Abosar

বৈকুণ্ঠপুর হল্ট

পার্থ দে

একটা আচমকা ঝাঁকুনিতে চটকা ভেঙে গেল। জানলার বাইরে চত্তির মাসের রোদ। জ্বালাপোড়া শুরু না হলেও তাপ ভালই। ট্রেনের দুলুনিতে তন্দ্রামতো এসে গিয়েছিল। সামনে তাকাতে দেখি কুশল দাঁত বের করে হাসছে, “বেশ তো একটা ঘুম দিয়ে নিলি। তৈরি হয়ে নে, বৈকুণ্ঠপুর ঢুকছে, এখানে গাড়ি বেশি ক্ষণ দাঁড়ায় না।”  

চোখ রগড়ে বাইরে তাকিয়ে দেখি, আমাদের ট্রেনটা একটা স্টেশনে ঢুকছে। কুশল উপরের বাঙ্ক থেকে আমাদের কাঁধের ব্যাগদুটো নামাল। কামরার আরও জনাকয়েক যাত্রী বোধহয় এখানেই নামবে। ব্যাগপত্তর নিয়ে তারাও লোকাল ট্রেনের দরজার কাছে এসে ভিড় জমিয়েছে। একটা বছরপাঁচেকের বাচ্চা ছেলে বাবা-মায়ের হাত ধরে ট্রেন থেকে নামার সময় আমার দিকে তাকিয়ে হাসল। হাসিটা অবিকল বুবুনের মতো।

স্টেশনে নামতেই মনটা জুড়িয়ে গেল। ছোট স্টেশন, মেটে প্ল্যাটফর্ম, দু’পাশে সার বেঁধে মাথা উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে কয়েকটা গাছ। শান-বাঁধানো হলুদ সাইনবোর্ডে মোটা-মোটা কালো অক্ষরে লেখা— বৈকুণ্ঠপুর হল্ট। দু’-চারটে কৃষ্ণচূড়া গাছ উজ্জ্বল কমলাবর্ণের ফুলে ছেয়ে আছে। তলা দিয়ে হাঁটলে মাথায়-কাঁধে টুপটাপ খসে পড়ছে। 

টিকিটঘরের পাশ দিয়ে বাইরে আসার গেট। বাইরে এসে দেখি বটতলার রিকশাস্ট্যান্ডে মাত্র একটাই রিকশা দাঁড়িয়ে। আশপাশের বেশির ভাগ দোকানপাট তপ্ত দুপুরে ঝাঁপ ফেলে দিয়েছে। দু’-চারটে যাও বা খোলা আছে তারাও ঝাঁপ ফেলব-ফেলব করছে। 

বুড়ো রিকশাওয়ালা বলল, “কোথায় যাবেন বাবু?”

আমি কুশলের দিকে তাকালাম। ঠিকানাটা ও জানে। বলতে খুব গ্লানি হচ্ছে যে, নিজের বাবা-মা কোথায় থাকে সেটাই জানি না! এই মুহূর্তে মা আর হিয়া দু’জনের উপরেই রাগ হচ্ছে আমার। ছেলে-বৌয়ের সঙ্গে কোন বাপ-মায়ের না রাগারাগি হয়! তা বলে রেগে দুম করে বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে হবে! আর বাবারও বলিহারি! মাকে বাধা পর্যন্ত দিল না। বড় হয়ে এখন বুঝতে পারি, বাবার মতো স্ত্রৈণ মানুষ খুব কম আছে।

“ষষ্ঠীতলার শ্রীকৃষ্ণ মিষ্টান্ন ভাণ্ডার চেনো? ছোট শীতলামন্দির পেরিয়ে। ওখানেই যাব জগদ্বন্ধু মিত্রের বাড়ি। চেনো তো?” কুশল গড়গড় করে বলে দিল।

‘‘হ্যাঁ বাবু,’’ বলে বুড়ো রিকশাওয়ালা আমাদের তুলে নিয়ে রিকশার প্যাডেলে চাপ দিল। আমি কুশলের দিকে তাকালাম। ওর মুখে চাপা হাসি। আমার বাবা-মায়ের এত সব খবর ও জানল কী করে! অবশ্য কুশল আমার সব কিছুই জানে। ছোটবেলা থেকে একই পাড়ায় আমরা বড় হয়েছি, একই স্কুলে পড়েছি। তার পর আমি ইঞ্জিনিয়ারিং পড়েছি, ও পড়ল ইংরেজি অনার্স। আমি সফটওয়্যার কোম্পানিতে, আর ও একটা নামকরা ইস্কুলে ইংরেজি পড়াচ্ছে। কুশলের ছবি তোলার নেশা সেই কলেজ শুরু থেকে। খুব ভাল নেচার ফোটোগ্রাফি করে, আমিও ইদানীং ওর এই নেশায় সামিল হয়ে পড়েছি। খুব দামি ডিএসএলআর ক্যামেরা আছে কুশলের। মাঝে-মাঝেই ছুটির দিন ছবি তোলার নেশায় দু’জনে মোটরবাইকে চড়ে বেরিয়ে পড়ি।

মাসছয়েক আগে মা-বাবা আমার সংসার ছেড়ে চলে যাওয়ার পর থেকেই খুব মনখারাপ করে থাকতাম। সাময়িক ডিপ্রেশনে চলে গিয়েছিলাম। ধীরে-ধীরে হিয়াও ওর ভুলগুলো বুঝতে পারছিল। মাঝে-মাঝে আফসোসও করত। কুশল এসে আমাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলত, “ওরা অভিমান করে চলে গিয়েছেন, তুই চাইলেই কি আর ফিরে আসবেন?”

আমার মনেও অনেক ক্ষোভ-অভিমান জমে ছিল। ঠিক করেছিলাম, আর কোনও দিন ওদের মুখই দেখব না। এত দিন পর আজ সকালে এসে কুশল আচমকা প্রস্তাবটা দিল, “চল, কাকু-কাকিমার ওখান থেকে ঘুরে আসি।” 

কুশল অবশ্য আমার ইচ্ছের উপর জোর খাটায়নি। বলল, “তোর রাগ পড়লে, ইচ্ছে হলে যাবি। তবে শুনেছি বৈকুণ্ঠপুর জায়গাটা বেশ নিরিবিলি।” 

কেন জানি না আমিও ওর কথায় রাজি হয়ে গিয়েছিলাম। 

একটা সবুজ দোতলা বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল আমাদের রিকশাটা। কুশল ইশারায় বোঝাল, দোতলায় বাড়িওয়ালা থাকেন আর একতলায় আমার বাবা-মা। দরজায় দাঁড়িয়ে দ্বিধাগ্রস্ত মুখে বেল টিপলাম। আমার হাতে এখানকার শ্রীকৃষ্ণ মিষ্টান্ন ভাণ্ডার থেকে কেনা মিষ্টির প্যাকেট। এখানে ডায়াবেটিক মিষ্টি পাইনি, খানদশেক জলভরা সন্দেশ নিয়েছি বাবার জন্য।

দরজাটা খুলেই মা একটু থমকে তাকাল। আমার মুখের দিকে তাকিয়ে কী যেন খুঁজে চলেছে। এখনও কথা বলছে না। বোবা বিস্ময়ের ভাবটা লেপটে আছে মুখেচোখে। দুপুরবেলা অসময়ে এসে পড়লাম বলেই কি মায়ের হতভম্ব ভাবটা কাটছে না! হয়তো ভাবছে, এমন করে না জানিয়ে চলে এসেছি, কী খেতে দেবে! জানা থাকলে দু’মুঠো চাল বেশি নিতে পারত। অবশ্য তাতে কী, আমি তো জানি, মা ঠিক নিজের ভাগ থেকে আমায় দিয়ে দেবে। 

আমি চৌকাঠের এ পাশে দাঁড়িয়েই মাকে দেখছিলাম। সামনের চুলগুলো আরও পেকেছে। ছলছলে চোখে আমার দিকে তাকিয়ে ছিল মা। 

“কী হল, কিছু বলছ না যে? এখনও হিয়া আর আমার উপর রাগ করে আছ?” আমিই প্রথমে মুখ খুললাম।

“তোকে কত দিন পর দেখলাম রে! দেখে আমার আশ মিটছে না যেন,” এত ক্ষণ আটকে রাখা চোখের জলটা মায়ের দু’গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ল, “আয়, ভিতরে আয়, বউমা আর বুবুনসোনা কেমন আছে...ও মা, কুশল, তুইও এসেছিস?” 

“আসব না! কাকুর ফোনটা পেয়েই তো রনোকে বগলদাবা করে নিয়ে হাজির হলাম,” পিছন থেকে মুখ বাড়িয়ে কুশল বলল। 

আমি ওর দিকে জিজ্ঞাসু 

চোখে তাকালাম, “বাবা... মানে বাবা তোকে ফোন করে ডেকেছে? কই বলিসনি তো?”

আমাকে পাত্তা না দিয়ে কুশল পাশ কাটিয়ে ঘরে ঢুকেই বাতাসে নাক টেনে বলল, “আহ্ কী সুন্দর গন্ধ ছেড়েছে, কী যেন একটা ভাজা হচ্ছে, কী রেঁধেছ গো কাকিমা?”

খানিক দ্বিধাগ্রস্ত গলায় মা বলল, “তোরা যে আসবি উনি আমাকে এক বারও বলেননি। সত্যি এক-একটা সময় উনি আমায় এমন লজ্জায় ফেলে দেন! আজ একদম ভাল রান্না হয়নি... তোদের যে কী দিয়ে খেতে দিই!”

“তাতে কী? কাকিমা, তুমি কী রেঁধেছ তাই বলো না!”

“পাটশাক দিয়ে ডাল, কালো সর্ষে দিয়ে থোড়, আলু-পটলের তরকারি, সর্ষে দিয়ে বাটামাছের ঝাল আর যেটা এখন ভাজা হচ্ছে সেটা হল কুমড়োফুলের বড়া,” শেষ কথাটা বলে মা আমার দিকে তাকায়। 

আমি জানি মা কেন আমার দিকে তাকাল। সেই ছোটবেলা থেকে আমি কুমড়োফুল আর পাটশাকের বড়া খেতে ভালবাসি। যখনই মা ভাজত, আমি রান্নাঘরের আশপাশে ঘুরঘুর করতাম। মা নিজে ডেকে আমার হাতে দু’টো-চারটে বড়া ধরিয়ে দিলে আমি সারা বাড়ি ঘুরে-ঘুরে খেতাম। আমার আসার কথাটা তো বাবা জানায়নি, তা সত্ত্বেও কেন মা কুমড়োফুল ভাজল? 

একটা খুট করে দরজা খোলার শব্দে চেয়ে দেখি, বাবা বাথরুম থেকে বেরিয়ে আসছে। ভিজে চুল, বাবার ফর্সা গায়ে ফোঁটা-ফোঁটা জল। পরনে সেই চেক-কাটা লুঙ্গিটা। এটা হিয়ার খুব অপছন্দ ছিল। বলত, “আজকাল কেউ ঘরে লুঙ্গি পরে না কি, বাবাকে পাজামা পরতে বলতে পারো না!”

বাবার মুখের দিকে তাকালাম। দিব্যি তো আছে। মায়ের আদরযত্নে স্বাস্থ্য একটুও টসকায়নি। মুখ দেখে তো মনে হয় না আমাদের আদৌ মিস করে। ঠিক তখনই বাবা আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “বৌমা আর দাদুভাই কেমন আছে?”

বাবা একদৃষ্টিতে আমাকে দেখছে। আমার মনের কথাগুলো পড়তে পারছে কি? অস্বস্তি ঢাকতে বললাম, “আসলে এখানে আসাটা হঠাৎ করেই ঠিক হল। তোমার ফোনের কথাটা কুশল আমাকে আগে জানায়নি। ট্রেনে ওঠার আগে পর্যন্ত জানতে পারিনি আমরা বৈকুণ্ঠপুরে আসছি। জানা থাকলে...”

“থাক, ওদের না এনে ভালই করেছ। এত দূরের পথ, ওদের কষ্ট হত,” আমাকে মাঝপথে থামিয়ে বাবা বলে ওঠে।

আমার একটু রাগই হয়েছে। বললাম, “কিন্তু কুশলকে ফোন করেছিলে কেন? ফোনটা তো আমাকেই করতে পারতে। দরকারটা আমাকে বলা যায় না?” 

বাবা কেমন হতভম্ব হয়ে তাকাল। কুশল হেসে বলল, “রনো, তুই ব্যাপারটা ও ভাবে নিচ্ছিস কেন। আমি বিয়ে-থা করিনি, ঝাড়া হাত-পা, ফোন করলেই টুক করে চলে আসতে পারব। তাই হয়তো...”

“অনেক হয়েছে, এ বার সবাই মিলে খেতে বোস দেখি,” আমাদের কথার মাঝখানে ঢুকে পড়ে মা বলে। 

রান্নাঘর-ঘেঁষা লাল সিমেন্টের মেঝেতে আমরা খেতে বসেছি। বাবার দু’পাশে কুশল আর আমি। আমি ঘরের চারদিকে চোখ বোলাচ্ছিলাম। দু’টো মাত্র ঘর, রান্নাঘর, বাথরুম, একটা বারান্দাও আছে। বাড়িওয়ালা জগদ্বন্ধু মিত্র দোতলায় থাকেন।  

মায়ের রান্নার স্বাদ আগের মতোই আছে। পৃথিবীর অনেক কিছু বদলালেও এটা একমাত্র ধ্রুবক। বাবাও বদলায়নি, নিঃশব্দ ইঙ্গিতে মাকে সমানে নির্দেশ দিয়ে চলেছে আমার পাতে যেন বড় মাছ পড়ে, বেশি ভাত দেয়। 

“বাবা, তুমি এখনও বলোনি কেন ফোন করেছিলে?” আমি বললাম। 

ঘরের হাওয়া ফের গম্ভীর হয়ে গেল। বাবা আগের মতোই নীরব। কুশলটাও মাথা নিচু করে খাওয়ায় ব্যস্ত। মা বলল, “সে হবে’খন, তুই আগে খেয়ে নে। তোকে আর-একটা কুমড়োফুল ভাজা দিই?”

খাওয়াদাওয়া সেরে টানা বারান্দাটায় এসে একটা সিগারেট ধরিয়েছি। বারান্দার ডান দিকে একটা পুকুর। বাঁধানো ঘাট। চারটে পাড় জুড়েই সবুজ গাছগাছালি। বাঁ দিকে রাস্তা পেরিয়ে বিশাল খেলার মাঠ। দু’প্রান্তে বারপোস্ট লাগানো। রোদটা কমে এলেই পাড়ার ছেলেরা খেলতে নামবে। বাবা নিশ্চয়ই বিকেলে চেয়ার পেতে বারান্দায় বসে। মানুষটা ফুটবল খুব ভালবাসে। গত বিশ্বকাপের সময় আমার সঙ্গে রাত জেগে বসে খেলা দেখেছে। হয়তো আমি ঘুমে ঢুলে পড়েছি, কিন্তু বাবা ঠায় বসে খেলা দেখে গিয়েছে। 

“কাল রনোর বড়মামা আসছেন শিকাগো থেকে। এত দিন পরে আসছেন, যত্নআত্তি না করলে চলে! বুঝলে কুশল, এখন আমার শরীরের যা অবস্থা, তাতে আর দৌড়ঝাঁপ করতে পারি না,” ঘরের ভিতর থেকে ভেসে আসছিল বাবার কথাগুলো। 

আমি সিগারেটটা ফেলে ঘরে ঢুকে একরাশ বিরক্তি ঝরিয়ে বললাম, “বড়মামা আসছেন, সে কথাটা তো আমাকে বললেই পারতে, বাবা!”

“না, আসলে তুমি ব্যস্ত মানুষ, ছুটিছাটা কম। কুশলের ইস্কুলের পরীক্ষাগুলো শেষ। ও কিছুটা ফ্রি আছে, চাইলেই দু’-চার দিন এখানে থেকে যেতে পারে, তা ছাড়া কুশল তো আর পর নয়, ঘরের ছেলের মতো।” 

“তুমি কুশলকে নির্ভাবনায় দায়িত্বটা দিতে পারছ, আর আমাকে সমস্যাটাও জানাতে পারোনি,” রাগে ফেটে পড়ি আমি। 

মা রান্নাঘর গোছাচ্ছিল, আমার চিৎকার শুনে ছুটে আসে। কুশল এসে কাঁধে হাত রেখে বলে, “রনো, তুই ব্যাপারটা ও ভাবে নিস না। তুই হুট করে ছুটি পাবি না। তা ছাড়া হিয়াকেও কিছু জানিয়ে আসিসনি। এ বারটা না হয় আমি সামলে দিই।”

‘‘তাতে কী? হিয়াকে একটা ফোন করে...’’ বলতে গিয়েও থমকে যাই। আমি বাবা-মায়ের কাছে এসেছি, তাও ওকে কিছু না জানিয়ে। এখন আবার বৈকুণ্ঠপুরে থেকে যেতে চাইছি। এত বড় একটা কথা ফোনে এ ভাবে সত্যিই হিয়াকে বলা যায় না। নিজের রাগটা গিলে ফেলতেই একটা হতাশাবোধ ফিরে এল। নিঃশব্দে ঘর ছেড়ে ফের বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম। এই মাঝদুপুরে কোথায় যেন একটা কোকিল বেদনার্ত স্বরে ডেকে উঠল। 

মা কখন পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে টের পাইনি। মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, “খোকা, মন খারাপ করিস না। তুই নিশ্চিন্তে ফিরে যা, এ বারটা না হয় কুশল সামলে দিক। পরে না হয় সময়-সুযোগ হলে আসিস।”

একটা কষ্টের হাসি মুখে টেনে বললাম, “বেশ, তাই হবে মা। তবে তোমাদের এই বৈকুণ্ঠপুর জায়গাটা কিন্তু বেশ। বাবা বরাবর কলকাতা ছেড়ে এমন শান্ত নিরিবিলি জায়গাতে থাকতে চাইত।”

বিকেল গড়িয়ে গেল। মায়ের হাতের চা খেয়ে ব্যাগ নিয়ে তৈরি হলাম। সন্ধে সাতটার ডাউন ট্রেন ধরব। মায়ের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করার সময় দেখলাম আঁচলের খুট দিয়ে চোখের জল মুছছে। বাবার মুখে অবশ্য একটা বিষণ্ণ হাসি ফুটে উঠল। বলল, “সাবধানে যাবে। গিয়ে একটা পৌঁছ-সংবাদ দিয়ো।”

বাইরে এসে দেখি, সকালের সেই বুড়ো রিকশাওয়ালাটা হাজির। রিকশায় তুলে দিয়ে কুশল হাসল, “মনখারাপ করিস না। একটুও ভাবিস না। বাজারহাট সব করে দেব, তোর বড়মামাকে এ দিকটা ঘুরিয়ে দেখিয়ে দেব। কী অপূর্ব জায়গা বল! ক্যামেরাটা ব্যাগে আছে, যা ছবি 

হবে না!”

ফেরার ট্রেনটা সময় মতোই এল। উঠেই জানলার ধারে একটা সিট পেয়ে গেলাম। কামরায় লোকজন বেশ কমই। হঠাৎ মনে হল হিয়াকে ফোন করে জানানো দরকার যে ফিরতে রাত হবে। অথচ ফোনে টাওয়ার নেই। এ দিক-ও দিক তাকাতে চোখে পড়ল, সকালের সেই বাচ্চা ছেলেটা। কোণের দিকের সিটে বসে আছে। মুখে বিষণ্ণতা, সকালের সেই হাসিটুকু যেন হারিয়ে গিয়েছে। আশপাশে ওর বাবা-মাকে খুঁজলাম, দেখতে পেলাম না। আচমকা আমার শরীর জুড়েও ক্লান্তি নেমে এল। চোখদু’টো বুজে এল, একটু ঘুম চাই আমার। 

চোখ মেলতেই উজ্জ্বল আলোয় চোখ ধাঁধিয়ে গেল। একটা বড় ঠান্ডা ঘরের বিছানায় শুয়ে আছি। সারবাঁধা বেডগুলোয় আমার মতোই কিছু মানুষ শুয়ে। চোখ খুলতে কষ্ট হচ্ছিল, সামনে দাঁড়ানো সাদা পোশাকের নার্স চেঁচিয়ে উঠল, “ডক্টর, প্লিজ় আসুন, বেড নম্বর ছয় রেসপন্স করছে!”

ভাল করে তাকাতে বুঝলাম, আমার মুখের ভিতর মোটাসোটা একটা নল ঢোকানো। পাশে একটা চেয়ারে বসে হিয়া আমার হাতটা ধরে আছে। ওর চোখে জল, মুখে স্বস্তির হাসি। মুখটা ঝুঁকিয়ে কাছে এনে বলল, “রনো, কেমন লাগছে এখন? বারো দিন পর তুমি কোমা থেকে ফিরে এলে।”

আমার সব কিছু মনে পড়ে যাচ্ছে। কুশল বাইক চালাচ্ছিল, আমি পিছনে বসেছিলাম। 

আমাদের রবিবারের নেচার ফোটোগ্রাফির দিন ছিল। সায়েন্স সিটি পেরিয়ে আমরা মোটরবাইকে ঘটকপুকুরের দিকে যাচ্ছিলাম। ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ পেরিয়ে হেয়ারপিন টার্নটায় উল্টো দিক 

থেকে একটা ট্রাক আচমকা সামনে এসে পড়ল…

হিয়ার পিছন থেকে হঠাৎ বুবুন মুখ বাড়াল। চোখমুখের হতভম্ব ভাবটা কাটিয়ে ও হাসছে। ওর হাসিটা আমার মন ভাল করে দিল। শুনতে পেলাম হিয়া বলছে, “ওরা কুশলদাকে বাঁচাতে পারেনি, খুব ব্লিডিং হয়েছিল, হাসপাতালে আনার আগেই...আরও একটা দুঃসংবাদ আছে...”

ক্লান্ত চোখদুটো বুজে আমি বললাম, “জানি। বড়মামা...”

আমার বন্ধ চোখের সামনে তখন ভেসে উঠল একটা মেটে প্ল্যাটফর্ম। চৈত্রপবনে কৃষ্ণচূড়া গাছ থেকে খসে পড়ছে ফুল। হলুদ সাইনবোর্ডে কালো হরফে লেখা বৈকুণ্ঠপুর হল্ট। এয়ারলাইন্সের ট্যাগ লাগানো একটা ট্রলিব্যাগ টানতে-টানতে ক্লান্ত পা ফেলে প্ল্যাটফর্ম ধরে এগিয়ে চলেছেন আমার বড়মামা।