Abosar

রজনীগন্ধার চারা

সোহিনী দাস

জলচৌকি ছেড়ে বাড়ির দাওয়ায় এসে বসেন স্নেহলতা। চারটে কুড়ির ট্রেন বেরিয়ে যায় ঝমঝম করে। রেল লাইনের ধারের বাড়ি কেঁপে-কেঁপে ওঠে। বুনো গন্ধ লাগে বিকেলে। বড় ভাল লাগে স্নেহলতার। 

স্বামী-শ্বশুরের পুরনো ভিটে। আজকাল আর তেমন কেউ আসে না বচ্ছর-পাব্বন ছাড়া। কেবল দিনভর ঝমঝম করে ট্রেন আসে-যায়...

বয়স বাড়ছে। ইদানীং চোখে তেমন ভাল দেখতে পান না স্নেহলতা। পায়ের ব্যথাটাও বেড়েছে। দিনরাতের ঝি রেঁধে-বেড়ে দেয়। ছেলেমেয়েরা ফোন করে, মাঝে-মাঝে এসে ঘুরেও যায়। কিন্তু কেউ আর থাকতে চায় না এখানে। অথচ স্নেহলতা চান, ও থাকুক, ওরা থাকুক। সকালে দাওয়ায় বসে ধান-চালের গল্প হোক দু’টো। চায়ের গন্ধ ছড়াক সকালময়... কয়েকটা মুড়ি এ-ধারে ও-ধারে খেলে বেড়াক ঘরদোরে।

স্নেহলতা বোঝেন, ওঁর সময় ফুরিয়ে আসছে। কিন্তু বড্ড মায়া তাঁর। এই ঘরদোর, জমানো ধানের গোলা, রান্নাঘর থেকে মুখ বাড়ানো পুকুর, বাড়ির পাশের ডোবায় জলপিপির ছানা— এ সব ছেড়ে যেতে হবে ভাবলেই বুকের ভিতর টনটন করে ওঠে তাঁর। ঠিক যেমন বিয়ে করে বাবার কাছ থেকে চলে আসার সময় বুকের ভিতরটা টনটনিয়ে উঠেছিল।

সেই কবেকার কথা। যে লোকটা বিয়ে করতে এসেছিল তাকে প্রথম দর্শনে একদম ভাল লাগেনি স্নেহর। বাবার আদরে মানুষ সে। পুতুলের বিয়ে দেওয়ার বয়স থেকেই সে জেনে এসেছে সুদর্শন রাজপুত্রদের কথা। বাবার কাছে আঁক কষতে আসা সুকুমারদাকেও তো দিব্যি লাগত তার। কিন্তু এ যে এক তালঢ্যাঙা তালপাতার সেপাই! বাবার সিদ্ধান্তের মুখে সেই সেপাইয়ের গলাতেই মালা দিতে বাধ্য হয়েছিলেন সেদিন।

ঠকেননি স্নেহলতা। বড় ভাল মানুষ ছিলেন অম্বরীশ। মুখ ফুটে না বললেও অম্বরীশের আশকারা ছিল স্নেহর সব বিষয়ে। বিয়ের পরপরই ধানবাদের সেই দিনগুলো আজও ছবির মতো লেগে থাকে স্নেহর চোখে। সেই ঝমঝম ট্রেন। সাদাকালো শহরের সিল্যুয়েট খালিচোখে আজও স্পষ্ট দেখেন স্নেহলতা।

কাঠকয়লা পোড়ার গন্ধ আসছে দূর থেকে। আগুনের গন্ধ। সন্ধে হয়ে আসছে। এক-এক দিন মাঝরাতে ঘুম ভেঙে যায়। উঠে জল খান। আর ঘুম আসতে চায় না। সারাটা রাত ভোরের জন্য ছটফট করতে থাকেন স্নেহলতা। যেন রাত্রি একটা বড় পাথর বসিয়ে দিয়েছে বুকের উপরে। দম বন্ধ হয়ে আসে তাঁর।

অথচ ধানবাদের সেই দিনগুলোয় রাতের জন্য মুখিয়ে থাকতেন স্নেহ। ভাত ফোটার গন্ধে ম-ম করত এক কামরার ঘর। অম্বরীশ ফিরে চারদিকের গল্প বলতেন। নতুন শহরের গল্প, রেললাইন, কতশত নতুন মানুষ।

গল্প শুনতে ভাল লাগত স্নেহর। অম্বরীশকে ক্রমশ একটা বিরাট আকাশ বলে মনে হত। বুকের ভিতর লুকিয়ে পড়লেই যেন রজনীগন্ধা ফুটে উঠবে এই এক্ষুনি, এখানেই।

গেল বছর রথের মেলা থেকে একটা রজনীগন্ধার চারা কিনে এনেছিল মালতী। দাওয়ার ঠিক পাশটায় পুঁতে দিয়েছিল। দু’-এক বেলা ছাড়া-ছাড়া জল দিয়েছেন, মাটি ঢেলেছেন, ভেজা চায়ের পাতাও দিয়েছেন বারকয়েক। কিন্তু ফুল ধরেনি এখনও গাছটায়। অথচ মাটি যে খারাপ, তা তো নয়। দিব্যি আম গাছে আম হয়েছে, জামরুল গাছটাতেও ফল ধরেছে।

তাঁর মনে আছে, বিয়ের অনেক বছর পরে তাঁর শরীর জুড়ে এসেছিল অনি। বড় ছেলে অনির্বাণ। কম সাধ্যসাধনা, কম মানত করেছিলেন স্নেহলতা! লোকজনের নানা কথা, টিপ্পনী। তার পর তো এক-এক করে অনিন্দিতা, অনিমিখ। ভাবতে-ভাবতে বুক জুড়িয়ে আসে তাঁর। আপনা থেকেই হাত চলে যায় রজনীগন্ধা গাছটায়। আদুরে হাত বুলিয়ে মনে-মনে বলেন, ‘‘আয় অনি, আয়।’’ 

তীক্ষ্ণ শব্দে কান বিঁধিয়ে আরও একটা ট্রেন চলে যায়— ঝমঝম ঝমঝম।

দাওয়া ছেড়ে উঠে পড়েন স্নেহলতা। কাপড় পাল্টে সন্ধে দেন মৃদু পায়ে। আগে ঘরের দরজায় জল ছিটোনোর স্বভাব ছিল তাঁর। এক বার পা পিছলে পড়েই সেই বিচ্ছিরি কাণ্ড... তবু অভ্যেসবশত হাতখানা ভেজান স্নেহলতা।

বয়স হলে সব কথা আর ঠিক মনে পড়ে না, কত কী যে দিনরাত ভাবেন। শিউলি ফুলের গন্ধ মনে পড়ে। ছোটবেলার বান্ধবী। মনে পড়ে সুকুমারদাকেও। কিন্তু মাকে কিছুতেই আর ঠিক করে মনে পড়ে না স্নেহর। শুধু একটা হলুদমাখা শাড়ি আর ঘামগন্ধ মিশে যায়। 

উঁহু, শিউলি ফুলের গন্ধটা কিছুতেই আর আলাদা করতে পারেন না স্নেহলতা। অস্থির লাগে। মুখে আলতো জলহাত বোলান।

রাত যত বাড়তে থাকে, তত বেশি একা লাগে তাঁর। রাগ হয় অম্বরীশের উপরে। তার চেয়েও যেন বেশি অভিমান হয় তাঁর ওই রজনীগন্ধা চারাটার উপর।

ভোর থাকতেই উঠে পড়েন স্নেহলতা। অনেক দিনের অভ্যেস। ভোরের গন্ধখানা ভারী ভাল লাগে তাঁর। লাঠিটা হাতে নিয়ে বেরিয়ে পড়েন বাড়ির বাইরে। ধীর পায়ে হাঁটেন। পাখির কিচমিচ। বুক ভরে অনেকটা নিঃশ্বাস নেন। সদ্য-ফোটা জবার কুঁড়িতে কুঁচকে যাওয়া হাত রাখেন। আঙুলে শিশির লেগে যায় তাঁর। কী মনে হয়... কুঁড়িটাকে আঁচল দিয়ে আলতো করে মুছে দিতে যান স্নেহলতা। যেন কান্না মুছছেন। অসাবধানে চাপ বেশি পড়ে যায় কি! অল্প ভারেই ঝরে যায় কুঁড়িটা মাটিতে। অপরাধবোধে কুঁকড়ে যান স্নেহলতা। সারা শরীর তেতো হয়ে ওঠে। এ স্বাদ তাঁর অনেক দিনের চেনা।

দ্রুতপায়ে ঘরে ফিরে আসেন স্নেহলতা। রাস্তার মাঝখানে পড়ে থাকা এক আধলা ইটে ধাক্কা খান। ‘‘উফ্ফ!’’ করে ওঠেন তবু হাঁটা থামান না। কোনও মতে হাঁপাতে-হাঁপাতে বাড়ির দাওয়ায় এসে বসেন। টনটন করতে থাকা পায়ের দিকে তাকিয়ে দেখেন জমাট বাঁধা রক্ত কিছুটা। আঙুল ছোঁয়ান জখমে আর আলতো হাসেন। হাওয়া দেয়। রজনীগন্ধার চারা  মাথা নাড়ায়।

মালতী আসতে-আসতে সাড়ে ন’টা। তার মানে এখনও ঘণ্টাখানেক সময় আছে হাতে। বাড়ির সব কাজই সামলায় মালতী। দোষের মধ্যে বড্ড বকবক করে মেয়েটা, মাঝে-মাঝে বকুনি দিয়েও কাজ হয়নি। হাল ছেড়ে দিয়েছেন স্নেহলতা। নানা বাড়ির নানা কথা, এসেই গল্পের ঝুড়ি খুলে বসে সে। কিন্তু সে সব অধিকাংশই কানে ঢোকে না স্নেহলতার। তত ক্ষণে কত কথা ঘুরপাক খায় তাঁর মাথায়। সারা দিন ভাবনা ছাড়া কি কাজ নেই কোনও তাঁর! আবার কিছু একটা ভাবনায় ডুবতে যাবেন কি... ফোনটা বেজে উঠল।

এই হয়েছে এক জ্বালা। এক রকম জোর করেই মোবাইল কিনে দিয়ে গিয়েছিল অনিন্দিতা। কাছে না হলেও খুব দূরেও থাকে না মেয়ে। মাঝে-মাঝে মায়ের কাছ থেকে ঘুরে যায়। সময়-সুযোগ মতো জামাই শুভায়ুও আসে। ফোন তো লেগেই আছে সারা দিন। স্নেহলতাকে অনেক বার নিজের কাছে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছে মেয়ে। যাননি স্নেহলতা।

ছেলে অনিমিখ বরং বরাবরই আপনভোলা গোছের। কোনও কিছু নিয়ম করে করা ধাতে নেই ওর। ইচ্ছে হলে ফোন করে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা বলবে, আবার নয় তো নয়। তবে রঞ্জু মনে করে নিয়মিত ঠিক ফোন করে বেঙ্গালুরু থেকে। শাশুড়ির শরীরের খবর নেয়। ওষুধ খেয়েছে কি না জানতে চায়। বড় ভাল লাগে মেয়েটাকে তাঁর। স্নেহলতা জানেন, অনিমিখের সব অভাব পূরণ করে দিতে পারবে ওই মেয়েই, তিনি যা পারেননি কোনও দিন।

ফোনটা বেজেই চলেছে। পা-টা জ্বালা করছে তাঁর। খুঁড়িয়ে-খুঁড়িয়ে গিয়ে ফোনটা ধরেন। অনিন্দিতা রোজকার মতোই মায়ের খবর নেয়। এটা-সেটা বলে। স্নেহলতা ছটফট করেন, সকাল থেকে আজ রজনীগন্ধার চারায় জল দেওয়া হয়নি।

দু’-তিনটে নতুন পাতা এসেছে রজনীগন্ধা গাছটায়। চৈত্রের শেষ। রোদ্দুরে তাপ লেগেছে বেশ। সে-সবে পাত্তা না দিয়েই দাওয়ায় গিয়ে বসেন স্নেহ। পাতা দুটো স্পর্শ করতে গিয়েও থমকে যান। রোদ্দুরে ম্লান হয়ে যায় স্নেহলতার মুখ। 

মালতী খ্যাচখ্যাচ করে, “আমারই ভুল হয়েছে গাছটা এনে। দিন নেই, রাত নেই... গাছ নিয়ে পড়ে আছে। নাওয়া নেই, খাওয়া নেই...বলি কত বেলা হল খেয়াল আছে! উঠবে তো না কি... দুটো মুখে দাও। ওষুধ খেতে হবে না!’’

ট্রেনের সাইরেন এসে ঢেকে দেয় স্নেহলতার কান। কিচ্ছু শুনতে পান না স্নেহলতা, কিছু শুনতে চানও না।

আগে দুপুরের দিকে একটু গড়িয়ে নিতেন স্নেহ। আজকাল আর তাঁর ঘুম আসে না। পায়ের কাটা আঙুলটার দিকে তাকাতেই ঝরে যাওয়া কুঁড়িটার কথা মনে পড়ে যায় তাঁর। এক কষ্ট কত বার আর! সারা শরীর যন্ত্রণায় কুঁকড়ে ওঠে। 

বেলা গড়িয়ে যায়। বিছানা থেকে উঠতে পারেন না স্নেহলতা। শীত করে। বুকের ভিতরটা খাঁ-খাঁ করে তাঁর। বিছানা হাতড়ে চাদরটা টেনে নেন বুকের কাছে। অম্বরীশের কথা খুব মনে পড়ছে তাঁর। শীত করছে খুব। তাঁর শুকিয়ে দড়ি হয়ে যাওয়া বুক দু’টো টনটন করে উঠছে। শিরশির করে উঠছে বৃন্ত দুধের ভারে। জ্বর বাড়ছে। অম্বরীশের উষ্ণ হাত তাঁর মাথায় বিলি কেটে দিচ্ছে, স্পষ্ট টের পাচ্ছেন স্নেহলতা। বলছে, “আমরা আবার পারব স্নেহ, তুমি দেখো ঠিক পারব আমরা।” 

নদীর পাশে গিয়ে দাঁড়াচ্ছেন তাঁরা। জলে ভেসে যেতে দেখছেন জবাফুলের সেই কুঁড়িটা। 

কেন সে দিন সন্ধে দিতে গিয়ে জল ছিটিয়ে ছিলেন ঘরময়... পা-টা পিছলে গিয়েছিল হঠাৎ। হাত থেকে ছিটকে গিয়ে ছোট্ট তুলতুলে শরীরটা দেওয়ালে ধাক্কা খেয়ে...! সারা শরীরটা ভয়ে, অবোধ্য এক যন্ত্রণায় শিউরে ওঠে স্নেহলতার। কেন জবার কুঁড়ি থেকে মুছতে গেলেন কান্না। না হলে তো..

ধানবাদ ছেড়ে কোনও দিনই আসতে চাননি স্নেহ। অম্বরীশ ভেবেছিলেন, শহর পাল্টালে হয়তো ঘটনাটা ভুলতে পারবেন তিনি। মাত্র কয়েকটা সপ্তাহ থাকল ছেলেটা। কষ্ট কি কিছু কম পেয়েছিলেন অম্বরীশ!  বুঝতে দেননি স্নেহকে। মনে-মনেও দোষারোপও করেননি কোনও দিন। কিন্তু কিচ্ছু ভোলেননি স্নেহলতা। ভুলতে পারেননি এক মুহূর্তও।  বঞ্চিত করেছেন ছেলে-মেয়ে দু’টোকেও। অম্বরীশ পারেননি স্নেহকে ভোলাতে কিছুই। রজনীগন্ধার গন্ধের জন্য ছটফট করেছেন স্নেহলতা আজীবন।

শরীর জুড়ে তাপ টের পাচ্ছেন স্নেহ। একটা ধুকপুকে হৃদয়,  শরীরে লেপ্টে থাকা আর-একটা শরীর, নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস, জোরালো দুধের গন্ধ... খুব কষ্ট করে জ্বোরো শরীরটাকে টেনে-হিঁচড়ে দাওয়ায় নিয়ে গেলেন স্নেহলতা। যন্ত্রণায় ফেটে যাচ্ছে, মাথাটা আস্তে করে রজনীগন্ধা গাছটার গায়ে হেলিয়ে দিলেন স্নেহ। আহ, সুগন্ধ! কবে থেকে এই গন্ধের কাছে পৌঁছতে চেয়েছেন স্নেহলতা। আরামে চোখ বুজে আসে তাঁর।

পরদিন অনেক দেরিতে ঘুম ভাঙে স্নেহলতার। এত বেলা করে কোনও দিনও ওঠেন না তিনি। গতকালের কথা ভাল মনে নেই। মালতী দুধ-রুটি নিয়ে এসেছে। খিদে পেয়েছে স্নেহলতার। দুধ-রুটি খেয়ে দু’টো ওষুধ খেয়ে নিতে বলে মালতী। বলে,  “যাও গিয়ে দেখো, স্টিক এসেছে তোমার রজনীগন্ধা চারায়।”

অল্প হাসেন স্নেহ। শুকিয়ে যাওয়া বুকে হাত দেন পরম তৃপ্তিতে। তার পর দুর্বল পায়ে আলমারির দিকে এগিয়ে যান। চাবি ঘুরিয়ে লকারের ভিতর থেকে বার করে আনেন একটা জং-ধরা নারকোল তেলের টিন। বুড়িয়ে যাওয়া হাতে পরম মমতায় বের করে আনেন তুলোয় মোড়া, শুকিয়ে যাওয়া এক টুকরো নাভি... ঠোঁট ছোঁয়ান। মাটি ঝুরঝুর করে। রজনীগন্ধার গন্ধ ম-ম করে ওঠে... 

ডুকরে কেঁদে ওঠেন স্নেহলতা — “অনি...”

হুইসেল বাজিয়ে আরও একটা ট্রেন চলে যায়।