ব্রজবাসী দাস মানে আমাদের ব্রজর দুঃখ বলতে ছিল একটাই, সে তার বাপ গোবিন্দ দাসের মতো ফর্সা গায়ের রংটি পায়নি। গোবিন্দ দাস মানুষটা ছিল যেমন রগুড়ে তেমন মিশুকে। কিন্তু দীর্ঘ জীবন লোকটার কপালে ছিল না। আগের বছর শিবরাত্রির রাতে সেই যে বুকে ব্যথা নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হল, আর ফিরে এল না। তার আগে সে অবশ্য একমাত্র ছেলে ব্রজকে যাকে বলে দাঁড় করিয়ে দিয়ে গিয়েছে।
নতুন বাজারের মুখে অমন চালু পান বিড়ি সিগারেটের দোকান টাউনে আর দুটি কোথায়?
বাপ গত হওয়ার পর সে আর তার মা চিন্তামণি, বাড়িতে দুটি মাত্র প্রাণী। এই বয়সেও তিনি যেমন খাটিয়ে মহিলা, তাতে বাড়ি নিয়ে ব্রজকে মাথা ঘামাতে হয় না। বাজারে চার আনা পয়সাও ধার নেই, আত্মীয় প্রতিবেশীদের সঙ্গে কোনও ঝামেলা নেই। মোটের উপর বলা যেতেই পারে ব্রজ এই টাউনের সুখীতম মানুষদের মধ্যে এক জন। তবু ব্রজর দুঃখ কিছুতেই যেতে চায় না। কারণ তার গায়ের রং ময়লাটে, মেয়েরা তার দিকে মোটেও সে ভাবে তাকায় না। খবরের কাগজ, টিভি কাঁপানো তিন সপ্তাহে ফর্সা করা ওই সব ম্যাজিক ক্রিম দু’বেলা মেখেও কাজের কাজ কিছু হয়নি। বিয়ের বয়স হয়ে যাওয়ার পর থেকে আত্মীয়রা চাপ দিচ্ছে। তাই সে ঠিক করল, আর বিলম্ব নয়।
ওর মতো রোজগেরে সুপাত্র বিয়ে করতে চাইলে তো আর পাত্রীর অভাব হবে না। কিন্তু ব্রজর সেই এক কথা, তার ফর্সা মেয়ে চাই। তবেই না তার টুকটুকে ফর্সা সন্তান জন্মাবে! আর দশটা ভদ্দর ঘরের ছেলেমেয়েদের সঙ্গে মিশবে, ইংরিজি মিডিয়ামে পড়বে, গলায় টাই বেঁধে রিকশা করে এই ঢাউস ব্যাগ কাঁধে ইস্কুলে যাবে। মুখ দিয়ে ভুট্টার খই ফোটার মতো ইংরিজি বুলি ফুটবে, কথায় কথায় বাপ মা-কে বলবে থ্যাঙ্ক ইউ, এক্সকিউজ় মি। আহা, সে সব শুনে মরেও শান্তি।
ব্রজর কপাল ভাল। বেশি দিন খুঁজতে হল না। ষষ্ঠীপদ ঘটকের তৎপরতায় সেই রকমই এক ফর্সা মেয়ে খুঁজে পাওয়া গেল। পাত্রীর পড়াশুনো সাত ক্লাস পর্যন্ত, নাম বুল্টি সাহা। বাবা বিপদভঞ্জন সাহার আছে পৈতৃক ভিটে লাগোয়া মুদিখানার ব্যবসা। বুল্টির মুখশ্রী নিখুঁত না হলেও যৌবনবতী। ব্রজ বিয়েতে রাজি হল। বুল্টিকে তার ভাল লেগে গিয়েছে।।
বুল্টির বাপের ইচ্ছে ছিল বিয়েটা শীতের দিকেই ফেলার, কিন্তু ব্রজর আর তর সইল না। ফলে বিয়ে লেগে গেল খর জ্যৈষ্ঠের প্রথম সপ্তাহেই। দেনাপাওনার ব্যাপারে দাবিদাওয়া একেবারেই ছিল না ব্রজর, তা বলে বিয়ের জাঁকজমকে কোনও রকম কার্পণ্য করেনি। বৌভাতে হাজারের কাছাকাছি লোক খাইয়েছে, শাশুড়িমা চিন্তামণি নববধূর মুখ দেখেছে জড়োয়া সেট দিয়ে। ফুলশয্যার রাতে গদগদ বর নিজের হাতে গলায় পরিয়ে দিয়েছে পুরোপুরি চার ভরির হলমার্ক দেওয়া সোনার নেকলেস।
অষ্টমঙ্গলা থেকে ফিরে লজ্জাবতী ভাবটা ঝেড়ে এ বাড়িতে বেশ জমিয়ে বসল বুল্টি। বাপের বাড়িতে যাও বা তাকে দু’বেলা খাটতে হত, এ বাড়িতে বলতে গেলে তার কোনও কাজই নেই। শাশুড়ি চিন্তামণি বৌভাতের রাতেই নববধূকে বলে দিয়েছিলেন, যত দিন তাঁর শরীরে তাগড় আছে, ওকে রান্নাঘরের দিকে মোটে ভিড়তে হবে না। বৌয়ের একমাত্র কাজ বলতে ছেলের আদরযত্ন করা আর বাড়ির লক্ষ্মীটি হয়ে ঘর আলো করে থাকা। তাই রাতে শুতে যাওয়ার আগে পর্যন্ত তার দায়িত্ব বলতে
খালি স্নো-পাউডার মেখে ফুলরানি হয়ে ঘুরে বেড়ানো। মাঝে মাঝে আয়নায় নিজেকে দেখা আর তাতে ক্লান্ত হয়ে পড়লে গদিওয়ালা বিছানায় গড়িয়ে নেওয়া।
দুধ-রঙা বৌ পেয়ে ব্রজ তো যাকে বলে বুল্টিকে একেবারে নয়নে হারাচ্ছে। কী কী করলে বৌকে আরও খুশি করা যায় সেই চিন্তা আজকাল তার মনপ্রাণ জুড়ে। কিন্তু কিছু কিছু ব্যাপারে তার বারণ আছে। পাড়ায় উড়তি বখাটে ছেলেপিলের দৌরাত্ম্য দিন দিন বাড়ছে। বাড়ির পিছনেই আছে পাড়ার ব্রাইট-স্টার ক্লাবের চ্যাংড়া ছেলেদের ক্যারমের ঠেক। তাই নতুন বৌয়ের একা একা ছাদে যাওয়া মানা। নতুন কোনও ব্যাটাছেলে বাড়ির উঠোনে এলে পর্দা সরিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসা মানা। শাড়ি গয়না বা অন্য জিনিস কেনাকাটার দরকার হলে অবশ্য ব্রজ নিজেই ওকে সঙ্গে করে দোকানে নিয়ে যায়। যদিও রাস্তাঘাটে স্মার্ট সুদর্শন কেতাবাজ পুরুষ মানুষদের দিকে বৌয়ের নজর যেন না যেতে পারে, তার জন্য রাখা থাকে আড়চোখের সতর্ক পাহারা।
তবে পাশের বাড়ির সমবয়সি দুই মেয়ে রুনু আর ঝুনুর সঙ্গে জানালা দিয়ে কথা বলার ব্যাপারে কোনও নিষেধাজ্ঞা নেই। ওরা অবাধে এই বাড়িতে আসে, খাবারদাবার দেওয়া নেওয়া হয়, সব রকম কথাবার্তা, হাসিঠাট্টা হয়। ওরা টাউনের মেয়ে, ওদের হাবভাব চলাবলা সাজপোশাক সবই যেন আলাদা! দুজনাই কত কিছু জানে, কী মডার্ন, কী সাহস! সবচেয়ে বড় কথা হল, দুটো ঢাউস ঢাউস মোবাইল ফোন আছে আর তাতে আছে চব্বিশ ঘণ্টা নেটওয়ার্কিংয়ের সীমাহীন সুযোগসুবিধা। তাতে কত ছবি, কত মজা, কত খবর অডিয়ো ভিডিয়ো, কত বন্ধু, কত কথা, আরও যে কত কী, তার কি শেষ আছে?
মোবাইল ওদের বাড়িতেও আছে কিন্তু তাতে নেট নেই। নেট মানে তো জাল। সে ছাই মানে যা-ই হোক, সে যে কী এক অবাক দুনিয়া, রুনু ঝুনুর কাছেই বুল্টি প্রথম দেখেছে। হাতে নিয়ে নেড়েচেড়ে, চালিয়ে, বিভিন্ন কোণ থেকে নিজের সেলফি তুলে, একটু একটু করে নানান সব কেরামতি বুঝে নিতে নিতে ইদানীং তার কেবলই মনে হচ্ছে, এমন একটা জুতসই মোবাইল ছাড়া এ জীবন বৃথা। নাহ্, আর অন্যের জিনিসে চোখ দিয়ে না, এ বার অমন এক যন্ত্র তার নিজের চাই, কিংবা ওদের চেয়েও ভাল কিছু, একেবারে তার হাতের মুঠোয়।
সে কথা অবশ্য সে গোপন করেনি। রাতে বিছানায় স্বামীর বক্ষলগ্না হয়ে বলেই ফেলেছে, ওই রকম একটা নেট দেওয়া বড় স্মার্টফোন তার চাই। সোহাগে থরথর সেই অনুরোধ নাকচ করে ব্রজর কী সাধ্যি। কিছু ক্ষণের জন্য চুপ মেরে যায় ব্রজ, তার পর ঠোঁটের কোণ বেঁকিয়ে ক্রমশ একটা হাসি তুলে আনে, খানদানি জমিদারের ঢঙে বলে “সে আর এমন কী, কালই ব্যবস্থা হয়ে যাবে। ওই তো আমার দোকানের দু’ঘর পরেই রনি বলে এক ছোকরা দোকান দিয়েছে, রোজ সেধে কানের মাথা খেয়ে নেয়, ‘দাদা একটা এস্মার্ট ফোন নিলেন না!’ আমার দোকানের রেগুলার খদ্দের।”
পরের দিনই দুপুরে বাড়িতে খেতে আসার সময় লেটেস্ট এক মোবাইল সেট নিয়ে হাজির ব্রজ। ঢাউস প্যাকেটটা খুলে ফোনটা হাতে নিয়ে দিশেহারা দেখায় বুল্টিকে। জানালার কাছে ছুটে গিয়ে হাঁক দেয় রুনু আর ঝুনুকে। ওরা দৌড়ে আসতেই
তিন জন মিলে হামলে পড়ে ওটার উপর, ঘাঁটতে লাগে নাওয়াখাওয়া ভুলে। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতে এল, ওদের যেন বাহ্যজ্ঞান নেই। রাতে দোকান বন্ধ করে ব্রজ বাড়ি ফেরে দেখে, বুল্টি তখনও খাটে উপুড় হয়ে শুয়ে মোবাইল ঘাঁটছে। ওর ঘাড়ের উপর ঝুঁকে পড়ে আদুরে গলায় ব্রজ বলে, “ফোন দেখা হল? খিদেয় পেট জ্বলছে যে!”
ঘাড় ঘোরানোর ফুরসত পায় না বুল্টি। স্ক্রিনের দিকেই তাকিয়ে বলে, “মা-কে বলো না পিলিজ! এত জিনিস, কোনটা ছেড়ে কোনটা দেখব বুঝে উঠতে পারছি না।”
কথা বাড়ায় না ব্রজ। চুপচাপ খেয়েদেয়ে এসে নিজেই মশারি টাঙিয়ে শুয়ে বৌয়ের জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। কিন্তু বৌ আসে না। পাশের ঘরের চৌকিতে সে তখনও নতুন ফোন আঁকড়ে পড়ে আছে গভীর মনোযোগের সঙ্গে। ডাক দেয় ব্রজ, কিন্তু সাড়া আসে না। এ পাশ-ও পাশ করতে করতে ঘুমিয়ে পড়ে। সকালে উঠে দেখে বৌ পাশের ঘরের চৌকিতেই অকাতরে ঘুমোচ্ছে, মোবাইলটা আধখোলা মুঠোর মধ্যে।
সকাল ন’টা নাগাদ যখন জলখাবার খেয়ে দোকানে বেরোচ্ছে, বৌয়ের ঘুম ভাঙাতে চায়নি ব্রজ। কিন্তু দুপুরে যখন খেতে বাড়িতে এল, তখনও আবার বুল্টিকে বালিশে বুক ঠেকিয়ে, পিছনের পা দোলাতে দোলাতে মোবাইল নিয়ে মগ্ন দেখে অবাক হয়ে যায় ব্রজ। বরকে দেখে খাট থেকে নামে না বুল্টি। ভদ্রতা রক্ষার মতো ঘাড় ঘুরিয়ে ফিক করে হেসে বলে, “বাপ রে এতটুকু জিনিসের মধ্যে এত কিছু, মাথার মধ্যে সব কেমন গুলিয়ে যাচ্ছে!” পকেটে সব সময় ফোন থাকলেও হাল আমলের এই সব জটিল ফোন-টোন নিয়ে তেমন একটা ধারণাও নেই ব্রজর। মনে মনে বলে, “যাক গে। ঘরে বসে যা খুশি করুক, বা’রমুখো না হলেই হল, তার বাইরে অন্য কোনও দিকে মন না গেলেই হল।’’
কিন্তু এ কী হল, রাতে বাড়ি ফিরেও সেই একই দৃশ্য! ওই যন্ত্রটার পর্দায় গেঁথে রয়েছে বৌয়ের চোখ। ডান হাতের আঙুলগুলো চলছে দ্রুত। কোনও রকমে খাবারটা এনে দিয়ে কাছাকাছি বসলেও মন মোটেও তার দিকে নেই! তার সঙ্গে দুটো বাড়তি কথা বলার পর্যন্ত প্রয়োজন বোধ করছে না, পাতে আর কিছু লাগবে কি না জিজ্ঞেস অবধি করছে না, স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে হাসছে। কিছু না বলে উঠে গিয়ে আবার বসে পড়ছে ফোন হাতে। পরের দিনও মোটের উপর সেই একই ছবি। তার পরের দিন, তার পরের দিনও। যদিও তার পরের দিন রাতে ব্রজর অনুরোধে দায়সারা ভাবে এসে শুল পাশে, কিন্তু আদর নেওয়ার সময় অন্যমনস্ক। মন পড়ে আছে বালিশের পাশে জেগে থাকা ওই যন্ত্রটায়, মেলামেশার সময়েও ঠিক যেন মন দিচ্ছে না।
দিনের পর দিন, সপ্তাহের পর সপ্তাহ সেই একই ছবি। মুখে কিছু বলতে পারে না, কিন্তু চোখের উপর দেখছে বৌটা যেন কেমন পাল্টে যাচ্ছে। ওর যেন এক মিনিটও চলছে না মোবাইলটা ছাড়া। দেখে অস্থির হয়ে ওঠে ব্রজ, রাতে ঘুম আসতে চায় না। দোকানে গিয়ে কাজে মন বসাতে পারে না। খদ্দেরদের কথায় কান নেই, জর্দা ছাড়া পান বানাতে বললে জর্দা দিয়ে দিচ্ছে, চমন দিতে গিয়ে দিচ্ছে গুচ্ছের সাদা খয়ের। হিসেব ভুল করছে। সে দিন তো পঞ্চাশ টাকা ফেরত দিতে গিয়ে কড়কড়ে একটা পাঁচশো টাকার নোট দিয়ে দিচ্ছিল। দেখেশুনে পাশের দোকানের পরেশ বলে, “কী ব্যাপার বল তো তোর, বাড়িতে কিছু হয়েছে?” জোরে মাথা ঝাঁকায় ব্রজ, “নাহ্! বাড়িতে আবার কী হবে, দু-চার দিন হল শরীরটা ঠিক জুতের নেই।”
সে ও স্বীকার করুক আর না করুক, আজকাল মাঝেমধ্যেই ও বাড়িতে বৌয়ের নম্বরে ফোন করে বসছে। খুশি হওয়ার বদলে বৌকে বিরক্ত হতে শুনে আরও অস্বস্তিতে পড়ে যাচ্ছে। মাথা জুড়ে খালি এক চিন্তা, মোবাইলটা নিয়ে ও সারা দিন করেটা কী? সে দিন রনি দোকানে সিগারেট কিনতে এলে ও সরাসরি জিজ্ঞেস করে, “এই তোদের এস্মার্ট ফোনের চক্করটা এক দিন আমায় বুঝিয়ে দিস তো, ভাবছি এ বার আমিও একটা সেট কিনে তোর কাছে শিখে নোবো।” দোকান ফাঁকা ছিল, তাই দেওয়ালে হেলান দিয়ে মৌজ করে একটা সিগারেট ধরিয়ে রনি বলে, “কেন আমার কাছে শিখবা কেন, বৌদিকে বললেই তো তোমায় হাতে করে শিখিয়ে দেবে। বৌদি তো এখন সব সময় অনলাইন, এই ক’দিনেই দেড় দু’হাজারের উপর ফ্রেন্ড করে ফেলেছে, আমিও তো আছি ওর ফ্রেন্ডলিস্টে, মাঝে মাঝেই কথা হয়।”
“কথা হয় মানে, ফ্রেন্ড বলতে?”
“ফ্রেন্ড মানে অন্য কিছু ভেবো না, ফেসবুকের ফ্রেন্ড, ফোনে ফোনে।” ঠোঁট মুচড়ে হাসে রনি। “বৌদি রোজ যে ছবিগুলো পোস্ট করে আমি দেখি, লাইক দিই, কমেন্ট করি।”
“কই দেখি দেখি কেমন ছবি?”
রনি নিজের ফোন থেকে ছবি বার করে দেখায়। ছবিগুলোর দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকে ব্রজ। এ সব ছবি বুল্টি কখন তোলে, কখনই বা এখানে লোড করে, নীচের এত কমেন্টই বা কারা লেখে, সে সবের প্রতিক্রিয়ায় বুল্টির নানা কমেন্ট, পান-চিহ্ন, ফুল-চিহ্ন, তারা-চিহ্ন আরও কত সব আকার-ইঙ্গিত! ছবিগুলোর উপর কী এক আশ্চর্য আলো! সে ফর্সা বটে, কিন্তু এমন নায়িকাদের মতো রূপের ছটা তো তার নেই, এমন টানাটানা চোখমুখ! বিড়বিড় করে ওঠে ব্রজ, “এ তো চেনাই যাচ্ছে না!”
“চেনা যাবে না, এ সব মোবাইলের ছবি তো দেখনি, তার ওপর আবার এমন সব অ্যাপ আছে নিজেকেই চিনতে পারবা না।”
ব্রজকে থম মেরে থাকতে দেখে রনি বলে “কী ভাবছ, এ বার নিজেও ফোন কিনে নাও। তোমারও একটা দারুণ ছবি দিয়ে একটা প্রোফাইল করে দেব। নিজেই বৌদির সব ছবি দেখতে পাবা, ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠাবা, সেখান থেকে গল্প করবা।”
“আমি! না না, আমি ও সব পারি না।”
“কেন, পারবা না কেন? আজকাল এ সব করে না এরম একটা লোকও দেখাতে পারবা?”
“না মানে আমি...মানে... আমি ও সব করে কী করব, দোকান করব না ও সব করব?”
“সবই তো করতে হবে। দোকানও করতে হবে, বৌও সামলাতে হবে?”
“মানে, বৌ সামলাতে হবে মানে? বৌ আবার কী করল?” ভ্যাবলা মেরে গিয়ে রনির দিকে তাকিয়ে থাকে ব্রজ। ওর চপল চোখের ভাষা পড়ে উঠতে পারে না।
“করেনি, কিন্তু করতে কত ক্ষণ। আজকালকার ব্যাপারস্যাপার, চার দিকে জন্ডিস সব কেস বস। বৌ হোক আর যেই হোক, কাউকে একশো ভাগ বিশ্বাস নেই, সব্বার উপর নজর রাখতে হয়। সে ঘরে বসে হোক বা বাইরে বসে।” হাওয়ায় ধোঁয়ার রিং ছাড়ে রনি।
“নজর! বাইরে বসে? কী করে?”
“সে সব অনেক রাস্তা আছে। আমার উপর সব ছেড়ে দাও, এখানে বসে ঘর-বার দুই সামলাতে হলে ভাইয়ের উপর বিশ্বাস রেখে চুপ মেরে বোস থাকো।”
ব্রজর মুখ লম্বা এক প্রশ্নচিহ্ন, “সে নয় রাখলাম, কিন্তু আমায় করতে হবেটা কী?”
“কিচ্ছু করতে হবে না, খালি একটা স্মার্টফোন কিনতে হবে।”
শুকনো ঢোঁক গেলে ব্রজ। আড় করে ধোঁয়া ছাড়ার ফাঁকে মুখ ঘুরিয়ে হাসে রনি, আরও একটা দামি সেট বিক্রি করতে পারায় যারপরনাই পুলকিত বত্রিশখানা দাঁত বার করে তাকায়। ব্রজর মেঘলা মুখে জমাট মেঘ দেখে বলে, “ঘাবড়ে গেলে মনে হচ্ছে? ঘাবড়িও না। আজকাল সব্বাই আমরা দুজন করে মানুষ। এক জন থাকে চোখের সামনে, আর এক জন স্মার্টফোনে।”
পুরোটা বোঝেনি ব্রজ, আস্তে আস্তে রনি বুঝিয়ে দিয়েছে। তবে বোঝার জন্য তাকে জুতসই ফোন কিনতে হয়েছে। বৌয়ের মতো অত দামি সেট না হলেও ঝাঁ-চকচকে ইয়াব্বড় একটা ফোন। বাড়ি নিয়ে যায়নি মোটেও, সেটা দোকানেই রেখেছে। নিজের নামে আর ছবি দিয়ে প্রোফাইল খোলার আত্মবিশ্বাস ছিল না, তাই রনি ওকে আর একটা নাম আর অন্য এক জন সুদর্শন পুরুষের ছবি দিয়ে প্রোফাইল বানিয়ে দিয়েছে। হাতে-কলমে শিখে নেওয়ার পর ও যে ফ্রেন্ড রিকয়েস্টটা পাঠিয়েছিল, বুল্টি সেটা তখনই অ্যাকসেপ্ট করে নিয়েছে। এখন মেসেঞ্জারে, হোয়াটসঅ্যাপে গোটা দিন জুড়ে ওদের ঘন ঘন কথা হয়। ফোনে টাইপ করা আঙুলগুলো ছোটে দ্রুত, বান্ধবীর রূপের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে ওঠে। ও পার থেকে ক্রমবর্ধমান সাড়া পেতে পেতে সাহস করে এমন সব কথাও লিখে ফেলে, যেগুলো লিখে আগুন জ্বলে ওঠে ঘিলুতে। তা বলে ওদের কথা বন্ধ হয় না!
এই ভাবে বেশ কয়েক মাস ধরে ব্যাপারটা চলেছে। এমনিতে সব ঠিকই আছে, কোনও সমস্যা নেই। কিন্তু আজকাল ব্রজর মুখে সেই চেনা হাসিটা আর দেখা যায় না। কপাল সব সময় থাকে কুঁচকে, মেজাজ তিরিক্ষে। রাতে ভাল ঘুম হয় না, দিনরাত গ্যাসের জ্বালা আর অম্বলে ভোগে। চোদ্দো পুরুষে কারও সুগার ছিল না কিন্তু সম্প্রতি ওর সুগার বর্ডারলাইন ছাড়িয়েছে। দেখা হলেও বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলে না, ভুলেও ওদের ঠেকমুখো হয় না। দিন-দিন চেহারা কেমন যেন রোগা কালিষ্টে মেরে যাচ্ছে, আগের সেই জেল্লা উধাও। কারণ জিজ্ঞেস করলে লোকজনকে যদিও বলে সব নাকি ব্যবসায় মন্দার ফল, কিন্তু আর কেউ না জানুক রনি তো জানে— ব্রজর দুঃখ দিন দিন কেন এমন হারে বেড়েই চলেছে!