Abosar

রুমির বোন

পত্রলেখা নাথ

দেওয়াল জুড়ে মিকি মাউসের ছবি, টেডি বিয়ারে বিছানা ভরে আছে, শো কেস ভর্তি গুচ্ছের খেলনা একটা আর একটার গায়ে হেলে পড়েছে। ঘরের বাঁ দিকে ছোট্ট টেবিলের ওপর বইগুলো ছড়ানো। বছর বারোর রুমি মাটিতে বসে রান্নাবাটি খেলছে। ছোট্ট গ্যাস, তাতে ছোট স্টিলের কড়াইয়ে রান্না চাপিয়েছে রুমি। পাশের ওভেনে প্রেশার কুকারে ভাত হচ্ছে। রুমির বয়সি মেয়েরা ইদানীং আর রান্নাবাটি খেলে না। তারা কম্পিউটারে বিভিন্ন গেমেই মেতে থাকে। রুমির বাবাও ওর জন্য বেশ কিছু কম্পিউটার গেমস এনে দিয়েছে। কিন্তু রুমির ও সব ভাল লাগে না।

রবিবারের দুপুরে ভাতঘুম সেরে খবরের কাগজটা হাতে নিয়ে ড্রয়িংরুমের সোফায় গা এলিয়ে দেন রুমির বাবা রূপম বন্দ্যোপাধ্যায়। বাবাকে দেখে রুমি তাড়াতাড়ি ছোট্ট প্লেটে বাবার জন্য খাবার নিয়ে যায়। সোফার পিছন থেকে দু’হাতে বাবার চোখটা চেপে ধরে বলে, ‘‘বাবা বলো তো রুমি তোমার জন্য কী রান্না করে এনেছে?’’ রূপম তখন মন দিয়ে একটা খবর পড়ছিলেন, ব্যাঙ্কের সুদ নাকি এই ফিনানশিয়াল ইয়ার থেকে কমিয়ে দেওয়া হবে। হঠাৎ এ ভাবে চোখটা বাধা পাওয়ায় রূপম চট করে রেগে যান। রুমির হাতটা জোর করে চোখ থেকে সরিয়ে বলেন, ‘‘আহ্‌ রুমি, বিরক্ত কোরো না, দেখছ আমি খবরের কাগজ পড়ছি।’’ বাবার ব্যবহারে রুমি প্রথমে একটু হকচকিয়ে যায়, তার পর নিরুৎসাহিত হয়ে ঘরে চলে যায়। খুব কান্না পায় রুমির, কেউ তার সঙ্গে খেলে না। বাবা, মা রোজ অফিস থেকে ফেরে রাত আটটায়। তার পর আর কখন খেলবে রুমি। আজ ছুটির দিন, তাও কারও সময় নেই। ইস, রুমির যদি একটা ভাই বা বোন থাকতো, তা হলে কত ভাল হত। ওদের পাশের ফ্ল্যাটে মধুরিমা দিদি থাকে। মধুরিমা দিদির একটা বোন আছে, ওরা দু’জনে কেমন সুন্দর খেলা করে। একসঙ্গে স্কুলে যায়, গল্প করে। রুমিও চায় ওর একটা বোন আসুক, ভাই হলেও কোনও আপত্তি নেই রুমির। সে দিন রাতে খাবার টেবিলে কথাটা বলেছিল রুমি, ‘‘মা, আমার একটা বোন বা ভাই এনে দাও না! তোমরা অফিসে চলে যাও, আমি স্কুল থেকে ফিরে একা একা বোর হই, একটা ভাই বা বোন থাকলে আমার আর কষ্ট হবে না, তোমাদেরও আর বিরক্ত করব না।’’ রুমির মা বিতস্তা রুমির কথা শুনে কিছু বলেননি, শুধু হেসেছিলেন।

 

******

দক্ষিণ কলকাতার একটি স্কুলে ক্লাস সিক্সে পড়ে রুমি। বাবা-মা ছাড়া ওকে সারা দিন দেখাশোনার জন্য মায়া মাসি থাকে। কাউকে না পেলে রুমি মায়া মাসিকেই হাত ধরে টেনে আনে ওর সঙ্গে খেলার জন্য। আজ স্কুল থেকে ফিরেই ব্যাগটা রেখে বিছানায় শুয়ে পড়েছিল রুমি। রুমিকে এ ভাবে শুয়ে পড়তে দেখে মায়া বেশ ভয় পেয়ে যায়। রুমি বলে, ‘‘স্কুল থেকেই তলপেটের কাছটায় অল্প অল্প ব্যথা হচ্ছিল। এখন খুব যন্ত্রণা হচ্ছে মাসি।’’ মায়া খেয়াল করে, রুমির সাদা স্কার্টের পিছনে লাল দাগ লেগে আছে। মায়া রুমিকে বাথরুমে নিয়ে যায়, তার পর বলে, ‘‘আজ থেকে তুমি কিন্তু আর সেই ছোট্ট রুমি নেই, এখন তুমি বড় হয়ে গিয়েছ। সাবধানে চলাফেরা করবে।’’ রুমি আস্তে আস্তে বুঝতে পারে, মায়া মাসি কী বলতে চাইছে। ক’দিন আগে ওদের স্কুলেও এই বিষয়টা নিয়ে কয়েক জন দিদিমণি ওদের বুঝিয়েছে।  রুমি বিছানায় শুয়ে শুয়ে ভাবে, ওর বোন আসলে ও আগে থেকে এ সব কথা বলে দেবে, যাতে রুমির মতো ওকে অসুবিধায় পড়তে না হয়।

চব্বিশশো স্কোয়্যার ফুটের দক্ষিণ খোলা ফ্ল্যাট রুমিদের। চারটে ঘর, ড্রয়িংরুম, বারান্দা, দু’টো বাথরুম, লম্বা রান্নাঘর। মা-বাবার ঠিক পাশের ঘরটাই রুমির। আজ প্রায় বছর চার হল, রুমি আর বাবা-মা’র কাছে শোয় না। প্রথম প্রথম একা ঘুমোতে খুব কষ্ট হত রুমির। এখন অভ্যেস হয়ে গিয়েছে। ঘড়িতে ঢংঢং করে দশটা বাজে। রুমি আজ সেই বিকেল থেকেই বিছানায় শুয়ে। কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছে, ও নিজেও জানে না। খিদের চোটে ঘুম ভাঙলে রুমি বিছানা ছেড়ে ডাইনিং-এর দিকে যায়। হঠাৎ বাবা-মা’র ঘর থেকে সে শুনতে পায় বাবা বলছে, ‘‘চিন্তা কোরো না, এ বার ছেলেই হবে, আমি তো ওর নামও ঠিক করে ফেলেছি— ঋজু। কেমন বলো তো?’’

ও পাশ থেকে মায়ের কণ্ঠস্বর, ‘‘আর যদি মেয়ে হয়, তা হলে?’’

রুমি আর দাঁড়িয়ে না থেকে ডাইনিং-এ গিয়ে বসে। বুকের ভিতরটা আনন্দে তোলপাড় করছে। এত দিন ধরে ভগবানকে রোজ যে কথা বলত রুমি, এত দিনে তিনি শুনেছেন। রুমি চায় ওর একটা বোন হোক। ওর যত ভাল ভাল জামাকাপড়, খেলনা, পুতুল আছে, সব বোনকে দিয়ে দেবে। মায়া মাসি টিভি দেখছিল, রুমি বলে, ‘‘মাসি তাড়াতাড়ি খেতে দাও, খুব খিদে পেয়েছে।’’

অনেক রাত অবধি বসে বসে নিজের সব খেলনার মধ্য থেকে ভাল খেলনাগুলো আলাদা করে রাখে রুমি। খাটে একটা বালিশ রেখে কিছুটা জায়গা ছেড়ে শোয় বোনের জন্য। ভাবতে থাকে নানা কথা। বোনের কী নাম রাখবে! বোনকে কী রঙের জামা পরাবে, কী কী খেলা খেলবে বোনের সঙ্গে... ভাবতে-ভাবতে চোখ জুড়ে ঘুম আসে রুমির।

 

******

স্কুলে টিফিন টাইমে বারান্দায় দাঁড়িয়ে বারবার মধুরিমা দিদিকে দেখছিল রুমি, কী ভাবে মধুরিমাদি ওর বোনকে শাসন করে, নিজের টিফিন বক্স থেকে কী ভাবে বোনকে টিফিন খাইয়ে দেয়। তিয়াসা এসে পিছন থেকে ধাপ্পা দিতেই চমকে ওঠে। তিয়াসা বলে, ‘‘কী রে, একা একা দাঁড়িয়ে কী ভাবছিস?’’ রুমি তিয়াসার গলাটা জড়িয়ে ধরে বলে, ‘‘জানিস তিয়াসা, আমার একটা বোন আসছে, ছোট্ট বোন।’’ তিয়াসা বলে, ‘‘তোর মন খারাপ হচ্ছে না? বাবা মা’র আদরে আবার ভাগ বসাতে আর এক জন আসছে? আমার তো খুব বিরক্ত লাগে, আমি একাই ভাল।’’ রুমি বলে, ‘‘ইস তুই কী বোকা রে, বোন এলে কত মজা, আমরা সব দুঃখ আনন্দ দু’জনে ভাগ করে নেব, সারা রাত গল্প করব, একসঙ্গে খেলব।’’ তিয়াসা অবাক হয়ে শোনে।

স্কুল থেকে ফিরে ইদানীং আর রুমিকে কিছু বলতে হয় না। নিজে নিজেই পোশাক বদলে চটপট খেয়ে নেয়। রাতে নিয়ম করে হোমওয়ার্ক করে, সময়মত টিউশনের জন্য রেডি হয়ে যায়। মায়া মাসি দেখে, এ যেন এক অন্য রুমি।

ঘড়িতে রাত আটটা বেজে গিয়েছে। মা-বাবা কেউই এখনও বাড়ি আসেনি। রুমি বারবার বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায়। বারান্দা থেকে আবার ঘরে গিয়ে টিভি চালিয়ে বসে। মোবাইল থেকে মায়ের নম্বরে ফোন করে, কিন্তু মা ফোন ধরে না। মিনিট দশেকের মধ্যে ডোরবেল বাজে। রুমি কান খাড়া করে। মায়া মাসি বলে, ‘‘রুমি, তোমার মা-বাবা এসে গিয়েছে।’’ রুমি বিছানা থেকে উঠতে যাবে, এরই মধ্যে ওর মা বিতস্তা ঘরে ঢোকে। মাকে এ রকম ভাবে আগে কখনও দেখেনি রুমি। প্রতি দিন অফিস থেকে এসে জামাকাপড় পালটানোর পর রুমির সঙ্গে মা-বাবার দেখা হয় খাবার টেবিলে। কিন্তু আজ মা সোজা  রুমির ঘরে এসেছে। রুমি মায়ের হাতটা ধরে বলে, ‘‘মা, আমি কিন্তু এখন ভাল মেয়ে হয়ে গিয়েছি, নিজের সব কাজ নিজেই করতে পারি, আর তুমি আমাকে বোর্ডিং-এ পাঠিও না। আমি এখানেই থাকব। না হলে বোন এলে ওকে কে সামলাবে?’’

বিতস্তা রুমির কোনও কথার উত্তর দেয় না, দু’হাতে রুমিকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে। রুমি বুঝতে পারে মা কাঁদছে, কিন্তু কেন মা আজ এ রকম করছে? তবে কি রুমিকে মা’কে ছেড়ে, বাবাকে ছেড়ে, ছোট্ট বোনকে ছেড়ে বোর্ডিং-এ চলে যেতে হবে!

রাতে খাওয়ার পর রুমির চোখে ঘুম আসে না। মায়ের মনে কী আছে জানতেই হবে রুমিকে। মায়া মাসি খেয়ে নিজের ঘরে চলে গেলে রুমি আস্তে আস্তে ঘর থেকে বেরিয়ে মা-বাবার ঘরের সামনে দাঁড়ায়। ওদের ঘরে তখনও আলো জ্বলছে। রুমি সতর্ক হয়ে ওদের কথা শোনার চেষ্টা করে। খানিক ক্ষণ পরে মায়ের কান্নার শব্দ শুনতে পায় রুমি। সঙ্গে বাবার কণ্ঠস্বর, ‘‘আবার একটা মেয়ে পৃথিবীতে এনে লাভ কি বলো তো? দেখলে তো অর্জুন বলল ফিমেল চাইল্ড, তার চেয়ে এ বারটা বাদ দাও, আবার নাহয় পরে চেষ্টা করা যাবে।’’ মায়ের কান্না-জড়ানো গলা শুনতে পায় রুমি। ‘‘জানো তো, রুমি বলছিল, ও আর বোর্ডিং-এ যাবে না। বোন এলে ও-ই সামলাবে। একা একা থাকে মেয়েটা, ওর না হয় আর এক জন সঙ্গী হত, আমরা দু’জনেই তো রোজগার করি, আসুক না আর একটা মেয়ে।’’ রুমির বাবার কণ্ঠস্বরে মায়ের কান্না চাপা পড়ে যায়, ‘‘তোমার কি মাথা খারাপ? এই বাজারে আর একটা মেয়ে, না না ও সব ছাড়ো, কালই কাজটা শেষ করে নাও, এর পর দেরি হয়ে যাবে। অর্জুন আমার বন্ধু, ওর নিজের নার্সিং হোমও আছে, কোনও অসুবিধা হবে না।’’ মায়ের ফোঁপানির শব্দ ভেসে আসে রুমির কানে। ও আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না। দৌড়ে নিজের ঘরে চলে আসে। অন্ধকার ঘরে জানলা দিয়ে চাঁদের আলো এসে পড়েছে। রুমি আলো জ্বালায় না। বোনকে দেবে বলে ওর যে প্রিয় পুতুলটা বিছানার পাশে রেখেছিল, সেটা দু’হাতে বুকে জড়িয়ে ধরে রুমি। নিজেকে বড় একা লাগে ওর।

 

******

মায়া মাসির ডাকে আজ ঘুম ভাঙে রুমির। পাশে টেবিল-ঘড়ির দিকে তাকিয়ে রুমি বলে, ‘‘মাসি, আমাকে ডাকোনি কেন, কত দেরি হয়ে গেছে, স্কুলে যেতে তো লেট হয়ে যাবে।’’ মায়া মাসি রুমির নাকটা নেড়ে বলে, ‘‘পাকা বুড়ি আমার, কিচ্ছু দেরি হবে না, সব রেডি আছে। তুমি স্নান সেরে স্কুল ড্রেসটা পরে নাও।’’ রুমি স্নান সেরে টেবিলে খেতে বসে দেখে, মা-বাবা কেউই টেবিলে নেই!

রুমি বলে, ‘‘মা-বাবা দু’জনেই কি বেরিয়ে গেছে?’’ মাসি বলে, ‘‘হ্যাঁ রুমি, মাকে নিয়ে বাবা ডাক্তারের কাছে গেছে, ফিরতে দেরি হবে।’’ ডাক্তারের কথা বলতেই গত কাল রাতে মায়ের কান্নার কথা মনে পড়ে যায়, আর তখনই এক অজানা আতঙ্ক গ্রাস করে ওকে।

স্কুলে আজ দিদিমণিদের কাছে সব পড়া অকারণে ভুল হয়ে যায় রুমির। টিফিনে বারবার চোখ চলে যায় মধুরিমাদি আর ওর বোনের দিকে। রুমিকে তো কেউ দিদি বলে ডাকার নেই। বাড়ি ফিরতেই যেন আজ আর ইচ্ছে করে না রুমির। অন্য দিন স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে মায়া মাসির সঙ্গে টিউশনে যায় রুমি। আজ মাসি স্কুলে রুমিকে আনতে গেলে রুমি বলে, ও আজ স্কুল থেকে বন্ধু তিয়াসার বাড়ি যাবে, ওখান থেকে টিউশন পড়ে রাতে বাড়ি ফিরবে। সন্ধে অবধি এক রকম কাটলেও তিয়াসার বাবা স্কুটারে করে রুমিকে যখন ফ্ল্যাটের নীচে নামিয়ে দেয়, তখন রুমির দমটা যেন বন্ধ হয়ে আসে। শরীরটা যেন কেমন ভারী হয়ে যায়। রুমি এক পা এক পা করে ওপরে ওঠে। ফ্ল্যাটের দরজায় মায়া মাসি দাঁড়িয়ে ছিল। রুমি মাসির দিকে এক বার তাকায়, তার পর পিঠের ব্যাগটা মাসির হাতে দিয়ে বলে, ‘‘মা এসেছে মাসি?’’

মাসি বলে, ‘‘হ্যাঁ, মা ঘরে শুয়ে আছে, মায়ের শরীরটা ভাল নেই।’’ রুমি আস্তে আস্তে মায়ের ঘরে ঢোকে। মা শুয়ে আছে। রুমি গিয়ে মায়ের পাশে বসে। বিতস্তা বলে, ‘‘কী রুমি, পড়াশোনা ঠিক মতো করছ তো? যাও, খেয়ে নাও এ বার।’’

রুমি মাথাটা নিচু করে অনেক ক্ষণ মায়ের সামনে বসে থাকে, তার পর জলভরা চোখে মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘‘মা, আমাকে বোর্ডিং-এ পাঠিয়ে দাও।’’