Abosar

বাক্সের বাইরে

অম্লানকুসুম

এই ঘুরে দাঁড়ানোর গল্পগুলো পড়লে সারা শরীর জুড়ে আনন্দধারা বইতে থাকে। মাথা তো সবারই আছে। কিন্তু কারও কারও মাথায় দপ করে বুদ্ধির মশালটা জ্বলে ওঠে। তা সব কিছু পাল্টে দেয়। ওই কোম্পানিটার কথাই ধরুন না, ক্যাসেট সিডির বিক্রি নামতে নামতে যখন তলানিতে এসে ঠেকল, ওরা বাজারে নিয়ে এল অদ্ভুত এক যন্ত্র। রেডিয়োর মতো দেখতে। কিন্তু ওর মধ্যে পুরে দেওয়া আছে কয়েক হাজার গান। সত্যি মিথ্যে জানি না, তবে কোথায় যেন পড়েছিলাম এক জন লোকের মাথা থেকেই বেরিয়েছিল এই আশ্চর্য বুদ্ধি। কোনও দিন দেখা হলে ওঁকে প্রণাম করতাম। ‘গুরু! কী খেলটাই না দেখালে’ তো বলা যায় না, তবে ওঁর আশীর্বাদ ছিনিয়ে নিতাম। অথবা ওই লোকগুলো, পর পর আউটলেট খুলে মোমো বিপ্লব ঘটিয়ে দিল রীতিমতো। কেউ ভেবেছিল, এ ভাবেও সেজেগুজে লোককে মোমো খাওয়ানো যায়! আর এক জন তো দেখছি কাপড় কাচা আর ইস্তিরি করাটাও ব্র্যান্ডেড করে দিচ্ছে। সব মিলিয়ে বাজারে আমার গুরুর অভাব নেই।

এই সব গুরুদের ইন্টারভিউ-টিউ পড়ি যখন, নিজের ঠোঁটটায় শান দিই। মাছরাঙা পাখির মতো একটা ঠোঁট পেতে বড় ইচ্ছে হয়। খপ করে ছোঁ মেরে তুলে নিতে হয় অপরচুনিটি। সুযোগ কথাটার তুলনায় ‘অপরচুনিটি’ শব্দটার মধ্যে বেশ একটা ব্যবসা-ব্যবসা গন্ধ আছে। ইচ্ছে করেই বললাম। গেরুয়ারঙা পাতার ব্যবসার খবরের কাগজগুলো গুলে খেয়ে অন্তত এটুকু বুঝেছি, বাজার কোনও দিনই ব্যবসা করার জন্য উপযুক্ত হয় না। ওটাকে ব্যবসার উপযুক্ত করে নিতে হয়। আমি ঘুমিয়ে পড়লেও আমার সন্ধানী চোখদুটো যেন সারা রাত জেগে থাকে। বাজারের লুকিয়ে থাকা, ঘাপটি মেরে বসে থাকা চাহিদাগুলো যেন অণুবীক্ষণ যন্ত্রের মতো চোখে বিরাট বড় হয়ে ধরা দেয়। ধরা দিয়েছি গো, আমি বাজারের পাখি। হি হি!

একটা ধাঁধা বলি। আমি বানিয়েছি। ‘বলো তো এমন স্টক কহ তার নাম / যুগে যুগে যার শুধু বেড়ে চলে দাম / স্টক এক্সচেঞ্জে যার নেই কোনও কাম।’ ইশ! বাংলাটা কী বাজে লিখে ফেললাম। মেলাতে পারলাম না। যাক গে। ধরতে পারলেন না তো! স্টকটার নাম হল অসহায়তা। ঝেড়ে কেশেই ফেলি এ বারে। আমার ব্যবসাটা অসহায়তা নিয়ে। ছিপ ফেলার পরে ফাতনাটা যে এমন নড়ে উঠবে প্রথম দিকে, মাইরি বলছি, আইডিয়া ছিল না। সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মে গিয়ে সার্চ মারবেন— সুকল্যাণ বসু। ডালাস, সান ডিয়েগো আর বস্টন যদি দেখতে হয়, ইউটিউবের ফালতু ভিডিয়োগুলো দেখবেন না প্লিজ়। আমার প্রোফাইলে গিয়ে ফটোগুলো দেখুন। ইউটিউবের ভিডিয়ো লজ্জা পাবে। রিইউনিয়ন টাওয়ারের নীচে ২০১২ সালে তোলা ফটোটা দেখেছেন? আমার ফ্যামিলি অ্যালবাম। আমি তখন ডালাসে। বাঁ দিকে মা, ডান দিকে বাবা। কতগুলো লাইক পড়েছে খেয়াল করেছেন? বাবা গেল ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে। ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাক। কন্ট্রোল হারিয়ে বাড়ির মেঝেয় পড়ে গেল যখন, তখন রাত্রি দেড়টা-দুটো হবে। সবই মায়ের থেকে শোনা কথা। মা কোলের উপরে বাবার মাথাটা রেখে চিৎকার করছিল। বাবা ছটফট করছিল খুব। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পরে ডাক্তার নাকি বলেছিল, আর আধ ঘণ্টা আগেও যদি নিয়ে আসতেন… 

আমি তখন বস্টনে। ছুটে চলে এলাম। মা বলল, “কী করব এ বার? একদম একা হয়ে গেলাম রে বাবু।” আমি বললাম, “আমার সঙ্গে চলো।” মা গঙ্গাফড়িংয়ের ডানা ঝাপটানোর মতো মাথা নাড়াতে নাড়াতে বলেছিল, “না, না, তা হয় না। এই বাড়ি জুড়ে তোর বাবার স্মৃতি। এ সব ফেলে… বরং তুই এ বার চলে আয়। আয়, বাবু, আয়। বহু বছর তো হল ও দেশে।” 

আমি আরও জোরে দু’দিকে মাথা নাড়িয়েছিলাম, মনে আছে। উল্টে বলেছিলাম, “যাঃ, তা আবার হয় না কি!” 

মা বলল, “তুই যদি থাকতিস তখন, লোকটাকে হয়তো এত তাড়াতাড়ি চলে যেতে হত না।” 

সামনাসামনি শুনলে এ ধরনের স্টেটমেন্টের প্রতিটি অক্ষর শাবলের মতো খোঁচা মারে, হাঁসুয়ার মতো কোপায় সারা গায়ে। আমি চুপ করে ছিলাম। কাজকম্মোগুলো মিটিয়ে চুপচাপ উঠে পড়েছিলাম আমেরিকার প্লেনে। তার মাসতিনেকের মধ্যে মা-ও পুরোপুরি চুপ হয়ে গিয়েছিল। সাড়া না পেয়ে লোকজনদের বলে কাজের লোক সকালে বাড়ির দরজা ভাঙে। দেখে বাথরুমের সামনে মুখ থুবড়ে পড়ে রয়েছে আমার তিয়াত্তর বছরের মা। ২০১৫-র মার্চ। আবার ডালাস টু কলকাতা। প্রতিবেশীরা ডান্স রিয়েলিটি শো-র ভলিউমটা মিউট করে দিয়ে বলেছিল, “ইশশ, সুকল্যাণ, তুমি যদি থাকতে! বৌদিকে তা হলে হয়তো এ ভাবে…”

এর মাসকয়েক পরে বস্টনের এক পাবে চিক করে বিয়ারের ক্যানটা খুলতে খুলতে এক বন্ধু বলেছিল, আমার লিঙ্কড ইন প্রোফাইলে কোম্পানিগুলোর নাম নাকি কেন্নোর পায়ের মতো লাগে। “ছ’-আট মাস পর পরই চেঞ্জ বস! হাউ লাকি ইউ আর তুই জানিস?” আমি বিয়ারে চুমুক দিতে দিতে মৃদু হাসছিলাম। ট্রাম্প ফরেন টুরে গিয়ে এয়ার ফোর্স ওয়ান থেকে নামার সময় যেমন হাসে, তেমন। এর পরেই ডায়ালগটা ছুড়ে দিয়েছিলাম, মনীষীদের মতো, “চাকরি ছেড়ে দেব রে। অনেক হয়েছে। উইল বিকাম অ্যান আন্তোপ্রানো।” বন্ধুটা বিষম খেল। বলল, “ব্যবসা? এত ভাল চাকরি ছেড়ে ব্যবসা? ইউ মাস্ট বি ক্রেজ়ি। কিসের বিজ়নেস? কার ইনস্পিরেশনে এ সব?” 

খুব ছোট্ট উত্তর ছিল আমার। বলেছিলাম, “ব্যবসাটা অসহায়তার।” বলতে পারিনি, ইনস্পিরেশনের লোকদুটোর ছবি আমার মোবাইলের গ্যালারিতে অনেক নীচের দিকে চলে গিয়েছে। 

নিজের ঘরে ব্যাক-টু-ব্যাক এই দুটো কেস না হলে বুড়োদের পোটেনশিয়ালটাই জানা হত না আমার। ওদের প্রত্যেকটা না পারার মধ্যে কয়েকশো বান্ডিল লুকিয়ে রয়েছে। ছোঁ মারতে হয়। মারতে জানতে হয়। দেশের কাগজগুলোর ই-এডিশন পড়ার সময় শকুনির মতো তাকিয়ে থাকতাম এমন খবরের দিকে। এই তো, সল্ট লেকে আরও একটা পচা-গলা কেস। কোটি টাকার বাড়িতে একা বৃদ্ধা নিথর বিছানায়। হাতিবাগানের বাড়িতে স্রেফ ওষুধ কিনতে যেতে না পারার জন্য আটাত্তর বছরের লোকটার কথা ব্যাটারি শেষ হয়ে যাওয়া ওয়াকম্যানের মতো বন্ধ হয়ে গেল। এই খবরগুলো বুকমার্ক করে রাখি একটা ব্রাউজ়ারে। বুকমার্কের প্লাবন হয়।

*****

বিয়েফিয়ে করিনি। সাড়ে সাত কোটি জমে গিয়েছিল পঁয়তাল্লিশ বছরের জীবনে। সত্যজিৎ রায়ের নোটবুকের মতো ব্যবসাটার পুরো ব্লুপ্রিন্ট আঁকা হয়ে গিয়েছিল মাথায়। চার লাইনের রেজ়িগনেশন দিলাম। চার পাতা লিখলাম ফেসবুক আর লিঙ্কড ইন-এ। ‘কুইটিং ফর এ সোশ্যাল কজ়।’ বুকমার্ক করে রাখা খবরগুলোর কয়েকটা স্ক্রিনশট লেখার সঙ্গে জুড়ে দিয়ে বললাম, ‘দেশের মাটিতে বয়স্কদের পাশে দাঁড়াতে চাই।’ লিখলাম, ‘জীবনসায়াহ্নে পৌঁছে যাওয়া আরও হাজার-হাজার মা-বাবা ভালবাসা উজাড় করে ডাকছেন আমায়। বিদায়, ডলার।’ 

প্রথম দিনেই ষোলোশো চুয়ান্নটা লাইক পড়েছিল, মনে আছে। মাথার ভিতর শুঁয়োপোকার রোঁয়ার মতো কিলবিল করছিল পাশে দাঁড়ানোর ইচ্ছে। বুড়ো লোকগুলোও ডাকছিল, যেন সোনার ডিম পাড়া হাঁস।

প্ল্যানটা সিম্পল। একটা অ্যাপ। একটা ওয়েবসাইট। অ্যাপ খুললেই প্রয়োজনগুলো চলে আসবে উপরে বাঁ দিকের কোণে, পর পর। গ্রসারি, মানে মুদির দোকানের জিনিসপত্র, ওষুধ, ডাক্তার ডাকা মানে অ্যারেঞ্জ কনসাল্টেশন উইথ আ ডক্টর— সব আসবে প্রেয়ারের লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা স্টুডেন্টদের মতো। এর আবার দুটো ভাগ করেছি— ইমারজেন্সি আর রেগুলার চেক আপ। বুড়োদের ইন্টারনেট আসক্তির ব্যাপারটা আবার খুব প্রমিসিং নয়। তাই একটা ফোন আর হোয়্যাটসআপ নম্বরও দিয়ে দিয়েছি। মিনিমাম অর্ডার ভ্যালু করে দিয়েছি দেড় হাজার টাকা। তার চেয়ে কম হলেই একশো টাকা ডেলিভারি চার্জ। ডাক্তারের সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে দিলে কুড়ি পার্সেন্ট কমিশন। দশ হাজার টাকার টোপ দিয়ে সোশ্যাল মিডিয়াতেই একটা ম্যানেজারের জন্য বিজ্ঞাপন দিয়ে দিয়েছিলাম। একশো বাষট্টি জন ইনবক্স করেছিল। চুরাশি পিস এমবিএ। বাইশ লাখ খরচা করে পড়া একটা ইংলিশ মিডিয়ামের মেয়ে তুলে নিলাম। আর তিনটে পাঁচ হাজারি ডেলিভারি বয়। এর মধ্যে একটা আবার পোস্ট গ্র্যাজুয়েট। পঁচিশ হাজার টাকায় ফাটাফাটি ওয়ার্কফোর্স। মেরা ভারত মহান।

মোটা হাঁসগুলোকে চিনে রাখার জন্য আমি নিজেই যেতাম। মোটা মানে যারা আড়াই-তিন হাজার টাকার অর্ডার করত। নতুন এসইউভিটা চালিয়ে চলে যেতাম সল্ট লেক, নিউ আলিপুর, নিউ টাউন। তিন তলা বাড়িতে একটি মাত্র প্রাণী। ডোরবেল বাজানোর পরে পাঁচ মিনিট ওয়েটিং। এমন ডেলিভারি বয় দেখে ওরা চমকে যেত। ব্র্যান্ডেড শার্ট, দামি জিন্স, বাহারি জুতো, হাতে আইফোন। “ম্যাডাম, আপনার অর্ডার” কিংবা “স্যর, আপনার জিনিসগুলো” বলে যখন একটা প্লাস্টিক হাসি ছুড়ে দিতাম ওদের দিকে, আমার দিকে ওরা তাকিয়ে থাকত ফ্যালফ্যাল করে। “তোমার নাম কী বাবা?” জাতীয় প্রশ্নগুলো এলে নিজের পুরো পরিচয় দিতাম। “ইন্ট্রোডিউস ইয়োরসেল্ফ”-এর উত্তর তো গোটা পঁচিশ বার বলেছি ইন্টারভিউ বোর্ডে। বুড়োদের সামনে এটা আওড়ানো ছিল ভিআইপি পাসের মতো। পরিচয় দেওয়ার পরেই বিশাল বাড়িতে এয়ারপোর্টের মতো প্রায়োরিটি চেক-ইন। বিরাট হলঘরের চার দিকে ছড়িয়ে থাকত ছেলে-মেয়ে, নাতি-নাতনিদের ছবি। শূন্যতা দিয়ে সাজিয়ে রাখা দেড়-দু’হাজার স্কোয়ারফিট। ওদের ছেলেমেয়েদের খবর নিতাম। ডেটাবেস ম্যানেজমেন্ট, নিজের স্বার্থে। এই খবর নেওয়াটা ব্যবসার মেকানিজ়মে দারুণ একটা লিভারের কাজ করত। সামান্য চাপলেই প্রচুর দীর্ঘশ্বাস। বাবা চলে যাওয়ার পর ফোনে মায়ের হাহাকারমাখা নিঃশ্বাসের কথা মনে পড়ত। এ ধরনের লোপ্পা বলে টুক করে এন্ট্রি নিয়ে নিতে হয়। স্যর, ম্যাডাম থেকে ডিরেক্ট মাসিমা কিংবা মেসোমশাইয়ে আপগ্রেড। বলতাম, “মাসিমা, আমি আপনার ছেলের মতো। যে কোনও দরকারে আমায় ডাকবেন। শরীরটাও তো ভাল মনে হচ্ছে না। একটা ফুল বডি চেক আপের অ্যারেঞ্জমেন্ট করিয়ে দিই?” 

ওরা মাথা নাড়ত। ঘড়িতে ছ’টা বেজে দশ বাজার মতো করে মাথা নাড়ত। যেন বাধ্য কোনও ছাত্র। পাঁচ হাজারের কুড়ি পার্সেন্ট মানে হাজার। স্ট্রেট পকেটে। বলতাম, “মেসোমশাই, আপনার ছেলে ফিরে আসবে ঠিক, পাকাপাকি ভাবে। আমি জানি, শুধু শরীরটাই ওদের পড়ে আছে বিদেশে। মনটা এইখানে, এই বাড়িতে।” এ সব কথায় ম্যাজিকের মতো কাজ হত। মনের ভিতরে কে যেন চোখ মারত আমায়। মাসখানেকের মধ্যে ছেলে-মেয়ে-নাতি-নাতনির বান্ডিল প্যাক দেশে ট্রিপ মারতে আসছে কি না খবর আদায়ের চেষ্টা করতাম। পজ়িটিভ দেখলেই প্রপোজ়াল, “তা হলে ওদের আসার আগের দিন হাজারদুয়েক টাকার কাজু আর আমন্ড পাঠিয়ে দিই মাসিমা। নাতি-নাতনিদের নিজের হাতে দেবেন।” এ সব কথার উত্তরে ‘না’ শুনিনি কখনও। বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসার সময় ওরা ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে হাত নাড়ত। লক্ষ্মীর ঝাঁপির হাত। 

দিব্যি চলছিল। ক্রমশ নাম ছড়াচ্ছিল বাজারে। একটা সর্বভারতীয় ইংরেজি খবরের কাগজের কলকাতা এডিশনে বারদুয়েক পেড স্টোরি করে দিলাম। হাজার পঞ্চাশ নিল। একটা মোটা হাঁসকে ডেলিভারি করার সময় এসএলআর ক্যামেরার খুচখুচ। পেজ থ্রিতে ছবির তলায় ক্যাপশন—সুকল্যাণ বসু ফাইটিং ফর এ নোবেল কজ়। সেবার জন্য কি কমপ্রোমাইজ় করেছি জীবনে, তা নিয়ে আমার মুখে দু’-চার লাইন। মুশকিল হল, পুকুরে মাছ নেমে গিয়েছিল আরও কয়েকটা। দু’-তিনটে কোম্পানি চলে এল ঝপাঝপ। বিদেশি ফান্ডিং। বিরাট টিম। ঝিনচ্যাক সাপ্লাই চেন। ফোন করলেই ওষুধ। আমি দশ পার্সেন্ট ডিসকাউন্ট দিতাম। ওরা দিতে শুরু করল পনেরো। বুঝেছিলাম, লস খেয়ে ব্যবসা করছে। পিঠের উপরে বিদেশি আদর থাকলে যে-কেউ প্রথম দিকে লস হজম করতে পারে। আমি জানি। গেরুয়া কাগজগুলো আমায় শিখিয়েছে। পাবলিক তো বোঝে না সে কথা। ওরা শুধু ডিসকাউন্ট বোঝে। বুড়োরাও। ডাক্তারদের দালালি করা জন্যও তিনটে কোম্পানি চলে এল মার্কেটে। ডুবছিলাম ক্রমশ। গুরুদের আশীর্বাদ বাঁচিয়ে দিল। গুরুনাম জপেছি লেখার শুরুতেই। গুরুরা বলে গিয়েছেন, কামড়াকামড়ির দুনিয়ায় বাঁচতে গেলে আউট অব দ্য বক্স চিন্তা ছাড়া গতি নেই। বাক্সের বাইরে গিয়ে ভাবতে হবে। বড় গুরুদের অনেক শার্প মাথা। আমার ছোট মাথায় যা দিল তাই করলাম। 

আমার অ্যাপে, ওয়েবসাইটে আরও একটা অপশন জুড়ে দিয়েছি ইদানীং। শুধু অপশন বললে ছোট করে বলা হবে। ওয়েবসাইট খুললেই এখন বড় বড় করে ফুটে উঠছে— কম্প্যানিয়নশিপ। একে বাংলায় বলে সঙ্গ। মানে সঙ্গী হওয়া। জীবনের শূন্যতার ফিল ইন দ্য ব্ল্যাঙ্ক। পাঁচশো টাকা চার্জ রেখেছি ঘণ্টায়। একটা মান্থলি প্যাকেজও বানিয়েছি। মাসে দশ বার যাব। মানে দশ ঘণ্টা। সাড়ে চার হাজার টাকা নিচ্ছি। মানে ন’ঘণ্টার জন্য পে করলে এক ঘণ্টা ফ্রি। সোনার পালক লাগানো অথচ ভিতরে ফাঁপা মোটা হাঁসগুলো তো শখ হলেও উড়তে পারে না আর। থপথপ করে দৌড়তে দৌড়তে ফোন করছে আমায়। আমি নিজে এই কলগুলো অ্যাটেন্ড করছি এখন। অন্য যাবতীয় ধান্দা আমার দশ হাজারি এমবিএ সামলাচ্ছে। আমি শুধু হিসেব নিই। নাক গলাই না।

ইদানীং আবার একটা নতুন সমস্যা হচ্ছে। আমি প্রফেশনাল। কাঁটায় কাঁটায় এক ঘণ্টা হলেই ‘থ্যাঙ্ক ইউ মাসিমা’ কিংবা ‘ভাল থাকবেন মেসোমশাই’ বলে উঠে পড়ি। ওঁরা এখন আবার হাত চেপে ধরা শুরু করেছেন। শিরা বেরিয়ে আসা, ফর্সা, কাঁপা হাতে আমার হাত চেপে ধরেন। বলছেন, ‘তুমিই তো বলেছিলে, ছেলের মতো। এত ঘড়ি দেখতে হয়?’ চোখের কোণে চিকচিক। এই হ্যাজ়ার্ডের একটা সলিউশন বের করতে হবে জলদি।

এখন সঙ্গ দেওয়া শেষ হলে পয়সা নিই। ভাবছি পুরোটাই অ্যাডভান্স পেমেন্টে নিয়ে চলে যাব। প্রিপেড। আমি তো ছেলের মতো। মাসের শুরুতে পুরো পেমেন্ট পকেটে ঢুকিয়ে নেওয়াটা এনশিয়োর করতে হবে প্রথমে। তার পর দরজা ঠেলে কোনও বাড়ি ঢোকার পর যদি আমার মুখ থুবড়ে পড়ে থাকা মায়ের মতো কাউকে দেখতে পাই, তা হলে এই লসগুলো পুষিয়ে যায়। শুরুর দিকে দু’-তিন মাসে একটা হলেও চলবে। স্টার্ট-আপ কোম্পানি তো!