“প্রতীপদা, সন্দেশ খাবে?”
“না।”
“প্রতীপদা, সন্দেশখালি যাবে?”
“হে-হে...”
“ওই দেখো প্রতীপদা, কত ঝিক্কু-ঝিক্কু মামুনি আসছে, ওদের কাউকে নিয়ে যাবে?”
“হে-হে-হে...”
এ হল দুপুরে খেতে বেরিয়ে প্রতীপদার সঙ্গে আমার ফাউ বকা। আমাদের অফিস ডালহৌসি অঞ্চলে। জয়েন করেছি মাস ছয়েক। প্রতীপদার বছর ছয়েক। আমার চেয়ে প্রতীপদা বছর আটের বড়। আমার এখন চব্বিশ। প্রতীপদার পাত্রী দেখা চলছে। মাঝে-মাঝেই আমরা বাড়ির খাবার না এনে দুপুরে একসঙ্গে খেতে বেরোই। আজ দুপুরে খেলাম সরু চালের ভাত, লাউ-চিংড়ি, ডাল, ঝুরো আলুভাজা আর রুইয়ের কালিয়া। দুজনেরই সরেস পেটি জুটেছিল। খুবই তরিবতের ব্যাপার। ফেরার পথে প্রতীপদাকে বললাম, “এর পর গঙ্গার ধারে একটা বাড়ি... তিনতলার ঘরে মুখোমুখি জানালা, নরম বিছানা, নরম বালিশ, পাশবালিশ, জানলা দিয়ে হুহু হাওয়া... কেমন হবে বলো তো?”
“হে-হে... আর সঙ্গে কে থাকবে?”
“আঃ প্রতীপদা... সঙ্গে কেউ থাকলে এমন ব্যায়াম হবে যে, ভাতঘুমটাই মাটি! সঙ্গে কারও থাকা নেই মাংতা...”
দীর্ঘশ্বাস ফেলে প্রতীপদা। আর এই দীর্ঘশ্বাসের কারণ ধরেই শুরু হয় আমাদের গল্প...
******
“এক মিনিট দাঁড়াও তো, এখানে আলোটা ভাল আছে...”
“না, না, প্লিজ়... মুড নেই...” বলতে-বলতে দ্রুত পায়ে করিডর ধরে চলে যায় সমন্বিতা। ক্যামেরা-গলায় বুকভাঙা দীর্ঘশ্বাস ফেলে প্রতীপদা। পাশের করিডর থেকে খ্যাকখ্যাক করে হাসতে-হাসতে বেরিয়ে আসে ইন্দ্রদা, শ্রীজিত্দা। এরা বছর দুয়েক আগে জয়েন করেছে, আমার চেয়ে বড়, প্রতীপদার চেয়ে ছোট। তবে প্রতীপদা তেমন সিনিয়রসুলভ নয় বলে সকলের সঙ্গেই ইয়ার্কির সম্পর্ক।
ইন্দ্রদা বলল, “ওফ প্রতীপদা! দেখছ পাত্তা দেয় না, তুমি সেই ছবি তুলবেই! তুমি ছবি তুলতে চাইছ আর সমন্বিতা মামুনি ঘ্যাম দেখিয়ে চলে যাচ্ছে! ও তোমাকে ভেবেছ কী? কাজের বেলা কাজি আর কাজ ফুরোলে পাজি?”
শ্রীজিত্দা বলল, “তা ছাড়া, সত্তর হাজার টাকা দিয়ে এসএলআর বাগিয়েছ, ক্যামেরার একটা মান-ইজ্জত নেই? তোমার কাছে লোকে লাইন দিয়ে ছবি তুলতে আসবে, তা নয়, তুমি যাচ্ছ সেধে-সেধে লোকের ছবি তুলে দিতে?”
উত্তরে ফের দেড় বিঘত দীর্ঘশ্বাস ফেলে প্রতীপদা।
এত ক্ষণে অভিজ্ঞ পাঠক ঠিকই ধরতে পেরেছেন, দীর্ঘশ্বাসের কারণ কী। হ্যাঁ, ওই সমন্বিতা। কালো টপ আর পিঙ্ক স্ল্যাক্স, পায়ে ইঞ্চিখানেক হিল— যার হিলের আওয়াজে প্রতীপদার লাবডুব শুনতে পাচ্ছেন সংবেদনশীল পাঠক— ও-ই সমন্বিতা। পাশের ডিপার্টমেন্টে আছে। আকাশছোঁয়া ঘ্যাম। কাউকেই পাত্তা দেয় না। প্রতীপদার চেনা, কারণ আগে প্রতীপদা ওদের ডিপার্টমেন্টেই ছিল। প্রতীপদাকে শ্রীজিত্দা-ইন্দ্রদারা বহু বার বলেছে, “ব্যথা আছে তো বলে দাও না...”
গ্যালগ্যাল করে হেসে প্রতীপদা বলেছে, “ব্যথা! সে আবার কী!”
আমরা বলেছি, “রোগ স্বীকার করলে ওষুধ দেওয়া যায়, কিন্তু রোগ স্বীকারই না করলে ওষুধও দেওয়া যায় না, রোগও সারে না...”
কাকস্য পরিবেদনা!
আচ্ছা, সমন্বিতাকে দেখলেই মুখে হাজার ওয়াটের আলো জ্বলে ওঠা, নতুন ক্যামেরা কেনার পর থেকে সমন্বিতার ইচ্ছেয়-অনিচ্ছেয়, তাকে জানিয়ে, না-জানিয়ে গুচ্ছের ছবি তোলা, সমন্বিতার ফোন খারাপ হলে নিজের কাজ ফেলে সমন্বিতার ফোন কিনতে বেরোনো, সমন্বিতা চার্জার চাইলে একছুটে চাঁদনি গিয়ে চার্জার কিনে আনা... এগুলো তা হলে কী!
******
“পেটে খিদে, মুখে লাজ, বুইলি না! ধম্মের ষাঁড়ের মতো রাস্তা আটকে শুয়ে থাকবে, নিজেও মন্দিরে যাবে না, কাউকে যেতেও দেবে না। না হলে তুইও তো এক বার ট্রাই নিতে পারতিস...” আমাকে চোখ টিপে বলে শ্রীজিত্দা।
“আমি! না... না...” আমি আঁতকে উঠে বলি।
“কেন রে ব্যাটা? তোর তো গার্লফ্রেন্ড নেই... সমন্বিতাকে বুঝি পছন্দ নয়?” আমাকে চাটার চেষ্টা করে ইন্দ্রদা।
“বড্ড নাক-উঁচু! আমার লো প্রোফাইলের সঙ্গে ম্যাচ করবে না...” সরল মনে দাঁত দেখাই আমি।
কথা হচ্ছিল প্রতীপদাকে নিয়েই। আজ প্রতীপদা আসেনি। ক্যান্টিনে আমি, ইন্দ্রদা আর শ্রীজিত্দা। প্রতীপদা প্রত্যন্ত গ্রামের ছেলে। কথাবার্তা আর চেহারায় গ্রামের ছাপ থাকলে কী হবে, প্রতীপদার ক্যারিশমা অন্যত্র। ওর মতো টেক-স্যাভি মানুষ অফিসে দ্বিতীয়টি নেই। মোবাইল, কম্পিউটারের যে কোনও প্রবলেমে আমরা প্রথমেই প্রতীপদার কাছে যাই এবং বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই প্রতীপদা এক্সপার্টের মতো সলিউশন দিয়ে দেয়। ভারী পরোপকারী মানুষ এই প্রতীপদা। সমন্বিতাই ওর দুর্বলতম জায়গা। না হলে সমন্বিতা দুচ্ছাই করে, পাত্তা দেয় না, তবু এক বার ডাকলেই ছুটে যায় কেন?
ইন্দ্রদা বলল, “মনে যদি কিছু থাকে, তা হলে বলে দেওয়া উচিত... কিচ্ছু না বলে ফিল্ডিং দেওয়ার মানে কী! ও দিকে পাত্রীও দেখা হচ্ছে... প্রতীপদার মতলব বোঝা মুশকিল!”
শ্রীজিত্দা বলল, “জানিস, সপ্তাহখানেক আগে আমাকে ফেসবুকে মেসেজ পাঠিয়েছে সমন্বিতা...”
“তাই? কী লিখেছে?” সমস্বরে জিজ্ঞেস করলাম আমরা।
“সেই কথাগুলো আমি প্রতীপদাকে বলে উঠতে পারিনি, লোকটা বড্ড কষ্ট পাবে রে...” পলকে সিরিয়াস শ্রীজিত্দা।
ঘটনা কী? সমন্বিতা কি তা হলে শ্রীজিত্দার সঙ্গে...? ত্রিকোণ সম্পর্ক?
******
“মানে... কথা হচ্ছে, মূলত্রিকোণে যদি বৃহস্পতি থাকে, যে নিজেই নবমাধিপতি, কথা হচ্ছে...” বলে কথা শেষ না করেই হাতে ধরা কাগজটায় ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে থাকে প্রতীপদা। সামনে বসে টাক চুলকোচ্ছেন আদিত্যদা। সমন্বিতার ডিপার্টমেন্টের সিনিয়র। সময়-সুযোগ পেলেই নিজের কোষ্ঠী নিয়ে এসে প্রতীপদাকে দিয়ে বিচার করায়। বলতে ভুলে গিয়েছি, প্রতীপদার আবার জ্যোতিষে গভীর জ্ঞান। সফ্টওয়্যারে হরোস্কোপ তৈরি করতে পারে, বিয়ের যোটক-ফোটক মেলাতে পারে, হাতও দেখতে পারে। কিন্তু ও দিকে যে আড়াইটে বাজতে চলল, খেতে যাব কখন! উসখুস করতে দেখে ইন্দ্রদা হেসে বলে গেল, “দাঁড়া, শ্বশুরবাড়ির লোক এসেছে, খাতির করতে হবে না...”
আদিত্যদা উঠলেন। খেতে বেরিয়ে প্রতীপদাকে জিজ্ঞেস করলাম, “এত ছক দেখো, সমন্বিতারটা দেখেছ কোনও দিন?”
“কী? ছক?” মিচকি হেসে জিজ্ঞেস করে প্রতীপদা।
“তা নয় তো কী?”
“উম... দেখেছি, ও-ই তো দেখতে বলেছিল।”
“কী দেখলে?”
“হে-হে... তোমাকে বলব কেন?”
“উফ... নিজের সঙ্গে ছক মিলিয়ে দেখোনি?” আগ্রহের সঙ্গে জানতে চাই আমি।
“দেখেছি, কিছু-কিছু মিলেছে, কিন্তু...” কী যেন ভাবতে-ভাবতে বলে প্রতীপদা।
আর কিছু জানতে চাওয়ার আগেই ভাতের হোটেল এসে যায়। সে দিন শ্রীজিত্দার কথায় ভুল ভেবেছিলাম, কোনও ত্রিকোণ সম্পর্ক নেই। সমন্বিতা চ্যাটে ওকে বলেছে, “প্লিজ়, প্রতীপদাকে আদেখলামো করতে বারণ করো! আমার চেয়ে দশ বছরের বড়! টেল হিম টু গ্রো আপ!”
সাদাসিধে, ভালমানুষ প্রতীপদাকে এ কথাটা কেউই বলে উঠতে পারব না। আবার প্রতীপদা আঘাত পাক তাও তো চাই না। কী হবে কে জানে!
******
“আকাশের অবস্থা দেখছিস, আজ কী হবে কে জানে!” জানলা দিয়ে তাকিয়ে দেখছে ইন্দ্রদা। এখন সকাল সাড়ে দশটা। কিন্তু আকাশের দিকে তাকালে মনে হবে সন্ধে। ঘন মেঘ জমে অন্ধকার। এখনও বৃষ্টি আসেনি। ঝড় আসার পূর্বাভাস। অফিস আসার সময় আবহাওয়া খারাপ ছিল না। কিন্তু এখন চিন্তায় পড়ে গেছে সবাই।
শ্রীজিত্দা বলে উঠল, “আরে ইন্দ্র, আকাশের অবস্থাটা দেখছিস, এক জনের মনের অবস্থা দেখছিস না? সেখানে যে আরও অন্ধকার! সূর্য উঠবে জানি কাল ভোরে পৃথিবীতে, কিন্তু এ বুকে?” নচিকেতার গানটা গেয়ে প্রতীপদার বুকে টোকা দিল শ্রীজিত্দা।
খেয়াল করে দেখলাম প্রতীপদা গম্ভীর। রহস্য ভাঙল শ্রীজিত্দাই, “মে মাসই সমন্বিতার লাস্ট। চাকরি ছেড়ে দিচ্ছে। জুনে বিয়ে। বিয়ের পরই স্টেটস। বর ডাক্তার।”
ইন্দ্র হেসে বলল, “আজকাল পাত্রদের মধ্যে এনআরআই-রাই মোস্ট ওয়ান্টেড!”
হেসে ফেললাম আমরা। প্রতীপদাও ফ্যাকাশে হাসল।
কিন্তু আকাশ পরিষ্কার হওয়ার কোনও নামগন্ধ নেই। বারোটার আগেই শুরু হয়ে গেল তীব্র ঝোড়ো বাতাস। আর তখনই ঘটল এক অদ্ভুত ঘটনা। একেই বোধ হয় বলে, ধর্মের কল বাতাসে নড়ে।
সমন্বিতাদের ডিপার্টমেন্টের সবাই ভিড় করেছে বারান্দায়। সমন্বিতা একা জানলার ধারে ফোনে কথা বলতে-বলতে এক হাতে জানলা বন্ধ করার চেষ্টা করছে। চোখ সরিয়ে নিয়েছিলাম কিন্তু হঠাৎই একটা আওয়াজ শুনে তাকিয়ে দেখি, সমন্বিতার মোবাইল মাটিতে পড়ে ছত্রাকার। জানলার কাচের পাল্লাটা পাগলের মতো ঝাপটাচ্ছে, পাল্লার নীচের ছিটকিনি ভাঙা। আর উপরের ছিটকিনিতে সমন্বিতার হাত পৌঁছচ্ছে না।
ব্যাপারটা ভাল করে বুঝে ওঠার আগেই দেখি ফিল্ডে নেমে পড়েছে প্রতীপদা। পলকে ফোনটা কুড়িয়ে জুড়ে ফেরত দিয়েছে সমন্বিতাকে। তার পর সমন্বিতাকে সরিয়ে নিজেই বন্ধ করতে গিয়েছে জানলা। কিন্তু চেয়ারে উঠে উপরের ছিটকিনিটা লাগানোর পরই ঘটল বিপত্তি। দমকা হাওয়ায় পাল্লার একটা কাচ ভেঙে পড়ল প্রতীপদার হাতে। কাটা জায়গাটা চেপে ধরে ওদের ডিপার্টমেন্ট থেকে দৌড়ে বেরোল প্রতীপদা। দেখলাম চাপা দেওয়া হাতটার পাশ দিয়ে রক্ত চুঁইয়ে নামছে। কাউকে কিছু ভাবার সুযোগ না দিয়েই প্রতীপদা ছুটে গিয়েছে ফার্স্ট এড বক্সের কাছে। আমরা অবাক। সমন্বিতাও স্থাণুবৎ। থ্যাঙ্কস দেওয়ারও কোনও সুযোগ পেল না।
******
“উফ, কাল যা জল জমল, বাসে ওঠার সুযোগই ছিল না, তার উপর মেট্রো ইরেগুলার...” পরদিন অফিসে ঢুকতে-ঢুকতে বলল ইন্দ্রদা।
প্রতীপদা খানিক আগেই এসেছে। বসে নিউজ় সাইটগুলো দেখছে। বাঁ-হাতে ব্যান্ডেজ। কালকের প্রচণ্ড দুর্যোগ এবং দুর্ভোগ পেরিয়ে বাড়ি যেতে হবে বলে আমরা প্রতীপদার হাতের মোটামুটি একটা ট্রিটমেন্ট হওয়ার পরে দুপুরের মধ্যেই বেরিয়ে গেছিলাম। বাড়ি পৌঁছতে খুব সমস্যা হয়েছিল। আজকের কাগজে দেখলাম, ক্ষয়ক্ষতির খতিয়ান বিশাল। সেটাই প্রতীপদা দেখছে। আমরা যে যার কাজকর্ম করছিলাম, হঠাৎ ডিপার্টমেন্টে ঢুকল সমন্বিতা। তুঁতে রঙের সালোয়ার-কামিজ। মুহূর্তে যেন ফ্রিজ় শটের মধ্যে ঢুকে পড়লাম সবাই। আজ সমন্বিতা সাজেনি একটুও। তাতে যেন ওকে আরও বেশি ভাল দেখাচ্ছে। ও এসে দাঁড়াল প্রতীপদার সামনে।
কিন্তু এ কী হল! প্রতীপদা এত সহজে হেসে সমন্বিতার সঙ্গে কথা বলছে কী করে! আজ তো সমন্বিতাকে দেখে প্রতীপদার হার্টবিট মিস হতে-হতে হার্ট অ্যাটাক হয়ে যাওয়ার কথা।
প্রতীপদা হেসে সমন্বিতাকে জিজ্ঞেস করল, “কাল ঠিকমতো বাড়ি ফিরতে পেরেছিলে?”
সমন্বিতাই আজ কী বলবে বুঝতে পারছে না, যেন অতি কষ্টে কথা খুঁজে বলল, “হ্যাঁ, বাপি গাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছিল, তোমার হাত... মানে আমার জন্যই... স্যরি প্রতীপদা, মানে থ্যাঙ্ক ইউ, তুমি কাল আমার জন্য ও ভাবে...”
প্রতীপদা ব্যান্ডেজ-বাঁধা হাতটা তুলল এক বার, মুখে সাধু-সন্ন্যাসীদের মতো হাসি। তার পর সুস্থ হাতটা জামার বুকপকেটে ঢুকিয়ে বার করে আনল একটা নীল রঙের লজেন্স! না, লজেন্স নয়, ভাল করে তাকিয়ে দেখি, একটা পেনড্রাইভ। সেটা প্রতীপদা বাড়িয়ে দিয়েছে সমন্বিতার দিকে।
“এই নাও। অনেক দিন ধরে চেয়েছিলে...” পেনড্রাইভটা সমন্বিতার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে প্রতীপদা বলে, “আমার তোলা সব ক’টা ছবিই আছে, অরিজিনাল ফাইল, ফুল রেজ়লিউশন, আর কথা হচ্ছে, ফোটোশপে টাচও করা আছে যেগুলো প্রয়োজন।”
অবাক চোখে তাকিয়ে হাত বাড়িয়ে পেনড্রাইভটা নেয় সমন্বিতা।
সমন্বিতার চোখ থেকে চোখ সরিয়ে কম্পিউটার মনিটরে চোখ রাখে প্রতীপদা, “তোমার কম্পিউটারে সেভ করে নিয়ো আর কপি রেখো, আমার কাছে কিন্তু আর কপি নেই।”
এত ম্লান দেখাচ্ছে কেন সমন্বিতাকে? এই মেয়েটাই শ্রীজিত্দাকে বলেছিল না, “...টেল হিম টু গ্রো আপ!”
খুব নিচু গলায় সমন্বিতা জিজ্ঞেস করে, “তোমার হাত...”
কম্পিউটার থেকে চোখ না সরিয়েই প্রতীপদা বলে, “ও তেমন কিছু নয়, জীবনে চলতে গেলে খুচরো চোট-আঘাত লাগেই, সেরেও যায়...” মনে হল ইতিহাসের পাতা থেকে সক্রেটিসের গলার আওয়াজ শুনলাম। সমন্বিতা পাথরের মূর্তির মতো নির্বাক।
ওর দিকে তাকিয়ে সহজ হেসে প্রতীপদা বলে, “শুনলাম মে-তে ছেড়ে দিচ্ছ... ভাল থেকো, বেস্ট অব লাক ফর ইয়োর লাইফ অ্যাহেড।”
অস্ফুটে ‘থ্যাঙ্ক ইউ’ এবং তার চেয়েও ক্ষীণ স্বরে ‘তুমিও ভাল থেকো’ বলে সমন্বিতা চলে গেল।
আমরা তখন একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করছি।
মাঝে ক’দিন কাজের চাপে প্রতীপদার সঙ্গে কথা বলার সুযোগ হয়নি। আজ আবার আমরা লাঞ্চ খেতে বেরিয়েছি।
“ও রকম হাঁ করে মুখের দিকে চেয়ে আছ কেন?”
“সে দিন ওটা কী করলে প্রতীপদা! এ তো ঘোর অ্যান্টি-ক্লাইম্যাক্স। তোমার কি কোথাও বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে?”
“না, মানে, বজবজের মেয়েটা মাঙ্গলিক, তাই আর কোথাও...”
“তা হলে?”
“আমার আর কী ক্ষমতা বলো... এনআরআই-এর সঙ্গে পারা যায়! যদি আমি জিতেও যেতাম, রাজকন্যে আমার গলায় মালাও দিত, তবুও বছর দশেক পরে বলত, ‘কী কুক্ষণে যে এনআরআই পাত্র ছেড়ে তোমাকে পছন্দ করেছিলাম!’ তাই না?”
“কিন্তু ও তো মনে হল তোমার প্রতি...” কথা শেষ করতে পারি না।
“ভালই তো... দশ বছর পরে ওর মনে হবে, এনআরআই ওকে প্রচুর সুখ, টাকাপয়সা, আনন্দ দিয়েছে বটে কিন্তু ওকে ভালবেসেছিল অন্য কেউ... হে হে হে...” হাসে প্রতীপদা।
মনে পড়ল কোথায় যেন পড়েছিলাম, ‘মিটিমিটি চায় কলসা নাড়ে, সেই বাঘেতেই মানুষ মারে।’
লাঞ্চ সেরে ফেরার পথে আবার ফাউ বকতে শুরু করলাম আমি, “প্রতীপদা, সন্দেশ খাবে?”
“না।”
“প্রতীপদা, সন্দেশখালি যাবে?”
“যেতে পারি, কিন্তু কথা হচ্ছে, সঙ্গে মামুনি থাকবে কি? কী রকম বয়স হবে সেই মামুনির? হে হে...”
একটু থমকে যাই। আজও আমরা খেলাম সরু চালের ভাত, লাউ-চিংড়ি, ডাল, ঝুরো আলুভাজা আর রুইয়ের কালিয়া। আজও দু’জনের বেশ সরেস দেখে পেটি জুটেছিল। খুবই তরিবত হল ফের। সবই এক রকম আছে, শুধু যে প্রতীপদাকে নিয়ে গল্প শুরু হয়েছিল, সেই লোকটা আর নেই। আমার সঙ্গে লাঞ্চ সেরে যে ফিরছে, সে অন্য লোক।
তাকে আগে কখনও দেখিনি।
(এই গল্পের সব চরিত্র ও ঘটনা কাল্পনিক। বাস্তবের সঙ্গে কোন মিল থাকলে তা নিতান্তই আকস্মিক ও অনিচ্ছাকৃত।)