শুভ জন্মদিন, অন্তু,”
কাঁটায়-কাঁটায় রাত বারোটায় মেসেজটা ঢুকল অন্তরীপের মোবাইলে। সঙ্গে স্মাইলি আর হাফ ডজন লাভ ইমোজি।
মুহূর্তে কল ব্যাক। শুচিস্মিতা প্রস্তুতই ছিল। পাঁচ সেকেন্ডের মধ্যে মোবাইলটা কানে চেপে ধরামাত্রই, উল্টো দিক থেকে ঈষৎ ঘুম-জড়ানো স্বরে ভেসে এল, “ধন্যবাদ, ম্যাডাম...”
“মেনশন নট, প্লিজ়! একটু ধর। মা, বাবা কথা বলবে।”
“ধরেই আছি...”
প্রায় কুড়ি সেকেন্ডের অপেক্ষা। বোধ হয় মা-বাবার প্রশিক্ষণপর্ব চলছে। অন্তরীপ হাসল। সত্যি, সময় কত বদলে গিয়েছে! আগে তার সঙ্গে কথা বলতে নমিতা বা দীপক, কাউকেই তেমন ইতস্তত করতে হত না। কিন্তু আজ…
অপেক্ষার অবসান। স্পিকার অন হয়েছে। সস্নেহে নমিতা বলে উঠলেন, “হ্যাপি বার্থডে, অন্তু। আমার অনেক আশীর্বাদ নিস...”
“আমার প্রণাম নিয়ো, কাকিমা...”
দীপকের বার্তা একই। সঙ্গে যোগ করলেন, “সারা বছর খুব আনন্দে কাটুক, এই শুভকামনা রইল।’’ ”
অন্তরীপ হাসল। মেকি হাসি। সৌজন্যমূলক ধন্যবাদ জানাতে ভুলল না। বাবার হাত থেকে ফোনটা নিয়ে এ বার নর্মাল মোডে নির্দেশ এল মেয়ের তরফ থেকে, “ডট সন্ধে ছ’টায় পার্ক স্ট্রিটের ‘লাভেরিয়া’য় চলে আসবি কিন্তু! যদি দেরি করিস…”
কথাটা শেষ করার প্রয়োজন বোধ করল না শুচিস্মিতা। তার নির্দেশের যে নড়চড় হওয়ার জো নেই, অন্তরীপ জানে। তাই মৃদু হেসে বলল, “জো ম্যাডাম কি মর্জি! কিন্তু…”
“আর কোনও ‘কিন্তু’ নয়! সাড়ে বারোটা বাজতে চলল। এ বার তুইও ঘুমিয়ে পড়। আমিও নাক ডাকাই। সন্ধেয় দেখা হচ্ছে। গুড নাইট!”
অন্তরীপের কিছু একটা বলতে চাওয়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষার মুখে পাথর চাপা দিয়ে, আচমকাই শুচিস্মিতা ফোন কেটে দিল। পাশে বসা নমিতা বলে উঠলেন, “ছেলেটা কী বলতে চাইছিল, শুনলি না কেন?”
“নতুন করে আর কী শুনব, মা?” তিক্ত স্বরে বলল শুচিস্মিতা, “ওর বক্তব্য তো আমার জানা। একঘেয়ে কথাগুলো শুনে মুড অফ করতে ইচ্ছে করছে না আর!”
“তাও…অন্তু কী ভাবল!”
“কিছুই ভাবেনি। ও বুঝেছে, আমি কেন ছেড়েছি!”
নমিতা আর কথা বাড়লেন না। জানেন, বাড়িয়েও কোনও লাভ নেই। মেয়ের মাথায় হাত রেখে ঈষৎ দ্বিধামিশ্রিত স্বরে দীপক জিজ্ঞেস করলেন, “যা করছিস, ভেবেচিন্তে করছিস তো, মা?”
“এতে এত ভাবনার কী আছে, বাবা?” দৃঢ় স্বরে পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ল শুচিস্মিতা, “যা হচ্ছে, সেটাই কি হওয়ার কথা ছিল না?”
“স্বাভাবিক অবস্থায়, অবশ্যই,” দীপক জবাব দিলেন, “কিন্তু এই পরিস্থিতিতে…”
“পরিস্থিতি প্রতিকূল ভাবলেই প্রতিকূল। আর বাস্তব ভাবলে বাস্তব। আজ যা হয়েছে, তা দশ বছর বাদেও হতে পারত। তখন কী করতাম? ছেড়ে দিতাম অন্তুকে?”
“মানছি। কিন্তু তাও, মনটা যে বড্ড খচখচ করে…”
“পাত্তা দিয়ো না। মানসিক খচখচানিকে গুরুত্ব দিলে বেড়েই যায়। তার চেয়ে শুয়ে পড়ো। একটা কথা মাথায় রেখো। নিষ্পাপ বাস্তব যতই প্রতিকূল হোক, তার সঙ্গে সৎ সহাবস্থান করতে তোমাদের মেয়ের কখনও অসুবিধে হবে না। ”
দীপক উঠে পড়লেন। চোখের ইশারায় নমিতাকেও নির্দেশ দিলেন উঠে পড়ার জন্য। এ কথা সত্যি, অন্তরীপ খুব ভাল ছেলে। কিন্তু এই মুহূর্তে তার আর শুচিস্মিতার সম্পর্কটাকে পরিণতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে তাঁদের বেশ বেগ পেতে হচ্ছে। আবার শুচিস্মিতার যুক্তিগুলোও উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। এই অবস্থায় মেয়ের মতামতের উপর ভরসা রাখাই শ্রেয়।
দীপকরাও তাই করলেন। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চলে গেলেন শুতে। তাঁরা ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ামাত্র শুচিস্মিতাও শুয়ে পড়ল। কিন্তু সহজে ঘুম এল না তার চোখে। মাথায় একটাই চিন্তা। অন্তরীপের জন্য যে সারপ্রাইজ় গিফ্টটার পরিকল্পনা সে করেছে, সেটা তার পছন্দ হবে তো!
অন্তরীপ ভৌমিক পেশায় চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট। সুদর্শন। বয়স সাতাশ। বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান। তার একটাই দোষ। বড্ড অমিশুকে। বন্ধুবান্ধব প্রায় নেই। শখ বলতে গান শোনা। আর ভালবাসা, শুচিস্মিতা।
অন্য দিকে, শুচিস্মিতা আবার বিখ্যাত নিজের হুল্লোড়ে স্বভাবের জন্য। রিয়েল এবং ভার্চুয়াল দুনিয়া মিলিয়ে তার অগুনতি বন্ধু। বছর পাঁচেকের বড় দিদি সুস্মিতার বিয়ে হয়ে গিয়েছে। তার শ্বশুরবাড়ির সঙ্গেও শুচিস্মিতার দারুণ ঘনিষ্ঠতা বিশেষত, জামাইবাবু বরুণ তো ‘শালিসাহেবা’ বলতে অজ্ঞান! সবটাই শুচিস্মিতার মিশুকে স্বভাবের গুণে।
চুম্বকের বিপরীত মেরুর পারস্পরিক আকর্ষণ ছাড়া এদের দু’জনের মধ্যে টান তৈরি হওয়ার কোনও ব্যাখ্যা বোধ হয় নেই। কিন্তু ‘প্রেম’ নামক মাধ্যাকর্ষণের টান শুচিস্মিতার প্রতি অন্তরীপ প্রথম অনুভব করল কলেজে ভর্তি হওয়ার সময়। দু’জনের বিষয় আলাদা। এক জনের আর্টস, অন্য জনের কমার্স। সেই ক্লাস ফাইভ থেকে একই স্কুলে পড়ে এসেছে তারা। কিন্তু গ্র্যাজুয়েশনের ফিল আপ করা ফর্মদু’টো যখন দু’জনার দু’টি পথ দু’টি দিকে বাঁকিয়ে দিল, তখন বিচ্ছেদের আয়নায় নিজের বুকের বাঁ দিকটা স্পষ্ট দেখতে পেল অন্তরীপ। আবিষ্কার করল, টিফিন ভাগ করে খেতে খেতে কখন যেন হৃদয়ের অর্ধেকটাও সে দিয়ে ফেলেছে শুচিস্মিতাকে, যা এখন ফিরিয়ে নেওয়া অসম্ভব।
শুচিস্মিতাও আন্দাজ করতে পেরেছিল ব্যপারটা। দুর্বলতা
তার দিক থেকেও কম ছিল না। ফলে, হৃদয় বিনিময়ের মাধ্যমে আরম্ভ হয়েছিল দু’জনের এক সঙ্গে পথ চলা। যাত্রাটা দুর্গম হয়নি কখনওই। শুরু থেকেই পরিবারের আশীর্বাদ ছিল তাদের সম্পর্কের পাথেয়। উপরন্তু, অন্তরীপ আর শুচিস্মিতা চাকরি পেয়ে যাওয়ার পর থেকে মধুরেণ সমাপয়েতের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিল সবাই।
কিন্তু সব কিছু বদলে গেল, গত বছর শুচিস্মিতার জন্মদিনের দিন। সে দিনও বরাবরের মতোই ‘লাভেরিয়া’য় দেখা করেছিল দু’জনে। দিব্যি চলছিল কেক কাটা, উপহার দেওয়া, টুকরো-টাকরা খুনসুটি। ডিনার চলাকালীন হঠাৎই অন্তরীপের চোখ থেকে জল পড়তে আরম্ভ করল। প্রথমটায় অন্তরীপ পাত্তা দেয়নি। ভেবেছিল, ঠান্ডা লেগে গিয়েছে বোধ হয়। শুচিস্মিতাও বিশেষ খেয়াল করেনি ব্যাপারটা। বাড়ি ফেরার পথে আচমকা চোখে চোখ পড়তে সে আঁতকে উঠে বলেছিল, “এ কী অন্তু, তোর চোখদু’টো তো মুছতে মুছতে লাল টকটকে হয়ে গিয়েছে রে!”
অন্তরীপের মায়োপিয়া আছে। ছোট থেকেই তার চোখে হাই মাইনাস পাওয়ারের চশমা। তাই সে হেসে বলেছিল, “চিন্তা করিস না। বাড়ি গিয়ে ড্রপ দিয়ে নেব। ”
শুচিস্মিতা তাও নিশ্চিন্ত হতে পারেনি। অত রাতে ডাক্তার দেখানো সম্ভব নয়। তাই, অন্তরীপের থেকে কথা আদায় করে নিয়েছিল, পর দিন ও যেন অবশ্যই আই স্পেশ্যালিস্টের সঙ্গে কনসাল্ট করে। কিন্তু পর দিন ভোরবেলায় ঘুম ভাঙতেই তো…
“অন্তু!”
এত ক্ষণ জানলার সামনে দাঁড়িয়ে স্মৃতিচারণ করছিল অন্তরীপ। মায়ের ডাকে চমকে উঠে ঘাড় ঘোরাতেই, সহেলি জিজ্ঞেস করলেন, “স্মিতা ফোন করেছিল?”
অন্তরীপ রাতের কথা খুলে বলল মাকে। বিকেলের অ্যাপয়েন্টমেন্টের খবরটাও বলল। দীর্ঘশ্বাস ফেলে সহেলি বলে উঠলেন, “ভাল তো। ঘুরে আয়। একা যেতে পারবি? না, তোর বাবাকে…”
“কেন!” রুক্ষ স্বরে বলল অন্তরীপ, “অফিসে তো রোজ একাই যাই! আজ কিসের অসুবিধে?”
সহেলির বুঝতে অসুবিধে হল না ছেলের বিরক্তির কারণ। ওই ঘটনাটার পর থেকেই ছেলেটা একটু খিটখিটে হয়ে গিয়েছে। প্রথম-প্রথম অফিসেও যেতে চাইত না। গুম হয়ে থাকত। তার পর শুচিস্মিতা এসে খানিকটা সহজ করল তাকে। কিন্তু পুরোপুরি আগের জীবনে ফেরা বোধ হয় তার পক্ষে আর সম্ভব নয়।
কথাটা মনে আসতেই, সহেলির বুকটা মুচড়ে উঠেছিল। পাছে চোখে জল এসে যায়, তাই তড়িঘড়ি তিনি ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। অন্তরীপ উঠে এগিয়ে গেল বাথরুমের দিকে। শুচিস্মিতাটা বরাবরের পাগল। প্রতি বারই কিছু না কিছু ছেলেমানুষি করে অন্তরীপের জন্মদিেন। অন্তরীপও উপভোগ করে ব্যাপারগুলো। কিন্তু আজ তার মনে ভয়— প্রতিকূল পরিস্থিতিতে, উপহারের আনুকূল্য আদৌ আনন্দদায়ক হবে কি?
ঘড়ি ধরে সাড়ে পাঁচটা নাগাদ ‘লাভেরিয়া’য় ঢুকতে ঢুকতে শুচিস্মিতার মনে পড়ে গেল, অন্তরীপের প্রোপোজ়ের দিনটার কথা। সে দিন প্রাইভেসি বজায় রাখতে, অতিরিক্ত চার্জ দিয়ে হলের পরিবর্তে নীল পর্দা ঢাকা ছোট্ট কেবিনটা বুক করেছিল অন্তরীপ। তার পর মুখোমুখি দু’টো চেয়ারে বসে, পকেট থেকে এক ঠোঙা কোকোবাইট বের করে শুচিস্মিতার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলেছিল, “আমার লাইফ পার্টনার হবি?”
কোকোবাইট শুচিস্মিতার খুব প্রিয়। তাই পাক্কা পাঁচ মিনিট ধরে একটা চকলেট খেয়ে সে জবাব দিয়েছিল, “হতে পারি। যদি রোজ একটা করে কোকোবাইট খাওয়াস।”
মুচকি হেসেছিল অন্তরীপ। চোখ টিপে বলেছিল, “এনি বাইট ইউ লাভ, ডার্লিং! তবে ক্যাভিটির দায়িত্ব নিতে পারব না কিন্তু!”
ইঙ্গিতটা বুঝতে শুচিস্মিতার অসুবিধে হয়নি। মুহূর্তে লজ্জায় লাল হয়ে গিয়েছিল তার গাল। সে প্রায় বছর সাত-আটেক আগেকার কথা। তার পর পেরিয়ে গিয়েছে দীর্ঘ সময়। কিন্তু দু’জনের সম্পর্কে ভাঙন ধরেনি। সেই বিশ্বাস নিয়েই আজও এসেছে শুচিস্মিতা। তার ধারণা, আজকের পর তাকে রোজ একটা করে কোকোবাইট খাওয়ানোর দায়িত্ব নিতে অন্তরীপের আর কোনও আপত্তি থাকবে না।
নির্দেশমাফিক ডট ছ’টায় অন্তরীপ ঢুকল সুইংডোর ঠেলে। পরনে কালো জিন্স আর সাদা শার্ট। চোখে কালো ফ্রেমের চশমা। কেবিন নম্বর জানাই ছিল। পর্দা ঠেলে প্রবেশ করামাত্রই তাকে ঈষৎ থতমত খেয়ে যেতে দেখে, তার অপ্রস্তুতির কারণটা আন্দাজ করে শুচিস্মিতা এক গাল হেসে বলল, “গত পুজোয় তুই যে কালো চুড়িদারটা গিফ্ট করেছিলি, সেটা… কেমন লাগছে?”
“ভাল। ”
নিরুৎসাহী গলায় জবাবটা দিতে দিতে বসে পড়ল অন্তরীপ। তার উদাসীন হতে চাওয়ার আড়ালে লুকিয়ে থাকা উদাসীন হতে না পারার যন্ত্রণাটুকু শুচিস্মিতার নজর এড়ায়নি। তাই বিনা ভূমিকায় সে বলল, “তোর জন্য সারপ্রাইজ় আছে।”
“সারপ্রাইজ়!” অন্তরীপ ম্লান হাসল, “আমার জন্য? শুনতে মন্দ লাগছে না! কিন্তু বুঝতে পারব কি?”
“খুব পারবি!”
“বেশ। দে তা হলে...”
শুচিস্মিতা তার চেয়ারের পাশ থেকে মাঝারি মাপের র্যাপার মোড়া একটা বাক্স টেবিলের উপর তুলল। তার পর প্রায় আদেশের ভঙ্গিতে বলল, “চোখ বন্ধ কর! আমি না বলা পর্যন্ত খুলবি না খবরদার!”
মৃদু ধমক খেয়ে চোখ বুজে ফেলল অন্তরীপ। দ্রুত র্যাপার খুলে বাক্স থেকে জিনিসগুলো বের করে, টেবিলে সাজিয়ে শুচিস্মিতা বলে উঠল, “নে, চোখ খোল এ বার...”
অন্তরীপ চোখ খুলল। তার পর টেবিলের দিকে তাকাতেই চোখ ছানাবড়া। খানকতক মোমবাতির ঘেরাটোপের মাঝখানে একটা বার্থডে কেক! কিন্তু…
অন্তরীপের মাথায় যন্ত্রণা আরম্ভ হয়ে গিয়েছে! হৃৎস্পন্দন দ্রুততর! ঘর্মাক্ত হাতে পাশে দাঁড়ানো শুচিস্মিতার ওড়নাটা সে খামচে ধরামাত্রই, শান্ত স্বরে শুচিস্মিতা বলল, “ভয় পাস না অন্তু! যা দেখছিস, সব সত্যি। এটাই তোর জন্মদিনে বিশেষ উপহার। আ ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট কেক, মেড বাই মি...”
“ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট… মানে?”
“মানে আবার কী? নর্মালি একটা কেক তৈরি করতে যা-যা উপকরণ লাগে, সবই আছে। শুধু ফ্লেভার দিয়েছি ডার্ক চকলেট আর পিয়োর ভ্যানিলা। খেয়ে দ্যাখ কেমন লাগে!”
মিষ্টি হেসে কথাগুলো বলতে বলতে অন্তরীপের হাতে ছুরিটা ধরিয়ে দিল শুচিস্মিতা। ছোট্ট একটা টুকরো কাটিয়ে, বার্থডে বয়ের মুখে ঢুকিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করল, “কেমন?”
ঘোর লাগা গলায় অন্তরীপ জবাব দিল, “ভাল!”
“সত্যি বলছিস? আমার মন রাখা কথা নয়?”
খুশি-খুশি শুচিস্মিতার গলায় সামান্য সংশয়ের ছোঁয়া। অন্তরীপ ঢোঁক গিলল। তার গলার কাছেও দলা পাকানো কিছু একটা ঘাই মারছে। অবিলম্বে সেটা বার করে দেওয়া আবশ্যক। তাই শুচিস্মিতা ‘‘এ বার তা হলে আমায় খাইয়ে দে’’ বলামাত্রই, তাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলল সে।
শুচিস্মিতার মনে পড়ে যাচ্ছিল, নিজের বিগত জন্মদিনের পরের দিনটার কথা। সেই দিনও ঠিক এই ভাবে সকাল সাতটা নাগাদ ফোন করে উদ্ভ্রান্তের মতো অন্তরীপ বলে উঠেছিল, “আমার চোখদু’টো বোধ হয় নষ্ট হয়ে গিয়েছে রে, স্মিতা!”
শুচিস্মিতা তখন সবেমাত্র ঘুম থেকে উঠেছে। তাও অন্তরীপের ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে দেওয়া বার্তা থেকে সে বুঝেছিল, ভোরে চোখ মেলা ইস্তক সব কিছু কেমন যেন ধূসর দেখছে অন্তরীপ! কেউ যেন তার দৃষ্টি থেকে যাবতীয় রং শুষে নিয়ে, ফেলে রেখে গিয়েছে কেবল সাদা আর কালো!
নিঃসন্দেহে ভয়াবহ অভিজ্ঞতা। শুনে আর স্থির থাকতে পারেনি শুচিস্মিতা। ছুটে গিয়েছিল অন্তরীপের কাছে। গিয়ে দেখেছিল, সে তখনও বারবার চোখ রগড়ে নিজের দৃষ্টি রঙিন করার চেষ্টা করছে। অতিরিক্ত ঘষাঘষির চোটে, তার দু’চোখ জবাফুলের মতো লাল, দৃশ্যপট পূর্ববৎ বিবর্ণ।
শুচিস্মিতা ঝুঁকি নেয়নি। তড়িঘড়ি অন্তরীপকে নিয়ে হাজির হয়েছিল চক্ষুবিশেষজ্ঞের চেম্বারে। পরীক্ষানিরীক্ষার পর তিনি জানিয়েছিলেন, স্নায়বিক কিছু জটিলতায় বাকি জীবনের জন্য বর্ণান্ধ হয়ে গিয়েছে অন্তরীপ।
সেই থেকে, অন্তরীপ কেমন যেন বদলে গিয়েছে! নিজেকে সব কিছু থেকে গুটিয়ে রাখে। যেন তার সাদা-কালো জগৎ শুচিস্মিতার রঙিন দুনিয়ায় ব্রাত্য, এমন ভাবে দূরে সরিয়ে রাখে শুচিস্মিতাকেও। তাই শুচিস্মিতা ঠিক করেছিল, এ বছর জন্মদিনে অন্তরীপকে এমন কিছু উপহার দেবে, যাতে তার হীনম্মন্যতা কেটে যায়। পরিকল্পনাটা আংশিক সফল। দেখা যাক, শুচিস্মিতার আনুগত্যের প্রতি তার হারানো বিশ্বাস পুরোপুরি ফিরে আসে কি না...
মিনিটখানেক পর, একটু ধাতস্থ হয়ে অন্তরীপ বলে উঠল, “তুই আমার জন্য… এ সব কেন করছিস, স্মিতা? আমি যে প্রতিবন্ধী!”
“কালার ব্লাইন্ডনেস কোনও প্রতিবন্ধকতা নয়, অন্তু! লাইফটাইম ব্লাইন্ডনেস নিয়ে মানুষ হিল্লি-দিল্লি করে বেড়াচ্ছে! সেখানে কালার ব্লাইন্ডনেস তো অতি তুচ্ছ...’’
“কিন্তু আমি তো তোকে কোনও দিন কোনও রঙে রাঙাতে পারব না!”
“ঘর বাঁধতে ভালবাসা আর অভিমানের বেশি কিছু লাগে না রে, অন্তু! ভালবাসার রং তো...” অন্তরীপের চোখ থেকে ঝরে পড়া এক ফোঁটা জল নিজের বাঁ হাতের তর্জনীতে নিয়ে বলল শুচিস্মিতা, “সাদা। আর অভিমানের রং যে কতটা কালো, সেটা আমার সঙ্গে এত দিন মিশে নিশ্চয়ই বুঝে গিয়েছিস! আর কী চাই বল তো! আমরা ভালবাসা আর অভিমানে গড়া একটা সাদা-কালো জীবন কাটাতে পারব না?”
কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে অন্তরীপ বলল, “আমি বোধ হয় আর কোনও দিনই রঙ চিনতে পারব না...’’
“কেন পারবি না?” তার মাথায় হাত রেখে বলল শুচিস্মিতা, “তুই আমার চোখ দিয়ে রং চিনবি! মনে কর না, আজ থেকে তোর চোখদু’টো সাদা ক্যানভাস! আর আমার দু’চোখ প্যালেট আর রং! আমি তুলি হয়ে তোকে রং চেনাব! হতে দিবি আমাকে তোর তুলি? দে না রে, প্লিজ়!”
অন্তরীপের অন্তরাত্মা থরথর করে কেঁপে উঠল। শুচিস্মিতাকে সে প্রাণের চেয়েও বেশি ভালবাসে! কেবল নিজের সীমাবদ্ধতার কারণেই চেয়েছিল দূরে সরে যেতে। কিন্তু এই আকুলতার সামনে আত্মসমর্পণ ব্যতীত উপায় কী? অতএব…
একই কেক দ্বিতীয় বার কাটা হল। দ্বিতীয় দফা খাওয়া এবং খাওয়ানোর পর বিষণ্ণ হেসে অন্তরীপ বলল, “তুই তো আমায় ভরিয়ে দিলি। কিন্তু আমি তোকে কী দেব?”
“একান্তই যদি কিছু দিতে চাস,” আঙুল চাটতে চাটতে জবাব দিল শুচিস্মিতা, “তোর তুলি হওয়ার অধিকারটুকু দে-”
“দিতে পারি। একটা শর্তে...”
“কী?”
“আজ থেকে তোকে তুলি বলে ডাকব। রাজি?”
“বেশ। তবে আমিও তোর একটা নতুন নাম দেব। শুধু আমার ডাকার জন্য...”
“কী, শুনি?” বলল অন্তরীপ,
মুচকি হেসে শুচিস্মিতা জবাব দিল, “রঙ্গন। ”
অন্তরীপও হেসে ফেলল। পর মুহূর্তেই, তার মুখে ফিরে এল বিষণ্ণতা। বলল, “কানা ছেলের নাম পদ্মলোচন... রঙ্গন হয়ে কোনও রংই তো আমি দিতে পারব না তোকে!”
“প্রয়োজন কী?” রঙ্গনের দু’কাঁধে হাত রেখে বলল তুলি, “তুই-ই তো আমার রং! আর আমি তোর?”
তুলির চোখে চোখ রেখে রঙ্গন উত্তর দিল, “রামধনু!”