়ে গেছে ছেলেটা। কপাল ফেটে রক্ত বেরোচ্ছে। কী করবে, কোথায় যাবে যখন ভেবে পাচ্ছে না দিশাহারা পুতুল, কোত্থেকে বাসু দলুই তার লজ্ঝড়ে ভ্যানটা নিয়ে এসে হাজির। তার পর সেই ঠনঠনে ভ্যানই সে দিন তাকে পঞ্চায়েতের শম্ভুডাক্তারের কাছে পৌঁছে দিয়েছিল। ডাক্তারের কাছে দৌড়াদৌড়ি, ওষুধপত্তর, সব লোকটাই করেছিল সে দিন। কপালে পট্টি বাঁধিয়ে ছেলেকে নিয়ে যখন ঘরে ফিরেছিল পুতুল, তত ক্ষণে চাঁদিফাটা বোশেখের বিকেল গড়িয়ে গিয়েছে।
গত কয়েকদিন ধরেই খেয়াল করছে পুতুল, বাসু দলুইয়ের ওপর থেকে কষাটে রাগটা ওর কেমন থিতিয়ে এসেছে। তার বদলে জমাট বেঁধেছে কেমন এক মায়া। লোকটাকে দেখলেই এখন বুকের মধ্যে রিনরিন করে ওঠে অজানা ব্যথার সুর। সুবল চলে যাওয়ার পর থেকে এক-একটা সময় নিজেকে বড় অসহায় মনে হত ওর! এ দিকে তিন মাসের ঘরভাড়া বাকি, বাড়িওলা এসে বেশ কয়েক বার তড়পে গেছে। এই তো ইটের দাঁত বার করা ভাঙা টালির একখানি মাথা গোঁজার ঠাঁই, কিন্তু এটুকুও চলে গেলে! তবু আজকাল কেন জানি না ওর মনে হয়, ওর তো তাও অন্ধকারে জড়িয়ে ধরার মতো খোকা আছে, লোকটার তো তাও নেই! মানুষের অবুঝ মন সত্যি বড় অদ্ভুত, বড় অনিশ্চিত। সেখানে কোনও কিছুই বোধহয় চিরকাল থিতু হয় না… রাগ, দুঃখ, ভালবাসা… কিছুই না! একটা সময় এই লোকটাকে দেখলেই গা চিড়বিড়িয়ে উঠত পুতুলের, এখন সেই মানুষটাই যখন জিলিপি-ফুলুরির বায়না করতে থাকা ঘ্যানঘেনে খোকাকে পুতুলের অজান্তেই ঠোঙায় করে সেই মহাপ্রসাদ এনে দেয়, হ্যাঁকাটে খোকাটাও কেমন চুপটি করে তার কোল ঘেঁষে বসে পড়ে।
ভরা ভাদরের বেলা। ক’দিন ধরে অঝোর ধারায় ঝরেই চলেছে। সেই সঙ্গে শোঁ-শোঁ তেজে পাগলা ঝোড়ো হাওয়া। জলের যেন বিরাম নেই। ভিজে চুলের ঢাল বিছিয়ে গোমড়ামুখো আকাশ ভারী হয়ে নেমে এসেছে চার ধারে। ভাঙা টালির চাল চুঁইয়ে পড়া জলে ভেসে যাচ্ছে ঘরের ভেতর। মাটির মেঝে জলকাদায় পিছল। বৃষ্টির জন্যে দু’দিন বেরোতে পারেনি পুতুল। মন্দিরেও যায়নি। আজ জলটা একটু ধরেছে। ছেলে-কোলে থকথকে কাদা, থইথই মাঠ পেরিয়ে মন্দিরের সামনে এসে দাঁড়ায় পুতুল। পাশের পুকুর ভেসে গিয়ে বাঁশবনে হাঁটু জল। পথের ধারে লিকপিকে জবাগাছটার ডাল ভেঙে গেছে। বেলগাছটা হেলে নুয়ে পড়েছে। তবে ডাগর বটগাছটার কিছু ক্ষতি হয়নি, সেটাকে আঁকড়ে ধরে চকচকে সবুজ পাতার নধর কোঁকারফুলের ঝাঁকড়া লতাগাছটিও লকলকিয়ে বেড়ে উঠেছে। মন্দিরের সামনে টুকরো জটলা। অশ্বত্থতলায় ভেজা চাতালে, ছেঁড়াখোঁড়া পাতা, ভাঙা ডাল, খড়কুটোর ওপর উপুড় হয়ে পড়ে রয়েছে বাসু দলুই। পুরুতমশাই উদ্বিগ্ন স্বরে সমানে ডেকে যাচ্ছেন, “বাসু, ও বাসু! ওঠ বাপ, জ্বরে যে গা পুড়ে যেতেছে। ঘর যা দিকিনি। এমন করে কি পেরাইচিত্তির করে কেউ?”
যে মানুষটাকে এমন আকুল হয়ে ডাকা, তার নিথর শরীরে হুঁশ নেই। সাড় নেই।
হঠাৎ চমকে উঠে পুতুল দেখে, কোল থেকে নেমে অবশ পুতুলের হাত ছাড়িয়ে কখন যেন খোকা পৌঁছে গেছে লোকটার কাছে। কচি হাতের ছোঁয়ায় তিরতিরিয়ে চোখ খুলেছে মানুষটা। করমচার মতো টকটকে লাল চোখে অদ্ভুত ঘোর। দুঃখ নয়, কষ্ট নয়, ব্যথা নয়, বেদনা নয়… বোঝা না-বোঝার বাইরে কোনও এক অজানা অনুভূতির বোধ খেলা করছে সেখানে। পাগলের মতো লোকটার হাত ধরে টানছে খোকা।
কিসের এক অমোঘ টানে কাঁপতে কাঁপতে লোকটা উঠে বসেছে!
ইস! আবার ঝেঁপে বৃষ্টি নেমেছে! চারিদিক ঝাপসা হয়ে যাওয়া অথৈ দুপুরে ছলছল চোখে চেয়ে দেখে পুতুল, খোকার হাত ধরে টলমলিয়ে লোকটা পুকুরপাড়ের জলকাদা ভেঙে, সবুজ বটের পাশ দিয়ে, কোঁকারফুলের ঝোপ মাড়িয়ে এগিয়ে চলেছে দলুইপাড়ার দিকে।
পাশে দাঁড়িয়ে অঝোর জলে ভিজতে থাকা লক্ষ্মীবৌদি হঠাৎ ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে, “ওরা ভালবাসার কাঙাল রে দিদি। নাওয়া নি, খাওয়া নি, ঘুম নি… এই ক’মাসে কী চেয়ারা হয়েছে লোকটার! আমি বলতেছি পুতুল, মানুষটারে তুই বাঁচা! তুই নিজেও বাঁচ!”
পুতুল এ কথার কোনও উত্তর দিতে পারে না। সে তখন ভিতরে-বাইরে এক বাঁধ না-মানা বর্ষণে আমূল ভিজে চলেছে।