গলিতে থিকথিকে ভিড়। অবাক হল সীমা। অসময়ে কারা? তার বাড়ির সামনে? পাশ কাটিয়ে ঢুকতে যাবে, তারক চেঁচিয়ে উঠল, “এই তো! ক্যামেরা রেডি করেন, আসি গিলা।” ফুর্তি হলে তারকের মুখ দিয়ে তাড়ির গন্ধ এবং ওড়িয়া দুইই বার হয় ভকভক করে। সীমা বুঝল, তার স্বামী তারক কিছু একটা ঘটিয়েছে।
“ওগো শুনছ, এই সেই টিভির লোকেরা।”
সীমা গনগনে চোখে তাকাল। চার বাড়ি রেঁধে, তেতেপুড়ে রোদ মাথায় করে ঘরে ঢুকেছে। এখন হাঁড়ি না চড়ালে দুপুরে পেটে কিল মেরে শুয়ে থাকতে হবে। তার মধ্যে তারকের আদিখ্যেতা।
দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯
কলোনির বারো ঘরের মধ্যে সীমা গোবরে পদ্মফুল। চল্লিশ বছর বয়স হল কে বলবে। আঁটসাঁট ছিপছিপে গড়ন, নির্মেদ কোমর, পরিপাটি খোঁপা। সিঁথিতে চিরুনির আগা ছুঁইয়ে সিঁদুর, ব্যস।
তার সুললিত হাঁটার ঢঙে মজেছিল পড়শি কার্তিক ঘোষ। ছোট পর্দার সিনেমাওয়ালা। তখন ‘রোজগেরে বধূ’র সিজন। বাসনের ঝনঝনানি, রান্নার ছ্যাঁকছোঁক, টিউবওয়েলের ক্যাঁচক্যাঁচের মধ্যেই ‘রোজগেরে বধূ’র টিজ়ার শোনা যেত। সন্ধেবেলা শাঁখের ফুঁ ছাপিয়ে টিভিতে ‘রোজগেরে বধূ’র সম্প্রচার। কার্তিক ছিল পরিচালকের ডান হাত।
গেল বার রাসপূর্ণিমাতে পাড়ায় কীর্তনের উৎসব। কান্তা মায়ের কীর্তন শুনবে বলে দূরদূরান্ত থেকে লোক এসেছে। বিরাট বড় প্যান্ডেল, হাজার ওয়াটের ঝাড়বাতি। কান্তা মা বিষ্ণুপ্রিয়ার অংশটুকু অভিনয় করছে। হঠাৎ চোখ উল্টে অজ্ঞান। মঞ্চ থেকে ধরাধরি করে নামানো হল। কিন্তু পাবলিক তো শুনবে না। কোলে কাঁখে বাচ্চা নিয়ে মেয়ে, মরদ, বুড়ি, ছুঁড়ি সব চিল্লামিল্লি শুরু করে দিল। কার্তিক ঘোষকে ধরে ঝুলে পড়ল সংগঠকরা, “বাঁচাও কার্তিকদা!”
রাস্তা দিয়ে যেতে সীমার দু-এক কলি কৃষ্ণভজন কানে গিয়েছিল কার্তিকের। কার্তিক ঘোষের জহুরির চোখ। নয় নয় করেও টিভির লাইনে তিরিশ বছর কাটল। তারককে ঠেলা দিয়ে কার্তিক বলেছিল, “তোর বৌকে স্টেজে তুলে দে।”
“পাগল!” তারকের চোখে বিস্ময়। “ওর কম্মো নয়। তা ছাড়া লোকে কী বলবে?”
পরের আধ ঘণ্টা মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে কীর্তন শুনেছিল পাড়ার লোক। বিষ্ণুপ্রিয়া, নিমাইয়ের উদ্দেশে কী চমৎকার কীর্তনই না গাইল সীমা। মঞ্চ থেকে নামার আগেই দর্শক সীমার গলায় ছুড়ে দিল ফুলের মালা। কপালে রসকলি এঁকে দিল। চারদিকে উলুর আওয়াজ, বাতাসা ছোঁড়া, হরির লুঠ। হাততালি। কে বলবে এ রোজকার বাটিচচ্চড়ি আর লাউঘণ্টের রাঁধুনি!
তখন থেকেই তক্বে তক্বে ছিল কার্তিক। টিভিতে ‘রোজগেরে বধূ’ বানানোর সময় অফার দিয়েছিল তারককে। সীমা তখনও রাজি হয়নি। আজও তাই।
“আমার হবে না।”
“শিখে নিবি।”
“সক্বাল সক্বাল গিলেছ? কখন শিখব? এতগুলো বাড়ি রাঁধাবাড়া!”
“মেয়েটাকে রান্নায় ঢোকা। ঘরে বসে ধুমসি হচ্ছে। টিভিতে চান্স মানে কেল্লা ফতে। কার্তিকদা বলল, ছপ্পর ফুঁড়ে টাকা আসবে।”
“যত উটকো শখ,” গজগজ করতে করতে চাল ধুতে লাগল সীমা। কলতলায় গুচ্ছের এঁটো বাসন ডাঁই করা। মাজতে হবে।
তারকের গদগদ গলা, “সে দিন অমন কীর্তন গাইলি কী ভাবে। আহা, ঠিক যেন বিষ্ণুপিয়া।”
“রংরলিয়া রাখো। কেরোসিন তুলে আনো দিকি,” সীমা তারকের হাতে জারিকেন ধরিয়ে দিল।
সীমার অষ্টাদশী কন্যা কলকল করে উঠল, “জানো বাবা, মাকে একদম মধুবালার মতো দেখতে।”
“সে কে?”
“পুরনো হিন্দি বইয়ের হিরোইন।”
সীমার বুক দুড়ুম দুড়ুম করে উঠল।
সদ্য-ফোটা যৌবনে একটা গান অষ্টপ্রহর গাইত সে... ‘আইয়ে মেহেরবা...’ নায়িকা মধুবালার লিপে ‘হাওড়া ব্রিজ’ ছবিতে শুনেছিল।
বাবা শুনে এমন মেরেছিল যে গান গাওয়াই বন্ধ হয়ে গেল।
“বম্বের নায়িকা হওয়ার শখ? দেখাচ্ছি মজা। ও সব বাইজিপনা ভদ্দরলোকের ঘরে চলবে না,” বলেছিল সীমার বাবা রাসু বৈষ্ণব। তড়িঘড়ি মেয়েকে পাত্রস্থ করেছিল।
কার্তিক ঘোষকে তাই মুখের উপর ‘না’ বলেছিল সীমা।
ভয়ও ছিল। তার ক্ষমতায় কুলাবে না। ‘রোজগেরে বধূ’র সাত-আটটা পর্ব দেখেছে শ্রীলাবৌদির ঘরে। সন্ধেবেলা রাঁধতে যায় সীমা। দশটা রুটি আর নিরামিষ তরকারি। দু’হাজার টাকা মাইনে।
ওরা সব শিক্ষিত মেয়ে-বৌ। তার মতো গণ্ডমূর্খ গাঁইয়া ভূত পারবে না। শ্রীলাবৌদি বলছিল, “অভিনয় খুব শক্ত কাজ। শুধু গান নয়,
নাচ, থিয়েটার, যাত্রা, অপেরা সব করলে তবেই পরিপূর্ণ অভিনেত্রী হওয়া যায়।’’
সীমা হাঁটতেও চায় না ও পথে।
মেয়েটা বাড়ছে কলাগাছের মতো। তারকের বোনেদের মতো গড়ন। চওড়া কাঁধ, গালের হনু ওঠা, চুলের ঘেঁষ নেই। বংশের ধারা পেয়েছে। বয়সের জেল্লা থাকতে থাকতে বিয়ে না দিলে মুশকিল। দেনাপাওনার ব্যাপারটা নিয়েই বেশি চিন্তা ওর।
ছেলেটাকে নিয়ে আর এক জ্বালা। কোনও কাজে টিকে থাকতে পারে না। অবিকল তারক। দু’দিন কাজে গেল তো দশ দিন শুয়ে কাটায়। অথচ পাইপকলের কাজে কত কাঁচা পয়সা। লেগে থাকলে ফ্ল্যাটবাড়ির প্লাম্বিংয়ের কাজটা পেত। আর একটা বদভ্যেস হয়েছে। চুল্লুর নেশা। কত বার বারণ করেছে সীমা। রাগ করে ভাত খায়নি, জিনিস ছুড়ে ফেলেছে। ছেলে তবুও শোধরাল না। সন্ধে হলেই মদের ঠেকে। তারক বাড়ি থেকে বার করে দিয়েছিল দু’বার, আবার নিয়ে এসেছে।
‘বনস্তে ডাকিলা গজা, বরসকি থারে আসিলা রাজা,’ তারক ঢুলুঢুলু চোখে গাইতে গাইতে বলল, “শিগগির পঞ্চাশটা টাকা ছাড়। মিষ্টি কিনে আনি।”
সীমা চোয়াল কঠিন করে বলল, “টাকা নেই।”
“আরে, মেগা সিরিয়াল। ভাল মালকড়ি দেবে। চটছিস কেন?”
“দ্যাখো, ও সব অ্যাক্টো আমার মুরোদে কুলোবে না। ঘ্যানঘ্যান কোরো না।”
তারক লুঙ্গির গেঁজ থেকে বিড়ি বার করে বলল, “কার্তিকদা বলেছে, টিভিতে এ জিনিস ছ’টা পর্ব করতে পারলেই চিত্তির। প্রতি খেপে পাঁচ হাজার।”
সীমার হাসিতে প্রচ্ছন্ন বিদ্রুপ। “যত ঢপ। আমার মতো নতুন লোককে তিরিশ হাজার টাকা?”
“আলবাত দেবে। ছাড় তোর রাঁধুনিগিরি।”
“কথায় কথায় শুধু রান্না ছাড়। ওই মাইনেতেই তো গুষ্টির পেটের আগুন নিভছে। বলি কাজটা কদ্দিনের শুনি? সেই তো আবার রান্নায় ঢুকতে হবে। মাঝখান থেকে নাটক।”
কার্তিক দরজার বাইরে থেকে বলল, “এটায় নাম হলে আর ফিরে দেখতে হবে না। বোঝা তারক।”
সীমা ঘোমটা টানল, “আমার দ্বারা এ হবে না দাদা। কিছু মনে করবেন না।”
“আমাদের নতুন প্রোজেক্টটা আগে শোনো তো!” হাল না ছেড়ে কার্তিক দরজা ঠেলে ঢুকল।
“দিদি একটু সাইডফেস,” ক্যামেরার ছেলেটির মুখ হাসিহাসি।
“এই কাপড়ে, ছবি নিও না ভাই।”
দুপুর দুটো। ভাত বসানো হয়নি এখনও। সীমার ভুরু কুঁচকে আছে।
“এটা মেয়েদের ক্ষমতায়নের কাহিনি। ঘরে বাইরে মেয়েরা কী ভাবে ম্যানেজ করছে, অ্যাডজাস্ট করছে, সেটাই ফুটিয়ে তুলতে চাই। স্ক্রিপ্ট লিখছে আমাদের টিম। তোমাদের মতো গ্রাসরুট মহিলাদের স্ট্রাগল, অ্যাডজাস্টমেন্ট দেখাতে চাই বলেই...” কার্তিক ঘোষের গলা গমগমে। “রিয়েলিটি শো। নাম ‘মধুবালা’।”
আর একটু হলেই হাত থেকে জল ভরা কাচের গ্লাস পড়ে যেত সীমার।
সীমার দিকে তাকিয়ে কার্তিক বলল, “ঘরে ঘরে বঙ্গবালারা অবিরাম খেটে চলেছে অথচ তাদের হৃদয় ফুলের মতো। মধু ভরা। সবার সঙ্গেই তারা মানিয়ে নেয়, এটাই কনসেপ্ট। মারকাটারি টিআরপি হবে, দেখে নিও।”
সীমার পেট দাউদাউ করে জ্বলছে। সকাল থেকে চা আর বাসি রুটি ছাড়া কিচ্ছু জোটেনি। এত ক্ষণে রান্নার অর্ধেক হয়ে যেত। অলম্বুষ ব্যাটাছেলে ঘরে বসে থাকলে যা হয়। অভিনয়! যতো আজাইরা কাম।
“বড় শক্ত। পারব না দাদা,” শব্দগুলোকে নিঃস্পৃহ অথচ কঠিন ভাবে ছুড়ে দিল সীমা। তার চলন বলন, অব্যক্ত ভাষা বুঝিয়ে দিল অনাসক্তি।
পুজোর আগে পুরনো কাজগুলো ছেড়ে বোনাস যাক আর কী! তা ছাড়া সে কোনও দিন অভিনয় করেনি। বৈষ্ণবের মেয়ে বলে কীর্তনটা ভিতর থেকে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে আসে। টিভিতে মেগা সিরিয়াল! ধুস! তাকে নিয়ে এরা হাত কামড়াবে। তখন আর পিছিয়ে আসারও পথ থাকবে না। রাজি করানো গেল না সীমাকে। দলবল নিয়ে ফিরে গেল কার্তিক। সীমা জানে, এই জন্য তারকের মেজাজ বিগড়ে থাকবে। কিন্তু এখন সে সব নিয়ে ভাবলে চলবে না।
মুসুরডাল, বেগুনপোড়া আর ডিমভাজা দিয়ে দ্রুত ছেলের পাতে ভাত বেড়ে দিল সীমা। নতুন একটা কাজের কথা হচ্ছে ছেলেটার। মইনুল প্লাম্বারকে সে বলে রেখেছিল। পাশেই বহুতল আবাসন হবে। ঠিকে মজুর নেবে। ছেলেটাকে ঢোকাতেই হবে যে করে হোক।
ভাত বেড়ে ডাকাডাকি করতে লাগল সীমা। জানে আজ তারক খেপে থাকবে। ফ্যাঁকড়া তুলবে প্রত্যেকটা ব্যাপারে। ছেলেকে চটালে হবে না। নরম গলায় জিজ্ঞেস করল, “মামলেট আর নিবি?”
“তোমার কই ?”
“তোর পেট ভরলেই আমার ভরবে। ছাইপাঁশ খাবি না।”
ছেলের এঁটো থালা মেজে ভাত বাড়ল সীমা। তার পর ঠাকুরের আসনে লুকনো একটা বান্ডিল নিয়ে তারকের কোলে ছুড়ে দিল।
তারক বিরক্ত।
“ঢং মারিস না তো। বিড়ি খাওয়া ছেড়ে দিয়েছি। সোয়ামির একটা কথা রাখে না, শুধু বিড়ি ঘুষ দেয়।”
“খুলে দেখো।”
তারক চমকে উঠল। মুহূর্তে তার চোখ মুখের রং বদলে গেল।
সীমা নির্লিপ্ত মুখে বলল, “লোন নিয়েছি।”
তারক মিইয়ে গেল, “যাহ্ শালা, আমি ভাবলাম লটারি। সুদ কত?”
“আগে খাবে এসো। ভাত বেড়েছি।”
“সুদফুদ বহুত ঝকমারি। কে বলল ঝামেলায় জড়াতে?”
“সুদ নেই।”
“অ্যাঁ!”
“হুঁ, আরও পাব। খেপে খেপে।”
“বলিস কী বৌ?” তারক গুছিয়ে ভাত মাখল। শুকনো লঙ্কা চেয়ে নিল।
“ভোরবেলা যার রান্না করি, সেই নন্দা ম্যাডাম। ব্যাঙ্কের বড় অফিসার। বলল, মেয়েদের জন্য কী এক যোজনা না কী। মোট এক লাখ দেবে। কিন্তু ব্যাঙ্কের বাবুরা প্রতি মাসে দেখতে আসবে যে কাজ কেমন চলছে।”
“কাজ?”
“আরে বাবা তুমিই তো সমানে চিল্লাচ্ছ, মেয়েটাকে রান্নার কাজে ঢোকাতে,” সুর বদলাল সীমা। “ভাবছি বাড়ি বাড়ি রান্না ছেড়ে একটা হোম ডেলিভারি খুলব। আমি সকালে আর মেয়ে বিকেলে রাঁধবে। তুমি সাইকেলে খাবার দিয়ে আসবে। নগদ হাতে আনবে।”
তারক চুপ।
“সাইকেল কিনব গো। রান্নার বাসনকোসনও তো কিনতে হবে। ডেচকি, কড়া, গামলা, দু’ডজন টিফিনবাস্কো।”
তারক বিষম খেল।
“ষাট ষাট। কে নাম করছে,” সীমা জলের মগ এগিয়ে দিল।
“কে আবার, তোমার মেয়ের নাগর। পিণ্ডি চটকাচ্ছে আমার। হাতেনাতে ধরেছি আজ মদনকে। শালা বিয়ের কথা পাড়লেই বাপে পণ চাইছে আর মেলামেশা করছিস এক বছর। আর সহ্য করব না।”
“কিন্তু তোমার মেয়ের যে ওকেই পছন্দ!” সীমা ফিসফিসিয়ে বলল, “সোমত্ত মেয়ের সঙ্গে তক্ব কোরো না। জেদের বশে একটা কাণ্ড করে বসলে আমাদেরই মুখ পুড়বে।”
“মেয়েকে দেখছি না কেন?”
“আমিই পাঠিয়েছি গ্যাসপল্টুর বাড়ি। ওর তিন মাসের বাচ্চাটাকে দেখবে কে? আহা, কচি বৌটা অকালে মরল গো ডেঙ্গুজ্বরে।”
তারকের ভাতের দলা মাঝপথে দাঁড়িয়ে পড়ল।
“তুই কী চাচ্ছিস বল তো?”
“কী আবার, পালবাড়ির ধাড়ি আইবুড়ি সবিতা হত্যে দিয়ে বসে আছে পল্টুর ওখেনে। ওর চেয়ে আমার মেয়ে কম কিসে? আর মায়াদয়া তো জানোই। বাচ্চাটাকে বুকে করে আগলাবে। এমন পাত্রী পাচ্ছে কোথায় পল্টু?”
তারক হোহো করে হাসতে শুরু করল।
“কী করছ পাগলের মতো? আবার বিষম খাবে।”
“এক অস্ত্রে মদনের বাবা বধ, পণের পঞ্চাশ হাজার, পাঁচ ভরি সোনা মকুব। তোর বুদ্ধিটা কী দিয়ে গড়া রে বৌ! তারক চেঁচিয়ে গান ধরল, ‘সাম্বালো সিম্বিলো ধান কাটাকাটি শুরু।’”
ভাত খেয়ে সুপারি কুচোতে বসল সীমা। এই সময়টুকু তার একান্ত। ছাদে ভেজা কাপড়গুলো মেলে দিয়ে এসেছে। শ্রীলাবৌদির ওখানে ঢোকার আগেই পল্টুর বাড়ি যাবে। পল্টুকে রাতে খাওয়ার প্রস্তাব দিতে হবে। বাচ্চাটাকে নিয়ে আসতে বলবে মেয়েকে। ছেলেকে দিয়ে ডাকাবে মইনুল মিস্তিরিকে। নারকেল দিয়ে কচু শাক আর তার হাতের স্পেশ্যাল মুড়িঘণ্ট। কাতলার বড় বড় দাগা, পেটি কিনে আনবে সন্ধের বাজার থেকে। সব ঠিকঠাক চললে এ বছর জন্মাষ্টমীতে ঠাকুরকে রুপোর মুকুট দেবে আর নন্দোৎসবে অন্নভোগ।
গুনগুন করে গেয়ে উঠল সীমা, ‘বঁধু তুমি সে আমার প্রাণ, দেহ মন আদি তোহারে সঁপেছি, কুল শীল জাতি মান...’
অঘ্রানের বাতাসে রিক্ত নিঃস্ব ভাব টের পায় সীমা। শীত আসছে। চামড়ায় টান। সব মিলিয়ে বোনাস উঠেছে বারো হাজার। বেলা ছোট হচ্ছে রোজ। কাজগুলো একে একে ছাড়তে হবে। নন্দাবৌদিকে নিয়েই সমস্যা। ধারকর্জ এঁরই দয়ায় পেয়েছে। ছুটি দিতে চায় না একেবারেই। কাজ ছাড়ার কথা বললে তো আঁতকে উঠবে।
কিন্তু তারও শিয়রে সংক্রান্তি। এই মাঘেই বিয়ে লাগিয়ে না দিলে গ্যাসপল্টুর ঘাড়ে চেপে বসবে অন্য কেউ। শাশুড়ি, ননদ নেই, এমন সুযোগ কেউ হাতছাড়া করে?
“হাউ স্ট্রেঞ্জ, যার খাবে, তার গলাতেই পা দেবে? তুমি তো সাক্ষাৎ গডেস কালী!”
“অমন বোলো না বৌদি। মাত্তর দশ দিনের ছুটি।”
“মেয়েকে বদলি পাঠাও। আমার ব্যাঙ্কে তো হুটহাট ছুটি মেলে না।”
“মেয়ে পারবে না বৌদি।
নতুন চাকরি।”
“বাহ! কোথায়?”
সীমা ঢোঁক গিলল, “গ্যাস কোম্পানিতে।”
“কিন্তু দশ-দশটা দিন চালাব কী ভাবে?”
ছোট মুখে বড় কথা বলছি, “লোক পেলে নিয়ে নাও বৌদি।”
“এত তাড়াতাড়ি রাঁধুনি পাব সীমা? এ জন্যই কারও উপকার করতে নেই,” গজগজ করল নন্দা।
“আচ্ছা, তোমাদের খাবার পাওয়া নিয়ে তো কথা! পাঠিয়ে দেব’খন।”
নন্দা বিস্মিত। সীমার কথা বোধগম্য হল না।
মাঘের সকালে দ্বিরাগমনে এসেছে মেয়ে-জামাই। রান্নাবান্না সারতে দুপুর কাবার। গ্যাস ফুরোতেই তারকের মাথায় হাত, “সব্বোনাশ! এই মাগ্যিগন্ডার বাজারে এখন গ্যাস সিলিন্ডার পাবে কোত্থেকে?”
পল্টু ফিকফিক হাসছে, “অত ভাবার কী আছে বাবা? মাকে বলেছি বিজনেসে আমিও পার্টনার। সিলিন্ডার আমিই দেব। উঠোন, ঘরও দেব।”
সীমা প্লেটে মিষ্টি সাজিয়ে মইনুলের সামনে ধরল।
“নাও বাবা। তোমার জন্যই আমার ছেলে বাজে নেশাটা ছেড়েছে।”
“আমি একা নই, রাজমিস্তিরি প্রকাশ, জোগাড়ে সিধু, রংমিস্তিরি হুসেন, সবাই ওকে আগলে রেখেছে।”
“বলছি আমার বাস্তুজমিটুকুতে তোমরা একসঙ্গে একটা ফ্ল্যাটবাড়ি তুলতে পারো না? আমার কত্তা তো বসেই থাকে। ওকেও টানো।”
“টাকার জোগাড় কে দেবে?” তারক খ্যা-খ্যা করে হাসছে। “তোর মাথায় গোবর...”
“আমি দেব,” কথাটা বলেই গাড়ির আওয়াজ পেয়ে বাইরের দিকে তাকায় সীমা। সানগ্লাস পরা নন্দার পাশে সুট-বুট পরা বয়স্ক ভদ্রলোক। গাড়ি থেকে নেমেছেন।
নন্দা সীমার হাতে টিফিন কেরিয়ার দিয়ে বলল, “রোজকার মতো ডিনার পাঠিও। আর শোনো, আমাদের ক্যান্টিনের খাবার অত্যন্ত খারাপ। তোমার হোম সার্ভিস ব্যাঙ্কেও চালু করো। ইনি আমাদের ম্যানেজার। স্যরকে একেবারে নিয়েই এলাম ভিজ়িটে।” সীমা ঘোমটা টেনে চেয়ার এগিয়ে দিল।
প্রচণ্ড গরমে কোল্ড ড্রিঙ্ক খুঁজতে খুঁজতে কার্তিক ঘোষের টিম হুড়মুড় করে দোকানে ঢুকল। সার সার বেঞ্চে লোক গিজগিজ করছে। টেবিলে প্লাস্টিকের জগ, কাচের গ্লাস, লবণ। দেওয়ালে মেনুকার্ড। ‘ভাত, ডাল, শুক্তো, ভাজা, কালিয়া, চাটনি...’ সাইনবোর্ডে লেখা ‘রোজগেরে বধূর রান্নাঘর’!
কার্তিক ঘোষ হাঁ হয়ে গেল। ছ’মাস শুটিংয়ের কাজে বাইরে ছিল। এ সব কিছুই কানে আসেনি।
সীমা গলদঘর্ম অবস্থায় ডেকচিতে তরকারি ঢালছে। আগুনের তাতে সৌন্দর্য লকলক করছে। তিন-চার জন মহিলা-পুরুষ তাকে সাহায্য করছে পু্রোদমে। তারক কোল্ড ড্রিঙ্কের বোতল আনছে ফ্রিজ খুলে।
বাইরে রেডিয়োতে তখন গান বাজছে ‘আইয়ে মেহেরবা, বৈঠিয়ে জানে জাঁ...’