কী একটা কারণে কলেজ ছুটি হতে স্মৃতিকে ফোনে ধরল সমীরণ।
‘ইয়েস, অধ্যাপক মহাশয়?’ ও পারে স্মৃতির খুশি-খুশি গলা।
‘ব্যস্ত?’
‘না! এইমাত্র কিছুটা রিল্যাক্সড হলাম, বলো।’
‘শোনো, কয়েকটা বিজ্ঞাপনে টিক দিয়েছি। বলব?’
‘ওক্কে বস, গো অন।’
‘সোদপুর মেন রোডের উপর, সু-পরিবেশে, বারোশো স্কয়্যার ফুট...’
‘রুখ যা বেটা। ক্রাউড, আনওয়ান্টেড পিপল, এত্তা জঞ্জাল, না বাবা না। টু স্মল।’
‘রাজারহাটে?’
‘দিনের বেলা ফ্লোটিং ক্রাউড। রাতে শুনশান। শেয়াল ডাকে। অশরীরী হেঁটে বেড়ায়, দরজার গ্রিল ভেঙে ডাকাতি রিজেক্টেড।’
‘বেশ, তা হলে ইকো-পার্ক সংলগ্ন টাউনশিপ প্রোজেক্ট-এ?’
‘সংলগ্ন নয় ডিয়ার, খুবই অসংলগ্ন। ধু-ধু মরুভূমি। কবে লোক আসবে, তবে মরুভূমিতে ফুল ফুটবে। বুকিং কমপ্লিট হয়ে গেলেও লোক আর আসে না। সাইলেন্স ইজ গুড বাট ফিলিং সাইলেন্স ইজ নো গুড অ্যাট অল। এই, এক মিনিট। একটা কল আসছে।’ দু’মিনিট বাদে স্মৃতি ফোন করল, ‘বলো।’
‘ই এম বাইপাস সংলগ্ন নির্মল, শান্ত পরিবেশে...’
‘আবার সেই সংলগ্ন! কতটা সংলগ্ন?’
‘দু’মিনিট।’
‘লোকেশন?’
‘ডি সি চন্দ্রের বাগান থেকে কিছুটা এগিয়ে। অ্যামবিয়েন্স গুড। স্কুল, মার্কেট কমপ্লেক্স...’
‘ঠিক আছে। এনিথিং মোর?’
‘রাজারহাট অ্যাকশন এরিয়া?’
‘অ্যাকশন এরিয়ায় তেমন কোনও অ্যাকশন হয় না প্রিয়। চুরি, ছিনতাই, ট্যাক্সিওয়ালাদের হুজ্জোতি। ছাড়া-ছাড়া দৈত্যের মতো বাড়ি, তাতে দিনের বেলায় কিছু সো-কল্ড অফিসের কাজ হয়, রাতে ভূতেরা গান গায়। কেউ কাউকে চেনে না। হাওয়ায় হাহাকার ঘুরে বেড়ায়।’
‘তা হলে কোথায় যাই বল তো? কোলাহল, রাজনৈতিক কোন্দল, জনবিস্ফোরণ, সংঘর্ষ, এ তো সব জায়গায়ই আছে। খোদ শহরে, তথাকথিত ভদ্রলোকদের জন্য তো এক ছটাক জমিও নেই। আচ্ছা, এয়ারপোর্টের কাছে, আম্রকুঞ্জে? একটু নিরিবিলিতে? যাবে?’
‘সে তো উইমেন ট্রাফিকিং হাব, ক্রিমিনালদের নন্দনকুঞ্জ। কুঞ্জে কুঞ্জে গাহে আড়কাঠি! তো?’
‘গিলি গিলি গিলি গিলি... এখানে আপনার জন্য রাখা আছে একটা সুদৃশ্য থলি। এই থলিতে আছে সোনা হিরে এবং রুপো। ফার্স্ট কাম ফার্স্ট সার্ভড। গোবি মরুভূমির ওপর থেকে আকাশের নীল ছেঁকে এনে আমরা রাঙিয়ে দিয়েছি মাথার উপরের চাঁদোয়া। বাচ্চাদের জন্য চার চারটে কুট্টি-কুট্টি চকোলেট ফালি বাগান, হরেক কিসিমের রাইড, লার্নিং আর্কেড। মিনি যোগা সেন্টার।’
‘স্বাস্থ্য? ডক্টর’স কর্নার?’
‘টোয়েন্টি ফোর আওয়ার্স অ্যাম্বুল্যান্স। আউটডোর জিম, ইন্ডোর গেমস, সুইমিং পুল, গল্ফ কোর্স, ফুটবল, ক্রিকেট গ্রাউন্ড। কফি শপ, শপিং-এর জন্য আস্ত একটি মল, ঝাঁ-চকচকে রেস্তরাঁ, ইউরোপিয়ান অ্যান্ড কনটিনেন্টাল কুইজিন...’
স্মৃতির সঙ্গে কথামত রবিবার সকালে যাওয়া স্থির হল। একটা ভাললাগা ছুঁয়ে যাচ্ছিল সমীরণকে। অবশেষে জীবনতরী ঘাটে ভিড়তে চলেছে। অনেক ঝড়ঝাপটা গিয়েছে জীবনে। হস্টেল, মেস, বোর্ডিং থেকে শেষকালে নিজের ফ্ল্যাট।
কিন্তু স্মৃতি যা খুঁতখুঁতে! ওর পছন্দ হলে হয়।
মনে-মনে হেসে ফেলল সমীরণ। এক দিনের কথা মনে পড়ে গেল। কিছুতেই স্মৃতির পছন্দ হচ্ছে না আউটিং-এর স্পট। সমীরণ বলেছিল, ‘একশোতে একশো ভাগ কোনও কিছুতেই মেলে না ম্যাডাম। কোথাও না কোথাও একটু ফাঁক মেনে নিতেই হয়। এই যেমন আপনি হাসছেন, আপনার সুন্দর দাঁতের সারির মাঝখানে একটা জানালা দেখা যাচ্ছে... এইটেই আপনার সৌন্দর্য, নয় কী?’
গলে গিয়েছিল স্মৃতি। কিন্তু নিজের পয়েন্ট থেকে কিছুতেই নড়বে না সে, ‘অধ্যাপক, দিস ইজ স্মৃতি। অ্যাম ডেড হোয়েন আই থিংক আই হ্যাভ রিচড মাই ডেস্টিনেশন। এই দেখো না, এই ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানিটা আমি জয়েন করার আগে মর-মর অবস্থায় ধুঁকছিল। আমি আসাতে ওরা জীবন ফিরে পেল। যেমন তোমার সোশ্যাল লাইফের ধারণাটাই আমি বদলে দিলাম। ছিলে গাঁইয়া, এখন ব্রিলিয়ান্টলি স্মার্ট।’
‘গাঁইয়া? মানে গ্রাম্য? ওক্কে গডেস!’
‘এই, এই অ্যাংরি ইয়াং স্ট্যাগ। আমি সে ভাবে বলিনি। ভেবে দেখো, তোমার জামাকাপড়, জুতো মোজা, স্যুট টাই, এমনকী তোমার অন্তর্বাসও আমার পছন্দে কেনা। ইউ আর ডিজাইন্ড বাই মি। আমি তোমার মাথায় চাঁটি মেরে পার্টিওয়্যার পরিয়েছি, স্টুডেন্টদের সামনে কোন পোশাকে সমীহ আদায় করবে, রেস্তরাঁয় কী ভাবে, কোন কায়দায় খাবে, সোশ্যাল গ্যাদারিংয়ে কাকে ইগনোর করতে হবে, কোথায় চওড়া হাসি হাসবে, কোথায় চিবিয়ে-চিবিয়ে... এ সব কি এই পাঁচ বছরে আমি শেখাইনি তোমায়, মাস্টারমশাই?’
‘আমি কী রকম যেন দূরে চলে যাচ্ছি স্মৃতি। আমার ছোট্ট গ্রামের ছোট্ট কুঁড়ে, হ্যারিকেনের আলোয় পড়াশোনা, উঠোনের সামনে দুটো বকুলগাছ, ফল পাকলে পাখিরা এসে নোংরা করে দেয়। একটা পোকায়-খাওয়া আমগাছ, বাঁশঝাড়ের ওপর দিয়ে আসা সূর্যের আলো, লাল মোরামের রাস্তা, এ সবে তো কোনও নিয়ম নেই।’
‘সমীরণ, দেখো, তোমাকে আমূল বদলে দেব।’
‘আমার জনমদুখিনী মা কি উচ্ছেদের তালিকায় পড়বে?’
‘ওঁর দুঃখী মুখটাতে গ্ল্যামার এনে দেব। আমাকে যদি পাথরও দাও, আমি সোনা করে দেব।’
মনে-মনে হাসল সমীরণ। এ কথা ঠিক, স্মৃতি খুব আত্মবিশ্বাসী। সমীরণের মনে পড়ে গেল ওর সঙ্গে প্রথম আলাপের কথা।
কলেজে ফ্রেশার্স ওয়েলকাম হবে। কিছুতেই স্টুডেন্টদের একত্র করা যাচ্ছিল না। হেড তার ঘাড়েই দায়িত্বটা চাপিয়ে দিলেন। স্টুডেন্টস ইউনিয়নও দলাদলি ভুলে তাকেই মুরগি বানিয়ে ফেলল, ‘স্যর, আপনি ছাড়া আর কে দেখবে আমাদের? আমরা অনাথ।’
ঠিক এই সময়েই, এক বন্ধুর পরামর্শে এক দিন গুটিগুটি পায়ে হাজির হয়েছিল স্টার ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানির সিটি অফিসে।
রিসেপশনটা চমকে দেওয়ার মতো। ততোধিক চমকে দেওয়ার মতো স্মৃতির ছোট্ট চেম্বার। সামনের রিভলভিং চেয়ারটাকে ঘুরিয়ে নিয়ে তার মুখোমুখি হয়েছিল স্মার্ট, বিউটিফুল স্মৃতি।
‘ইয়েস, হোয়াট ক্যান আই ডু ফর ইউ?’
‘একটা ফ্রেশার্স ওয়েলকাম অর্গানাইজ করে দিতে হবে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, রেপুটেশন আছে। ’
‘নো প্রবলেম। উই আর দেয়ার।’
সেই শুরু। তার পর পাঁচ পাঁচটা বছর স্টেডি রিলেশনশিপ। কী করে সম্ভব হল, কে জানে!
ফ্ল্যাটের লোকেশন পছন্দ হয়ে গেল স্মৃতির। প্ল্যানিং, পরিবেশ— সব কিছুই।
সমীরণ হাঁপ ছেড়ে বাঁচল। ওকে পছন্দ করানো শিবেরও অসাধ্যি! যাক, শান্তি!
‘তিনতলা, সাউথ ফেসিং, দক্ষিণে বারান্দা, গ্র্যান্ড!’
‘এই দেখো, ঠিক বারান্দার সামনে, বাঁ দিকে দু’দুটো তালগাছ। আমাদের জন্য বোনাস। ফল খাব, জল খাব।’
‘ওহ মাই গড! দুটো তালগাছ, এক পায়ে দাঁড়িয়ে। এতগুলো পাখির বাসা! এ তো উইভিং ফ্যাক্টরি অফ নেচার।’
‘আমাকে ধন্যবাদ নয়। এ দিকে এসো। কাম ক্লোজার।’
কাছেপিঠে কেউ নেই দেখে স্মৃতি সমীরণকে এক গভীর চুম্বন উপহার দিল।
আপ্লুত সমীরণ বারান্দার গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে বলল, ‘আমার একটা দারুণ প্ল্যান আছে।’
‘তোমার কোনও প্ল্যানই আমি শুনব না। ইন্টিরিয়ারের যাবতীয় পছন্দ সব আমার।’
‘কী আর করব, রানিসাহেবের হুকুম।’
‘বারান্দায় শাটার দেওয়া বড়-বড় কাচের দরজা থাকবে।’
‘অ্যাপ্রুভড।’
‘তুমি অ্যাপ্রুভ করার কে হে? বেডরুমের ব্যাকওয়ালে থাকবে আর্টওয়ার্ক। কিউরিও শপ থেকে আমি নিয়ে আসব গৌতম বুদ্ধ।’
‘ঘরের মাথার দিকে থাকবে ছোট্ট একটা কিউবিক্ল, আমার স্টাডি। ওখােন দেওয়ালে থাকবে একটি চমৎকার মিনি বুক কেস।’
স্মৃতি ভ্যাঙাল, ‘বু-ক-কে-স? আরশোলা, মাকড়সা, টিকটিকি...এখানে হবে না। পাশের ওই ছোট্ট ঘরটাতে করো।’
ছেদ পড়ল কথায়। এক জন ট্রেতে দুটো কাপ নিয়ে এসে বলল, ‘ম্যাডাম, কফি।’
‘ও ইয়েস, থ্যাংক ইউ। টেবিলে রাখো।’
এ বার এসে পড়লেন ‘অলৌকিক’-এর এক পার্টনার। কাকে যেন বললেন, ‘দুটো চেয়ার এনে দে। ওঁরা বারান্দায় বসে প্রকৃতির শোভা দেখতে-দেখতে কফি খাবেন। আর ম্যাডাম, আজ কিন্তু আপনাদের জন্য ফ্রি লাঞ্চ। না করবেন না। এটা বলতে পারেন আমাদের অতিথি সেবা। ওকে? এনজয় ইয়োরসেল্ফ।’
পার্টনার চলে গেলেন। স্মৃতি খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে দেখল, চমৎকার কফি, কফি-ট্রে, সুগার বোল...
পার্টনার আড়াল হতেই স্মৃতি বলল, ‘কফি ইজ গুড। কিন্তু আমার কফি খাওয়ার সরঞ্জাম হবে সব ইমপোর্টেড। বুঝলে গঙ্গারাম!’
‘ভাগ্যিস ‘হাঁদা’ বলোনি!’
‘এই দেখো।’
‘কাকে দেখব? তোমাকে না বাইরেটা?’
‘ধ্যাত! এই দেখো, কী সুন্দর একটা পাখি! উড়ছে, হাওয়ায় গা ভাসাচ্ছে, আবার ভিতরে ঢুকে যাচ্ছে। ঠোঁট দিয়ে ঠুকরে- ঠুকরে কী করছে? ’
‘যেমন তুমি কাঠঠোকরার মতো ঠুকে-ঠুকে কাঠ-কাঠ অনুষ্ঠানকে মনে রাখার মতো ইভেন্ট বানাও, এরাও ঠিক তেমনই। এরা বাসা বুনছে।’
‘ওহ মাই গড! কী অধ্যবসায়, কী নিষ্ঠা! এক্কেবারে তোমার মতো।’
‘বাড় খাইও না। আচ্ছা, এরা কোত্থেকে ওই সবুজ সুতোগুলো নিয়ে আসছে?’
‘সুতো নয়, ওগুলো তালগাছের পাতা। ওরা ঠোঁট দিয়ে নিখুঁত ভাবে পাতাগুলো চিরে সুতোর মতো করে নীচে নেমে আসে বাসার কাছে। তবে এই যে দেখছ পাখিটা, এটা তোমার মতো না, আমার মতো।’
‘অমনি ক্রেডিট নিয়ে নিলে!’
‘না ম্যাডাম, এটা পুরুষ পাখি, মাথায় দেখো, হলুদ রঙের টোপর! এগুলি হল পুরুষ পাখি। কায়দাটা দেখো, ডানা উঁচু করে তুলে পালক ফাঁক করল মানে হাওয়া ছেড়ে দিল।’
‘ঠিকই তো। লাভলি।’
‘এ বার দেখো, শূন্যে উঠে সুতো নিয়ে সেলাই করবার মতো করে গুঁজে দিচ্ছে বাসায়...’
‘আবার তো নীচে নামছে। এ ভাবে নীচে নেমে এসে ভেসে থাকছে কী করে?’
‘ডানা নীচে নামিয়ে দিয়ে বাতাসে ভর রাখছে, পালকগুলোকে ডানার সঙ্গে লেপটে চেপে রেখেছে, যাতে বাড়তি হাওয়া বাধা না দিয়ে নীচের দিকে চলে যায়। এ বার দেখো, হাওয়া যেই নীচের দিকে ঠেলে দিল, অমনি হাওয়ার গতিই ওকে আবার শূন্যে ভাসিয়ে ঠেলে তুলে দিল।’
‘ওহ! ওয়ান্ডারফুল, অ্যামেজিং। আচ্ছা, তুমি কি পক্ষী-বিশারদ?’
‘গ্রামের বাড়িতে এই পাখির সঙ্গে আমার আলাপ।’
‘আচ্ছা, এদের বাসা বানানো কবে শেষ হবে?’
থমকে গেল সমীরণ। তার কী হল কে জানে। এক অজানা হাহাকার তাকে গ্রাস করল। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে বলল, ‘শেষ না হওয়াই বোধহয় ভাল।’
‘কেন?’
‘তুমি কি একটা ইভেন্ট সাকসেসফুলি লঞ্চ করবার পর সন্তুষ্ট হয়ে সব কিছু ছেড়ে দিয়ে তৃপ্ত হয়ে বসে থাকো?’
‘নো, নেভার।’
এর মধ্যে দু’দুবার ফোন এলো
কেজরিওয়ালের— বিরাট ল্যান্ড মাফিয়া।
‘ম্যাডাম, আপনি পছন্দমত অ্যাপার্টমেন্ট খুঁজছিলেন?’
‘হ্যঁা, কিন্তু এখন তো আমার আর খোঁজার দরকার নেই। আমার তো ফাইনাল হয়ে গিয়েছে মিস্টার কেজরিওয়াল।’
‘আরে ম্যাডাম শোনেন, ফাইনালের পরেও একটা ফাইনাল হয়।’
‘আমার হাতে যেটা আছে, সেটা স্বর্গ ম্যাডাম। এক বার ঘুরে যাবেন না?’
‘আমার তো আর কোনও স্বর্গের দরকার নেই,’ কেটে দিল স্মৃতি।
অধৈর্য সমীরণ জিজ্ঞেস করল, ‘হু ইজ দ্যাট?’
‘ওই যে, কেজরি।’
‘পাত্তা দিও না। একেবারে ছিনে জোঁক।’
আবার ফোন এল। সমীরণ স্পষ্টতই বিরক্ত। স্মৃতি ফোন ধরে বলল, ‘হ্যালো, মিঃ চট্টরাজ? বলুন, বলুন।’
‘আমি আপনাকে অনেক দিন ধরে বলেছি, ম্যান্ডেভিলা গার্ডেন্স-এর কথা?’
‘সো কাইন্ড অব ইউ। আসলে কী, আমার উড-বি একটা অলরেডি সিলেক্ট করে ফেলেছেন, আমারও পছন্দ হয়ে গিয়েছে।’
‘আরে আমারটা দেখলে আপনি পছন্দ ক্যানসেল করতে বাধ্য হবেন।’
‘তা কী করে হয়? সব কিছু ঠিকঠাক হয়ে গিয়েছে।’
‘জীবনে অনেক কিছু অনেক সময়ে বেঠিক হয়ে যায় ম্যাডাম। আপনি একবারটি আমার প্যালেসটা দেখে যান, তার পর আপনার ডিসিশন পালটাতে বাধ্য হবেন।’
‘ঠিক আছে, দেখব।’
সমীরণ আরও বিরক্ত। প্রায় উত্তেজিত, ‘আরে কাটিয়ে দাও না!’
স্মৃতি মোবাইল অফ করে দিয়ে ফিসফিস করে বলল, ‘ওর হাতে দুটো বড়-বড় ইভেন্ট। ছোকরার এলেম আছে। বাপের বিরাট ব্যবসা চালাচ্ছে মাত্র বত্রিশ বছর বয়সে। কিছু দিন ওর সঙ্গে প্রফেশনালি খেলতে হবে। প্লিজ বেয়ার উইথ মি।’
‘খেলবে, মানে?’
‘সমীরণ, ব্যাক্তিগত জীবন আর প্রফেশনাল লাইফ, দুটোকে গুলিয়ে ফেলো না। এক দিন আমার নিজের কোম্পানি হবে। কানেকশানগুলো জিইয়ে রাখতে যদি সামান্য খেলতে হয়, হোক না।’
নম্বর ডায়াল করল স্মৃতি। সমীরণের মুখটা ব্যাজার হয়ে গেল।
স্মৃতি হেসে গড়িয়ে পড়ল। ও পার থেকে কলার কিছু বলল।
‘ওক্কে, ওক্কে। আরে বললাম তো যাব।’
ফোন রাখতেই আবার ফোন।
‘ইয়েস? আচ্ছা, আচ্ছা। অ্যাম কামিং।’
‘ওহ, স্যরি সমীরণ, এই লোকগুলো আমাকে এক মুহূর্তও তিষ্ঠোতে দেবে না। সমীরণ, আমাকে একটু অফিসে পৌঁছে দাও প্লিজ। ও হ্যঁা, কাজ যেমন চলছে চলতে থাকুক। নেক্সট সানডে। ওক্কে?’
‘এই, এটা কী করে রেখেছ? এটা তো তোমার স্টাডি করবার কথা ছিল? আর ওটা কী, এক কোণে, মার্বেল স্ল্যাব দিয়ে?’
‘ঠাকুরের জন্য সিংহাসন।’
‘তোমার আবার এ সবেও মন আছে নাকি?’
‘মা থাকবে তো।’
‘মা! আই মিন দ্যাট ওল্ড লেডি?’
‘এ ভাবে কথা বলছ কেন? দিস ইজ হিউমিলিয়েটিং।’
‘দুঃখ পেলে?’
‘অফকোর্স।’
‘ওকে। আমি কথা তুলে নিলাম,’ স্মৃতি সঙ্গে-সঙ্গে উত্তর দিল।
‘চারটে জিনিস ফিরে আসে না। সময়, ছোড়া তির, ছড়িয়ে পড়া দুধ এবং বলে ফেলা কথা।’
‘অ্যাম রিয়েলি স্যরি। আসলে বলতে চেয়েছিলাম, ঘরটাকে একটু অন্য রকম করে সাজাতে হবে। আমাদের কোম্পানির ইন্টিরিয়র টিমটাকে এখানে নিয়ে আসব। ওকে?’ সমীরণ কিছু বলল না।
বেডরুমে এসে চার দিকে চোখ ঘুরিয়ে দেখতে লাগল স্মৃতি।
‘শোনো, এখানে থাকবে বেড, গাঢ় নীল রঙের বেডকভারে মোড়া। পায়ের নীচের দিকটায় বেড মুড়ে দিয়ে থাকবে সাদা চাদর। পায়ের নীচে ধূসর রঙের কার্পেট। তুমি নোট করে নিচ্ছ না কেন? সব কি মনে থাকবে?’
সমীরণ নোট নিচ্ছিল, হঠাৎ একযোগে অনেক পাখির ডাক শুনে ওরা দু’জনেই সামনের তালগাছের দিকে তাকাল।
‘এই, এরা হল্লা করছে কেন?’
‘এদের পাড়ায় উৎসব হচ্ছে।’
‘কী হচ্ছে? পাখিদের উৎসব! ভাল বলেছ তো!’
‘ইয়েস। এদের স্বয়ংবর সভা হচ্ছে। মেয়ে-পাখিগুলো একযোগে বর খুঁজতে এসেছে।’
‘ও মাই গড! স্ট্রেঞ্জ!
‘আরও স্ট্রেঞ্জ আছে। এই যে দেখছ হলুদ টোপরওয়ালা পাখিগুলো কেমন ডানা মেলে, ডিগবাজি খেয়ে আকাশে হাউইয়ের মতো উঠে যাচ্ছে?’
‘হ্যাঁ-হ্যাঁ। আবার গান গাইতে গাইতে কেমন নীচে নেমে আসছে, অপরূপ, চমৎকার...’
‘ধৈর্য ধরো ম্যাডাম। এই পুরুষ-পাখিগুলো অর্কেস্ট্রা বাজিয়ে নতুন-আসা মেয়ে-পাখিগুলোকে আকৃষ্ট করার চেষ্টা করছে। এদের সমাজে মেয়েরা বর দেখতে আসে। বরের বাসা বানাবার দক্ষতা পছন্দ হলে তবেই কনে সেই বাসায় এসে ঘর বাঁধবে। তখনই হয়ে উঠবে, হোম সুইট হোম।’
‘বিউটিফুল। আচ্ছা, সব পাখি গেল কোথায়?’
‘নারীরা বাসায় ঢুকে সরেজমিনে বাসা পরীক্ষা করছে। দক্ষতা, শিল্প, আর্কিটেকচারাল বিউটি, বসবার ঘর, ডিম রাখবার জায়গা, সুড়ঙ্গঘর, মানে সাপের হাত থেকে ছানাদের বাঁচাবার জন্য গোলকধাঁধা, সব কিছু ঠিকঠাক হলে তবে মেয়েপাখি সার্টিফিকেট দেবে। তবেই হবে সংসার, হোম সুইট হোম।’
‘হেসে উঠল স্মৃতি। লা-জবাব, লা-জবাব। আই অলসো লাইক মাই...’ আবার ফোন বাজল, ‘হ্যঁা বলুন, মিঃ চট্টরাজ। নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই। ঠিক আছে, আমি আমার উড-বি’কে নিয়ে আজই যাচ্ছি। আপনার ডাকে সাড়া না দিয়ে পারি? আপনি হলেন মোস্ট কালারফুল, ওয়েলদি, আর্টিস্টিক...’
সমীরণ স্পষ্ট জানাল, ‘আমি যাচ্ছি না।’
পরের রবিবার স্মৃতি এল না। ‘ড্যাম বিজি বস, তুমি একা ম্যানেজ করে নাও।’
তার পরের রবিবারও স্মৃতির ফোন, ‘কিছু মনে কোরো না সোনা। চট্টরাজের একটা ইভেন্ট নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছি। মরবার ফুরসতও নেই। এখন আমি ম্যান্ডেভিলা গার্ডেন্সে।’
‘আচ্ছা শোনো স্মৃতি, তোমার ডিজাইন মতো কাজ প্রায় শেষ। কিছু দিনের মধ্যে মালিকানাও হ্যান্ডওভার হয়ে যাবে। তোমার কথা মতো বেডরুমের এক দিকে চামড়া রঙের সোফা, মাল্টি-কালার্ড ছোট-ছোট বালিশ, বালিশের কভার ইমপোর্টেড, কর্ডের কাপড় দিয়ে তৈরি। টয়লেট ফ্লোরে ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট রাজস্থানি মার্বেল... বাথ টাব... হট অ্যান্ড কোল্ড...’
স্মৃতি বোধহয় লাইনটা কেটে দিয়েছে। ‘হ্যালো, হ্যালো, হ্যালো...’
তার পরের রবিবারও স্মৃতি এল না। ফোন করে-করে ক্লান্ত সমীরণ। কিন্তু ও যাবে না ওর সঙ্গে দেখা করতে। পর্বতপ্রমাণ অভিমান নিয়ে, ঘর সাজিয়ে বসে রইল সমীরণ।
কাঠের মিস্ত্রি এল। ডাইনিং টেবিলের সঙ্গে চেয়ারগুলোর উপর টেক্সচার্ড ফোম বসছে, দরজার সামনে ফল্স সিলিংয়ে ঝকঝকে রঙ চোখ ধাঁধিয়ে দিচ্ছে। মিস্ত্রিদের কথার উত্তরে শুধু হ্যাঁ-হুঁ করে গেল সমীরণ।
মরিয়া হয়ে আরও এক বার ফোন করল স্মৃতিকে। উত্তর এল, ‘প্লিজ চেক দ্য নাম্বার ইউ হ্যাভ ডায়ালড।’ আবার এক বার করল। আরও এক বার। সেই একই উত্তর।
সমীরণ বারান্দায় এসে বসল। বারান্দায় চমৎকার গ্লাস প্যানেলের ওপর ট্রান্সপারেন্ট ঝালর, না-পরদা না-আড়াল।
শাটার ওপেন করে দিতে, অনেক দূর পর্যন্ত চোখ গেল সমীরণের। কেমন যেন ধু-ধু করছে চারপাশ। গাছগুলো আবছা রেখার মতো... গোবি মরুভূমির উপর থেকে ছেনে-আনা আকাশের নীল কেমন ঘোলাটে। এত মুক্ত চারপাশ, অথচ খুব দমবন্ধ হয়ে আসছে তার। অন্যমনস্ক ভাবে তালগাছদুটোর দিকে চোখ ফেরাল সমীরণ। প্রত্যেকটি বাসা তৈরি হয়ে গিয়েছে। বাসায় দুটো করে পাখি। সুখী দম্পতি।
কিন্তু একটি বাসা তখনও অসমাপ্ত।
তার ওপর জবুথবু হয়ে বসে আছে একটা পুরুষ বাবুই পাখি। তার যেন আর বাসা বানাবার কোনও উৎসাহই নেই!
‘রবিবাসরীয়’ বিভাগে ছোটগল্প পাঠান, অনধিক ১৫০০ শব্দে।
ইমেল: rabibasariya@abp.in সাবজেক্ট: rabibasariya galpa
ডাকে পাঠানোর ঠিকানা:
‘রবিবাসরীয় গল্প’,
আনন্দবাজার পত্রিকা,
৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট,
কলকাতা ৭০০০০১
যে কোনও একটি মাধ্যমে গল্প পাঠান। একই গল্প ডাকে ও ইমেলে পাঠাবেন না। পাণ্ডুলিপিতে ফোন নম্বর বা ইমেল আইডি জানাবেন। ইউনিকোড ব্যবহার করা বাঞ্ছনীয়।