একটু দেরিই হয়েছে। রাত প্রায় ন’টা। কালও রিয়া বলেছিল, তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে। হয়নি। আজও হল না। বাড়িতে ঢুকে চমকে গেল বিনোদ। হাসিহাসি মুখে এ কে দরজা খুলছে? না, রিয়াই তো। হলুদ জরিপাড় তাঁতের জমকালো শাড়ি, খোলা চুলের আলগা বাহার, ঠোঁটে গাঢ় লাল লিপস্টিক, কানে লম্বা ঝোলা দুল, গভীর ভাবে পিঠ কাটা লাল ব্রোকেডের ব্লাউজ! সব মিলিয়ে একদম অন্য রকম! নিজের বৌয়ের দিকেই হাঁ করে চেয়ে রইল বিনোদ।
বাড়ির ভিতরে ঢুকতেই মুচকি হেসে রিয়া বলল, “এনি ড্রিঙ্কস্?”
ভালরকম ঘাবড়ে গেল বিনোদ! চোখেমুখে হয়তো সেটা ফুটে উঠে থাকবে। তবু নিজেকে এক ঝটকায় সামলে নিয়ে বলল, “না, লাগবে না। কিন্তু তুমি কোথাও যাচ্ছ?”
খুব আস্তে, নরম গলায় রিয়া বলে, “এখন? কোথায় আবার যাব? তুমি তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে এস। আমি খাবার গরম করছি।”
বাথরুমে ঢুকেও স্বস্তি পাচ্ছিল না বিনোদ। হাল্কা রবীন্দ্রসঙ্গীতের সুর কানে ভেসে আসছিল। না, টিভিতে নয়। মিউজ়িক সিস্টেমেই বাজছে। ভারী অদ্ভুত কাণ্ড ঘটছে আজ! এ সময়ে রোজ গমগম করে টিভি চলে। অফিস থেকে ফেরার পর দরজাটা কোনও রকমে খুলে দিয়েই ভিতরে চলে যায় রিয়া। হাতের রিমোটে একের পর এক চ্যানেল ঘোরাতে ঘোরাতে ওকে উদ্দেশ্য করে, প্রতিদিন প্রায় একই বাক্য ছোড়ে।
“আমার খাওয়া হয়ে গিয়েছে। মিঠিও খেয়ে নিয়েছে। তোমার খাবার টেবিলে ঢাকা আছে। খাওয়া হলে বলো, জায়গাটা পরিষ্কার করে নেব।”
তার পর যত ক্ষণ ওর প্রিয় সিরিয়াল চলে, কোনও সাড়াশব্দ পাওয়া যায় না। বিনোদ ঘুমিয়ে যাওয়ার পর রিয়া বিছানায় ঢোকে, আবার ঘুম থেকে ওঠার আগে বিছানা ছাড়ে। কোনও কথাই হয় না। স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক এখন তলানিতে এসে ঠেকেছে।
আর আজ! খাবার টেবিলে ফুলদানিতে রজনীগন্ধা। এই ফুলের চেনা মিষ্টি গন্ধে উৎসববাড়ির আবহ তৈরি হয়েছে। তবে কি আজ ওদের বিবাহবার্ষিকী? না, তাও তো নয়। এখন তো শীত। ওদের বিয়ে তো বর্ষাকালে হয়েছিল। তবে? কী হল হঠাৎ? বাড়ি, বাড়ির মালকিন এ ভাবে পাল্টে গেল কেন? ‘আশ্চর্য প্রদীপ’ -এর দৈত্যটা এ বাড়িতে উপস্থিত হয়েছে না কি?
*****
এই তো একটু আগেই বাথরুমটাকে চিনতে পারেনি ও। মেঝে, দেওয়ালের টাইল্স নিখুঁত বাসনের মতো পরিষ্কার দেখাচ্ছে। কলগুলোও তো বদলে গিয়েছে মনে হচ্ছে। অন্য দিন বাথরুমটা নোংরা হয়ে থাকে। বাথরুমের রডে ঝুলছে বিয়ের তত্ত্বে পাওয়া সেই নীল তোয়ালেটা। ওটা সব সময় রিয়ার আলমারিতেই তোলা থাকত। অন্য দিন বাথরুমে ঢুকলেই চোখে পড়ে রিয়ার ম্যাক্সি বা শায়া বালতিতে ডোবানো। রঙ জ্বলে যাওয়া গামছাটা জড়ো হয়ে ঝুলছে। আজ সে সবের বালাই নেই।
বিনোদ বাইরে বেরোতেই রিয়া আবার সামনে এসে দাঁড়াল। ‘‘শোনো, তোমার পোশাক বেডরুমে দেওয়া আছে। পাল্টে চলে এস। আমি খাবার গরম করে টেবিলে সাজাচ্ছি। ”
বেডরুমের দরজার পিছনে লাগানো রডে, এক সেট সাদা ধবধবে পাজামা-পাঞ্জাবি সাজানো। গায়ে পাউডার ঢেলে পাঞ্জাবিটা গলাতে গলাতে ও একটু অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছিল। সাদা চিকনের পাঞ্জাবিটা বাড়িতে পরবে বলে শখ করেই কিনেছিল। তা রিয়া পরতে দিলে তো! সব সময়েই বলে, “ওটা কোনও অনুষ্ঠানে পরো। বেশি কাচলে সাদা রঙ ম্যাটমেটে হয়ে যায়। ”
চিন্তায় বেশ মগ্ন হয়ে গিয়েছিল বিনোদ। হঠাৎ চটকাটা ভাঙল। কোন সাতসকালে বেরোতে হয় ওকে। দোকান–বাজার, মেয়ের স্কুল, পড়তে যাওয়া, নাচের ক্লাস, সাঁতারের ক্লাসে যাওয়া-আসা, সব কিছু রিয়াই দায়িত্ব নিয়ে করে। তাই বোধ হয় এ রকম অদ্ভুত আচরণ করছে। মানে এ ভাবেই প্রতিশোধ নিচ্ছে। প্রতিশোধেরও রকমফের আছে তো!
*****
খাবার টেবিলে চামচ ডোবানো কাচের বাটিতে সুপ পরিবেশন করা হয়েছে। এই শৌখিন সুপের সেটটাও তোলা থাকে। শেষ কবে দেখেছে, মনে করতে পারে না বিনোদ। একদম নিখুঁত ব্যবস্থা। টেবিলে সাজানো নানান রকমের ফল। বিনোদ ফল খেতে ভালবাসে। রিয়া ফল মুখেও তোলে না। মিঠি শুধু কলা খায়। তাই এত দিন ওদের বাড়িতে ফল বলতে শুধু কলা আসত। আজ ফলদানি উপচে পড়ছে আঙুর, আপেল, পেয়ারা, বেদানায়! বিয়েতে অফিসের বন্ধুরা কাচের ডিনার সেট দিয়েছিল। আজ সেটাই টেবিলে শোভা পাচ্ছে ।
বিনোদ কত বার বলেছে, “শুধু অতিথিদের জন্য ডিনার সেটটা বার কর কেন? এক-আধ বার আমরাও তো খেতে পারি। ”
কিন্তু রিয়া কথা শোনেনি। এত দিনে ওর কথা রেখেছে। এর পিছনে কি বিশেষ কোনও কারণ আছে? হয়তো কালই কাগজে বেরবে, ‘বিষক্রিয়ায় স্বামী–স্ত্রীর মৃত্যু।’ এ রকম আচরণের অর্থ কী?
হঠাৎ ভোল পাল্টে রিয়া ভাল মানুষ হয়ে গিয়েছে, ওর সব কথাই শুনছে। এতেই তো সন্দেহ হচ্ছে বিনোদের। এত দিন তো পুরোটাই উল্টো ছিল।
টেবিলে সাজানো ন্যাপকিন হাঁটুর উপর পেতে নিয়েছে বিনোদ। ব্যাপারটা খুব নাটকীয় লাগছে। তবু রিয়ার নির্দেশের মান রাখছে। সত্যি সত্যি রহস্যটা হজম করা যাচ্ছে না। কৌতূহলে ফেটে পড়লেও চুপ করে আছে বিনোদ। ক’দিন ধরেই মেয়ে মিঠি মামার বাড়িতে আছে। না হলে ওর কাছেও কিছু জানা যেত। এখন তো সবই ধরা-ছোঁওয়ার বাইরে।
ডাইনিং টেবিলে রাখা হাবিজাবি জিনিসগুলো আজ আর চোখে পড়ছে না। টানটান করে পাতা সাদা টেবিলক্লথের উপর বড় বড় বোলে একের পর এক খাবারের পদ সাজানো হয়েছে। মেনুটা বেশ আকর্ষণীয়। সুপ, স্যালাড, রুটি, চিকেন রেজ়ালা, পুডিং... বেশি না ভেবে খাওয়ায় মন দেয় বিনোদ। উল্টোদিকের চেয়ারে বসেছে রিয়া। খুব ইচ্ছে করছিল বিনোদের, মোবাইলে পুরো পরিবেশটার একটা ছবি তোলে। নিজেদের খাবার ঘরটাকেই রেস্তরাঁর মতো লাগছে তো! ফেসবুকে ছবিটা পোস্ট করে সবাইকে বেশ চমকে দেওয়া যেত।
রিয়া খেতে খেতেই পরিবেশন করছে। ওকে এখন একদম বিরক্ত করা যাবে না। ফলে কথায় কথায় বিষয়টা জানার সুযোগও হারিয়েছে ও। একটু উসখুস করছিল। রিয়া ভ্রু তুলে মধুর কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল, “এনি প্রবলেম ?”
“নো, নো, সার্টেনলি নট,” বলে হাসিমুখে সবটা এড়িয়ে গেল বিনোদ।
রাতে শুতে এসে আবার চমক! ড্রেসিংটেবিলের সামনে বসে ক্রিম মাখছে কে? ‘সিন্ডারেলা’! গোলাপি লেসের নাইটিতে রিয়াকে তো চেনাই যাচ্ছে না। মনে হচ্ছে দশ বছর বয়স কমে গিয়েছে।
শোওয়ার ঘরেও আলাদিনের পিদিম কাজ করেছে। একটা বড় কাচের পাত্রে জল, তার মধ্যে বেলফুল ভাসছে। গন্ধে ভুরভুর করছে সারা ঘর। বারান্দার খোলা দরজার ও পারের আকাশে চাঁদ। হাওয়ায় পর্দা উড়ছে। মনে মনে বিনোদ গুনগুন করে, “আজ জ্যোৎস্নারাতে সবাই গেছে বনে।”
সমুদ্রের মতো নীল চাদরের উপর গড়িয়ে গিয়ে, ঘরের সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে, নিজেকে বোঝায়, আবেগে ভাসলে চলবে না। এই রহস্যের মর্ম উদ্ধার করতেই হবে। একটা ‘কেন’ ওকে অস্থির করে তুলেছে। কথা না বাড়িয়ে, বিছানা থেকে উঠে রাতের ওষুধগুলো পটাপট গিলে নেয়।
চোখ বুজে প্রায় ঘুমিয়েই পড়েছিল। হঠাৎ পায়ের উপর হাতের স্পর্শে ঘুম চটকে যায়।
কী আশ্চর্য! রিয়া! পায়ের উপর হাত বোলাচ্ছে। পনেরো বছর আগে, পঁচিশ বছরের রিয়া, এ ভাবেই রাতে পা টিপে দিয়েছে তো। তার পর অনেক দিন এ সব হয়নি। বরঞ্চ সারা দিন খাটাখাটুনির পর রিয়ার পা কামড়ালে, ওকেই মাঝে মাঝে রিয়ার পা টিপে দিতে হয়। পা ছেড়ে রিয়ার হাত এখন চুলে, কপালে ঘুরছে। ঘাড়ের ব্যথাটায় বড্ড আরাম লাগছে! চোখ বুজে ফেলে বিনোদ। কিন্তু না, ঘুমোলে চলবে না। ওকে জানতে হবে রহস্যটা।
*****
শেষ পর্যন্ত ভয়ে ভয়ে রিয়াকেই জিজ্ঞেস করে, “ব্যাপার কী? এমন করছ যে! কোনও কিছু...”
“দূর! কী আবার করলাম?”
“কেন? বাড়িটার ভোল পাল্টেছে। তুমি নিজেও তো... এত সেবা-যত্ন করছ!”
মিষ্টি হেসে রিয়া আশ্বস্ত করে, “এ বার থেকে আমরা এ রকমই থাকব লক্ষ্মীসোনা।”
আঁতকে উঠে বিছানায় বসে পড়ে বিনোদ। “কী বললে? লক্ষ্মীসোনা! তোমার মাথা খারাপ হয়েছে। কই আগে তো এমন লক্ষ্মীসোনা বলোনি। তা হলে এখন কেন ডাকবে!”
“না ডাকিনি। তবে শুরু তো করাই যায়। তাতে দোষ কী? লজ্জায় মাথা নিচু করে হাসে রিয়া।”
“কেন? কী ঘটল যে হঠাৎ এত দিনের অভ্যেস উল্টেপাল্টে দেবে? আজ তো টিভিও দেখছ না। এ সবের মানে কী?”
“মানে একটাই। ভাল জিনিস দেখে দেখে শিখছি। টিভিতে একটা নতুন সিরিয়াল শুরু হয়েছে। ‘রঙ্গিণী’। ওই সিরিয়ালেই তো দেখলাম। কী সুন্দর করে ঘর সাজিয়ে রেখেছে। স্বামী ঘরে আসতেই, বৌ সুন্দর করে খাবার পরিবেশন করে দিল। গোটা বাড়ি ফুল দিয়ে সাজানো। আমারও ইচ্ছে হল, আমিও করে ফেললাম। আমাদের বাড়িটা তো বেশ আধুনিক ডিজ়াইনের। সাজালে-গোছালেও মন্দ লাগে না। তাই সারা দিন ধরে মনের মতো করে সাজিয়েছি। ঠিক যেমন ‘রঙ্গিণী’-তে দেখেছি!”
হঠাৎ উৎসাহে বুকের উপর ঝুঁকে রিয়া বলতে থাকে, “জানো, ‘রঙ্গিণী’ সিরিয়ালের নায়িকা কাকলি, খুব পটু। চাকরি, রান্না, বাজার-হাট সব একাই সামলায়। চোখে-মুখে কোনও ক্লান্তি নেই। সব সময় সেজেগুজে ফিটফাট থাকে। আমার তো চেহারাটা নিয়েই সমস্যা। ও রকম স্লিম তো নই। যতই সাজি, ওর মতো দেখাবে না।” কথা শেষ করে দীর্ঘশ্বাস ফেলল রিয়া।
সব শুনে রীতিমতো মাথায় হাত বিনোদের। হাত তুলে বলে, “আমি বলছি, একদম না। তোমাকে ‘কাকলি’ হতে হবে না। ওই সব সুন্দরীরা টিভিতেই ভাল। আর ওই সব কায়দা চালু করতে হলে বাড়িটা বাড়িই থাকবে না। আমি তো আজ এসে থেকে অস্বস্তিতে ভুগছি। মনে হচ্ছে কোনও সিনেমার সেটে ঢুকে পড়েছি। ভীষণ কৃত্রিম লাগছে সব।”
রিয়া হাঁ করে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে আছে দেখে বিনোদ আবার বলে, “কাল অফিস থেকে ফেরার আগে সব আবার আগের মতো করে ফেলবে বুঝলে!’’ কথা শেষ করে রিয়ার ঘাবড়ে যাওয়া মুখে, টুকুস করে একটা চুমু খায় বিনোদ। ‘‘যাও, এ বার একটু ঠান্ডা জল দাও তো।”
জলের গ্লাস এগিয়ে দিতে দিতে হেসে ফেলে রিয়া। “ও মা, তুমিও ‘রঙ্গিণী’ দেখছ না কি? না, মানে, ...ওখানেও শেষ সিনে এ রকম চুমু- টুমু থাকে তো!”