Abosar

রত্ন-প্রাপ্তি

সৌরভকুমার ভূঞ্যা

ভাবনাটা সবে ইতিবাচক দিকে মোড় নিয়েছে, এমন সময় বেজে ওঠে মোবাইল। অভ্রনীল একটু বিরক্ত হয়। প্রায় পনেরো দিন চেষ্টা করছে কিন্তু কিছুতেই একটা গল্প লিখতে পারছে না। ওদিকে মেঘবালিকা-র সম্পাদক অদিতিদি নিয়মিত তাগাদা দিয়ে যাচ্ছে। অন্য কেউ হলে না বলে দিত, কিন্তু অদিতিদিকে না বলা অসম্ভব ব্যাপার। অদিতিদি তাকে খুব স্নেহ করেন। এ দিকে নিজের অক্ষমতার কথাও বলতে পারছে না।

বিভিন্ন ঝামেলায় মনটা অশান্ত হয়ে রয়েছে অভ্রনীলের। কিছুতেই লেখাতে মন দিতে পারছে না। ও দিকে সময় চলে যাচ্ছে। অভ্রনীল সংকল্প করেছিল, আজ লেখাটা লিখবেই। তাড়াতাড়ি রাতের খাওয়া সেরে বসে পড়েছে। একটা প্লটও হালকা ভাবে মাথায় ছিল। মনে মনে সেটাকে ঠিকঠাক সাজিয়ে ভাবনাটা যখন পরিণতির দিকে এগোচ্ছিল, তখনই বেজে ওঠে মোবাইল।

অজানা নম্বর। এক বার ভাবে ধরবে না। কিন্তু না ধরলে আবারও করবে। আর যদি পরিচিত কেউ হয়, না ধরলে খারাপ ভাববে। স্থির করে, কলটা রিসিভ করেই ফোনটা বন্ধ করে দেবে।

ও পাশের কণ্ঠস্বর শুনে অভ্রনীল বুঝতে পারে, ভদ্রলোক খুবই বয়স্ক। এমন বয়স্ক লোক এত রাতে ফোন করছে ভেবে একটু অবাক হয়। বিরক্তি চেপে বলে, ‘‘হ্যাঁ, আমি অভ্রনীল। আপনি কে বলছেন?’’

‘‘পরিচয় দিলে চিনতে পারবেন না।’’

খুব একটা ভুল বলেননি ভদ্রলোক। কত অপরিচিত লোকেরই ফোন আসে। সবার পরিচয় নেওয়া হয়ে ওঠে না। নেওয়ার যে খুব একটা তাগিদ অনুভব করে তাও নয়। তাই ও ব্যাপারে না গিয়ে সরাসরি বলে, ‘‘বলুন, কেন ফোন করেছেন।’’

‘‘বার্তাবাহকে আপনার গল্পটি পড়লাম। অসাধারণ।’’

‘‘বার্তাবাহকে!’’ অভ্রনীল বেশ অবাক।

ভদ্রলোক সঙ্কোচের সুরে বলেন, ‘‘বার্তাবাহকে আপনার গল্প বার হয়েছিল না!’’

অভ্রনীল কী বলবে ভেবে পায় না। বার্তাবাহকে তার গল্প বেরিয়েছিল ঠিকই, তবে তা মাস ছয়েক আগে। সে কথা সে নিজেই প্রায় ভুলে গিয়েছিল। এত দিন পরে তা নিয়ে ফোন, তাও আবার এত রাতে! বিস্ময়-মাখা সুরে বলে, ‘‘হ্যাঁ, তা বেরিয়েছিল ঠিকই, তবে সে তো কয়েক মাস আগের কথা!’’

‘‘তা ঠিক। তখন আপনার নম্বর ছিল না।’’

‘‘ও।’’

‘‘গল্পটি আমার খুব ভাল লেগেছিল। পড়ে মুগ্ধ হয়ে গেছি।’’

‘‘ধন্যবাদ। শুনে ভাল লাগল। আপনার কথায় অনুপ্রাণিত হলাম।’’

ভদ্রলোক চুপ। অভ্রনীলের খুব জানতে ইচ্ছে করছিল ভদ্রলোক তার নম্বর পেলেন কী করে। একটু ঘুরিয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘‘আপনি বুঝি গল্প-উপন্যাস পড়তে খুব ভালবাসেন?’’

ভদ্রলোক আবারও সঙ্কোচ-মাখা সুরে বলেন, ‘‘সত্যি বলতে কী, আমি গল্প-কবিতা-উপন্যাস পড়ি না। পড়ার ইচ্ছেও হয় না।’’

অভ্রনীলের মনে হল, কানের পাশে কেউ বোধহয় সপাটে একটা চড় কষাল। মাথাটা দপ করে ওঠে। কড়া করে একটা কথা বলতে গিয়েও নিজেকে সামলে নেয়। গলার স্বর যতটা সম্ভব স্বাভাবিক রেখে বলে, ‘‘আপনি গল্প-উপন্যাস পড়েন না। পড়ার ইচ্ছেও হয় না বললেন। তা হলে হঠাৎ আমার লেখাটা পড়লেন কেন?’’

ভদ্রলোক অদ্ভুত কণ্ঠে বলেন, ‘‘কেন যে পড়লাম তা নিজেও ঠিক বুঝতে পারিনি।
আমি খবরের কাগজ নিয়মিত পড়ি। তবে ওই পাতাগুলো এড়িয়েই যাই। হঠাৎ কী মনে হল, পড়েই ফেললাম। হয়তো আপনার নামটাই আমাকে দিয়ে পড়িয়ে নিল।’’

নামের কথা শুনে একটু অবাক হয় অভ্রনীল। বলেই ফেলে, ‘‘নামটা পড়িয়ে নিল মানে!’’

‘‘না না, ওটা কিছু নয়। এমনি বললাম।’’ ভদ্রলোক ব্যাপারটা এড়াতে চান। অভ্রনীলও তা বুঝতে পারে। তাই কৌতূহল হলেও ব্যাপারটা সে চেপে যায়। লেখালিখি করে এখন একটু নাম হয়েছে তার। সে জন্য মনে মনে একটা প্রচ্ছন্ন অহঙ্কারও আছে। তাই প্রসঙ্গ বদলে বলে, ‘‘আপনি আমার নম্বর পেলেন কী করে?’’

‘‘সে অনেক কথা।’’

‘‘সমস্যা না থাকলে বলুন না।’’

কিছু সময় চুপ থাকার পর ভদ্রলোক একটু সঙ্কোচের সুরে বলেন, ‘‘সত্যি বলতে কী, ওই গল্পটি পড়েই যে ফোন করতে ইচ্ছে হয়েছিল তা নয়। এটা সত্যি, গল্পটি অসাধারণ। কিন্তু ফোন করার ইচ্ছে হয়নি।’’

অভ্রনীলের সারা শরীর রাগে জ্বলে ওঠে। বুঝতে পারে না ভদ্রলোক তার প্রশংসা করার জন্য ফোন করেছেন নাকি অপমান করতে। ভাবে, ভদ্রলোকের বয়স হয়েছে। মাথার দোষ নেই তো! চাইলেও নিজেকে স্বাভাবিক রাখতে পারে না সে। একটু রুক্ষ সুরেই বলে ওঠে, ‘‘তা হলে এত দিন পরে ফোন করার ইচ্ছে হল কেন?’’

‘‘সে অনেক কথা। আপনার শোনার মতো নয়।’’

‘‘হোক অনেক কথা। আপনি বলুন।’’ অভ্রনীলেরও জেদ চেপে যায়।

ভদ্রলোক একটু থেমে শুরু করেন, ‘‘গল্পটি আমাদের মতো মানুষের জীবন নিয়ে লেখা। ওটা আমার এত ভাল লেগেছিল যে কাগজটি আমি আমার বিছানার নীচে গুছিয়ে রেখেছিলাম।’’

আবারও ধাক্কা খায় অভ্রনীল। সে নিশ্চিত, লোকটির মাথার দোষ আছে। বিরক্ত হতে গিয়েও নিজেকে সামলে নেয়। ভদ্রলোক বলে চলেন, ‘‘মাস তিনেক আগে আমার নাতনি বাড়ি এসেছিল। বিছানা ঝাড়তে গিয়ে ও গল্পটি দেখতে পায়। আমি সেটি পড়েছি জেনে তার আনন্দ যেন আর ধরে না। বুঝতে পারি সেও গল্পটি পড়েছে।’’

অভ্রনীলের মনে হয় ভদ্রলোক তার নাতনির কথা বলতেই ফোন করেছেন। মেয়েটি নিজে বোধ হয় ফোন করার সাহস পায়নি। তাই দাদুকে দিয়েই ফোন করাচ্ছে।

অভ্রনীলের ভাবনা বাধা পায়। ভদ্রলোক বলে চলেন, ‘‘ও আমাকে জানায়, আপনার অনেক গল্প-উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছে। আপনার অনেকগুলো গল্পের বই ওর কাছে আছে। ও আপনার গল্পের বিরাট ভক্ত।’’

শেষ কথাটা ভাল লাগে অভ্রনীলের। ভক্ত কে না চায়! আর সে যদি মহিলা হয়, তা হলে ভাল লাগা এক লাফে অনেকটাই বেড়ে যায়। মুহূর্তে কল্পনার চোখে ভেসে ওঠে একটা সুন্দরী নারী-মুখ। হাস্যময়, বিস্ময়-মাখা চোখ। কিন্তু কল্পনা বেশি দূর গড়ায় না। ভদ্রলোক বলে চলেন, ‘‘মাসখানেক পর ও আমাকে আপনার পাঁচটা গল্পগ্রন্থ দিয়ে যায়। গত এক মাসে আমি সবগুলো পড়ে শেষ করেছি।’’

অভ্রনীল নির্বাক। সাহিত্যপ্রেমী না হয়েও এক জন তার সমস্ত গল্প পড়েছে! অনেক ভাগ্য করলে এমন পাঠক পাওয়া যায়। লোকটির প্রতি শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে আসে তার।

‘‘দিন কয়েক আগে আমার নাতনি আমাকে একটা তথ্য দেয়। ফেসবুক ঘেঁটেই তথ্যটা পেয়েছিল।’’

‘‘কী তথ্য?’’ জানতে চায় অভ্রনীল।

‘‘আপনার স্কুলের নাম।’’

‘‘ও! কিন্তু স্কুলের খবরে কী এসে যায়?’’

আমার বাড়ি ওই স্কুলের প্রায় কাছাকাছি বলতে পারেন। গত পরশু আমি ওই স্কুলে যাই। তবে এই যাওয়ার পিছনে আরও একটা কারণ ছিল। একটা পুরনো স্মৃতি মনে ভেসে উঠেছিল। যাই হোক, ওখানে বিভাস নামে এক জন স্যর আছেন, যিনি আপনার সময়ের।’’

স্যরের নাম শুনে উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে অভ্রনীল। ‘‘বিভাস স্যরের বয়স হয়ে গিয়েছে। কয়েক বছর পরে অবসর নেবেন। বিভাস স্যরের সঙ্গেও কোনও যোগাযোগ ছিল না। ফেসবুকের মাধ্যমে যোগাযোগ হয়েছিল। তার পর ফোনে কথাবার্তা।’’

ভদ্রলোক বলে চলেন, ‘‘বিভাসের কাছে জানতে পারি গল্পকার অভ্রনীল আর এই স্কুলের অভ্রনীল এক ব্যক্তি। ওঁর সঙ্গে আপনার নিয়মিত যোগাযোগ আছে। ওঁর কাছে আপনার নম্বর পেলাম।’’

‘‘ও!’’ নিজের স্কুল, বিভাসবাবুর প্রসঙ্গ ইত্যাদি আসায় সে নস্টালজিক হয়ে পড়েছিল। তার উপর বয়স্ক মানুষটি তার পরিচয় জানার জন্য স্কুলে ছুটে গিয়েছেন ভাবতেই মনটা অদ্ভুত এক ভাল লাগার রাজ্যে হারিয়ে যায়। কিন্তু তা ক্ষণিকের। সহসা একটা অস্ফূট কান্নার শব্দে চিন্তার জাল ছিন্ন হয়। কিছু বুঝে ওঠার আগেই ভদ্রলোক কান্নামিশ্রিত ক্ষীণ কণ্ঠে বলে ওঠেন, ‘‘বিভাস আমায় বলল, ‘স্যর আপনার ‘অপদার্থ’ আজ বিখ্যাত হয়ে গেছে।’’’

‘অপদার্থ!’ কিছু একটা যেন অভ্রনীলের বুকে জোর ধাক্কা মারে। পিছু ফেরা পথে স্মৃতির পাতায় এক ঝটকায় ফিরে যায় অনেকটা পথ। অনেক কিছু হারিয়ে গেলেও সেই স্মৃতি আজও স্পষ্ট।

অঙ্ক কোনও দিন মাথায় ঢুকত না অভ্রনীলের। বাকি বিষয়গুলোও যে ভাল ঢুকত তা নয়। ইংরেজি তো ঠিকঠাক উচ্চারণও করতে পারত না। তবুও সেগুলো কোনও রকমে পার হয়ে যেত। কিন্তু অঙ্ক যেন এক রহস্য ছিল তার কাছে। অঙ্কের জন্য স্যরের কাছে কত মার খেয়েছে তার হিসেব নেই। যাই হোক, দশম শ্রেণির হাফ-ইয়ার্লি পরীক্ষায় সে শূন্য পায়। শূন্য পাওয়ার নজির প্রথম নয়। এ বারের শূন্য পাওয়াটা হয়তো স্যর মেনে নিতেন, কিন্তু পারলেন না। কেননা অঙ্কের খাতায় অভ্র একটা গল্প লিখে এসেছিল।

ছোটবেলা থেকেই কবিতা, গল্প লেখার পাগলামি ছিল অভ্রর। তিন ঘণ্টা অঙ্কের পরীক্ষায় সময় কাটে না। ভাবতে ভাবতে মাথায় একটা প্লট এসে যায়। ব্যস, ওই দিয়ে ভরিয়ে ফেলে কয়েক পাতা। অঙ্কের স্যর ভবভূতিবাবু খুব কড়া মানুষ। অঙ্কের জায়গায় গল্প দেখে তাঁর মেজাজ যায় চড়ে। মনে হয় অভ্রনীল যেন তাঁকে অপমান করেছে। তাকে বেদম প্রহার করেন তিনি। অভ্রনীলের নামের সঙ্গে ‘অপদার্থ’ শব্দটি উপনামের মতো জুড়েছিল। তিনি তাকে ওই সম্বোধনেই বেশি ডাকতেন। কিন্তু সে দিন পিঠে লাঠি ভাঙার সময় ভবভূতিবাবু কত বার যে ‘অপদার্থ’ শব্দটি বলেছিলেন তার হিসেব নেই। শুধু লাঠি ভেঙে ক্ষান্ত হননি। পরদিন প্রার্থনার সময় সকল ছাত্রছাত্রীর সামনে তিনি তার কীর্তি তুলে ধরেন। সকলের হাসির পাত্র হয়ে ওঠে অভ্রনীল। কয়েক দিন পর আর স্কুলমুখো হয়নি সে। ওখানেই তার পড়াশোনার ইতি ঘটে।

ঘটনাটি মনে পড়তেই অভ্রনীল চমকে ওঠে। আবেগতাড়িত সুরে বলে, ‘‘স্যর, আপনি!’’

ও পাশের মানুষটা অস্ফুট কান্নার শব্দে কথা শেষ করতে পারে না। অভ্রনীল ‘স্যর, স্যর’ বলে ডাকতে থাকে। কিন্তু ভবভূতিবাবুর মুখে কোনও কথা নেই। কিছু সময় পর তিনি বলেন, ‘‘সারা জীবন ধরে আমি কেবল বইয়ের অঙ্ক করেছি। জীবনের অঙ্ক শিখতে পারিনি কোনও দিন। যে ছেলেটির খাতা সকলকে দেখিয়ে আমি তাকে উপহাসের পাত্র করেছি, যাকে এক প্রকার স্কুল ছাড়তে বাধ্য করেছি, বুঝতে পারিনি তার খাতার মধ্যে কী রত্নই না লুকিয়ে ছিল। অঙ্কের শিক্ষক হিসেবে আমার একটা সুপ্ত অহঙ্কার ছিল। এখন বুঝতে পারছি আমি নিজেই একটা অপদার্থ ছিলাম।’’

‘‘স্যর এমন কথা বলবেন না। সে দিনের কথা ভেবে নিজেকে ছোট মনে করবেন না। আপনি মোটেও অপদার্থ নন। আমিই অপদার্থ। সে দিন ছিলাম, আজও আছি।’’

ভবভূতিবাবু চুপ। অভ্রনীল বলে চলে, ‘‘আমি কোনও দিন অঙ্ক বুঝিনি। আজ পর্যন্ত কোনও দিন বোঝার চেষ্টাও করিনি। কিন্তু আপনি, কোনও দিন সাহিত্যকে পছন্দ না করেও আজ শেষ বয়সে এসে এই অপদার্থ ছেলেটির গল্প পড়েছেন। তার গল্প বোঝার চেষ্টা করেছেন। এ আমার কাছে বিরাট সম্মান। আপনার কত ভাল ভাল ছাত্রছাত্রী আছে। অঙ্কে খারাপ হওয়া সত্ত্বেও আপনার মনের কোণে যে ভাবেই হোক আমি ছিলাম। এর থেকে বড় প্রাপ্তি আর কিছু হতে পারে না। এই প্রাপ্তি আমাকে লেখার অনুপ্রেরণা জোগাবে।

কিছু ক্ষণ দু’জনেই চুপ। নীরবতা ভেঙে ভবভূতিবাবু বলেন, ‘‘একটা অনুরোধ করব? যদি কিছু মনে না করিস।’’ নিজের অজান্তেই ‘তুই’ সম্বোধনে নেমে আসেন ভবভূতিবাবু।

‘‘এমন করে বলবেন না। আপনি যা বলতে চান বলুন।’’

‘‘বয়স হয়ে গেছে। আর কত দিন বাঁচব জানি না। মরার আগে তোকে এক বার দেখতে ইচ্ছে করছে খুব।’’

নিজেকে আর ধরে রাখতে পারে না অভ্রনীল। তার দু’চোখ দিয়ে জলের ধারা গড়িয়ে পড়ে। জীবনের সর্বোচ্চ সম্মান প্রাপ্তির পর বোধ হয় মুখের ভাষা হারিয়ে যায়। নীরব অশ্রুই হয়ে ওঠে শ্রেষ্ঠ উত্তর।