কিটব্যাগের জ়িপ খুলে খুব সন্তর্পণে একটা প্যাকেট রাখতে যেতেই সহসা ঘরে ঢুকে ‘‘ও মা, কী ঢোকাচ্ছ ওটা?’’ বলে চেঁচিয়ে উঠলেন শ্রীরূপা। শেষ মুহূর্তে ধরা পরে গিয়ে কাঁচুমাচু মুখে ‘‘ও তেমন কিছু না’’ বলে পরিস্থিতি সামলাতে চেষ্টা করলেন অসিতাভ। ‘‘না মানে? আমি পরিষ্কার দেখলাম তুমি কি একটা প্যাকেট ঢোকালে এই মাত্র’’ বলতে বলতেই শ্রীরূপা এগিয়ে এসে ব্যাগের ভিতর হাত ঢুকিয়ে সন্দেহভাজন বস্তুটি বের করে আনলেন। ‘‘সন্দেশের প্যাকেট! তাই বলি, আমি স্নানে গিয়েছি আর এই ফাঁকে চুপিচুপি...আচ্ছা, তুমি কি গো? গতমাসে সুগার লেভেল কতটা বেড়েছিল, খেয়াল আছে? ডাক্তারবাবু না তোমায় পইপই করে বারণ করে দিয়েছেন মিষ্টি না ছুঁতে!’’
‘‘আরে হ্যাঁ, সেই মতোই তো চলছি। তাই বলে ক’দিনের জন্য ঘুরতে গিয়েও যদি এত নিষেধাজ্ঞা মেনে চলতে হয়, তাহলে তো...’’
‘‘তোমার শরীরের কথা ভেবেই তো বলা, বোঝো না, বাচ্চা নাকি?’’
‘‘ঠিক আছে বাবা, নিতে হবে না সন্দেশ। পাশের বাড়ির পুপাইকে ডেকে দিয়ে দিও। আমরা তো এক সপ্তাহ থাকব না।’’
‘‘তা কেন?’’ ঠোঁটের কোণে হাসি শ্রীরূপার। ‘‘তোমার বন্ধুদের তো আর সন্দেশ খেতে মানা নেই! ট্রেনেই সবাইকে বিলিয়ে দেওয়া যাবে। মন খারাপ কোরো না, তবে তোমার কোটা ওই একটা, তার বেশি না।’’
এত ক্ষণে হাসি ফুটল অসিতাভর মুখে, যাক! অন্তত একটা সন্দেশ তো জুটবে তাঁর কপালে!
রাত দশটায় ট্রেন, দার্জিলিং মেল। বিকেল বিকেল তাই একটু খাবার করে নিলেন শ্রীরূপা। মনটা আজ বেশ ভাল। কত দিন বাদে ঘুরতে যাওয়া হচ্ছে। কর্মরত অবস্থায় অসিতাভকে এত অফিস টুর করতে হত যে পরিবার নিয়ে আলাদা করে বেড়াতে যাওয়া খুব একটা হয়ে ওঠেনি। ছেলেমেয়ের পড়াশুনো, স্কুলের পরীক্ষা এসবের সঙ্গে তালমিল করে ছুটি নেওয়া সম্ভব হয়ে উঠত না অসিতাভর পক্ষে। চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার পর পরই তো মেয়ের বিয়ে, ছেলেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে বেঙ্গালুরু পাঠানো, সব খরচ খরচা কুলিয়ে আর ঘুরতে যাওয়ার মতো বিলাসিতা করা যায়নি। তার পর ছেলে চাকরি পাওয়ার পরে তার বিয়ে। একটা না একটা লেগেই ছিল। শেষমেশ সব দিক সামলে যখন থিতু হলেন, সেই সময় এক দিন হঠাৎ অসিতাভর ব্ল্যাক আউট হয় বাড়িতেই। সঙ্গে সঙ্গেই হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, তাই বেঁচে গেলেন সেই যাত্রা। আইসিসিইউ-তে ছিলেন পাঁচ দিন। দীর্ঘ দিন চিকিৎসা চলছিল। ফিজ়িয়োথেরাপি করে করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসেছেন। তবে এখনও খাওয়াদাওয়া সামলে চলতে হয়। ওষুধ খান নিয়মিত। মর্নিংওয়াক করেন। রাতে তাড়াতাড়ি ঘুমোতে যান। ঠিকঠাকই আছেন।
‘‘কী গো, তোমার শাল, কার্ডিগান সব গুছিয়ে নিয়েছ তো?’’
‘‘নিয়েছি দুটো।’’
‘‘সে কী! ঠান্ডা লাগবে তো! কাশ্মীরি শালটা নাও, ওই নীল সোয়েটারও। কালো জ্যাকেটটা বের করে দিয়েছি। ক’সেট মোজা নিয়েছ?’’
‘‘ধুর! এত্ত সব লাগবে নাকি?’’
‘‘লাগবে না? এখন অক্টোবরের শেষ। দার্জিলিংয়ে ভাল ঠান্ডা হবে।’’
‘‘ঠিক আছে, নিয়ে নিচ্ছি তাহলে। আমার মাঙ্কিক্যাপটাও নিয়ে নিও।’’
‘‘মাঙ্কিক্যাপ!’’
‘‘হ্যাঁ, সন্ধেবেলায় মলে ঘুরতে বেরলে ঠান্ডা লাগবে।’’
শিয়ালদহ স্টেশনে এসে অসিতাভর মনে হল, কত দিন বিভিন্ন স্টেশন থেকে ট্রেন ধরতে হয়েছে ওঁকে। চাকরি সূত্রে যেতে হয়েছে কত দূর দূর! কিছুই মনে হয়নি তো তখন আর আজ এইটুকু আসতেই! নাঃ! সত্যিই বাহাত্তুরে বুড়ো হয়ে গেলেন! মনে মনেই হেসে নিলেন অসিতাভ।
প্ল্যাটফর্মের দিকে এগোতেই হইহই করে একে একে সকলে এসে যোগ দিলেন। তা প্রায় জনা দশেকের একটা দল। সকলেই সিনিয়র সিটিজেন। এঁরা সবাই পরস্পরের বন্ধু, কেউ একই অফিসের, কেউ কলেজের সময় থেকে। কিন্তু বন্ধুত্ব এঁদের বহুকালের। দলের লিডার হিসেবে যাঁকে মেনে নিয়েছেন সবাই, সেই শিবাশিস আচার্য এগিয়ে এসে সবাইকে প্ল্যাটফর্ম নম্বর জানিয়ে ওঁকে অনুসরণ করতে বললেন।
ট্রেনে উঠে সকলে জায়গা মতো বসে যাওয়ার পরে ঠিক রাত দশটা পাঁচে যেই ট্রেন নড়ে উঠল, শ্রীরূপা ভিতরে ভিতরে একটা অদ্ভুত উত্তেজনা টের পেলেন। এঁরা সবাই যেমন পরস্পরের বন্ধু, এঁদের স্ত্রীরাও একে অপরের বন্ধু হয়ে উঠেছেন কালক্রমে। বিভিন্ন উৎসব অনুষ্ঠানে তো দেখা সাক্ষাৎ হয়ই, তা ছাড়াও প্রতিমাসে কোনও এক জনের বাড়িতে আড্ডা বসে। সবাই কিছু কিছু রান্না করে নিয়ে যান, এক সঙ্গে বসে খাওয়াদাওয়া হইচই করে বেশ মজায় কাটে সময়। সবাই তো আজকাল একা। ছেলেমেয়েরা সব দূরে দূরে। কেউ বা এদেশে, কেউ বিদেশে। মাস তিনেক আগে এক সন্ধেয় এরকমই এক আড্ডায় হঠাৎ সুরটা যেন কেমন কেটে যাচ্ছিল, মণিময়ের খেদোক্তিতে, ‘‘নাঃ, এবারও ছেলেটা আসতে পারবে না লিখেছে। আর আশাই করব না। ওপারে যাওয়ার আগে আর দেখাই হবে না হয়তো!’’ মণিময়ের স্ত্রী সুরভির চোখেও বিষাদের মেঘ। ওঁদের একমাত্র ছেলে আমেরিকাতে সেটল্ড। প্রায় বছর সাত হল ও ওখানেই আছে। একটি আমেরিকান মেয়েকে বিয়ে করেছে। এখন তো গ্রিন কার্ড হো্ল্ডার।
এই কারণে মণিময় ও তাঁর স্ত্রী বেশ ডিপ্রেসড থাকেন। কথাটা শোনার পরে অন্যরাও দীর্ঘশ্বাস চাপার চেষ্টা করছিলেন। ঘরের ভিতরে একটা অস্বস্তি ঘুরপাক খাচ্ছে। সেই সময় শিবাশিসই বলে উঠেছিলেন, ‘‘চলো, আমরা সবাই মিলে বেরিয়ে পড়ি। ছেলেমেয়েদের আসার প্রতীক্ষায় দিন গুনে, শরীর মন ক্ষয় না করে, এবার নিজেদের মতো করে জীবনটা উপভোগ করি!’’
‘‘গুড আইডিয়া’,’ লাফিয়ে উঠেছিলেন সুকোমল। ‘‘ঠিক বলেছিস! কার জন্য হা হুতাশ করব আমরা! ওরা আমাদের কথা কতটুকু ভাবে যে আমরা দিনরাত ওদের কথা চিন্তা করে মরব?’’
সবাই সমস্বরে বলে উঠেছিলেন, ‘‘ঠিক ঠিক, আমরা রাজি। আর তারই ফলস্বরূপ আজকের উত্তরবঙ্গ যাত্রা। লক্ষ্মীপুজোর দু’দিন পরেই রওনা হয়েছিলেন ওঁরা। রাতের আকাশে তাই জ্যোৎস্নার রেশ। দার্জিলিংয়ে একটা নামী ও দামি হোটেল বুক করা হয়েছিল। তিন দিনের জন্য সবাই রাজি ছিলেন ওই ব্যয়ভারটুকু বহন করতে। ‘কাদের জন্য টাকা রেখে যাব!’ এই মনোভাবই কাজ করেছিল পরোক্ষে। তাই খরচের কথা ভাবতে চাননি কেউই। সুন্দর হোটেল রুমের বারান্দা থেকে দেখা যায় উন্মুক্ত প্রকৃতি। আকাশের গায়ে কাঞ্চনজঙ্ঘা আর মেঘের লুকোচুরি। কখনও তার চূড়া উঁকি মারে তো পরক্ষণেই আবার মেঘে ঢেকে যায়। সকলেই খুব উত্তেজিত! খুশিতে উদ্বেল। যেন প্রথম যৌবনের দিনগুলোতে ফিরে গিয়েছেন সকলে।
দার্জিলিংয়ের চারপাশ গাড়ি করে ঘুরে সন্ধে নাগাদ হোটেল ফিরে এসেছেন সকলে। জামাকাপড় বদলে একটু ফ্রেশ হয়ে ব্যালকনিতে চেয়ার টেনে বসলেন অসিতাভ। আকাশে আজ অনেক তারা। বিক্ষিপ্ত টুকরো টুকরো মেঘ মাঝে মাঝে চাঁদকে ঢেকে দেওয়ার চেষ্টা করছে। মেঘ ছেঁড়া আলো তবু ফাঁকফোঁকর দিয়ে বেরিয়ে এসে গাছ গাছালির উপর পড়েছে। এ যেন এক অপার্থিব দৃশ্য! নাহ্, এখানে না এলে এই মনোরম অভিজ্ঞতা থেকে বঞ্চিতই থেকে যেতে হত জীবনভর।
‘‘কী হল শ্রী, প্রসাধন শেষ হল?’’
‘‘আহা, আমি যেন দিনরাত প্রসাধনই করি শুধু!’’
‘‘না, এখানে তো একটু অন্যরকম, তাই না, সেই জন্যই বলছিলাম...’’
‘‘বুঝেছি, এই পরিবেশে দেখে তুমি ভাবুক হয়ে গেলে নাকি?’
‘‘সে সুযোগ আর পাচ্ছি কই? আমার সঙ্গিনী তো একসঙ্গে বসে কিছু উপভোগই করছে না।’’
ঘর থেকে বেরিয়ে এসে পাশে চেয়ার টেনে বসতে বসতে শ্রীরাধা বলেন, ‘‘খুব হয়েছে। এই তো বসলাম। বলো কী বলছ?’’
‘‘বলার কিছু নেই আলাদা করে। ভাষা হারিয়ে যায় এমন প্রকৃতির মাঝে থাকলে।’’
‘‘ঠিকই বলেছ গো, কী শান্তি না এখানে!’’
‘‘হু...’’
‘‘‘এখানে না এলে সত্যি মিস করতাম। প্ল্যানটা কিন্তু দারুণ হয়েছে।’’
‘‘আচ্ছা, সমু তোমায় ফোন করেছিল?’’
‘‘না তো! কেন?’’
‘‘সমু বলেছিল এবারে পুজোতে বাড়িতে আসবেই। শেষ পর্যন্ত তো আর...’’
‘‘আবার সেই কথা ভাবছ? আরে ও বলল না, কী একটা প্রজেক্ট নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে, তাই ছুটি পাচ্ছে না। তুমি ভেবে খালি মন খারাপ করছ।’’
‘‘ ও সব অজুহাত শ্রী। না আসার অজুহাত...’’
‘‘থাক না ওসব কথা! এখন ক’টা দিন আমরা নিজেদের মতো করেই কাটাই।’’
‘‘শোনো শ্রী, সমুকে পুরোপুরি বাদ দিয়ে আমাদের জীবনটা তুমি ভাবতে পারো?’’
‘‘সে কি হয়?’’
‘‘তাহলে?’’
শ্রীরাধা চুপ করে যান। সমুর না আসায় নিজের মনের অবস্থাটা প্রকাশ করেন না স্বামীর কাছে। পাছে তাঁর শরীর আবার খারাপ হয়ে যায়। আলোচনা অসমাপ্ত থাকে। ডিনারের ডাক পরে ওই সময়। মনের মেঘলা কাটিয়ে আবার হইহই করে জড়ো হয় সকলে।
দু’দিন ধরে মেঘ রোদ্দুরের খেলা খেলে শেষে আজ ঝকঝকে আকাশ। কাঞ্চনজঙ্ঘা একেবারে সপার্ষদ বিদ্যমান। ব্রেকফাস্ট সেরে বেরনোর তোড়জোড় চলছে। আজই নীচে নেমে যাওয়ার কথা, ডুয়ার্সের দিকে। দুটো গাড়িও রেডি, মালপত্র তোলা হচ্ছে। হোটেলের সামনের রাস্তাটায় হাঁটাহাঁটি করে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত কাঞ্চনজঙ্ঘাকে কামেরাবন্দি করতে করতে একটু এগিয়ে গিয়েছেন অসিতাভ। শ্রীরূপা সঙ্গেই আছেন। পথের পাশে একটা গাছের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়াতে বললেন শ্রীরূপাকে।
‘‘উঁহু...উঁহু, হচ্ছে না, শালটা একটু ঠিক করে নাও। হ্যাঁ, ঠিক আছে। এই বার তাকাও আমার দিকে। ঠিক আছে, নড়বে না। এবার হাসো... আরে হাসো না একটু ...’’
বলতে না বলতেই, পাশের রাস্তা দিয়ে একটা গাড়ি যেতে যেতে স্পিডটা স্লো করল আর গাড়িটার জানালা দিয়ে একজোড়া চোখ ফোটো তোলার দৃশ্যটায় আটকে গেল। গাড়ি যতই এগিয়ে যাচ্ছে, মানুষটা ততই জানালা দিয়ে মাথাটা যতটা সম্ভব বের করে দৃশ্যটা ভাল ভাবে দেখার চেষ্টা করছে অবাক বিস্ময়ে।
‘‘আরে কী দেখছ কী এত, ঠিক ভাবে বসো না!’’ বর্ণালি একরকম খেঁকিয়ে উঠল সমিতাভ অর্থাৎ সমুকে। সমু এবার গাড়ির ভিতরে সোজা হয়ে বসল ঠিকই, তবে মনটা ভীষণ চঞ্চল হয়ে উঠল। কী দেখল ও! বাবা আর মা! কিন্তু সেটা কীভাবে সম্ভব? ঠিক দেখেছে তো? হোটেল ক্রস করার সময় দেখল হোটেলের গেটের কাছে কয়েকটা গাড়ি দাঁড়িয়ে। ওখানেই শিবাশিসকেও দেখতে পেল সমু, এক ঝলক।
‘‘এই শোনো, ওরা আর ফোন করেনি তো?’’
‘‘অ্যাঁ?’’ চমকে তাকালো সমু।
‘‘আরে তোমার বাবা মায়ের কথা বলছি। ফোন করেনি তো এর মধ্যে? বাব্বাঃ, শেষ মুহূর্তে তুমি যে বুদ্ধি করে পুজোয় বাড়িতে যাওয়াটা কাটাতে পেরেছ... বাঁচা গিয়েছে। না হলে, এত সুন্দর টুরটা মিস করতাম...বলো? তোমাদের বাড়িতে তো আবার লক্ষ্মীপুজো হয় বড় করে। আমার আর বাইরে বেরনই হত না!’’
সমু নির্বাক, নিরুত্তর।