বারান্দায় পা রেখেই চেঁচালেন তমালবাবু, “সাধনা। শুনছ? ওরা বলছে আজই নাকি বৃষ্টি আসবে!” সাধনা গরম তেলে ফোড়ন দিলেন। সাড়াশব্দ করলেন না, করা উচিতও নয়। শহরে ভরা রৌদ্রদিন, এই সময় যে লোক বৃষ্টির পূর্বাভাসের গল্প শোনায়, তার সঙ্গে কথা বলার অর্থ হয় না। তিনি বললেন, “বাজারের থলি খালি করো। এত বেলা করো রোজ রোজ!”
তমালবাবু বেজার মুখে ব্যাগ খালি করছেন, মিনমিন করে বললেন, “তুমি আমার কথাটা ইগনোর করলে সাধনা? সত্যিই বৃষ্টি আসছে। অবশ্য কাগজে দেয়নি, টিভি চ্যানেলগুলোও খবর পায়নি এখনও, কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়া সরগরম, চায়ের দোকানও। এ রকম জটিল নিম্নচাপ নাকি আগে হয়নি। হু-হু করে জলীয় বাষ্প ধেয়ে আসছে বর্গি সেনার মতো। তুমুল ঝড় বৃষ্টি হবে সাধনা, কেলেঙ্কারি কাণ্ড!”
সাধনা রান্নাঘরের জানলা দিয়ে বাইরে তাকালেন। পিচ গলানো রোদ পথেঘাটে। যে কোনও দিন খরা ঘোষণা করবে হাওয়া-অফিস। আর এই লোক ঝড়জলের খবর দিচ্ছে! তিনি শীতল স্বরে বললেন, “মাছগুলো বার করো, কী এনেছ দেখি।”
তমালবাবুর স্বর হঠাৎই খুশিতে ডগমগ, “আরে, দারুণ মৌরলা মাছ পেয়ে গেছি আজ! বুঁচকির তো আবার মৌরলা মাছের টক পেলে আর কিছু চাই না। আছে কোথায় সে?”
**
যে মেয়ের ডাকনাম বুঁচকি, তার ভাল নাম প্রজ্ঞালাবণী। সে এই মুহূর্তে দোতলার ব্যালকনিতে টাঙানো দোলনায় দুলছে। তার হাতে একটা বই। প্রাণপণ চেষ্টাতেও সে পড়ায় মন বসাতে পারছে না। অশান্ত মন ছোট্ট বাঁদরশিশুর মতো এ-ডাল ও-ডালে লাফিয়ে বেড়াচ্ছে।
তমালবাবু মেয়ের পাশে মোড়ায় বসে হাসিমুখে জানতে চাইলেন, “তা, এ বার কারণটা কী?”
প্রজ্ঞালাবণী বই মুড়ে রেখে দিয়ে সহজ ভাবে বলল, “পাখি।”
“অ্যাঁ! শেষমেশ পাখি!”
তমালবাবু কৌতুকের হাসি হাসলেন। বিয়ের এক বছরের মধ্যেই যদি কোনও মেয়ে তিন-তিন বার রাগ করে শ্বশুরবাড়ি থেকে বাপের বাড়ি চলে আসে, তবে মেয়ের বাবার মুখে হাসি থাকার কথা নয়।
তার পরও তমালবাবু হাসছেন, তার কারণ নিজের মেয়েকে তিনি ভাল করে চেনেন। আর চেনেন জামাইকে। সম্বন্ধ করার সময় জানতে পেয়েছিলেন সরকারি যে দফতরে ছেলে কাজ করে সেখানে নাকি ডান হাত আর বাঁ হাত সমানে চালানোর প্রচুর সুযোগ। তবে উৎকোচ তো আর আজকের দিনে সামাজিক গ্লানি নয়, বরং দারুণ গৌরবের বিষয়। এই সে দিনই চায়ের দোকানের আড্ডার সমীর ঘোষাল তো উচ্চকণ্ঠেই বলে দিলেন, “আমার বাবাজীবনের বাঁ হাত কতটা সচল, তা আপনি ভাবতে পারবেন না চ্যাটার্জিদা। যে পরিমাণ উপরি আসে, মাইনে তো তার তুলনায় নস্যি মশায়, হা হা হা।”
অচিরেই তমালবাবু বুঝেছিলেন এই ছেলে অন্য রকম। এ সব্যসাচী নয়, দু’হাত সমানে চলে না এর। বরং যেন অনেক আলাভোলা প্রকৃতির। সাধনারও জামাই পছন্দ, আপনভোলা টাইপের অর্পণ তাঁর কাছে ষাঁড় ছাড়া শিবঠাকুর।
সমস্যা লাবণীর। ছেলেটাকে সে বুঝে উঠতে পারে না। নেশা নেই, আড্ডা নেই, না আছে অ্যাম্বিশন। এমন লোকেরা সচরাচর গল্প, কবিতা লেখে, অর্পণের সে সবেরও বালাই নেই। সে শুধু ভাবে। আকাশপাতাল ভাবে। বৃষ্টি নামলে সে প্রায় ভাবসমাধির পর্যায়ে পৌঁছে যায় আর লাবণীকে একটু বেশিই ভালবাসে।
বিয়ের আগেই চমকে গেছিল লাবণী। সে প্রশ্ন করেছিল, “এক্সট্রা কারিকুলার অ্যাকটিভিটি কিছু টিকিয়ে রাখতে পেরেছেন, না কি শুধু বাড়ি টু অফিস আর অফিস টু বাড়ি?”
অর্পণ লাজুক হেসে মাথা নামিয়ে নিয়েছিল, আর তার পর বলেছিল, “তেমন কিছু না, শুধু একটা স্পেশাল ট্যালেন্ট আছে। জানেন তো, আমি না, বৃষ্টির ভাষা বুঝতে পারি।”
এই কথার অর্থ বুঝতে সময় লেগেছিল লাবণীর। বিয়ের পর অবশ্য বুঝেছিল একটু-একটু করে। বুঝে ওঠার পর হাসবে না কাঁদবে বুঝে উঠতে পারেনি লাবণী।
অফিস বেরনোর মুখে যে দিন হঠাৎ বৃষ্টি নামল, লাবণী কৌতুকের ছলে জানতে চাইল, “এই যে মশাই, কী বলছে আজ বৃষ্টি?”
অর্পণ ভাবলেশহীন মুখে বলেছিল, “উঁহু, আজ নো ননসেন্স বৃষ্টি। বৃষ্টি বলছে, আজ ও এসেছে শুধুই পৃথিবীকে শস্যশ্যামলা করতে, আজ তার সিরিয়াস কাজের দিন।”
থমকে গিয়েছিল লাবণী।
লাবণীর প্রিয় ছোটমামা মারা যাওয়ার রাতেও তো নেমেছিল ঝিরঝির ইলশেগুঁড়ি। লাবণীর চোখের জল মুছে অর্পণ বিড়বিড় করেছিল, “আজ বৃষ্টি কী বলছে শুনছ লাবণী? ওই শোনো, বৃষ্টি আজ এসেছে শুধু তোমার দুঃখে কাঁদবে বলে। সারা রাত বৃষ্টির সেই কান্না আগলে রাখবে তোমায়। শান্ত হও লাবণী, সব শোক-তাপ সময়ের সঙ্গে মিলিয়ে যাবে।”
বিয়ের পরের প্রথম বর্ষাকাল। ঘুমোনোর আগে রাতে বৃষ্টির তোড় হঠাৎ বেড়ে গেছিল।
অর্পণ ঘন হয়ে এসেছিল বিছানায়, “ওই শোনো, আজ আবার বৃষ্টি কথা বলছে। এ বার বলছে, এটা শুধু ভালবাসায় ভিজে যাওয়ার রাত্রি… তুমি কি শুনতে পাচ্ছ না লাবণী?”
বেডরুমের আবছা আলোয় স্বামীকে সে দিন অলীক মানুষ মনে হয়েছিল লাবণীর। শরীরের প্রতিটি রোমকূপে জেগে উঠেছিল পদ্মকাঁটা। শিউরে উঠে লাবণী আঁকড়ে ধরেছিল অর্পণকে, “চুপ করো। চুপ করো, প্লিজ়। আর পারছি না আমি।”
আলতো হাতে এর পর লাবণীর শিথিল খোঁপা খুলে দিয়েছিল অর্পণ। আবরণহীন লাবণী… এলোকেশী লাবণীর শরীর থেকে প্রথম বৃষ্টির ভাপ উঠেছিল।
সেই ছেলেকে ছেড়ে লাবণী আবারও চলে এসেছে।
প্রথম বার কারণ ছিল, কোথায় বেড়াতে যাওয়া যায় তাই নিয়ে ঝগড়া। লাবণী চেয়েছিল সমুদ্রে যেতে। অর্পণ পত্রপাঠ রাজি হয়েছিল। আর তাতেই সাংঘাতিক রেগে গিয়েছিল লাবণী।
আসলেই কি অর্পণের কোনও ইচ্ছে-অনিচ্ছে আছে? না কি লাবণী যা বলবে, তা-ই মেনে নিতে হবে চুপচাপ! অর্পণ যদি ‘পাহাড়’ বলে চেঁচিয়ে উঠে প্রতিবাদ করত, সম্ভবত বেশি খুশি হত লাবণী। এমন ব্যক্তিত্বহীন ছেলের সঙ্গে থাকা সম্ভব?
দ্বিতীয় বার লাবণীর চলে আসার কারণ ছিল বৃষ্টি। প্রথম বৃষ্টিতে লাবণী ভিজতে চেয়েছিল অর্পণদের প্রকাণ্ড ছাদটায়। এমন ছাদ পৃথিবীতে খুব বেশি নেই। উত্তর কলকাতার প্রকাণ্ড ছাদ, উঁচু উঁচু বুক সমান সিমেন্টের পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। কিন্তু অর্পণ নিচু গলায় বলেছিল, “দু’দিন আগেই টনসিলের ব্যথায় কষ্ট পেলে, আজ না হয় না-ই ভিজলে, লাবণী!”
লাবণী কয়েক মুহূর্ত জ্বলন্ত চোখে তাকিয়ে ছিল গোবেচারা ছেলেটার দিকে। এই ছেলে কথায় কথায় তাকে ‘রাজেন্দ্রাণী’ বলে ডাকে। সেই রাজেন্দ্রাণীর ছাদে উঠে সামান্য বৃষ্টি ভেজার স্বাধীনতাটুকু থাকবে না! এই অবমাননা আর যে-ই মানুক প্রজ্ঞালাবণী মেনে নেবে না।
যে ছেলে ভাবুক-ভাবুক অভিনয় করে, বৃষ্টির ভাষার অভিধান লিখবে ভাবে, অথচ বছরের প্রথম বৃষ্টিতে ভিজতে দেয় না, তার সঙ্গে কি অমন সুন্দর ছাদের ওপর এক সঙ্গে থাকা চলে? ছাদের ওপর তো দূর, এমন ছেলের সঙ্গে ওই ছাদের নীচেও এক দণ্ড থাকা চলে না।
এ বারের কারণ পাখি। ঘরে একটা পোষ্য থাকুক, এটা লাবণীর বিয়ের পর থেকেই ইচ্ছে। প্রতি বারই নাকচ করেছে অর্পণ। মাছ?— না লাবণী, বদ্ধ জলে ওদের আটকে রাখা একটা অমানবিক ব্যাপার।
কুকুর, বেড়াল?— না লাবণী, ওরা তো আদতে জংলি জানোয়ার। মানুষকে বিশ্বাস করে জঙ্গল ছেড়ে আমাদের সঙ্গে লোকালয়ে এসেছিল এক দিন। শুধুমাত্র বুদ্ধির বলে আর পয়সার জোরে তাদের গলায় বকলস পরানো কি ভাল কথা?
মরিয়া লাবণী শেষমেশ এসে ঠেকেছিল পাখিতে। সেই প্রসঙ্গে অর্পণ বলেছিল, “অমন রঙিন পাখি, ওদের আকাশেই মানায় লাবণী। ওইটুকু ছোট্ট খাঁচায় ওদের কি দম বন্ধ হয়ে যাবে না, বলো?”
এর চেয়ে বেশি বেচাল সহ্য করার ক্ষমতা ঈশ্বর লাবণীকে দেননি। অতঃপর আবার হলুদ ট্যাক্সি, আবার বেলা দুপুরে বাপের বাড়ি।
তমালবাবু আবারও মনে মনে হাসলেন, তিনি মেয়েকে চেনেন। মেয়ের রাগ আসে দমকা হাওয়ার মতো, কিন্তু যেতে সময় নেয়। কিন্তু এই বাড়িতে আসা ইস্তক তার মুখে ‘অর্পণ’ ছাড়া অন্য কথা থাকে না।
প্রথম দু’বার অর্পণ দ্বিতীয় দিনের মাথায় এসে হাজির হয়েছিল। বন্ধ দরজার আড়ালে কী সব কথা হয় আর তার পর দিনই হাসিমুখে অর্পণের সঙ্গে ফিরে যায় মেয়ে।
আজ সাত দিন হল মেয়ে এসেছে। এখনও অর্পণ এল না।
একটা গুরুগম্ভীর শব্দে বারান্দা থেকে আকাশের দিকে তাকালেন তমালবাবু। রাজনৈতিক সমাবেশে সমর্থকদের মতো আকাশে জড়ো হচ্ছে কালো মেঘের দল।
ছেলেটার হাতে একটা মস্ত খাঁচা। তার ভিতর মোটে দু’-তিনটে পাখি। এই ক’টা পাখির জন্য এত বড় খাঁচা কেউ কেনে না, দোকানদারও অবাক হয়েছিলেন, ছেলেটি তাঁকে বলেছে, “একটু হাত-পা ছড়িয়ে থাকতে পারবে তা হলে। আপনি এটাই দিন।”
ছেলেটা পায়ে-পায়ে রবিবারের হাট থেকে এগোচ্ছে বড় রাস্তার দিকে। এত বড় খাঁচা নিয়ে তাকে বাসে উঠতে দেওয়া হবে কি না, বুঝতে পারছে না সে। খাঁচার পাখিদের দিকে তাকিয়ে মন খারাপ লাগছে তার। কিন্তু ভালবাসা বড় বিষম বস্তু।
মেয়েটা চলে গেছে আজ সাত দিন। প্রথম প্রথম ছেলেটাও রাগ করে ছিল, কিন্তু দু’দিন পর থেকেই বুঝতে পেরেছে মেয়েটাকে ছাড়া সে থাকতে পারবে না। তাই আজ সে হাটে এসেছে, পাখি কিনেছে এবং ঠিক করেছে টালা পোস্ট অফিসের সামনে থেকে বাসে চেপে হাজির হবে সোজা শ্বশুরবাড়ি। কত ক্ষণেরই বা পথ? বড়জোর কুড়ি পঁচিশ মিনিট। বাস-কন্ডাক্টর কি খাঁচাটা দেখে খুব ঝামেলা করবে?
গ্যালিফ স্ট্রিটের মোড়ে আসতে বৃষ্টি নামল। ঝিরঝির বৃষ্টি। গা ভেজে না এই বৃষ্টিতে, শুধু চোখের পাতায় অনুভব করতে হয় এমন ধারাপাত।
ছেলেটা চোখ বন্ধ করল। সে বৃষ্টির কথা বুঝতে পারে। তার মনে হল এমন বৃষ্টি বিরহী-দয়িতের মিলনের গল্প বলছে। যেমন তীব্র ভালবাসাবাসির পরে মেয়েটার ঠোঁট আলতো ছুঁয়ে যায় তার ঘর্মাক্ত কপাল, ঠিক তেমনই কোনও আসঙ্গলিপ্সার গল্প বলছে এই বারিধারা।
বড় রাস্তায় পৌঁছে একটা আশ্চর্য দৃশ্য দেখে মন ভাল হয়ে গেল ছেলেটার। ছুটির বেলার শুনশান শহরে রাস্তার ঠিক মাঝখানে বৃষ্টি মেখে নাচছে একটা পাগল গোছের লোক। ছেঁড়াখোঁড়া পোশাক, হাড়-পাঁজর বেরনো ক্ষয়াটে চেহারা, মুখেচোখে তবু উথলে পড়ছে সুখ।
নিজের মনেই হাসল ছেলেটা। বৃষ্টি নামার আগে ময়ূর নাচে। সে নাকি ভারী মনোরম দৃশ্য। কোনও দিন দেখেনি ছেলেটা। তবে সে এই লোকটিকে নাচতে দেখছে বৃষ্টি নামার আগে। মনে মনে সে এই পাগলের নাম দিল ময়ূর-পাগল।
তখনই তীক্ষ্ণ শব্দটা কানে এল ছেলেটার, পাঁচ মাথার মোড়ের দিক থেকে দু’টো একই রুটের বাস প্রায় রেষারেষি করে তীব্র গতিতে এগিয়ে আসছে তাদেরই দিকে।
ছেলেটার প্রতিটি ইন্দ্রিয় সচেতন হয়ে উঠল, “অ্যাই! অ্যাই! সরে যা। সরে যা ওখান থেকে। আরে পাগল বাসচাপা পড়বি তো!”
পাগলের হুঁশ নেই। নিজের মনে সে আকাশের দিকে তাকিয়ে নেচে চলেছে। বাসদু’টো যখন একদম কাছে এসে পড়েছে, তখনই ছেলেটা হাতে খাঁচা নিয়েই ছুটতে শুরু করল। বাসদু’টো হুড়মুড়িয়ে এসে পৌঁছনোর ঠিক কয়েক সেকেন্ড আগে পাগলটাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিতে পেরেছিল সে।
খাঁচাটা ছিটকে পড়ে আছে রাস্তায়। খাঁচাগুলোর এটাই মজা। সাজানো-গোছানো ঝকঝকে খাঁচা অথচ দরজা নড়বড়ে, কখন খুলে যায় কেউ জানে না। কয়েক মুহূর্তের ব্যাপার। পাখিগুলো খাঁচা থেকে বেরিয়ে কোথায় যে মিলিয়ে গেল, তাদের আর দেখাই গেল না।
বৃষ্টিটা চেপে নামল। শূন্য একটা খাঁচা পড়ে আছে রাজপথে। লোকের ভিড় বাড়ছিল।
***
সন্ধেবেলা ঝুম বৃষ্টি নামল। বৃষ্টি নামলে এ বাড়িতে খুব মজা। লাবণী চা করেছে আদা দিয়ে, সাধনা বেগুনি ভেজেছেন। সুড়ুৎ-সুড়ুৎ করে চায়ে চুমুক দিতে দিতে বিজ্ঞের মতো হাসছেন তমালবাবু। বৃষ্টি নেমেছে। তাঁর প্রেডিকশন মিলে গেছে।
বেগুনি ভাজতে গিয়ে অর্পণের কথা মনে পড়ছিল সাধনার। ছেলেটা বেগুনি খেতে বাড়াবাড়ি ভালবাসে। হামলে পড়ে গরম বেগুনি খায়।
চায়ে চুমুক দিয়ে লাবণী হঠাৎই বলে উঠল, “মা,শুনতে পেলে? সদর দরজায় কড়া নাড়ল না কেউ?”
সাধনা আর তমাল উৎকর্ণ হয়ে শোনার চেষ্টা করলেন। বাইরে শুধু অঝোরে বৃষ্টির শব্দ আর উথালপাথাল হাওয়া।
লাবণী আবার চমকে উঠল, “ওই তো! আবার!”
তমাল আর সাধনা মুখ চাওয়াচাওয়ি করলেন। মেয়ের হলটা কী! এমন তুমুল বৃষ্টি, অর্ধেক শহর জলের নীচে… এই দুর্যোগ মাথায় করে কে আসবে এই সময়?
কিছু ক্ষণ উসখুস করে উঠে পড়ল লাবণী। পায়ে পায়ে ঘর থেকে বেরিয়ে টানা বারান্দাটায় এসে দাঁড়াল।
জায়গাটা আবছা আঁধার। উঁচু পাঁচিলের ও পারে হলদে স্ট্রিট ল্যাম্প প্রবল বৃষ্টিতে ঝাপসা। উঠোনের রঙ্গন, স্থলপদ্ম, কামিনী, করবীরা হাপুস ভিজছে অসহায়।
ঠিক তখনই শব্দটা আবার শুনতে পেল লাবণী। উঠোনের ও পাশের দরজায় প্রবল করাঘাতের শব্দ।
লাবণী জানে, এ ভাবে এক জনই দরজা ধাক্কা দেয়। শুনলে মনে হয় যেন প্রলয় হয়েছে কোথাও, যেন রসাতলে গেছে ব্রহ্মাণ্ড, অথবা এসেছে এক দারুণ দুঃসংবাদ।
লঘু পায়ে থইথই উঠোনে নেমে এল লাবণী। এক ছুটে দরজা খুলতে গিয়েও হঠাৎই থেমে গেল সে।
তার ঠোঁটের কোণে এক ধারালো অভিমানের হাসি ফুটে উঠল।
সেই সর্বগ্রাসী তুফানের মধ্যে দরজায় পিঠ দিয়ে নিঝুম ভিজতে লাগল লাবণী।
দরজায় হাতের শব্দ বাড়ছে একটু একটু করে, লাবণীর মনে হচ্ছে তার পাঁজরের হাড় বুঝি বা গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে যাবে।
তুমুল বৃষ্টির জলধারা কিছু কি বলতে চাইছে তাকে? অথচ লাবণী তো সেই ভাষা বোঝে না। তাই বৃষ্টি মাথায় ঠায় দাঁড়িয়ে রইল লাবণী।
এত দিনে মনে পড়ল? সাত-সাতটা দিন কেটে গেছে, তার পর? থাকো তুমি তোমার বৃষ্টি নিয়ে। লাবণী আজ দরজা খুলবে না।
কিছুতেই না।