বুধুলালের মৃত্যুটা রহস্যজনক।
নিশ্চিত খুন করেছে কেউ ওকে। ইট বা শক্ত পাথরে মাথা থেঁতলেছে। তারপর এই খালপাড়ে এনে ফেলে দিয়েছে। কিন্ত কে সে? কেন-ই বা খুন করল ওকে? ও তো পাড়ার পয়সাওয়ালা, কেউকেটা নয়।
এই বীরপাড়ার অতি নগণ্য এক মানুষ বুধুলাল। পেশায় মজুর। দিন আনি দিন খাওয়া লোক। নেশা, গাঁজা-মদ, বিড়ি-সিগারেট, সবেতেই আছে। ঘর বলতে, বাঁশখুঁটি আর খড়ে ছাওয়া একটি ছোট্ট ডেরা। নিত্যকার নুন আনতে পান্তা ফুরনোর সংসার ওর। ঘরে সে ছাড়া তার বউ খেন্তি। আর বছর তিন-চারের ফক্কু। তা এহেন বুধুলাল শত্রু হতে যাবে কার? কীসের লোভে খুন করতে যাবে?
আপাতত পাড়ার সকলের মুখে-মুখে ঘুরে বেড়াচ্ছে বুধুলালের নাম। বলা যায়, মরে গিয়ে জাতে উঠল ব্যাটা। একজন ভিআইপি-র কদর পাচ্ছে। শোনা যাচ্ছে, আজ-কালের মধ্যেই কাগজ-টিভির লোক আসবে পাড়ায়।
বুধুলালের মড়া প্রথম দেখল হরিপদ। সেই কোন কাকভোরে। হরিপদ গিয়েছিল খালপাড়ে প্রাতঃক্রিয়া সারতে। পাছার কাপড় তুলে বসতে গিয়েই চোখ আটকাল নীচের দিকে। দেখল, কেউ একজন কাদা-জলে গোল্লা পাকিয়ে শুয়ে আছে। অমনি হাগা ডকে। পাছার কাপড় গুটিয়ে ব্যাটা সাহস করে নামল আর একটু নীচে। তারপর দুই চোখ ছানাবড়া ওর। অবাক হয়ে লক্ষ্য করল, নিঃসাড় মৃতদেহটি বুধুলালের। ওর মাথা ফেটে চৌচির। তাজা রক্ত মাখামাখি হয়ে আছে কপালে-মাথায়। আর মুহূর্তকাল দেরি করেনি হরিপদ। এক ছুট্টে এসে থেমেছিল দিগম্বর বাঁড়ুজ্জের উঠোনে। ও-বাড়িতেই সারা দিন কাজ করত বুধুলাল। দিগম্বর ওর গড-ফাদার। সুতরাং খবরটা প্রথম ওর কানেই তোলা উচিত।
তখনও রাত-ঘুমে আচ্ছন্ন দিগম্বর বাঁডুজ্জে। হেলতে-দুলতে বিল্লু এসে জানাল, কত্তাবাবুর গাঢ় ঘুম। তার মধ্যে গতরাতে ঘুমিয়েছেন গভীর রাতে। কোথাও বেরিয়েছিলেন। অসময়ে ঘুম চটকালে আর রক্ষা নেই। খুনোখুনি কাণ্ড হয়ে যাবে।
‘কী কথা, আমারে কও? আমি কোই দিবনে।’
বলতে গিয়ে গলা জড়িয়ে এল হরিপদর। ওর দু-ঠ্যাং কাঁপছে। তবু কোনওপ্রকারে খবরটা জানিয়ে হনহনিয়ে বাড়ির পথে হাঁটা দিল ও। তারপর এক ঘণ্টার মধ্যে খালপাড়ে মেলা বসল। লোকে-লোকারণ্য। সকলের চোখেই ঘোর বিস্ময়। ভয়ার্ত সকলেই বলাবলি করছে, এ নির্ঘাত খুন।
‘কিন্তু খুন করল কে বুধুলালেরে? অ যে বেজায় নিরীহ। গোবেচারা। কিছুর সাতে-পাঁচে থাকে নে। না কারুর লগে শত্রুতা ছেল ককনো, ঝগড়া-বিবাদ হোয়েচে কারোর সাতে-এমনটিও জানা যায় নে,’ মৃতদেহের সামনে বসে মাথায় চাপড় মেরে-মেরে কাঁদছে খেন্তি।
চোখের জলে দু’গাল ভিজে চুবচুবে ওর। অবুঝ ফক্কু মায়ের সুরে সুর মেলাচ্ছে কখনও। কখনও বা ছোট্ট আঙুলের ডগায় মায়ের গাল মুছে দিচ্ছে। ততক্ষণে পাড়ার মোড়ল দিগম্বর বাঁড়ুজ্জে এসে খেন্তির সামনে দাঁড়ালেন। তাতে দ্বিগুণ বাড়ল ওর কান্নাকাটি। দিগম্বর ওর মাথায় হাত বোলালেন। সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, ‘কাঁদিস নে। যে গেচে, সে গেচে। আর ফিরবেনি। তবে আমি আচি। না খাই মত্তি হবে নে তরে।’ কিন্তু ‘কে মাইল্ল অরে? কেনে?’ বোলে ফোঁপাচ্ছে তবু খেন্তি।
ভুঁরু কুঁচকে তাকান দিগম্বর। মাথা ঝাঁকান, ‘সেই ত লাক ট্যাকার পোশ্ন রে, খেন্তি। বার কোত্তি হবে তা, যেমন কোরি হোক। অ ত আর এমনি-এমনি খালপাড়ের জল-কাদায় ডুবে মরেনি। এ খুন। কিন্তু কইল্ল ক্যাটা?’
দুপুরনাগাদ পুলিশ এসে নিয়ে গেল বুধুলালের মৃতদেহ।
পোস্টমর্টেম রিপোর্টও জানা গেল ক’দিন পর। সত্যিই খুন করা হয়েছে বুধুলাল। বড় কোনও পাথরের আঘাতে মাথা থেঁতলে দেওয়া হয়েছে। সারা শরীরেও রয়েছে একাধিক আঘাতের চিহ্ন। পুলিশের ধারণা, অনেক ক্ষণ ধস্তাধস্তি হয়েছে খুনির সঙ্গে ওর। শাবল বা লোহার রড জাতীয় শক্ত কিছু দিয়েই এলোমেলো আঘাত করা হয়েছে ওর শরীরে। মাথা থেঁতলানো হয়েছে শেষে।
কিন্তু কে করল এই নৃশংস খুন? আগে তো ঘটেনি এমন এই বীরপাড়ায়। কারওর সঙ্গে শত্রুতা ছিল বুধুলালের? না, খোঁজ পাওয়া যায়নি তেমন কোনও তথ্যেরও। তবে কোনও পারিবারিক বিবাদের জেরে? খেন্তিই লোক-টোক ধরিয়ে এমনটি করিয়েছে গোপনে? না, তেমনটিও নয়। প্রশ্ন করতেই ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে ও, ‘অবাবে দিন কেটেচে। না খাই থাকিচি। তবু অশান্তি কি জিনিস জানতুমনি দুজনে। তক্ক নেগিচি বটে, তবে তা আদ ঘণ্টার নাগি। একটু পরে ভুলিচি আবার।’
দিগম্বর সহৃদয় ব্যক্তি। পরোপকারী। পাড়ায় নাম-ডাক, ওই একটিই কারণে। বিপদের দিনে সকলের পাশে দাঁড়ানো ওর আজন্মের বৈশিষ্ট্য। ক’দিন যেতেই খেন্তিকে তার বাড়িতে নিয়ে এলেন। বড় বাড়ি-ঘর। অট্টালিকা প্রায়। তেমনই জমি-জমা। কাজের শেষ নেই সেখানে। বাড়িতে ফাই-ফরমাস খাটে হাজার-গন্ডা লোক। বুধুলালের জায়গায় খেন্তিকে নিয়োগ করলেন। বললেন, ‘তর কান্না আইজ থিকে ফুরল। বুধুরে ভুলি যা। কাঁদলে ত ফিরবেনি আর। কাজে মন দে। পেট ভরি খা। ছেলেটারে মানুষ কর। আমি ত রইনু।’
কথাটা মনে ধরেছে খেন্তির। দিগম্বরের পায়ের ধুলো মাথায় নিয়ে ছলছল দৃষ্টিতে তাকায়, ‘আপনি মানুষ না কত্তা, ভগপান। ছেলেটিরে লই খাই-পরি বাঁচি থাকব, মোর কাচে এর চেয়ে খুশির কতা আর কী?’
সারা দিনের কাজ সেরে যখন ঘরে ফেরে খেন্তি, হাতে থাকে ওর একটি ছোটখাটো পুটলি। তাতে থাকে রাতে ফুটিয়ে খাবার চাল-ডাল। কখনও বা দু-এক টুকরো মাছ। তার উপর মাস ফুরোলে হাতে এক হাজার নগদ। তবে আর দুঃখ কী ওর?
মাস কয় যেতে বুধুলালের কথা ভুলে গেল গাঁ। খেন্তিও। যদিও কিনারা হল না আর ওর খুনের রহস্য। জানা গেল না, কার হাতে, কেন খুন হল ও? অনেক চেষ্টা-চরিত্র করেছিলেন দিগম্বর বাঁড়ুজ্জে। পুবস্থলী থানায় ছুটোছুটিও করেছিলেন ঢের। শেষে নিরাশ হয়ে থামলেন। তবে এটুকু বোঝা গেল পুরনো কোনও শত্রুতার জের এ। নিশ্চয়ই বুধুলালের সঙ্গে ঝগড়া-ঝামেলা হয়েছিল কখনও কারও। তারই প্রতিশোধ নিয়েছে খুনি এভাবে। পুলিশের অনুমান, খুনি বহিরাগত। বীরপাড়ার কেউ নয় অন্তত।
কেটে গেল আর মাস ছয়।
খেন্তি এখন দিগম্বরের বাড়িতেই থাকে। রাতে আর ঘরে ফেরে না। একদিন রাত করে ঘরে ফিরতে গিয়ে বিপদে পড়েছিল খুব। এক মাতাল জাপটে ধরেছিল ওকে। ঠেলতে-ঠেলতে নিয়ে গিয়েছিল রাস্তার পাশের ঘাস-জমিতে। কিন্তু শোয়াতে পারেনি। তার আগেই শরীরের সর্বশক্তি দিয়ে লাফিয়ে উঠেছিল ও। এলোকেশি চুলে রণচণ্ডী মূর্তি ধারণ করেছিল। তারপর সপাটে একটি লাথি কষিয়েছিল। অমনি পেট চেপে ধরে লুটিয়ে পড়ল জানোয়ারটা। তারপর ফক্কুকে কোলে আগলে দে-দৌড়।
লোকটি আসলে কে, চিনে উঠতে পারেনি খেন্তি। দিগম্বর বাঁড়ুজ্জে থাকলে ছাড়ত না ওকে। মেরে তক্তা করত। তবে সব শুনে-টুনে বড় নিঃশ্বাস ফেলে চোখ গোল-গোল করে তাকালেন খেন্তির দিকে, ‘তবে যে তরে একানেই থাকতি হয় রে। খবদ্দার, আর রাত-বিরেতে বাড়ি না।’
‘কোতা থাকপো কন?’ ঘোমটার কাপড় সামান্য আলগা করে তাকিয়ে বলেছিল খেন্তি।
‘আমার একানে, আবার কোতা? তর আর ঘর যাবার দরকার নাই। রাত্তিরটা একানেই কাটা। দেকিস ত, সময়কাল ভাল না। রাস্তা-ঘাটে শেয়াল-কুকুর ঘুরি বেড়ায়। বয়েস বেশি না তর। ডগমগ শরীর। ককন কার নোব লাগে। ছিঁড়ি খায় তরে।’
সেই থেকে দিগম্বর বাঁড়ুজ্জের চিলেকোঠা ঘর হল খেন্তির স্থায়ী আস্তানা।
নামে চিলেকোঠা, আসলে মস্ত ঘর একখানি। খেন্তি সেখানে ফক্কুকে পাশে নিয়ে আরাম করে শোয়। বালিশ-তোশকের অভাব নেই কোনও। মেঝেয় আবার রংচঙে মোটা কাপড় পাতা। রাতের কাজকর্ম সারা হলে ওই ঘরে গিয়ে ওঠে খেন্তি। এক ঘুমে সকাল হয় ওর। ঝলমলে লাল সূর্যটা এসে ওর চোখে আঁকি-বুঁকি কাটে প্রথম। অমনি তড়াক করে বিছানা ছাড়ে ও। ঝটপট কাজে লাগে।
ক’দিন যেতে রোজ নিশুত রাতে চিলেকোঠা ঘরে গিয়ে উদয় হন ষাট ছুঁই-ছুঁই দিগম্বর। পরম সুখে ওর নধর শরীর দলাই-মলাই করেন। ওর স্তনবৃন্তে কামুক ঠোঁট ঘষেন। কখনও-কখনও মিলনান্তে কিছু একটা যৌতুকও ভাগ্যে জুটে যায় খেন্তির। সেইটি নিয়ে সার্থক জীবনের হিসেব গোনে ও।
প্রথম দিন লজ্জায়-ঘেন্নায় কুঁকড়ে গিয়েছিল খেন্তি।
চোখদু’টি পাথর হয়ে গিয়েছিল আবছা আলোয় লোকটির মুখের দিকে তাকিয়ে। প্রথমে বিশ্বাস করতে চায়নি মন। পরে সংবিত ফিরল। দেখল, সত্যি-ই ওর চোখের সামনে দাঁড়িয়ে দিগম্বর বাঁড়ুজ্জে। ওর শরীর পোশাকহীন। এই বয়সেও সুঠাম দেহ। জিভ দিয়ে লাল গড়িয়ে পড়ছে ওর। নিশ্বাসে আগুন-বাষ্প। কী আশ্চর্য! এই লোকটিকে যে ভগবান বলে চেনে-জানে। স্বামীহারা হতেই নিজের বাড়িতে এনে আশ্রয় দিয়েছেন। মনের ভিতরে এই ছিল বুঝি ওর?
‘চলি এনু। নজ্জা করিস নে। এ কিচু না,’ ফিসফিসান দিগম্বর।
খেন্তি তেমনই জড়সড়। তেমনই নির্বাক। চোখের মণিদু’টি পাথর।
‘কী ভাবিস, আমি তর বাপ? দেবতা? তরে আশশয় দিচি? ধুস! ওসপ কিচু না। আমি অ মানুষ। মোর অ ঘর-সংসার, ছেলে-পিলে আচে। এদ্দিন বউটা ছেল, অর লগে শোয়াশোয়ি করচি। একন ফাঁকা,’ বলে ফোঁস করে নিশ্বাস ফেলে একটু থামেন দিগম্বর। তারপর খেন্তির আরও কাছ-ঘেঁষে দাঁড়ান। ‘রামায়াণ-মহাভারতের গল্প শুনিস নি রে, মুখপুড়ি? সেকেনে কত মুনি-ঋষির কতা নেকা আচে। তাগ শরিলে অ কামভাব ছেল। এর-অর লগে ফষ্টিনষ্টি করি বেড়াত। ত আমাগ বেলা দোষ কী?’
দিগম্বরের ফিসফিসানি সাপের ‘হিশ-হিশ’ শব্দ হয়ে কানে বিঁধছিল খেন্তির। ভয়ে শুকিয়ে উঠছিল ওর ভিতরটা। বাক্যহারা হয়ে গিয়েছিল কিছুক্ষণের জন্য। অথচ শক্ত হাতদু’টি সামনে বাড়িয়ে দিয়ে প্রতিবাদ করবে, সে-শক্তিও হারিয়েছে। দিগম্বরের হাতের ঠেলায় বিছানায় কাত হয় ও। অনেক কাল বাদে আবার রতিসুখ ভোগ করে নিঃশব্দে। নানা ভঙ্গিতে আড়মোর ভেঙ্গে বেয়াড়া শরীরের আশ মিটিয়ে নেয়। তা ছাড়া প্রতিবাদ করে ও কোন মুখে? যে তাকে মাথা গুঁজবার একটি পোক্ত ছাদ দিয়েছে, তাকে কেমন করে রক্তচক্ষু দেখায়?
খেন্তির বুকের উপর চাপি মনে-মনে হাসে দিগম্বর, ‘ব্যাটা বুধুলাল, জন্মের বুদ্দুরাম আচস একটি। আমার লগে গোঁয়ার্তুমি করি নিজের জেবনটা খোয়ালি, তেমনি হাতে তুলি দিলি তর ডাঁসা বউডারে অ। হায় রে মুখ্যু! দেশের পোধানমোন্তির কথায় নাচলি? অরে পাগলা, ব্যাংকে গিয়া বই করি দিনু মুই। ট্যাকাও মোর। একটি-দুটি না, আড়াই লাক। ত কস কিনা, ওইটি অর! দিবিনে আর আমারে! খা তবে ক্যালানে।’
যদিও এসবের কিছু জানে না খেন্তি। একদিন কী সব কাগজ-পত্তরে টিপ-সই করিয়ে নিলেন দিগম্বর। অনেক খোঁজাখুঁজির পর খেন্তির ঘর থেকে বেরোল ব্যাংকের বই। সেটি হাতে নিলেন দিগম্বর। তারপর ঠোঁটে এক-চিলতে হাসি জড়িয়ে খেন্তির হাবা-গোবা চোখদু’টির দিকে চাইলেন, ‘তরে একটি হার গড়ি দিব ভাবচি। তর খালি গলাটা ভাল্লাগে না মোটে দেকতে।’
‘রবিবাসরীয়’ বিভাগে ছোটগল্প পাঠান, অনধিক ১৫০০ শব্দে।
ইমেল: rabibasariya@abp.in সাবজেক্ট: rabibasariya galpa
ডাকে পাঠানোর ঠিকানা:
‘রবিবাসরীয় গল্প’,
আনন্দবাজার পত্রিকা,
৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট,
কলকাতা ৭০০০০১
যে কোনও একটি মাধ্যমে গল্প পাঠান। একই গল্প ডাকে ও ইমেলে পাঠাবেন না। পাণ্ডুলিপিতে ফোন নম্বর বা ইমেল আইডি জানাবেন। ইউনিকোড ব্যবহার করা বাঞ্ছনীয়।