কয়েক দিন ধরেই ব্যাপারটা নজরে আসছে অবিনাশের। দোতলার বারান্দায় বসে দেখছেন, একটা বুলবুলি ঠোঁটে করে কুটি এনে ঝাঁকড়া লিচুগাছটার মগডালে জড়ো করছে। আর তার সঙ্গী একটার সঙ্গে আর একটা কুটি সুন্দর করে গেঁথে রাখছে। বেশির ভাগটা হয়ে গিয়েছে। সামান্যই আর বাকি। গত বছরেও ঠিক এই সময়ে দুটো বুলবুলি ঠিক এইখানে বাসা বেঁধে ডিম পেড়েছিল। এরাই কি সেই না অন্য কেউ, বলতে পারবেন না অবিনাশ। বিড়াল-কুকুরদের তবু একটু আলাদা করে চেনা যায়। কিন্তু সব বুলবুলিকেই এক রকম মনে হয়।
কী দারুণ ক্ষিপ্রতা! সেই সঙ্গে শিল্পচেতনা। ঠিক জায়গা থেকে ঠিক মাপের কুটি খুঁজে আনা, মজবুত করে লাগানো, যাতে ঝড়-জলে বাসা না ভাঙে! তার পর বাসায় ডিম পাড়া! ডিমে তা দেওয়া। ডিম ফুটে বাচ্চা বেরোলে ঠোঁটে করে খাবার এনে সমান ভাবে ভাগ করে খাওয়ানো! শুধু কি তাই! চারপাশে শত্রুও তো কম নেই! অবিনাশদের এলাকাটা কলকাতার এত কাছে হলেও পুরোপুরি শহর হয়ে ওঠেনি। চিল-শকুন, সাপ, বেজি-খটাশ-বিড়াল সুযোগ পেলে বুলবুলির বাচ্চাদের খেয়ে নেবে বা মেরে ফেলবে। না না, সেটা যেন একদম না হয়! মনে মনে বললেন অবনাশ। আসলে শুধু এই দুটো বুলবুলি নয়, পৃথিবীর সব দম্পতিই চায় প্রেমের স্বাক্ষর রেখে যেতে। অবিনাশ আর সর্বাণীও কি কম চেষ্টা করেছেন! কিন্তু কী আর করা যাবে। তাঁদের দুর্ভাগ্য! ললাট লিখন!
ওই তো, সর্বাণী ঘুম থেকে উঠে পড়েছেন। শোওয়ার ঘরে নড়াচড়ার শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। এ বার অবিনাশ দু’কাপ চায়ের জল বসাবেন। সর্বাণী বাথরুম থেকে বেরিয়ে তাতে পরিমাণ মতো চা চিনি দুধ দিয়ে চা করবেন। পুরোটাই অবিনাশ পারেন। কিন্তু সর্বাণীর না-পসন্দ। অগত্যা স্ত্রীর সিদ্ধান্ত মেনে নিতে হয়েছে! গ্যাস ওভেন অন করে সসপ্যানে জল চাপিয়ে আবার গিয়ে বারান্দায় বসলেন অবিনাশ। তাকিয়ে থাকলেন নির্মীয়মাণ বাসাটার দিকে।
অবিনাশদের পাশেই প্রমিত বসুর বাড়ি। কেন্দ্রীয় সরকারি চাকরি করে। যে লিচুগাছটায় বুলবুলি দুটো বাসা করছে, সেটা তাঁদের। অবিনাশের সঙ্গে তাঁর খুব একটা হৃদ্যতা না থাকলেও রাস্তায় দেখা হলে কথা হয়। গতকালই তো! বাজার যাওয়ার পথে ক’টা কুকুরকে অবিনাশ বিস্কুট কিনে খাওয়াচ্ছিলেন। প্রমিতও বাজার যাচ্ছিলেন। দাঁড়িয়ে পড়লেন। হাসতে হাসতে বললেন, ‘আপনি মশাই পারেনও বটে! সক্কালবেলাতেই কুকুর-বেড়ালদের খাওয়াতে শুরু করেছেন! আর কী-ই বা করবেন!’ অবিনাশ কোনও উত্তর দিতে পারেননি। ম্লান হেসেছিলেন।
প্রায় এক বিঘা জমির ওপর প্রমিতদের বাড়ি। বাগানটা বেশ সুন্দর। শুধু লিচুগাছ নয়, আম, জাম, কাঁঠাল এবং আরও কয়েকটা ফুলের গাছ— গন্ধরাজ, হাসনুহানা, চাঁপা এই সব কিছুই আছে। অবিনাশেরও ইচ্ছে করে বাগান করার। কিন্তু কী করবেন, মাত্র তিন কাঠা জমির ওপর মিউনিসিপ্যালিটির আইন মেনে চার পাশে জমি ছেড়ে যেটুকু জায়গা পেয়েছেন সেটাতেই তাঁর ছোট্ট দোতলা বাড়ি। শিক্ষকতা থেকে অবসর নিয়ে কোনওক্রমে
দিন গুজরান।
লিচুগাছটা পাঁচিলের একেবারে ধার ঘেঁষে। অবিনাশদের দিকে অনেকটাই ঝুঁকে এসেছে। বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসে যখন লিচু হয়, ইচ্ছে করলেই হাত বাড়িয়ে তোলা যায়। অবিনাশদের কাজের মেয়ে অর্চনা সুযোগ পেলেই ছোট একটা আঁকশি জোগাড় করে লিচু পাড়ে। অবিনাশ বারণ করলেও শোনে না। যুক্তি দেখায়, ‘আমাদের ড্যাঙায় তো গাছটা ঝুঁকে আছে। কেন পাড়ব না!’ অবিনাশ আর কিছু বলেন না। অর্চনা বহু দিন ধরে তাঁদের বাড়িতে কাজ করছে। সেই জন্যেই তার অধিকার তৈরি হয়েছে ‘আমাদের’ বলায়।
‘কী ব্যাপার! কখন থেকে দেখছি গাছটার দিকে তাকিয়ে আছ?’
বউয়ের দিকে ফিরে তাকান অবিনাশ। হাসতে হাসতে বলেন, ‘এই যে দুটো বুলবুলি বাসা করছে, তাই দেখছি।’ চুল ছোট করে কেটে, নাইটি পরে সর্বাণীকে বেশ ছেলেমানুষ লাগছে। সবেমাত্র ঘুম থেকে উঠেছেন, তাই মুখটা একটু ফোলা ফোলা। তা হোক, তাঁর ফরসা তন্বী বউটা এই বয়সেও বেশ সুন্দরী।
চা-বিস্কুটের ট্রে’টা রাখতে রাখতে সর্বাণী বললেন, ‘এ বছরেও বুলবুলি দুটো মনে হচ্ছে আবার ডিম পাড়বে!’ ‘হ্যাঁ, আমারও তাই মনে হচ্ছে!’ সর্বাণী উদাসীন ভাবে চোখ সরিয়ে নেন লিচুগাছ থেকে। জানতে চান, ‘কাগজ দেয়নি?’
‘নাহ্! কখন দেবে কে জানে! একটু যে চোখ বুলিয়ে বাজার যাব তার উপায় আছে! রোজ রোজ দেরি!’
সর্বাণী কোনও উত্তর না দিয়ে নিঃশব্দে চায়ের একটা কাপ অবিনাশের দিকে এগিয়ে দেন। অন্য কাপটা নিয়ে বিস্কুট সহযোগে খেতে শুরু করেন।
একটু পরেই কাগজের ছেলেটা এসে গেল। রোজের মতোই খবরের কাগজটা পাকিয়ে নির্ভুল নিশানায় দোতলার বারান্দায় ছুড়ে দিল। অবিনাশ এগিয়ে গিয়ে সেটা তুলে নিয়ে আবার চেয়ারে এসে বসলেন। হেডলাইনগুলোয় চোখ বোলালেন। সেই রাজনৈতিক চাপানউতোর! হামলা, ধর্ষণ, খুনোখুনি! কী-ই বা পড়ার আছে! খেলার পাতায় একটু চোখ বুলিয়ে কাগজটা বউয়ের হাতে দিলেন। চায়ের অবশিষ্ট অংশ শেষ করতে করতে আবার তাকালেন লিচুগাছটার দিকে। আরিব্বাস! আর সামান্যই বাকি। সকালে দেখলেন অর্ধেকটা, এর মধ্যেই আরও এতটা! ভাবা যায়, কী তাড়াতাড়ি কাজ হচ্ছে!
সর্বাণী কাগজের পাতা উলটে যান। রাজনীতি তাঁর ভাল লাগে না। তিনি সিনেমার ভক্ত। টিভিতে আজ কোন চ্যানেলে কী সিনেমা আছে, সেটাই দেখতে থাকেন।
কলিং বেলটা হঠাৎ ডিংডং করে বেজে উঠল। অর্চনা এসে গিয়েছে। অবিনাশ নীচে গিয়ে দরজা খুলে দিলেন। অর্চনা ভিতরে ঢুকেই রোজের মতো বকবক শুরু করে। ওপরের ঘর থেকে তার ঝাঁট দেওয়া শুরু। সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে সে বলে, ‘উহ্ কী গরম! কী গরম! আর হবে না-ই বা কেন! দু’দিন ছাড়া একটা করে ফ্যালাট উঠতেছে!’ ‘তুই এ সব জানলি কী করে? ফ্যালাট উঠলে গরম বাড়ে!’ ‘জানব না কেন? আমার ছেলে তো কালই চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে পড়ছিল, চারদিকে বাড়িঘর হচ্ছে, গাছপালা কমে যাচ্ছে, তাই পৃথিবীতে উষ্ণতা বাড়ছে...’
‘কোথায় ফ্ল্যাট উঠছে রে!’ এ বার অবিনাশ কথা বলেন। ‘কোন জায়গার কথা বলব বলো! যে পাড়াতে যাই, সেখানেই দেখতে পাই! আর শুধু ফ্যালাট ওঠা নয়, গাছপালা কেটেও চার দিক ফাঁকা করে দিতেছে। এই তো, তোমাদের উলটো দিকের বাগানটায় শুনলুম গ্যারেজ হবে। দু-এক দিনের মধ্যেই সব গাছ কেটে ফেলবে।’ ‘অ্যাঁ! কী বলছিস তুই?’ আঁতকে ওঠেন অবিনাশ। ‘হ্যাঁ গো হ্যাঁ, কালকেই তো ঝুনুদির কাছে শুনলুম।’ ‘কে ঝুনুদি?’ ‘ঝুনুদি ওদের বাড়ি কাজ করে!’ প্রমিতদের বাড়ির দিকে ইঙ্গিত করে অর্চনা। ‘তুই ঠিক শুনেছিস, প্রমিতদের বাগানটা গ্যারাজ হবে?’ ‘ঝুনুদি তো তা-ই বলল!’
কী সর্বনাশ! বুলবুলি দুটোর ডিম ফুটে বাচ্চা হতে এখনও অন্তত এক সপ্তাহ। তার পর তাদের বড় হওয়া, ডানা মেলতে শেখা... আর কিছু ভাবতে পারছেন না অবিনাশ। এখনই তাঁকে প্রমিতের সঙ্গে দেখা করতে হবে! ‘যাই বাজারটা করে আনি! বেশি বেলা করলে আবার ঠিকঠাক মাছ পাওয়া...’ স্ত্রীর উদ্দেশে বলতে বলতে ব্যস্ত পায়ে সিঁড়ির দিকে এগিয়ে যান। নীচের ঘরে ঢুকে পোশাক বদলে, পার্স, বাজারের থলে নিয়ে বেরিয়ে পড়েন। অবিনাশের ব্যস্ততায় অবাক হন সর্বাণী।
পথে বেরোতেই চেনা কুকুরগুলো রোজকার মতো অবিনাশকে ঘিরে ধরল। সামনে চায়ের দোকানে ঢুকে বিস্কুট কিনে পোষ্যদের খাওয়াতে শুরু করলেন অবিনাশ।
পাঁচ মিনিট কেটে গেল... দশ মিনিট কেটে গেল। কুকুরগুলোর খাওয়া শেষ হয়ে গেল। কী ব্যাপার! প্রমিত এখনও তো কই এলেন না! চিন্তা করতে করতে বাজার থেকে দরকার মতো মাছ-আনাজ কিনে তাড়াতাড়ি বাড়ির পথ ধরলেন অবিনাশ। শেষ পর্যন্ত ঠিক করলেন, বাজারটা রেখেই প্রমিতের সঙ্গে দেখা করে আসবেন। ভদ্রলোক একটু বিরক্ত হবেন। তা হোন। বুলবুলি দুটোর জন্য এটুকু তাঁকে করতেই হবে। বাড়িতে ঢোকার আগে প্রমিতদের গেটে এক বার উঁকি দিলেন। আশ্চর্য! গাড়িটা একটু আগেই তো ছিল! ভদ্রলোক কি তবে বেরিয়ে গিয়েছেন?’ ঝুনু ঘাড় নেড়ে বলল, ‘হ্যাঁ, এই তো গেলেন!’
হতাশ হয়ে বাড়ি ঢুকে আবার বারান্দায় গিয়ে বসলেন অবিনাশ। দশটা বাজল, এগারোটা বাজল, তবু কোনও গাছ কাটার লোক এল না। যাক বাবা! আজকের মতো বাঁচা গেল! স্বস্তির শ্বাস ফেলেন অবিনাশ। মনে মনে ঠিক করেন, সন্ধেয় প্রমিতের সঙ্গে অবশ্যই দেখা করবেন। ভদ্রলোককে ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলতে হবে। গাছ যদি কাটতেই হয়, কিছু দিন পরে কাটলেই হবে! তত দিনে সব মিটে যাবে! খবরের কাগজটা নাড়াচাড়া করতে করতে তাকিয়ে থাকলেন লিচুগাছটার দিকে। অর্চনা চলে গিয়েছে। সর্বাণী রান্নাঘরে ঢুকেছেন।
দুপুরের মধ্যেই বুলবুলি দুটো বাসাটা শেষ করে ফেলল। মা বুলবুলিটা জাঁকিয়ে বসল তার মধ্যে। সময়মত স্নান-খাওয়া সারলেন অবিনাশ। এর পর সর্বাণীর সঙ্গে একটু গল্পগাছা, দিবানিদ্রা।
হঠাৎ কয়েক জন গুন্ডা দরজা ভেঙে বাড়িতে ঢুকল। প্রথমেই তারা অবিনাশ আর সর্বাণীর মুখে কাপড় গুঁজে হাত-পা শক্ত করে বাঁধল। প্রাণপণ চেষ্টা করেও অবিনাশ কিছু করতে পারলেন না। সর্বাণীও না। শয়তানগুলো অবিনাশের সামনেই পূর্ণগর্ভার শ্লীলতাহানি করতে লাগল। সব শেষে অশ্রাব্য গালিগালাজ করতে করতে সর্বাণীর পেটে লাথি কষিয়ে চলে গেল... ঘুমটা ভেঙে গেল অবিনাশের। ধড়ফড় করে উঠে বারান্দায় গেলেন। আবার সেই ভয়ংকর স্বপ্ন। আগে প্রায়ই দেখতেন। অনেক দিন পর আজ আবার দেখলেন।
আসলে স্বপ্ন তো নয়, সত্যি ঘটনা। অবিনাশ তখনও চাকরি পাননি। জমি কিনে নিজেদের বাড়ি করে উঠতে পারেননি। টিউশনি করতে করতে ছাত্রীর প্রেমে পড়ে তড়িঘড়ি বিয়ে করে ফেলেছিলেন। শ্বশুরবাড়ি, নিজেদের বাড়ি কারও সমর্থন ছিল না সেই বিয়েতে। তাই ভাড়াবাড়িতে উঠে আসতে হয়েছিল। সুখেই কাটছিল দিনগুলো। কিন্তু বিনামেঘে বজ্রপাতের মতো বাড়িওয়ালা হঠাৎ এক দিন জানাল, তিন দিনের মধ্যে বাড়ি ছেড়ে দিতে হবে। শুনেই তো অবিনাশ খেপে গিয়েছিলেন। রেগেমেগে বলেছিলেন, অসম্ভব! কিছুতেই তিনি বাড়ি ছাড়বেন না। সর্বাণী তখন ছ’মাসের অন্তঃসত্ত্বা! শুধু তা-ই নয়, অত তাড়াতাড়ি কোথায় বাড়ি পাবেন! সেই ঘটনার পর সর্বাণী প্রচণ্ড অসুস্থ হয়ে পড়েন। বাঁচানোই প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। যাই হোক, কোনও রকমে তাঁর প্রাণ রক্ষা পেলেও বাচ্চাটাকে আর বাঁচানো যায়নি। শুধু তাই না, ডাক্তারবাবু জানিয়ে দিয়েছিলেন, সর্বাণী আর কোনও দিন মা হতে পারবেন না। পুলিশ, স্থানীয় কাউন্সিলর সকলকেই বাড়িওয়ালার ষড়যন্ত্রের কথা জানিয়েছিলেন অবিনাশ। অপরাধীরা তো ধরা পড়েইনি, উলটে সবাই পরামর্শ দিয়েছিল, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বাড়ি ছেড়ে দিতে।
বিকেলটা বারান্দায় বসে, লিচুগাছ আর রাস্তার দিকে তাকিয়েই কেটে গেল। সাড়ে ছ’টা নাগাদ প্রমিতের গাড়ি গেটের সামনে এসে দাঁড়াল। ড্রাইভার হর্ন বাজালো। ওঁদের সর্বক্ষণের কাজের লোক শশব্যস্তে ছুটে গেল গেট খুলতে। অবিনাশও পড়িমরি করে সিঁড়ি ভেঙে নীচে নামলেন। গেটের মুখেই যাতে প্রমিতকে ধরা যায়।
প্রতি সন্ধেতেই টালমাটাল অবস্থায় গাড়ি থেকে নামেন তিনি! ঘরে ঢুকে বউয়ের সঙ্গে চেঁচামেচি করেন। কিন্তু কী আশ্চর্য! আজ বেশ স্টেডি আছেন প্রমিত। মুডটাও ভাল মনে হল। অবিনাশকে দেখেই হাসতে হাসতে বললেন, ‘গুড আফটারনুন মিস্টার ঘোষাল! বলুন কী ব্যাপার?’ ‘আপনার সঙ্গে একটা কথা ছিল।’ ‘কী কথা? আসুন আসুন, ভিতরে আসুন!’ অনুগত ভৃত্যের মতো প্রমিতকে অনুসরণ করলেন অবিনাশ। প্রমিত তাঁকে বৈঠকখানায় বসিয়ে পোশাক বদলাতে ভিতরে গেলেন। একটু পরেই ফ্রেশ হয়ে ফিরে এসে বললেন, ‘হ্যাঁ, এ বার বলুন কী বলতে চান!’ ‘শুনলাম আপনাদের বাগানটায় গ্যারেজ করবেন।’ ‘হ্যাঁ, করব তো! কালকেই গাছ কাটার লোকেরা আসবে। গাছগুলো কেটে বাগানটা পরিষ্কার করবে। আপনি গাড়ি কিনছেন বুঝি? রাখবেন এখানে? কিন্তু আর তো...’ ‘না না, গাড়ি কিনব না। তবে একটা অনুরোধ। গাছগুলো না কেটে যদি গাড়ি রাখার ব্যবস্থা করেন...!’
তত ক্ষণে চা এসে গিয়েছে। তাই প্রসঙ্গটায় একটু যতি টানলেন প্রমিত। একটা কাপ অবিনাশের দিকে এগিয়ে দিয়ে আর একটা নিজে নিয়ে বললেন, ‘দেখুন অবিনাশবাবু, ফলন্ত গাছগুলো কাটতে আমারও কি ভাল লাগছে! ফল হলে সকলেই তো খাই। এই তো ক’দিন আগে দেখছিলাম আপনাদের কাজের মেয়েটা আমাদের গাছ থেকে লিচু চুরি করছে! কী আর করা যাবে! আপনাদের সঙ্গে কি কোমর বেঁধে ঝগড়া করব! যাই হোক! গাছ থাকলে বেশ কয়েকটা সমস্যা। প্রথমত গাড়ি ঠিকঠাক ঢোকানো বা বের করার অসুবিধা। তার পর গাছে পাখপাখালি থাকে, বাসা করে। যাঁরা গ্যারেজ ভাড়া নেবেন, তাঁরা কি চাইবেন তাঁদের গাড়ি নোংরা হোক! শুধু গাড়ি কেন, মাথাতেও তো পাখি পটি করে দিতে পারে! কেউ হয়তো কাজে বেরোচ্ছেন, তখন ঝামেলা হলে কে সামলাবে!’ ‘আসলে ওই লিচুগাছটার মগডালে দুটো বুলবুলি বাসা করেছে। দু-এক দিনের মধ্যেই মনে হচ্ছে ডিম পাড়বে! তাই বলছিলাম...’ আর বেশি রাখঢাক না করে আসল কথাটা এবার বলে ফেলেন অবিনাশ।
পশ্চিম দিকে এই মুহূর্তে সূর্য উঠলেও বোধহয় এতটা অবাক হতেন না প্রমিত। ‘কী বলছেন মশাই! বুলবুলির বাসা বাঁচাতে আমাকে গ্যারেজ করা বন্ধ করতে হবে! গাড়ি পিছু মাসে কত করে পাব জানেন!’
অবিনাশ কোনও উত্তর খুঁজে পান না। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকেন প্রমিতের দিকে। আশ্চর্য! প্রমিতের মুখটা হঠাৎ মনে হচ্ছে অবিকল সেই বাড়িওয়ালার মুখ! সেই থ্যাবড়া নাক, ও রকমই মোটা ঠোঁট, লোভে চকচক করা দুটো চোখ...
একটু থেমে প্রমিতই আবার কথা বলেন, ‘ঠিক আছে, আপনার যখন বুলবুলির ওপর এতই দরদ, আমি লিচুগাছ কাটা বন্ধ রাখছি। আপনি মাসে তিন হাজার টাকা করে দিয়ে যাবেন। গ্যারেজে না হয় একটা গাড়ি কমই থাকবে!’
প্রমিতকে কিছু না বলেই বৈঠকখানা ছেড়ে বেরিয়ে আসেন অবিনাশ। কী করবেন তিনি! কী করা উচিত! রাস্তায় দাঁড়িয়ে ভাবতে থাকেন... ভাবতেই থাকেন।
‘রবিবাসরীয়’ বিভাগে ছোটগল্প পাঠান, অনধিক ১৫০০ শব্দে।
ইমেল: rabibasariya@abp.in সাবজেক্ট: rabibasariya galpa
ডাকে পাঠানোর ঠিকানা:
‘রবিবাসরীয় গল্প’,
আনন্দবাজার পত্রিকা,
৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট,
কলকাতা ৭০০০০১
যে কোনও একটি মাধ্যমে গল্প পাঠান। একই গল্প ডাকে ও ইমেলে পাঠাবেন না। পাণ্ডুলিপিতে ফোন নম্বর বা ইমেল আইডি জানাবেন। ইউনিকোড ব্যবহার করা বাঞ্ছনীয়।