Abosar

বাইরের লোক

শুভমানস ঘোষ

অফিসে আবার সেই ঘটনা। এই নিয়ে তৃতীয় বার। আজ একটু দেরিই হয়েছিল আবেশের অফিসে আসতে। অ্যারাইভালটা মারতে তাড়াহুড়ো করে ভাদুড়ীসাহেবের চেম্বারের দরজা ঠেলে ঢুকতেই ভাদুড়ী সটান চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। ‘‘ইয়েস স্যর, ইয়েস স্যর’’ বলে তাকে বসতে বলে হাত কচলাতে কচলাতে জানতে চাইল, মিস্টার সিং কষ্ট করে এখানে আসতে গেলেন কেন? ফোনে একটা ডাক দিলেই সে নিজেই তাঁর চেম্বারে পৌঁছে যেত।

মিস্টার সিং মানে রিজিওনাল ডিরেক্টর রতনলাল সিং, ক্যামাক স্ট্রিটের হেড অফিসে বসেন, এই অফিস ও এখানকার প্রধান মিস্টার ভাদুড়ীর ওপরওয়ালা, মাঝে মাঝে সারপ্রাইজ ভিজিটে আসেন, আবেশকে দেখে গুলিয়ে ফেলেছে, তাকেই তার বস বলে মনে করছে।

‘‘কাকে স্যর বলছেন স্যর?’’ ভাদুড়ীর ভুল ভাঙানোর চেষ্টা করল আবেশ, ‘‘আমি আবেশ, আমায় চিনতে পারছেন না?’’

কিন্তু ভাদুড়ী শুনল না, সমানে ‘‘বসুন স্যর বসুন স্যর’’ করতে লাগল, তার আপ্যায়নের জন্য বেল বাজানোর কথা ভুলে উদ্‌ভ্রান্তের মতো চেম্বার থেকেই আর্দালির নাম ধরে ডাকাডাকি জুড়ে দিল। এক সময় না এক সময় ভাদুড়ীর ভুল ভাঙবেই, অফিসের অধস্তন কর্মচারীকে স্যর বলে ডাকার লজ্জা ঢাকতে সে স্বাভাবিক ভাবেই আবেশের উপর খাপ্পা হয়ে যাবে। এই সব ফার্মে টিকে থাকার ভবিষ্যৎ সব সময়ই বড়সড় জিজ্ঞাসাচিহ্নের উপর দাঁড়িয়ে থাকে। চাকরি নিয়ে টানাটানি পড়ে যাওয়াও আশ্চর্য নয়। রইল পড়ে অ্যারাইভাল। বড়সাহেবের চেম্বার থেকে ছিটকে বেরিয়ে সে দিনের মতো অফিস থেকেই উধাও হয়ে গেল আবেশ। একটা দিন কামাইয়ের উপর দিয়ে গিয়ে যদি চাকরি বাঁচে তো বাঁচুক।

প্রথম ঘটনাটা ঘটেছিল অফিসে আসার পথে। বাড়ি থেকে বেরিয়ে রোজকার মতো সে মনখারাপ করে বাসরাস্তায় দাঁড়িয়ে ছিল বাসের অপেক্ষায়। মনখারাপের কারণ তার বউ সিক্তা। সিক্তা জাতে নারী হলেও দয়ার লেশমাত্র নেই তার, উঠতে বসতে কথা শোনায়, ভাল কথা বললেও খারাপ মানে করে কোমরে আঁচল এঁটে ঝগড়া করতে শুরু করে।

আবেশ মুখচোরা ও ঘরে-বাইরে তাড়া খেয়ে বেড়ানো ভিতু প্রকৃতির মানুষ। পাড়ার-অফিসে কেউ তাকে পাত্তাই দেয় না, সব সময় হ্যাটা করে, আজেবাজে নাম দেয়। সকলের কাছে সে হাসির খোরাক। বউয়ের সঙ্গে ঝগড়া করার শক্তি বা সাহস কোনওটাই নেই বলে চুপচাপ সে সব হজম করে। তাতে বউয়ের রাগ আরও বাড়ে, এমন বিশ্রীভাবে মুখ ছোটায়, বুকে শেল বেঁধে তার।

কাল রাতে সেই রকম একটা মোক্ষম শেল বুক ফুঁড়ে দিয়েছে তার, চড়া রোদ্দুরে বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে ঘামতে ঘামতে সে কথা ভাবছিল আর ধিক্কারে মন ছেয়ে যাচ্ছিল তার। মনে হচ্ছিল, দুদ্দুর! এটা একটা বাঁচা হল! সকলে রাজার মতো মাথা উঁচু করে বাঁচে, সে কেন ইঁদুরের মতো, আরশোলার মতো, কীটপতঙ্গের মতো বেঁচে আছে? তার জীবনের হাওয়া কখনও বদলাবে না? একটা দিনের জন্য হলেও না?

চোখ জলে ভরে আসছিল তার। ঠিক তখনই ঘটনাটা ঘটল। তার আকুল ইচ্ছেয় সাড়া দিয়েই যেন ছাতা মাথায় পাড়ার ইন্দ্রনীল সামনে এসে দাঁড়াল, তার দিকে অবাক চোখে চেয়ে বলল, ‘‘আরে চেয়ারম্যান সাহেব যে? কেমন আছেন স্যর? পাঁচ মাস হয়ে গেল বাড়ির মিউটেশনের কাগজ জমা দিয়েছি, ভালই হল আপনার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল।’’

ইন্দ্রনীল লোকটি মহা ত্যাঁদড়, আবেশকে দেখলেই তার পিছনে পড়ে যায়, জ্বালিয়ে খায়। এটাও সেই রকম কিছু হবে এই ভেবে আবেশ বিরক্ত ভাবে বলেছিল, ‘‘অ্যাই ইন্দ্রনীল, ইয়ার্কি করবি না।’’

‘‘আপনি মিউনিসিপ্যালিটির চেয়ারম্যান, আপনার সঙ্গে ইয়ার্কি করব? ছি!’’ ইন্দ্রনীল সিরিয়াস গলায় বলল, ‘‘এখানে দাঁড়িয়ে যে, গাড়ি আসবে বুঝি? রোদ্দুরে দাঁড়িয়ে আছেন, ছাতার তলায় আসুন স্যর।’’

ইন্দ্রনীল ছাতাটা তার মাথায় বাড়িয়ে ধরে নিজে রোদ্দুরে দাঁড়িয়ে মিউটেশনের কাগজটা যাতে স্মুদলি বেরিয়ে যায় তার জন্য ভাল ভাল খাতিরের কথা বলে তাকে ভেজাতে লাগল, সমানে ‘স্যর স্যর’ করতে থাকল। আবেশ তাকে বোঝানোর চেষ্টা করল, তার ভুল ভাঙাতে চাইল, লাভ হল না। কোনও রহস্যময় কারণে ইন্দ্রনীলের চোখে সে এখন সত্যি সত্যিই মিউনিসিপ্যালিটির চেয়ারম্যান।

তবে মান-সম্মান-ক্ষমতা কিছুই পৃথিবীতে স্থায়ী হয় না। তাই একটু পরেই তার ভুল ভাঙবে, আবেশকে ঠিকঠাক চিনতে পেরে রাগে-অপমানে-লজ্জায় ঝাঁপিয়ে পড়বে, লাইফ হেল করে দেবে তার। যত তাড়াতাড়ি এখান থেকে পালানো যায়, মঙ্গল। একটা ফাঁকা টোটো-রিকশা হাত তুলে দাঁড় করিয়ে চটপট তাতে উঠে পড়ল আবেশ, চালকও কোনও কথা না বলে গাড়ি ছেড়ে দিল। মনে মনে ‘বাঁচলুম বাবা’ বলে পা ছড়িয়ে সিটে আরাম করে বসল সে।

মিনিট দুই যেতেই সে টের পেল, বাঁচা এত সহজ নয়। হঠাৎ ঘাড় ঘুরে গেল টোটোচালকের, লাজুক হেসে বলল, ‘‘আপনার কলেজে যদি গার্ড-টার্ড লাগে, তবে বলবেন স্যর। টোটো চালিয়ে সুবিধে হচ্ছে না। একটা পাকা চাকরি পেলে বেঁচে যাই।’’

আবেশ সচকিত হয়ে ছোকরার দিকে ভাল করে তাকিয়ে থ হয়ে গেল। না দেখে, ভাল করে খেয়াল না করে এ কার টোটোয় চড়ে বসেছে? এ-ও তার পাড়ার আর এক পিস বদমাশ— বল্টু। বল্টু দু’বাড়ি পরেই থাকে, এক সময় স্কুলে তার সহপাঠী ছিল, আবেশ মন দিয়ে পড়াশোনা করত বলে খুব রাগ ছিল তার উপর। তার পড়ার বই ছিঁড়ে দেওয়া, ব্যাগ লুকিয়ে রাখা, টিফিন চুরি করে খাওয়া ইত্যাদি করেও আজও শান্তি হয়নি তার। সে কেন তার মতো চাকরিবাকরি না করে টোটোরিকশা চালায়, এই রাগে এখনও তাকে দেখলেই এমন বাজে বাজে কথা বলে যে, দূর থেকে তাকে দেখলেই আবেশ পালায়। এটাও তার একটা ইয়ার্কির কথা এই ভেবে সে রা কাড়ল না। বল্টুও আর কথা বাড়াল না, জোরে টোটো হাঁকিয়ে চলে এল শ্যামাদাস স্মৃতি মহাবিদ্যালয়ে। কলেজের গেটের সামনে ব্রেক কষে দাঁড় করিয়ে বলল, ‘‘নামুন স্যর, আপনার কলেজ এসে গিয়েছে।’’

ইয়ার্কির একটা সীমা আছে! কোথায় যেতে গিয়ে কোথায় নিয়ে চলে এল তাকে! অফিসটা আজ হলে হয়। আবেশ নিরীহ নির্বিবাদী লোক, এ বারও টুঁ শব্দটি না করে গাড়ি থেকে নেমে পকেটে হাত গলাতে যাবে, বল্টু মাথা নাড়াল, ‘‘ভাড়া দিতে হবে না স্যর, লোক লাগলে দয়া করে আমায় একটা খবর দেবেন, তা হলেই হবে।’’

এই বলে বল্টু গাড়ি থেকে নেমে এল। কলেজের ছেলেছোকরাদের সামনেই ঢিপ করে তাকে প্রণাম ঠুকে বিনয়ে গলে গেল, তার যাতে এখানে একটা চাকরি হয় তার জন্য এমন ভাবে তোয়াজ করতে লাগল যে আবেশের খটকা লাগল।

তবে কি একটু আগে যা হল আবার সেই গোলমালটাই হয়েছে? তাকে দেখে বল্টুও চিনতে পারেনি? ভেবেছে সে কলেজের অধ্যাপক? তাই যদি হয়, যখন তার ভুলটা ভাঙবে খেয়ে ফেলবে তাকে, লজ্জায়-অপমানে তাকে চরম হেনস্তা করবে। ‘ঠিক আছে ঠিক আছে’ বলে কোনও রকমে সেখান থেকে তাকে বিদেয় করে তবে শান্তি। তার পর অফিসে এসে এই কাণ্ড। এত দিন ঘষেও বেতন পাঁচ অঙ্ক ছুঁল না যার, সে কিনা রিজিওনাল ডিরেক্টর!

অফিস থেকে বেরিয়ে ‘কোথায় যাই কোথায় যাই’ ভাবতে ভাবতে আবেশের মনে হল বাড়িই ফিরে যাই, গিয়ে সব খুলে বলি সিক্তাকে। শুনলে সে নির্ঘাত চমকে যাবে। সে তো তাকে পাত্তাই দেয় না, কোনও কথাই শোনে না তার, তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে, বিছানায় ভালবেসে একটু আদর করতে গেলেও ঠেলে সরিয়ে দেয়। আজকের ঘটনা শুনলে একটু হলেও কি তার ধারণা বদলাবে না? তার স্বামীকে দেখে লোকে আজকাল বড় মাপের মানুষ বলে ভাবছে, এই ভেবে এই ঠা-ঠা রোদ্দুরের নির্জন-মধুর দুপুরে তাকে হয়তো সমীহ করেই বিছানাতেই অ্যালাও করবে, কে জানে।

আবেশ আর দেরি করল না, উৎসাহে টগবগ করে ফুটতে ফুটতে বাস ধরে চলে এল বাড়িতে। ডোরবেলের শব্দে সিক্তা দরজা খুলতেই সে সাসপেন্স ভরা গলায় বলল, ‘‘অফিস করা হল না, বুঝলে? আজ যা কাণ্ড হল না!’’

চোখ দু’টো বিস্ফারিত হয়ে গেল সিক্তার, ভুলে গেল দরজা বন্ধ করতে। আবেশই দরজা বন্ধ করে মুখে হাসি টানল, ‘‘আমি তো ছুটতে ছুটতে আসছি তোমায় বলব বলে। শুনলে অবাক হয়ে যাবে।’’

অবাক তত ক্ষণে হয়েই গিয়েছে সিক্তা, এতটাই যে মানুষ মানুষকে দেখলে হতে পারে বিশ্বাস করাই শক্ত। আবেশের খটকা লাগল, ‘‘কী দেখছ বলো তো আমার দিকে?’’

‘‘দেব! দেব! এত দিন কোথায় ছিলে তুমি?’’ সিক্তা বিড়বিড় করে উঠল, ‘‘তুমি এখানে এলে কী করে? কে দিল তোমায় আমার ঠিকানা?’’

‘‘কে দেবে?’’ আবেশ আকাশ থেকে পড়ল।

উত্তরে সিক্তা যে-কাণ্ডটা করল স্বপ্নেও ভাবেনি আবেশ। আচমকা তার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে হাহাকার করে উঠল, ‘‘দেব তোমাকে কত খুঁজেছি, তোমার জন্য কত কেঁদেছি, কোথায় চলে গিয়েছিলে তুমি
আমায় ছেড়ে?’’

আবেশ ঘাবড়ে গেল, ‘‘আরে কাকে কী বলছ? আমাকে তুমি চিনতে পারছ না সিক্তা?’’

‘‘পারছি পারছি! এত দিন লুকিয়ে লুকিয়ে বেরিয়েছ, ভেবেছ চিনতে পারব না? সেই তো ফিরে এলে, দেব! পারলে থাকতে? বিয়ের পরে প্রতিটি রাত তোমার জন্য বুক দিয়ে ফোঁটা ফোঁটা রক্ত ঝরেছে আমার, পালিয়ে তুমি যাবে কোথায়?’’ সিক্তার গলা ভেঙে এল, ‘‘তোমার পৃথিবীতেই তো আমি থাকি, ওটাই আমার আসল ঘর, এক বারও ভাবলে না তোমায় ছেড়ে আমি থাকব কী করে? কী করে কাটবে আমার আস্ত একটা জীবন? ঘণ্টার পর ঘণ্টা, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর? তোমাকে আমি কঠিন শাস্তি দেব, কঠিন শাস্তি।’’

আবারও সেই ভুল, আবারও সেই গোলমাল! এ বার আরও শোচনীয়, আরও মর্মঘাতী ভুল! সিক্তা তাকে তার প্রাক্তন প্রেমিক বলে ভুল করেছে। তাকে পায়নি বলেই সে এত রুক্ষ, এত কর্কশ, তার প্রতি এতটা নির্দয়! কষ্টে বুক ফালাফালা হয়ে গেল আবেশের। কিন্তু সে তো রাগ করতে জানে না, কাউকে আক্রমণ করতে পারে না, সে যা পারে সেটাই করল, ‘না, না’ বলে অস্ফুট আর্তনাদ করে উঠল।

সিক্তা শুনল না, তাকে টানতে টানতে বিছানায় ফেলে তার বুকে মাথা রেখে হু-হু করে কেঁদে ফেলল, কান্না-জড়ানো গলায় বলতে থাকল, ‘‘এ কার সংসারে তুমি আমায় ফেলে রেখে চলে গেলে, দেব? এ তো বাইরের লোক। আমি তাকে মেনে নেব কী করে? বিয়ের পর থেকে লোকটাকে শুধুই কষ্ট দিয়েছি, উঠতে বসতে যন্ত্রণা দিয়ে তোমাকে না পাওয়ার যন্ত্রণা ভুলতে চেয়েছি। ও কী করে জানবে সে কেউ নয়, তুমিই আমার সব?’’

সিক্তা আবেশকে আদর করতে থাকল, তার কপালে-গালে হাত বোলাচ্ছে, চোখের পাতায় চুমু খাচ্ছে। নারী এতটাই যত্ন করে ভালবাসে পুরুষকে! প্রিয় পুরুষের জন্য এতটা অমৃত জমা হয়ে থাকে তার বুকে! পলকে সব কষ্ট-ব্যথা চলে গেল আবেশের, সে একেবারে মুগ্ধ হয়ে গেল। অবাক হয়ে দেখল, সকালে সে আকুল ভাবে যে-ইচ্ছেটা করেছিল এত ক্ষণে সেটা কী সুন্দর ভাবেই না পূর্ণ হচ্ছে! হলই বা ভুল, এই তো সে নারীর ভালবাসা পাচ্ছে! মিথ্যে করে হলেও কীটপতঙ্গের মতো বেঁচে থাকার জীবন থেকে রাজার মতো বাঁচার সুখ পাচ্ছে। তার মতো ভীত-নিগৃহীত, অপমান-বিড়ম্বিত মানুষের কপালেও এত বড় মধুর পুরস্কার ছিল! আহা, এই সুন্দর সময়টা যেন এখনই শেষ না হয়। ভুলটা যেন নিষ্ঠুর সত্যে বদলে না যায়!

সিক্তার ভালবাসায় নিজেকে ভাসিয়ে দিতে দিতে আকুল ভাবে আবার ইচ্ছে করতে থাকল আবেশ।

 

ছবি: শুভম দে সরকার