Abosar

মনের কোণে

অনির্বাণ বসু

সন্ধেবেলায় স্কুলের পড়া পড়তে পড়তেই হঠাৎ নিজের সদ্য কেনা মোবাইল চেক করে চেঁচিয়ে উঠল রিঙ্কি, “ইয়েস! আমার এই পোস্টটায় থার্টি টু-টা লাইক পড়েছে!”

মেয়ের পাশেই বসে ছিল তপতী। হাতে নিজের মোবাইল। চমকে উঠে মেয়ের দিকে ফিরে বলল, “দিলি তো আমার মেসেজ পাঠানোর বারোটা বাজিয়ে? তোর চেঁচানির চোটে হ্যাপিদা পাঠাতে গিয়ে হ্যাপি বার্থডে চলে গেল। এখন সমা কী মনে করবে? কত বার বলেছি না, পড়ার সময় মোবাইল সাইলেন্ট রাখতে?”

“সাইলেন্টই রেখেছি, কিন্তু আমি ঠিক শুনতে পেয়েছি!” উজ্জ্বল দেখায় রিঙ্কির মুখ।

মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে আর কিছু বলতে পারল না তপতী। রিঙ্কির জন্ম ওদের বিয়ের সাত বছর পর। তাই একটু বেশিই আদরের। লেখাপড়ায় ভাল, কিন্তু মোবাইলের পোকা। আগে ওর বা অনিমেষের মোবাইল নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করত। অনেক বোঝানো সত্ত্বেও কিছুতেই যখন শুনল না, তখন মোবাইল দিতে হল। তবে এটা নিয়ে যে এত বাড়াবাড়ি হবে, সেটা আন্দাজ করা যায়নি। রিঙ্কি যেন সারা ক্ষণ মোবাইলের সঙ্গে লেপ্টে থাকে। এটা শরীরের পক্ষে যে কতটা খারাপ, সেটা বোঝালেও মানতে চায় না। লেখাপড়ায় ব্যাঘাত ঘটবে বলে ঠিক করা হয়েছিল, পড়ার সময় মোবাইল সাইলেন্ট থাকবে। তপতীও বরাবরের মতোই পড়ার সময় রিঙ্কির পাশেই থাকবে। কিন্তু এতে কাজ কিছু হচ্ছে বলে তো মনে হচ্ছে না। বেশি কিছু তো বলাও যাবে না ছেলেমেয়েদের, যা সব কাণ্ড হচ্ছে আজকাল! এই তো কিছু দিন আগে অনিমেষের এক সহকর্মীর ছেলে মেট্রোয় সুইসাইড করতে গিয়েছিল। খোলসা করে আর কারণ জানতে পারেনি অনিমেষ, তবে ছেলেটি রিঙ্কিরই বয়সি।

তাড়াতাড়ি ঠিকঠাক মেসেজ পাঠিয়ে তপতী দেখল, রিঙ্কি আবার পড়তে শুরু করে দিয়েছে। যাক তাও ভাল। তবে এটা নিয়ে কথা বলতে হবে অনিমেষের সঙ্গে। এখন নয়, ও অফিস থেকে ফিরে আসার পর। শুধু শুধু এই কারণে অফিসে ফোন করার কোনও মানে হয় না। এমনিতেই অফিসে যা কাজের চাপ…

এই রে! ঠিক যে ভয়টা পেয়েছিল তপতী, সেটাই হয়েছে।

তার দুটো মেসেজই দেখেছে সমা, কারণ দু’টো নীল টিক মার্ক পড়েছে, কিন্তু রেসপন্ড করেনি। সমার বরের ভাল নাম থাকলেও, ওর ডাক নাম হ্যাপি ওদের খুব পছন্দ। ওর শরীর ঠিক যাচ্ছে না, তাই ওর নামে একটা ‘গেট ওয়েল সুন’ মেসেজ পাঠিয়েছিল তপতী। বোঝাই যাচ্ছে, ‘গেট ওয়েল সুন হ্যাপিদা’-র বদলে ‘গেট ওয়েল সুন হ্যাপি বার্থডে’ চলে যাওয়ায় সমা নির্ঘাত চটেছে। এমনিতে সমা ভীষণ প্রম্পট, মেসেজ পাঠালে সঙ্গে সঙ্গে রিপ্লাই করে। এ বার কিন্তু একেবারে চুপ। এমনিতে প্রবলেম ছিল না, কিন্তু হ্যাপিদা আবার অনিমেষের সিনিয়র কোলিগ। ইস! মেয়েটা যদি তখন ও রকম না চেঁচাত…

“আরে! আবার একটা লাইক!” আবার চেঁচিয়ে উঠল রিঙ্কি।

“তোর লাইকের ঠেলায় আমি ডিসলাইকড হয়ে গেলাম,” আর থাকতে না পেরে রেগেমেগে বলে উঠল তপতী।

“কই দেখি! ডিসলাইক-এর ইমোটিকন?” রিঙ্কি ভারী এক্সাইটেড।

“ডিসলাইক কি দেখা যায় না কি? এটা বোঝা যায়।”

“তা হলে ওটা কিছু নয়। দেখা যাচ্ছে না তো…” মায়ের কথাটাকে একেবারে ডিসমিস করে দিয়ে নিজের পড়ায় ফিরে গেল রিঙ্কি।

কী দিনকাল পড়ল, ভাবল তপতী। আজকাল ইমোটিকন না দেখতে পেলে সেটা আর ইমোশনই নয়। আবার শুধু নিজে দেখলে হবে না, অন্যদেরও বুক ফুলিয়ে দেখানো চাই। ভাবটা এমন, ‘আমায় দেখো! আমার ইমোশন দেখো!’

রাত সাড়ে ন’টা নাগাদ সে সুযোগ পেল অনিমেষের সঙ্গে কথা বলার। ব্যাপারটা বলতেই অনিমেষ বলল, “সমা হয়তো হ্যাপিদাকে নিয়ে ব্যস্ত।”

“তা হলে হ্যাপিদার বাড়াবাড়ি হয়নি তো?”

“না বোধহয়, সে রকম হলে খবর পেতাম নিশ্চয়ই।”

“তুমি একটু খবর নিয়ে দেখবে?”

“আমি? কেন?”

“না মানে…”

“তোমার মোবাইল মেসেজিং-এর ঝামেলায় আবার আমি কেন?” নিজের মোবাইল সার্ফ করতে করতে বলল অনিমেষ।

‘আমার মোবাইল মেসেজিং!’ মনে মনে ভাবল তপতী। খুব বিরক্ত হল সে। অনিমেষের কাছ থেকে আর কোনও প্রতিক্রিয়া না পেয়ে অধৈর্য হয়ে বলল, “তুমি তোমার মোবাইল ঘাঁটা একটু থামাবে?”

“কেন, আমি থামাব কেন?” অনিমেষ বেশ বিরক্ত, “তুমিও তো থামাও না। আমি করলেই দোষ, আর তুমি করলে…”

“তোমরা থামবে?” রিঙ্কির গলা ভেসে এল তাদের কথোপকথনের মাঝেই, “শুধু শুধু আমি-তুমি করছ কেন? একটু চিল করো না প্লিজ় যে যার মোবাইলে।”

মোবাইলে চিল? আর কত কী হবে মোবাইলে?

রাতে, প্রায় আধঘুমন্ত অবস্থায় তপতীর খেয়াল হল যে, রিঙ্কির ব্যাপারটা নিয়ে আর কোনও আলোচনা করা হয়নি।

**

পরের দিনও সমা নিশ্চুপ। কী করা যায়? এক বার ফোন করে দেখবে না কি? থাক, দরকার নেই। বরং, দিনের শেষে একটা ভাল ছবিওয়ালা মেসেজ ফরোয়ার্ড করে দিলেই হবে। মোবাইল যেমন ফট করে কারও কাছে পৌঁছে দিতে পারে, তেমনি দুম করে একেবারে অফ করে দিতে পারে কারও কাছ থেকে। খুব ডেলিকেট। নাঃ, মোবাইলটা চার্জে বসাতে হবে। চার্জারটা খুঁজে পেল না সে। গেল কোথায় সেটা? কিছু ক্ষণ খোঁজাখুঁজির পর না পেয়ে বাড়ির কাজে লেগে পড়তে হল তাকে। রান্নার মাসি ছুটি নিয়েছে। সুতরাং রান্নার কাজটা আজ তারই ঘাড়ে।



দেড়টা নাগাদ খেতে বসতেই তার খেয়াল হল, অনিমেষকে সে একটা তরকারি দিতে ভুলে গেছে। সেটা খাবার টেবিলেই পড়ে আছে। আশ্চর্য! এত ক্ষণ এখানে ঘুরঘুর করছে, খেয়াল হয়নি তার! এ রকম তো হয় না! ডাল দিয়ে ভাত মেখে, মুখে এক গ্রাস তুলতেই… এঃ হে, ডালে আজকে নুনই দেওয়া হয়নি। বিস্বাদ লাগছে। উঠে নুন আনতে গিয়ে শুনতে পেল, তার মোবাইল বাজছে। চেনা রিংটোন। অনিমেষ। নিশ্চয়ই টিফিনের গন্ডগোলের জন্য। ‘বলো’ বলতেই ও দিক থেকে অনিমেষের উত্তেজিত গলা।

“তোমার কী হয়েছে বলো তো? আমার টিফিনের ব্যাগে আর-একটা তরকারি নেই, তার বদলে তোমার মোবাইলের চার্জার। ডালে নুন নেই। ব্যাপারটা কী?”

“যাক!”

“মানে?”

তপতী বুঝতে পারল, তার অবচেতন মনে মোবাইলের চার্জার খুঁজে না পাওয়ার টেনশনের হঠাৎ রিলিফের ফলেই তার এই উক্তি। একেবারে মুখ ফস্কে বেরিয়ে গেছে। একটু নরম হয়ে বলল, “আহা, খেয়ে নাও না আজকে। ও রকম কি রোজ রোজ হয় না কি?”

অফ হয়ে গেল লাইনটা। চার্জ আছে, না গেছে? না, আছে। তার মানে অনিমেষ লাইন কেটে দিয়েছে। চটে আছে। এখন থাক। অফিস থেকে ফিরলে দেখা যাবে। চার্জারটাও পাওয়া যাবে। তার আগে আর একটা ব্যাপারও তাকে করতে হবে। মোবাইল না নিয়ে একটা বই নিয়ে বসবে সে রিঙ্কির পাশে। দেখা যাক কী হয়।

**

সন্ধেবেলায় রিঙ্কির পাশে বসে তপতী বলল, “তোর মোবাইলটা রাখ না!”

“কেন?”

“না, এমনিই, ” শ্বাস ফেলে ছোট্ট করে বলল তপতী।

“নাঃ!”

রিঙ্কি আর কোনও কথা না বলে পড়ায় ফিরে গেল। তপতী বইটার আড়ালে দেখল, মেয়েটা পড়ছে বটে, কিন্তু মাঝে মাঝেই তার চোখ চলে যাচ্ছে তার মোবাইলে। আশ্চর্য! এই রকম ভাবে মেয়েটা কনসেনট্রেট করে কী করে? সে কি নিজে পারত? নিজেরই মেয়ে, কিন্তু কত তফাত, কত আলাদা! কিন্তু না, এখন নিজের কথা ভেবে লাভ নেই। বরং মেয়েটার জন্যই তাকে ভাবতে হবে। একটা প্ল্যান ঘুরছে তার মাথায়, দেখা যাক সেটা কাজে দেয় কি না।

মিনিটপাঁচেক পর আস্তে আস্তে জিজ্ঞেস করল তপতী, “তোর ছোটবেলার কথা মনে পড়ে?”

“উঁ?”

“ছোটবেলার কথা? মনে পড়ে?”

“উঁ…” এক বার মোবাইলের দিকে তাকিয়ে, ফের বইয়ের দিকে ঝুঁকে পড়ল রিঙ্কি।

“কী মনে পড়ে?”

“মা, আমাকে কি পড়তে দেবে?” হঠাৎ রিঅ্যাক্ট করে উঠল রিঙ্কি, “উফ্! তোমার মোবাইলটা নিয়ে একটু চিল করো না!”

“আমার মোবাইলটার চার্জ শেষ হয়ে গেছে,” শান্ত স্বরে বলল তপতী।

“তা হলে চার্জ করে নাও!”

“কেন, আমি যদি তোর সঙ্গে কথা বলি, তোর আপত্তি কিসের?”

“কী নিয়ে কথা বলব বলো তো তোমার সঙ্গে?” খাতা বন্ধ করে সটান তপতীর মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল রিঙ্কি, “আর তা ছাড়া আমার হোমওয়ার্কও তো আছে।”

“কই দেখি।”

রিঙ্কি বিনা বাক্যব্যয়ে এগিয়ে দিল তার পড়ার খাতা। তাতে চোখ বোলাতে বোলাতে তপতী দেখল, রিঙ্কি আবার তার মোবাইল নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে।

“আজ তো বেশি পড়া নেই,” বলল তপতী।

“না, তা নেই,” মোবাইলে খুট খুট করতে করতে বলল রিঙ্কি, “তাই আজকে চ্যাট করার সময় পাব।”

“তুই চ্যাট কর না আমার সঙ্গে?”

“তোমার সঙ্গে? হোয়াট ফর?”

“হোয়াট ফর… মানে?”

“মানে… হোয়াট ফর!” মোবাইল দেখতে দেখতে বলল রিঙ্কি।

“না… মানে চ্যাট মানে তো কথা বলা!” বলে তপতী।

“উফ মা! চ্যাট ইজ় চ্যাট। ওটা মোবাইলে হয়। ইট’স নট কথা!”

বোঝো! আর কিছু না ভেবে, তপতী দুম করে জিজ্ঞেস করল, “আচ্ছা, তোর সেই পিকনিকের কথা মনে আছে?”

“অ্যাঁ? কী?”

“সেই যে রে আমাদের গাড়ি আসছিল না, খুব দেরি করছিল, আর তুই তোর হাত তুলে বাবাকে সমানে বলছিলি ‘থিক আসবে, থিক আসবে, তুমি ভেবো না’?”

কিছু ক্ষণ চুপ করে বসে রইল রিঙ্কি। তার পর ওর মায়ের দিকে ঘুরে বসে বলল, “ও হ্যাঁ, হ্যাঁ, ঠিক, ঠিক! বাবা সে দিন খুব টেনশন করছিল।”

“ঠিক! তার পর?”

“তার পর সেই পিকনিকে তো তোমরা মেমরি গেমে ফার্স্ট হয়েছিলে,” বলে রিঙ্কি।

“হ্যাঁ! হ্যাঁ! মনে আছে তোর?”

“আছে, কিছু কিছু। অনেক দিন আগে… মানে…”

“কী রে?”

“আসলে… তুমি বললে এগুলো ভাবতে… ভাবতে বেশ ভাল লাগছে আমার,” আস্তে আস্তে বলল রিঙ্কি। তপতী খেয়াল করল, রিঙ্কির গলাটা যেন অন্য রকম। সেই কেঠো ব্যস্ত ভাবটা যেন আর নেই। এই বার আবার রিঙ্কির কথা শুনতে পেল তপতী। মনে হল সেটা যেন বহুদূর থেকে আসছে।

“এগুলো নিয়ে আমরা আর কথাই বলি না!” বলল রিঙ্কি।

কথা বলতে গিয়ে আটকে গেল তপতী। আশ্চর্য! তাদের এই তিনটি প্রাণীর সংসারে দূরত্বের আসল কারণ তো মেয়েটাই বলে দিয়েছে। তাদেরই মেয়ে। এটা তার আগে মনে হয়নি কেন? তারা কেন এমন দিগ্বিদিক ভুলে নিজেদের দুনিয়ায় আবদ্ধ হয়ে পড়েছিল? এর কোনও উপায় নেই? এই প্রশ্নের মধ্যে পড়েও তার একটা ব্যাপার মনে হল, একটা মোবাইলের উপস্থিতি যেমন কাছের মানুষদের পরস্পরের থেকে দূরে সরিয়ে দেয়, আবার তার অনুপস্থিতি মানুষকে সম্পর্কের পুরনো ধুলো ঝেড়ে কাছেও টানে। মোবাইল ফোন যেন চোখের সামনে টাঙানো একটা কালো পর্দা, সামনের জিনিস দেখতে দেয় না। কত কথা, সময়মতো বলা হয় না বলে সময়ের পলি চাপা পড়ে হারিয়ে যায় জীবনের গভীরে। অদ্ভুত! কখনও ভেবে দেখা হয় না তো!

এক মুহূর্ত পর পুরনো দিনের কথা শুরু করতে গিয়ে আবার আটকে গেল তপতী। তাকে উঠতে হবে।

তবে তার কারণ রিঙ্কি নয়। তার মোবাইলও নয়।

কারণ অনিমেষ। সে আজ তাড়াতাড়ি এসে পড়েছে।

উঠতে গিয়ে তপতী দেখে, রিঙ্কির মোবাইল পড়ে আছে টেবিলে, বহু ক্ষণ সেটা ছোঁয়া তো দূরের কথা, এক বারও তাকায়নি পর্যন্ত। উল্টে বরং তাকিয়ে আছে তার দিকে, চোখে অদ্ভুত এক আকুতি। ভাবটা এমন, ‘তোমাকে কি যেতেই হবে এক্ষুনি?’

তপতীর মনে হয়, এখন মানুষ মানুষের সঙ্গ পায় না বলেই নিজেকে খেলনা দিয়ে ভুলিয়ে রাখে! কিন্তু মনের গোপন কোণে আপনজনকে কাছে পাওয়ার আকুলতা নষ্ট হয় না কখনও। এক বার কাছের মানুষের সঙ্গে মনের কথা বলার সুযোগ হলে সব খেলনা পড়ে থাকে অবহেলায়।