এই গল্পটা সনাতন ঢালির। গল্পটা বোধহয় আমারও। গীতাঞ্জলি মেট্রো, নাকতলা, রামগড়, গাঙ্গুলিবাগান, রবীন্দ্রপল্লী অঞ্চলে রিকশা চালায় সনাতন। তখন সনাতন ভাঙাচোরা একটা রিকশা চালাত, ও লাইনে দাঁড়ালে অনেক প্যাসেঞ্জারই ওর বিবর্ণ রিকশা দেখে নাক কুঁচকে এড়িয়ে যেত। অন্য রিকশায় সওয়ার হত। রামগড়ে এক চায়ের দোকানে সনাতনের সঙ্গে প্রথম যে দিন আলাপ হয়, সে দিন ও দুঃখ করে কথাগুলো বলেছিল। ও বিড়ি টানতে টানতে গোষ্ঠগোপালের ‘এমন মানুষ পেলাম না রে যে আমায় ব্যথা দিল না’ গানটা ক্রমাগত সাত-আট বার লুপে গেয়ে চলেছিল। চায়ের দোকানের বেঞ্চিতে বসে ওই একটাই লাইন গাইছিল আর গেলাসের চায়ে চুমুক দিচ্ছিল। বিকেল গড়িয়ে তখন সন্ধে নেমে আসছিল, রাস্তার সিগন্যালের আলোগুলো লাল থেকে সবুজ হচ্ছিল। ওর লাইনের রিকশাগুলো একটার পর একটা আরোহী তুলে গন্তব্যের দিকে রওনা দিচ্ছিল, অথচ ও চুপ করে বসেছিল, একটার পর একটা সওয়ারি ছেড়ে দিচ্ছিল। চোখেমুখে একটা তাচ্ছিল্যভাব টেনে সনাতন বুঝিয়ে দিচ্ছিল, ও আপন মর্জির মালিক। আমার কানে ভাসছিল একটাই লাইন— ‘এমন মানুষ পেলাম না রে যে আমায় ব্যথা দিল না।’
“একটা বিড়ি হবে, ভাই?” ওর দিকে তাকিয়ে বলেছিলাম। হঠাৎই।
প্রথমে খানিকটা অবাক হলেও সনাতন একটা কালো সুতোর বিড়ি এগিয়ে দিয়েছিল আমার দিকে। ওর জ্বালানো দেশলাই থেকেই আমি বিড়িটা ধরিয়ে নিয়ে ওকে দেখছিলাম ভাল করে। সনাতনের বয়স বিয়াল্লিশ-তেতাল্লিশ, তোবড়ানো গাল, মুখে কাঁচাপাকা দাড়ি, তলার ঠোঁটটায় কালচে দাগ। চেহারায় কোনো বিশেষত্ব নেই, থাকার কথাও নয়। এই নিম্নবিত্ত মানুষগুলোর জিন-এ কোনও বিশেষত্ব থাকে না, এদের সবার ফেনোটাইপ অর্থাৎ চেহারা-ছবি একই রকমের হয়। ও কথা বলার সময় শ্বাস থেকে দেশি মদের কূট গন্ধ ভেসে আসছিল। আমি বোঝার চেষ্টা করছিলাম একটা রিকশাওয়ালাকে জীবনে কে কে ব্যথা দিতে পারে? সনাতন সম্ভবত ইস্কুল শেষ করেনি, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। তা হলে কোন বিদ্যুল্লতা ওকে ব্যথা দিয়ে থাকতে পারে? প্রশ্নটা আমাকে বার বার ভেতর থেকে খোঁচাচ্ছিল। আমার মতো ভদ্দরলোক বুদ্ধিজীবীদের অনেক রকম কল্পনাবিলাস থাকে, অথবা বলা যায় এগুলো এক ধরনের অনুশীলন, হাতে কোনও কাজ না থাকলে আমার মতো তথাকথিত শিক্ষিত মানুষেরা নিম্নতর অর্থনৈতিক অবস্থার মানুষদের এ রকম ভাবে কালচার করে। প্রশ্ন করে, তোমার ঘরে কে কে আছে? তোমার ছেলেমেয়ে কয়টি? রিকশা চালিয়ে রোজ কত আয় হয়? হ্যাঁ, এই শেষ প্রশ্নটিই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এটির উত্তর আমাদের নিজেদের একটা স্বস্তি দেয়, একটা অদৃশ্য সুরক্ষা বলয়ে ঢেকে রাখে।
আমি ভিন্ন রাস্তা নিয়েছিলাম। ওকে প্রশ্ন করেছিলাম, “সনাতন, তোমাকে জীবনে কে কে ব্যথা দিয়েছে বলো তো?”
প্রথমে হকচকিয়ে গেলেও প্রশ্নের পূর্বাপর বুঝতে পেরেই ও হেসে ফেলেছিল। বলেছিল, “কত ব্যথাই তো পেয়েছি, সব ব্যথা-বেদনার চিহ্ন কি আর গতরে লেগে থাকে?”
“সে তো বুঝেইছি। কেউ তোমায় দাগা দিয়েছে, সেই ব্যথাই বুকে বয়ে বেড়াচ্ছ, তাই তো?”
চায়ের গেলাসে চুমুক দিয়ে সনাতন হাসে আর মৃদু মৃদু মাথা নাড়ে। কিছু বলে না।
“তুমি রিকশা চালাচ্ছ না কেন? তখন থেকে দেখছি তুমি পর পর প্যাসেঞ্জার ছেড়ে দিচ্ছ। এখানে বসে বসেই তুমি চারটে ভাড়া ছাড়লে!”
“আজ আর ভাড়া খাটব
না কর্তা।”
“সে কী, কেন? এই ভর সন্ধেবেলায় তুমি ভাড়া না খেটে বাড়ি চলে যাবে?” অবাক হয়েই ওকে প্রশ্নটা করেছিলাম।
ফাঁকা চায়ের গেলাসটা রেখে সনাতন বলেছিল, “কর্তা, আপনি কীর্তন শোনেন? শ্রীকৃষ্ণকীর্তন, মানে নৌকাবিলাস, মানভঞ্জন… তার পর ধরেন, পালাকীর্তন, মানে রামি-চণ্ডীদাস, বিল্বমঙ্গল-চিন্তামণি?”
আমি চুপ করে বোঝার চেষ্টা করছিলাম সনাতন কথার মোড় কোন দিকে ঘোরাতে চাইছে।
আমাকে দ্বিধাগ্রস্ত দেখে সনাতন বলেছিল, “কর্তা, হাতে এট্টু সময় থাকলে আমার সঙ্গে চলেন। ব্যথা কোথায় পাই, আপনেরে বরং দেখায় আনি।”
ছুটির সন্ধেবেলা তেমন কোনও কাজ ছিল না। সনাতনের ইশারা বুঝতে পেরে চেপে বসেছিলাম তার রিকশায়। কিছু ক্ষণের মধ্যেই ওর রিকশা বড় রাস্তা ছেড়ে কাঁচা ড্রেনের পাশ দিয়ে সঙ্কীর্ণ গলি ধরে চলতে চলতে খালপাড়ের শেষ দিকটায় চলে এল। এ দিকে আমার বড় একটা আসা হয় না। বেশির ভাগ গা-ঘেঁষাঘেঁষি করা টালি বা টিনের চালের ঘর। এই কলোনি এলাকায় রাস্তার আলোগুলোও তেমন জ্বলে না। তার মধ্যেই একটা প্লাস্টারহীন দোতলা বাড়ির সামনে পৌঁছলাম। দু’-চার জন নারীপুরুষ দাঁড়িয়ে ছিল স্বল্পালোকিত গেটের মুখে।
সনাতন বাড়িটার কাছেই রিকশাটা এক পাশে দাঁড় করিয়ে তালা ঝুলিয়ে বলল, “কর্তা, আসেন।” সনাতনের পিছন পিছন দরজা দিয়ে ঢুকে পড়লাম। ঢুকে দেখি একটা চওড়া উঠোনের মেঝেতে তেরপল পাতা, তার ওপর বসে আছে নানা বয়সের নারী-পুরুষ-শিশু। আমরাও একটু এগিয়ে গিয়ে বসলাম।
“আজ বিনোদিনী কীর্তন গাইবে,” আমার কানের কাছে মুখ এনে সনাতন ফিসফিস করে বলল।
সন্ধে থেকেই সনাতন কিঞ্চিৎ রসসিক্ত ছিল। মুখটা যেন আরও উজ্জ্বল তার। আমি কোনও দিন কীর্তনগানের আসরে যাইনি। চারদিকে লক্ষ করছিলাম বেশির ভাগই নিম্নবিত্ত পরিবারের মানুষ। সাদামাঠা পোশাক, কিন্তু সবার চোখেমুখেই একটা অদ্ভুত উজ্জ্বলতা। সামনে এক টুকরো ফাঁকা জায়গাকে ঘিরে আমরা জনা ষাট-সত্তর লোক বসেছিলাম।
মিনিটপাঁচেক বাদে সেখানে যে নারী এসে দাঁড়াল, তাকে এক বার দেখলে আর এক বার ঘুরে তাকাতেই হয়। কীর্তনিয়া বিনোদিনী দাস। বয়স পঁয়ত্রিশের আশপাশে, মাজা-মাজা রং, আঁটোসাঁটো শরীর। পরনে লাল-সাদা প্রিন্টেড শিফন শাড়ি, একটি উত্তরীয় দিয়ে ভরাট বুকটি আড়াল করা। চোখে কাজল, ললাটে আঁকা রসকলি। তবে দেখতে পেলাম হাতে নোয়া, শাঁখা রয়েছে। একটি কিশোরী এসে বিনোদিনীর গলায় মোটা রজনীগন্ধার মালা পরিয়ে দিয়ে গেল। বাতাসে ভাসছে চন্দন আর অগুরুর গন্ধ। আমি পাশে বসা সনাতনের দিকে তাকালাম। সে ঈষৎ ঘোর-লাগা চোখে মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাকিয়ে।
স্ট্যান্ড লাগানো মাইকের সামনে দাঁড়িয়ে বিনোদিনী বলল, “অ বাবা, মায়েরা আজ হরিবাসরের শুরুতে তোমরা গোবিন্দকে কী দেবে গো? গোবিন্দকে তো আর অর্থ দেওয়া যায় না, কী দেবে বলো?”
সবাই নিশ্চুপ।
বিনোদিনী বলল, “বাবারা, মায়েরা, ভাইয়েরা, বোনেরা তোমাদের অহংটুকু আজ গোবিন্দকে দিয়ে যাও গো।”
সমস্বরে হরিধ্বনি উঠল। হারমোনিয়াম, ঢোল, করতালের সঙ্গতে কীর্তন গান শুরু হল। মেঝেয় বসা দোহারেরা বিনোদিনীর গানের পঙ্ক্তির শেষে ধুয়ো দিল। মধ্যযুবতী তন্ময় হয়ে দুলে দুলে গাইছিল। বিনোদিনীর কণ্ঠস্বর মদির হলেও কথা বলার ধরনে ঈষৎ গ্রাম্য টান। অথচ কী এক মদিরতা জড়িয়ে আছে, আমি টের পাচ্ছিলাম। সে একের পর এক গেয়ে চলল শ্রীরাধার মানভঞ্জন, নৌকাবিলাস। গাইতে গাইতে আচমকা বিনোদিনী আঙিনায় বসা শ্রোতাদের উদ্দেশে বলে উঠল, “এই হরিবাসরে সবচেয়ে মূল্যবান কী বলেন তো, বাবা? অ মা, জানো কি সবচাইতে দামি কী?”
শ্রোতাদের মধ্যে এক মুহূর্তের নীরবতা। পরক্ষণেই বিনোদিনী কান্নাভেজা গলায় বলল, “বৈষ্ণবের পদধূলি গো, বৈষ্ণবের পদধূলি। মহাপ্রভু বলেছেন, সে ধুলোয় যে আমার গোবিন্দ রয়েছে।” বলতে বলতেই নিচু হয়ে সে সাষ্টাঙ্গে প্রণিপাত করল সামনে বসা এক অপরিচিত বয়স্ক মানুষকে। যখন প্রণাম করে সে উঠে দাঁড়াল তখন তার দু’চোখ কান্নাভেজা, ফুঁপিয়ে কান্নার দমকে তার বুকখানি তিরতির করে কাঁপছে। মুখেচোখে অপূর্ব এক বিভা। ধরা গলায় সে হরিধ্বনি করে উঠল—“হরিবোল, হরিবোল। জয় গোবিন্দ, জয় নিতাই।” অমনি হরিবাসরের সকলে তার সঙ্গে গলা মিলিয়ে হরিধ্বনি করে উঠল।
সমস্ত হরিবাসরের ভেতরে যেন এক সাড়া পড়ে গেল। দু’টি সধবা বউ এসে বিনোদিনীকে জড়িয়ে ধরল। সেও তাদের নিবিড় ভাবে আলিঙ্গন করে অশ্রু বিসর্জন করতে লাগল। দেখতে দেখতে আসরের নারীরা পরস্পরকে আর পুরুষেরাও একে অপরকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগল। আমি পাশ ফিরে তাকাতেই সনাতন ঢালিও আমাকে জড়িয়ে ধরে আমার কাঁধে তার মুখটি রেখে কাঁদতে শুরু করল। টের পেলাম আমার বুকটাও যেন কেমন ভিজে উঠছে। তখনই আচমকা আমার চোখ পড়ল বিনোদিনীর চোখে। মনে হল কত দিন ধরে সে যেন আমাকেই দেখছে।
বিনোদিনীর অনুষ্ঠান চলেছিল ঘণ্টা দেড়েক। শেষ হতেই সনাতন আমাকে হাত ধরে বাইরে টেনে এনেছিল, যেন তার খুব তাড়া আছে। রাস্তায় এসে তার রিকশায় বসার সিটটা তুলে ভেতর থেকে একটা প্যাকেট বের করে এনে বলেছিল, “কর্তা, এই পেকেটটা এট্টু বিনোদিনীরে দিবেন, আমার হয়ে?”
“কী আছে এতে?”
“নিজেই দেখেন।”
আমি প্যাকেট খুলতেই দেখেছিলাম একটা রজনীগন্ধার মালা আর একটা নীল ধনেখালি শাড়ি।
মৃদু হেসে ওকে বলেছিলাম, “তা হলে সনাতন, এই হল তোমার ব্যথা?”
ও কিছু বলেনি। ওর অনুরোধটুকু রাখার জন্য কাতর চোখে তাকিয়েছিল শুধু। আমি ফিরে গিয়েছিলাম বাড়ির ভেতরে। কীর্তনিয়ার দল তখন ব্যাগপত্তর গুছিয়ে লক্ষ্মীকান্তপুর লোকাল ধরার জন্য তৈরি। শাড়ি আর মালাটা বিনোদিনীর হাতে তুলে দিতে সে ঠোঁট মুচড়ে হেসেছিল, “অ গোসাঁই, তোমার বন্ধুটি কেন নিজে এল না?”
আমি কোনও উত্তর না দিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিলাম।
“অ গোসাঁই, আমি যে কৃষ্ণসখী। তাঁর আনন্দরূপের হ্লাদিনী শক্তি,” বিনোদিনী মদিরকণ্ঠে বলেছিল, “আমাকে কি পাওয়া যায়? আমি যে গোবিন্দের। তোমার বন্ধুটিকে বোলো, ললিতাকে চাইলে পেতে পারে, বৃন্দাকেও পাওয়া যায় কিন্তু রাধারানিকে কী করে পাবে, সে যে কৃষ্ণের।”
যাওয়ার আগে শাড়ি আর গোড়ে মালাটা হাতে নিয়ে আমার চোখে গভীর দৃষ্টি হেনে সে বলেছিল, “তুমি কিন্তু আবার এস গোসাঁই।”
*****
আজ ফের সনাতনের কাছে এসেছি। হাসপাতালের বিছানায় ও বসে আছে। ঘন ঘন কাশছে আর রুগ্ণ বুকের খাঁচাটায় মাঝে মাঝে হাত বুলোচ্ছে। হপ্তাখানেক আগে হাসপাতালের আউটডোরে এনে আমিই ওকে ডাক্তার দেখিয়েছি। ডাক্তারবাবুরা বলেছেন, সনাতনের লিভার সিরোসিস হয়েছে, তার ওপর ফুসফুসের ব্যামো। আমিই ওকে হাসপাতালে ভর্তি করে দিয়েছি। সাধ্যমতো ওষুধপত্রও কিনে দিয়ে যাই। সনাতন দীর্ঘ দিন বিপত্নীক। আপনজন বলতে ওর বুড়ি মা আর বারো বছরের মেয়ে লক্ষ্মী। সনাতন বোধহয় আমাকেও ওর আপনজনই ভেবে নিয়েছে। মাঝে মাঝে কথা বলতে বলতে আমার হাতদু’টি চেপে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়ে, বিহ্বল চোখে অবোধের মতো আমাকে দেখে। বুঝতে পারি আমাকেও সে খুবই আপনার জন ভেবে বসেছে। তবে আমি তো জানি, আমি আসলে কী! আসলে আমি একটা গভীর চক্রান্ত করে চলেছি। আজকাল সব কথা আমি সনাতনকে বলিও না।
কাশতে কাশতে সনাতন বিছানার ওপর উঠে বসল, ফিসফিস করে বলল, “বিনোদিনীর খবর কী, কর্তা? দেখা হয়?”
“বিনোদিনীর কথা আমি কেমন করে জানব, সনাতন? সেই তোমার সঙ্গেই যা চার-পাঁচ বার গিয়েছিলাম তার কীর্তনের আসরে।”
আমি চেপে যাই অনেক কথা। সনাতনকে সব কথা বলা যায় না, বলিও না আমি। অথচ সনাতন আপনজন ভেবে আমার দিকে নিষ্পলক চেয়ে থাকে, ক্লিষ্ট হাসে।
বছরখানেক ধরেই আমাকে চুম্বকের মতো টানছে বিনোদিনী দাসের হরিবাসর। অফিস থেকে বেরিয়ে ট্রেন ধরে তার কীর্তন শুনতে কোনও দিন চলে যাই বারুইপুর, গোচরণ, দক্ষিণ বারাসত। আমার বৌ ভাবে, আমি বুঝি কোনও সাহিত্যসভায় গিয়েছি, নয়তো কোনও প্রকাশকের বাড়ি। সে সব দিনগুলোয় বিনোদিনীকে দেখার তৃষ্ণা মিটিয়ে আর কীর্তনগানের অনুরণনটুকু বুকে নিয়ে যখন বাড়ি ফিরি, তখন অনেক রাত হয়ে যায়।
“আমি কি বাঁচব না, কর্তা?” ছলছলে চোখে সনাতন প্রশ্ন করে।
আমি ওর প্রশ্ন এড়িয়ে যাই, বলি, “সনাতন, আজ আমি আসি, একটু কাজ আছে।”
ওর পাশে বসে থাকা লক্ষ্মীকে বাইরে ডেকে বলি, “কাল সকালে অফিস যাওয়ার আগে আমার সঙ্গে একটু দেখা করিস তো।”
ইদানীং এই সন্ধেগুলোয় আমার অনেক কাজ বেড়েছে। আমার ষড়যন্ত্রটাকে একটু একটু করে রূপ দিই। সনাতনের রিকশার মালিকের ডেরায় চলে যাই। ইদানীং লোকটাকে রাজি করিয়ে নতুন বন্দোবস্ত করেছি, সনাতনের রিকশাটা নিয়ে বাড়ি থেকে দূরে বেপাড়ায় চলে যাই। রানিং ভাড়া খাটি। তবে কোনও রিকশার স্ট্যান্ডের লাইনে দাঁড়াই
না। তাই অন্য রিকশাওয়ালাগুলো সন্দেহের চোখে তাকায়। ওরা বোধহয় বুঝতে পারে, আমি কারও রিকশা চুরি করে চালাচ্ছি।
কোনও কোনও দিন কাছেপিঠে বিনোদিনী দাসের কীর্তনের আসর থাকলে দু’-তিন ট্রিপ খেটেই রিকশার চেনে তালা ঝুলিয়ে চলে যাই। এ সব কথা সনাতন ঢালি কিচ্ছু জানে না। সে হাসপাতালের বিছানায় বসে কাশতে কাশতে রক্ত তুলে ফেলে, কখনও পেটের শূলবেদনায় খামচে ধরে বিছানার চাদর। আর বসে বসে ভাবে হাসপাতালের বাইরে বুঝি আমার মতো কোনও আপনজন আছে তার। বেচারা জানেই না, এক ষড়যন্ত্রকারী ক্রমেই জাল বিছিয়ে একে একে তার সমস্ত কিছু হরণ করে নিচ্ছে। তার সাধের পাঁজরভাঙা রিকশাটা, তার মরমি কীর্তনের আসর, তার গোষ্ঠগোপালের গান, তার বিনোদিনীর দেওয়া ব্যথাগুলো। সব, সব কিছু চুরি করে নিচ্ছে আমার মতো একটা ভদ্দরলোক।
তবে সনাতন তো আর জানে না তার কাছ থেকে চুরি করে নেওয়া ব্যথাগুলো দিনে-দিনে আমার ভিতরে বাড়ছে। বেড়েই চলেছে। আজকাল বিনোদিনীর সব কীর্তনের আসরে আমি যাই, তাকে নয়ন ভরে দেখি, চোখের ভাষায় দু’টি কথা বলি।
তবু বিনোদিনী টের পায়, তার আর আমার মাথুরপর্ব ক্রমেই অনন্ত হয়ে উঠছে।