উ
ঠোন ঝাঁট দিয়ে জলছড়া দিতে দিতে রোজ ভোরে গুনগুন করে গায় ফুলি— “শুক বলে ওঠো সারী ঘুমায়ো না আর… এ জীবন গেলে ফিরে আসে না আবার…”
বেলফুলের গাছটায় কলি ধরল বোধ হয়, মিঠে গন্ধ আসছে বেশ। আরামে চোখ জড়িয়ে আসে হারানের। কাছেই ফুলির ছেড়ে রাখা বাসি ন্যাতানো শাড়িখানা জড়িয়ে নেয় গায়ে। ফুলির গন্ধ লেগে আছে এতে। চিরকালের বৌ-আঁকড়া মরদ সে। সবাই বলে। মন্দ লাগে না তার। বৌ ছাড়া আর তার আছেটাই বা কে!
একটা ভ্যাপসা গরমের চোটে ঘুমটুম লাটে উঠেছিল গত রাতে। এ বার চত্তির মাসের শেষ থেকেই যেন আগুন ঝরছে। বসন্তের ফুরফুরে মেজাজখান চোখের পাতা ফেলতি না-ফেলতিই ফুড়ুত! পিঠে এখনই ঘামাচি বিজবিজ করছে হারানের। মেঝেতে মাদুর বিছিয়ে তারা কত্তা-গিন্নিতে পালা করে হাতপাখা নেড়ে-নেড়ে বাতাস করছিল একে অপরকে। ফুলি একটা ঝিনুক দিয়ে পুটপুট করে ঘামাচিগুলো মেরে দিতে বেশ আরাম হচ্ছিল। এ সময় খুব সোহাগ আসে দু’জনেরই। ঘামাচি মারতে মারতেই ফুলি ঘেঁষে আসে হারানের দিকে। হারান পাশ ফেরে। আঁচল সরিয়ে ফুলির শুকনো বুকে মুখ গুঁজে দেয়। একটা ছাওয়াল-পাওয়াল এলে তাও বুক দুটোয় খানিক রস আসত, তা সে দিকেও তো মাগির শিলচাপা কপাল।
কোন শত্তুরের অভিশাপে এমন দুর্ভাগা তারা কে জানে! দীর্ঘশ্বাস বুক ভেদ করে বোধ হয় আরও খানিক ভেতরে ঘা দিয়ে ফেলে। ফুলি হারানের মাথাটা আরও বেশি করে টেনে নেয় তার বুকে। গায়ে পিঠে হাত বুলিয়ে দেয়। হারান মনে-মনে ডাকে বার বার… মা! মা!…
“চা-মুড়িটুকুন খেয়ে বাজার যাও দিকি। আর হ্যাঁ, চুনো মাছ নিতে ভুলুনি যেন। গাছে বেগুন ধরেছে অনেক। আলু-বেগুন দিয়ে ঝাল-ঝাল করে রেঁধে নেব’খন। ভাজা খেতে গেলে বড্ড তেল খচ্চা হয়।”
ফুলি চান সেরে নিয়েছে সকাল-সকাল। সিঁদুর পরতে গিয়ে নাকের ডগায় বেশ খানিকটা ছড়িয়ে পড়েছে। চুল থেকে টুপটুপ করে জল পড়ে বেলাউজের পিঠ ভিজে উঠেছে অনেকখানি। হারান এই দৃশ্যটা রোজই খুব মন দিয়ে দেখে। চোখে চোখ পড়লে ফুলি মুখ টিপে হাসে। বলে, “মরণ! বুড়ো হতে চলল, ঢং দেখো মিনসের!”
হারান চায়ে চুমুক দিতে দিতে বলল, “ভাবছিলাম চৌধুরীদের মাসকাবারির টাকাটা মিটিয়ে দে আসব এ বেলা। আজ একটু কষ্ট করে বেগুনপোড়া দিয়ে চালিয়ে নে।
কাল বরং তোর চুনো মাছ আনব’খন।”
ফুলি দীর্ঘশ্বাস লুকিয়ে ফেলে। আজ একাদশী। সধবাদের একটু
মাছ মুখে না দিলে যে সংসারের অকল্যাণ, সে আর কে বোঝায় এই আলাভোলা মানুষকে!
ফতুয়াখানা গায়ে গলিয়ে বেরিয়ে যায় হারান। সেদিকে তাকিয়ে ফুলি কপালে হাত ঠেকায় অভ্যেসে,
“দুগ্গা দুগ্গা…”
হারানের বাড়ি থেকে মিনিট দশেকের হাঁটাপথ পেরোলেই চৌধুরীদের বিশাল বাগান। এই বাগানেরই গোটা পনেরো নারকেল গাছের ইজারা নিয়ে রেখেছে হারান। গরমের সময় স্টেশনের ধারে ডাব নিয়ে বসে। ক্লান্ত লোকজন তাতে গলা ভেজায়। পরানটা ঠান্ডা হয় খানিক। হারান তাদের সঙ্গে সুখদুঃখের গপ্পগাছা করে। দু’পয়সা আয়ের পাশাপাশি মনটাও বেশ হালকা হয়।
প্রায় বছর দশেক হয়ে গেল এই গাছগুলোই বলতে গেলে হারানকে বাঁচিয়ে রেখেছে। শুধু পেটের টানেই নয়, কী যেন এক অদ্ভুত মায়ায় জড়িয়ে গেছে সে এই গাছগুলোর সঙ্গে। প্রত্যেকটা গাছের আলাদা আলাদা নাম রেখেছে সে মনে-মনে। সবচেয়ে পুরনো যেটা, সেটার নাম বুড়ো, শুরু থেকেই হেলে-বেঁকে উঠেছে যেটা, সেটা বঙ্কু, আর ওই যেটা সবচেয়ে উঁচু, ওর নাম লম্বু। মেয়েও আছে গোটা কয়েক। তাদের নামের বাহার অনেক বেশি। মধু, চড়ুই, সোহাগ… ডাব বা নারকেল নামানোর সময় সে গাছগুলোর গায়ে খুব আদরে হাত বোলায়। ফিসফিস করে বলে, “ব্যথা লাগেনে তো বেশি? অক্ষম বাপ তোদের। ক্ষমা করে দিস।”
গাছগুলোর পাতা তখন একটু যেন বেশিই নড়েচড়ে ওঠে। পাতায় পাতায় ঘষা লেগে খসখস শব্দ। সেই সব শব্দে কান পাতে হারান। যেন মনে হয় কলকল করছে এক ঘর ছেলেপিলে। রুক্ষ বাকলে গাল পেতে আদর দেয় সে। হাত বুলোয় খুব ওদের সারা গায়ে।
চৌধুরীদের ছোট বৌমা চারু দূর থেকে মানুষটাকে দেখে অবাক হয়ে। বছর দেড়েক হল সে এসেছে এই পরিবারে। বাড়ির মধ্যে সবচেয়ে ছোট হওয়ায় তার আদর খানিক বেশিই। সাত মাসের পোয়াতি চারু। ভারী শরীরটা নিয়ে সে যেন আর পেরে ওঠে না। মুখে রুচিও নেই তেমন। পিসিশাশুড়ি এক বয়াম আমচুর আর তেঁতুলের আচার দিয়ে গেছে। ওই দিয়েই দুটো ভাত গিলতে হয় কোনও মতে। বাড়ির পিছনে একটা গন্ধলেবুর গাছ আছে। বিকেল দিক থেকে একটা ফুরফুরে হাওয়া বয়। সেই হাওয়ায় ভেসে আসে লেবুফুলের মন-ভাল-করে-দেওয়া গন্ধ। চারু প্রাণভরে শ্বাস টানে। হারানদাকে দেখতে দেখতে সকালবেলার অস্বস্তিটা যেন ভুলেই গেছিল চারু। পেটের ভেতর থেকে এখন আর এক জন জানান দিচ্ছে যে, তেনার খিদে লেগেছে। নিজের উঁচু হয়ে আসা পেটে খুব নরম করে হাত বুলোয় চারু। মনে মনে কত গপ্পো করে তার হবু সন্তানের সঙ্গে। দূর থেকে এক জোড়া কাতর চোখ বুভুক্ষুর মতো সেই দৃশ্য গিলে নিতে থাকে। চারু টের পায় না।
“সোহাগের পালা আর ফুরোয় না দেখি তোর! তা বলি মালকড়ি
কিছু এনেছিস আজ? না কি খালি হাতেই ফের…”
তপু, মানে ত্রিদিব চৌধুরীর বড় ছেলে তপেনের ছুড়ে দেওয়া কথার ঝাঁঝে ঘোর ভাঙে হারানের। কত্তাবাবার এই বড় ব্যাটাখান এক্কেবারে চশমখোর, পয়সা ছাড়া জগতে আর কিস্যু চেনে না। হারান কোনও উত্তর না দিয়ে তার ফতুয়ার পকেট থেকে জমিয়ে আনা আধময়লা নোটগুলো বার করে তপুর হাতে তুলে দেয়। তপেন ঠোঁট উল্টে বিরক্ত গলায় বলে, “এহহ! মোটে এই ক’টা টাকা! নাহ, বাবা দেখছি দানছত্র খুলে রেখে আমাদেরই হাঁড়ির হাল করবে। শোনো হারানদা, সামনের মাসে আরও শ’তিনেক বাড়িয়ে দিয়ো। এই বাজারে এত সস্তায় ব্যবসা চলে না।”
হারান প্রতিবাদের ভাষা শেখেনি। খানিক ভালবাসতে পারে শুধু নিজের মতো করে। চুপ করে মেনে নেওয়া তার মজ্জাগত। ফুলি ঠিকই বলে। ফুলি না থাকলে এত দিনে তার ভিটেমাটিটুকুও টিকে থাকত না।
চলেই যাচ্ছিল সে, হঠাৎ পিছু ডাকল বলাই। বাচ্চা ছেলে। চৌধুরীদের ফাইফরমাশ খাটে। হাতে তার একখানা বাটি। সঙ্গে ঘটিভরা জল। হারানের দিকে বাটিটা এগিয়ে দিয়ে বলল, “খাও। ছোটবৌমণি পাঠাল তোমার জন্যি।”
এক বাটি নারকেল নাড়ু। হারানের মুখটা আলো হয়ে ওঠে। এক গাল হাসি নিয়ে সে দূর থেকে হবু মা-টিকে প্রাণভরে আশীর্বাদ করে।
“কী হল! নাও, খাও দিকি ঝটপট। আমারে আবার বাজার যেতি হবে এর পর। মেলা কাজ বাকি পড়ে আছে…”
বলাই তাড়া লাগায়। হারান একটু আমতা-আমতা করে বলে, “একখান পেলাস্টিকে করে নাড়ু ক’খান একটু বেঁধে দিবি বাপ? তোর কাকি খুব ভালবাসে, তাই আর কী…”
বলাই অনিচ্ছাসত্ত্বেও না বলে উঠতে পারে না। ফেনিকাগজের মধ্যে নাড়ুগুলো ভরে ভাল করে গিঁট বেঁধে হারানের হাতে দেয়। হারান বাড়ির দিকে পা বাড়ায়। আজ আর বাজার করা হল না তার। হঠাৎ কী মনে করে ঘুরে আসে দরজায়। বলাই তত ক্ষণে ভেতরে চলে গেছে। বুকের মধ্যে একটা ইচ্ছে ঘুরপাক খায়। জানা হল না তো, কোন গাছটার…
গত কয়েক দিন ধরেই ফুলির খুব জ্বর। হারান বলতে গেলে একাই সামলাচ্ছে ঘরের সাতসতেরো কাজকর্ম। তবু রোগীর পথ্যি বানাতে গিয়ে হিমশিম খাবার জোগাড়! যোগেন ডাক্তার বলছে রক্ত পরীক্ষা করা দরকার। দরকার তো বোঝা গেল, কিন্তু হাত যে একেবারে ঠনঠন করছে। এই বাদলার দিনে এমনিতেই গাছের গায়ে শেওলা জমে পিছল হয়ে থাকে। এই সময় গাছে ওঠা বেশ ঝক্কির ব্যাপার। আর ব্যবসাও তেমন একটা জমে না এই দুটো মাস। আঁকশি দিয়ে উঠোনের পেয়ারা গাছটা থেকে ডাঁশা দেখে গোটা কয়েক পেয়ারা পাড়ল হারান। জ্বরের জন্যই মনে হয় ফুলির অরুচি হয়েছে খুব। পেয়ারা চিবোলে খানিক রুচি ফেরে যদি।
ফুলি হারানের অবস্থা দেখে করুণ গলায় বলে ওঠে, “তোমায় ভারী বেপদে ফেললুম যা হোক… কী যে মরণের অসুখে ধরল আমায়! এই অলক্ষ্মী দশার চেয়ে বরং যদি যমরাজ নেত তো বাঁচতুম।”
হারানের চোখে জল উপচে আসে। ফুলিকে দেখতে দেয় না। ডান হাতের পিঠ দিয়ে আলগোছে মুছে নেয়। তার পর ফুলির কাছে এসে বলে, “না-হয় তোর কোল খালিই রয়ে গেছে, আমারই দোষ হবে কিছু। তুই বাঁজা, এ আমি মানিনে। কিন্তু তা বলে আমি কি কেউই নই? ছেড়ে যাবার এতই তাড়া পড়েছে!”
এই ক’দিনেই মানুষটার চেহারাটা বেশ খারাপ হয়েছে। বুকের পাঁজর ক’খানা যেন গোনা যায় এমন… ফুলির বুকটা মুচড়ে আসে।
কানে হাত দেয় সে। শাশুড়িমায়ের দেওয়া আশীব্বাদি এই মাকড়িজোড়া এখনও অবশিষ্ট রয়েছে। ভয়ে ভয়েই সে হারানকে বলে, “এই কানের ফুল দুটো বাঁধা দিয়ে ক’টা ট্যাকা যদি… পরে না-হয় কখুনো ছাড়িয়ে এনে দিতে সময় সুযোগমতো।”
হারান এ বার ঝরঝর করে কেঁদে ফেলে। ফুলি ব্যস্ত হয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে বলে, “মাফ করো গো,
ট্যাকা লাগবেনি… আমারই ভুল, আমারই… তুমি এমন কান্নাকাটি করুনি, আমি যমেরও অরুচি, নেবেনে সে আমায়…”
অঝোরে বৃষ্টি আজ সন্ধে থেকেই। সঙ্গে তুমুল ঝোড়ো হাওয়া। টালির চাল ভেদ করে টুপটাপ জল পড়ছে। হারান হাঁড়ি-পাতিল বসিয়ে রেখেছে এখানে-ওখানে। রাতের দিকে ফুলির গায়ের তাপ বাড়ে। কাঁথাখানা ভাল করে টেনেটুনে দেয় হারান তার গায়ে। কপালে হাত রাখে। ফুলি তার ঠান্ডা হাতখানা নিজের গরম কপালে চেপে ধরে। হারান শিয়রে বসে রাধামাধবকে ডেকে চলে আর জলপট্টি বদলে বদলে দেয়। মেঘের হাঁকডাকে বুকের ভেতরটা কেমন জানি দুরুদুরু
করছে, কেন কে জানে! থেকে থেকে হড়হড় কলকল আওয়াজ। উঠোন জলে টইটম্বুর…
“উহহ মা গো… এ কী সব্বনেশে কাণ্ড… আগুন কেন এত! আগুন কেন…” হঠাৎ কেমন আর্তনাদ করে ওঠে ফুলি।
মারাত্মক জোরে পড়ল বাজখানা। ফুলি জ্বরের ঘোর থেকে ছিটকে উঠেছে আতঙ্কে। বড় কু ডাকছে যেন মনটায়! হারান ফুলিকে আশ্বস্ত করে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। বলে, “আগুন কই রে! জল… জল…”
ফুলি জল খায়। গলা শুকিয়ে উঠেছে তার। শুকনো বুকদুটো টনটন করে উঠছে খুব। হারানের হাতটা মুঠোয় নিয়ে সে এক সময় ফের ঘুমিয়ে পড়ে, গভীর ক্লান্তি বাসা বেঁধেছে তার শরীর জুড়ে।
হারান জেগে থাকে। সারা রাত। আগুনের এক চিলতে রেখা কোথাও কি সত্যিই… একটা পোড়া গন্ধ ঝাপটা দেয় কেন থেকে থেকে!
ভোর হবে খানিক বাদেই। পুবের আকাশ খানিক পরিষ্কার হয়ে আসছে। ফুলির গা এখন ঠান্ডা। জ্বর ছাড়ল বুঝি। বৃষ্টিটাও ধরে এসেছে প্রায়। কাঞ্চন গাছটার পাতায় জমা জল কাচের মত ঝকঝক করছে। উঠোনের জল বেশ খানিকটা নেমে গেছে। শিকভাঙা ছাতাটা নিয়ে হারান বেরিয়ে পড়ে কোনও শব্দ না করেই। ফুলি ওঠার আগেই চলে আসবে ঠিক। ছেলেপুলেগুলো বড় টানছে।
চৌধুরীবাড়িতে আজ এত ভোর-ভোর সবাই উঠে পড়েছে! কোনও বিপদ-আপদ হল না তো? পোড়া গন্ধটা নাক থেকে যাচ্ছেনে কেন!
বাগানের দিকে দ্রুত পায়ে এগোয় হারান। ওই তো তার লম্বু, ওই তো ঝুপ্পুস ভিজে দাঁড়িয়ে মধু… চড়ুই…
ওই তো…
হারান ছুটে যায় পাগলের মতো… পোড়া গন্ধটা আরও, আরও জড়িয়ে ধরে তাকে…
বোবা চোখ শুকনো খটখট করে। একটা আদ্যোপান্ত জ্বলেপুড়ে খাক-হয়ে-যাওয়া শরীরের মড়া চামড়ায় হাত বুলিয়ে বুলিয়ে বার বার দেখে, কোথাও কি একটুও প্রাণ অবশিষ্ট আছে এখনও!
“কালকের বাজখানা খেয়ে নিল গো ফলন্ত গাছটাকে…”
বলাইয়ের গলা পেয়ে হারান ফ্যালফ্যাল করে তাকায়।
যেন এক বিশ্রী বান মেরে কোনও গুনিন খেয়ে নিয়েছে তার সোহাগকে। শুধু ছাইটুকু পড়ে আছে বুক জুড়ে।
ফিরে যাচ্ছে এক হেরো বাপ। খালি হাতে। বলাই পেছন থেকে ডাক দেয়, “ও কাকা… একটা খবর তো দেওয়াই হল না। ছোট বৌমণির কাল রাত্তিরে একখান চাঁদপানা মেয়ে হয়েছে গো! সবাই বলছে লক্ষ্মী এয়েছে ঘরে। পরে এসে মিষ্টি খেয়ে যেয়ো কিন্তু। যা ঝকমারি গেল কাল! এই দুর্যোগের মধ্যে হাসপাতাল যাওয়া আসা… উফ্ফ্…”
হারান এক বার ফের তার মেয়েটার দিকে চায়। তার চোখ ভিজে আসে। বিড়বিড় করে বলে ওঠে, “সোহাগ…”
কেউ শুনতে পায় না। ভিজে বাতাসে দু’-এক টুকরো ছাই শুধু উড়ে আসে, এমনিই।
ছবি: মহেশ্বর মণ্ডল
উ
ঠোন ঝাঁট দিয়ে জলছড়া দিতে দিতে রোজ ভোরে গুনগুন করে গায় ফুলি— “শুক বলে ওঠো সারী ঘুমায়ো না আর… এ জীবন গেলে ফিরে আসে না আবার…”
বেলফুলের গাছটায় কলি ধরল বোধ হয়, মিঠে গন্ধ আসছে বেশ। আরামে চোখ জড়িয়ে আসে হারানের। কাছেই ফুলির ছেড়ে রাখা বাসি ন্যাতানো শাড়িখানা জড়িয়ে নেয় গায়ে। ফুলির গন্ধ লেগে আছে এতে। চিরকালের বৌ-আঁকড়া মরদ সে। সবাই বলে। মন্দ লাগে না তার। বৌ ছাড়া আর তার আছেটাই বা কে!
একটা ভ্যাপসা গরমের চোটে ঘুমটুম লাটে উঠেছিল গত রাতে। এ বার চত্তির মাসের শেষ থেকেই যেন আগুন ঝরছে। বসন্তের ফুরফুরে মেজাজখান চোখের পাতা ফেলতি না-ফেলতিই ফুড়ুত! পিঠে এখনই ঘামাচি বিজবিজ করছে হারানের। মেঝেতে মাদুর বিছিয়ে তারা কত্তা-গিন্নিতে পালা করে হাতপাখা নেড়ে-নেড়ে বাতাস করছিল একে অপরকে। ফুলি একটা ঝিনুক দিয়ে পুটপুট করে ঘামাচিগুলো মেরে দিতে বেশ আরাম হচ্ছিল। এ সময় খুব সোহাগ আসে দু’জনেরই। ঘামাচি মারতে মারতেই ফুলি ঘেঁষে আসে হারানের দিকে। হারান পাশ ফেরে। আঁচল সরিয়ে ফুলির শুকনো বুকে মুখ গুঁজে দেয়। একটা ছাওয়াল-পাওয়াল এলে তাও বুক দুটোয় খানিক রস আসত, তা সে দিকেও তো মাগির শিলচাপা কপাল।
কোন শত্তুরের অভিশাপে এমন দুর্ভাগা তারা কে জানে! দীর্ঘশ্বাস বুক ভেদ করে বোধ হয় আরও খানিক ভেতরে ঘা দিয়ে ফেলে। ফুলি হারানের মাথাটা আরও বেশি করে টেনে নেয় তার বুকে। গায়ে পিঠে হাত বুলিয়ে দেয়। হারান মনে-মনে ডাকে বার বার… মা! মা!…
“চা-মুড়িটুকুন খেয়ে বাজার যাও দিকি। আর হ্যাঁ, চুনো মাছ নিতে ভুলুনি যেন। গাছে বেগুন ধরেছে অনেক। আলু-বেগুন দিয়ে ঝাল-ঝাল করে রেঁধে নেব’খন। ভাজা খেতে গেলে বড্ড তেল খচ্চা হয়।”
ফুলি চান সেরে নিয়েছে সকাল-সকাল। সিঁদুর পরতে গিয়ে নাকের ডগায় বেশ খানিকটা ছড়িয়ে পড়েছে। চুল থেকে টুপটুপ করে জল পড়ে বেলাউজের পিঠ ভিজে উঠেছে অনেকখানি। হারান এই দৃশ্যটা রোজই খুব মন দিয়ে দেখে। চোখে চোখ পড়লে ফুলি মুখ টিপে হাসে। বলে, “মরণ! বুড়ো হতে চলল, ঢং দেখো মিনসের!”
হারান চায়ে চুমুক দিতে দিতে বলল, “ভাবছিলাম চৌধুরীদের মাসকাবারির টাকাটা মিটিয়ে দে আসব এ বেলা। আজ একটু কষ্ট করে বেগুনপোড়া দিয়ে চালিয়ে নে।
কাল বরং তোর চুনো মাছ আনব’খন।”
ফুলি দীর্ঘশ্বাস লুকিয়ে ফেলে। আজ একাদশী। সধবাদের একটু
মাছ মুখে না দিলে যে সংসারের অকল্যাণ, সে আর কে বোঝায় এই আলাভোলা মানুষকে!
ফতুয়াখানা গায়ে গলিয়ে বেরিয়ে যায় হারান। সেদিকে তাকিয়ে ফুলি কপালে হাত ঠেকায় অভ্যেসে,
“দুগ্গা দুগ্গা…”
হারানের বাড়ি থেকে মিনিট দশেকের হাঁটাপথ পেরোলেই চৌধুরীদের বিশাল বাগান। এই বাগানেরই গোটা পনেরো নারকেল গাছের ইজারা নিয়ে রেখেছে হারান। গরমের সময় স্টেশনের ধারে ডাব নিয়ে বসে। ক্লান্ত লোকজন তাতে গলা ভেজায়। পরানটা ঠান্ডা হয় খানিক। হারান তাদের সঙ্গে সুখদুঃখের গপ্পগাছা করে। দু’পয়সা আয়ের পাশাপাশি মনটাও বেশ হালকা হয়।
প্রায় বছর দশেক হয়ে গেল এই গাছগুলোই বলতে গেলে হারানকে বাঁচিয়ে রেখেছে। শুধু পেটের টানেই নয়, কী যেন এক অদ্ভুত মায়ায় জড়িয়ে গেছে সে এই গাছগুলোর সঙ্গে। প্রত্যেকটা গাছের আলাদা আলাদা নাম রেখেছে সে মনে-মনে। সবচেয়ে পুরনো যেটা, সেটার নাম বুড়ো, শুরু থেকেই হেলে-বেঁকে উঠেছে যেটা, সেটা বঙ্কু, আর ওই যেটা সবচেয়ে উঁচু, ওর নাম লম্বু। মেয়েও আছে গোটা কয়েক। তাদের নামের বাহার অনেক বেশি। মধু, চড়ুই, সোহাগ… ডাব বা নারকেল নামানোর সময় সে গাছগুলোর গায়ে খুব আদরে হাত বোলায়। ফিসফিস করে বলে, “ব্যথা লাগেনে তো বেশি? অক্ষম বাপ তোদের। ক্ষমা করে দিস।”
গাছগুলোর পাতা তখন একটু যেন বেশিই নড়েচড়ে ওঠে। পাতায় পাতায় ঘষা লেগে খসখস শব্দ। সেই সব শব্দে কান পাতে হারান। যেন মনে হয় কলকল করছে এক ঘর ছেলেপিলে। রুক্ষ বাকলে গাল পেতে আদর দেয় সে। হাত বুলোয় খুব ওদের সারা গায়ে।
চৌধুরীদের ছোট বৌমা চারু দূর থেকে মানুষটাকে দেখে অবাক হয়ে। বছর দেড়েক হল সে এসেছে এই পরিবারে। বাড়ির মধ্যে সবচেয়ে ছোট হওয়ায় তার আদর খানিক বেশিই। সাত মাসের পোয়াতি চারু। ভারী শরীরটা নিয়ে সে যেন আর পেরে ওঠে না। মুখে রুচিও নেই তেমন। পিসিশাশুড়ি এক বয়াম আমচুর আর তেঁতুলের আচার দিয়ে গেছে। ওই দিয়েই দুটো ভাত গিলতে হয় কোনও মতে। বাড়ির পিছনে একটা গন্ধলেবুর গাছ আছে। বিকেল দিক থেকে একটা ফুরফুরে হাওয়া বয়। সেই হাওয়ায় ভেসে আসে লেবুফুলের মন-ভাল-করে-দেওয়া গন্ধ। চারু প্রাণভরে শ্বাস টানে। হারানদাকে দেখতে দেখতে সকালবেলার অস্বস্তিটা যেন ভুলেই গেছিল চারু। পেটের ভেতর থেকে এখন আর এক জন জানান দিচ্ছে যে, তেনার খিদে লেগেছে। নিজের উঁচু হয়ে আসা পেটে খুব নরম করে হাত বুলোয় চারু। মনে মনে কত গপ্পো করে তার হবু সন্তানের সঙ্গে। দূর থেকে এক জোড়া কাতর চোখ বুভুক্ষুর মতো সেই দৃশ্য গিলে নিতে থাকে। চারু টের পায় না।
“সোহাগের পালা আর ফুরোয় না দেখি তোর! তা বলি মালকড়ি
কিছু এনেছিস আজ? না কি খালি হাতেই ফের…”
তপু, মানে ত্রিদিব চৌধুরীর বড় ছেলে তপেনের ছুড়ে দেওয়া কথার ঝাঁঝে ঘোর ভাঙে হারানের। কত্তাবাবার এই বড় ব্যাটাখান এক্কেবারে চশমখোর, পয়সা ছাড়া জগতে আর কিস্যু চেনে না। হারান কোনও উত্তর না দিয়ে তার ফতুয়ার পকেট থেকে জমিয়ে আনা আধময়লা নোটগুলো বার করে তপুর হাতে তুলে দেয়। তপেন ঠোঁট উল্টে বিরক্ত গলায় বলে, “এহহ! মোটে এই ক’টা টাকা! নাহ, বাবা দেখছি দানছত্র খুলে রেখে আমাদেরই হাঁড়ির হাল করবে। শোনো হারানদা, সামনের মাসে আরও শ’তিনেক বাড়িয়ে দিয়ো। এই বাজারে এত সস্তায় ব্যবসা চলে না।”
হারান প্রতিবাদের ভাষা শেখেনি। খানিক ভালবাসতে পারে শুধু নিজের মতো করে। চুপ করে মেনে নেওয়া তার মজ্জাগত। ফুলি ঠিকই বলে। ফুলি না থাকলে এত দিনে তার ভিটেমাটিটুকুও টিকে থাকত না।
চলেই যাচ্ছিল সে, হঠাৎ পিছু ডাকল বলাই। বাচ্চা ছেলে। চৌধুরীদের ফাইফরমাশ খাটে। হাতে তার একখানা বাটি। সঙ্গে ঘটিভরা জল। হারানের দিকে বাটিটা এগিয়ে দিয়ে বলল, “খাও। ছোটবৌমণি পাঠাল তোমার জন্যি।”
এক বাটি নারকেল নাড়ু। হারানের মুখটা আলো হয়ে ওঠে। এক গাল হাসি নিয়ে সে দূর থেকে হবু মা-টিকে প্রাণভরে আশীর্বাদ করে।
“কী হল! নাও, খাও দিকি ঝটপট। আমারে আবার বাজার যেতি হবে এর পর। মেলা কাজ বাকি পড়ে আছে…”
বলাই তাড়া লাগায়। হারান একটু আমতা-আমতা করে বলে, “একখান পেলাস্টিকে করে নাড়ু ক’খান একটু বেঁধে দিবি বাপ? তোর কাকি খুব ভালবাসে, তাই আর কী…”
বলাই অনিচ্ছাসত্ত্বেও না বলে উঠতে পারে না। ফেনিকাগজের মধ্যে নাড়ুগুলো ভরে ভাল করে গিঁট বেঁধে হারানের হাতে দেয়। হারান বাড়ির দিকে পা বাড়ায়। আজ আর বাজার করা হল না তার। হঠাৎ কী মনে করে ঘুরে আসে দরজায়। বলাই তত ক্ষণে ভেতরে চলে গেছে। বুকের মধ্যে একটা ইচ্ছে ঘুরপাক খায়। জানা হল না তো, কোন গাছটার…
গত কয়েক দিন ধরেই ফুলির খুব জ্বর। হারান বলতে গেলে একাই সামলাচ্ছে ঘরের সাতসতেরো কাজকর্ম। তবু রোগীর পথ্যি বানাতে গিয়ে হিমশিম খাবার জোগাড়! যোগেন ডাক্তার বলছে রক্ত পরীক্ষা করা দরকার। দরকার তো বোঝা গেল, কিন্তু হাত যে একেবারে ঠনঠন করছে। এই বাদলার দিনে এমনিতেই গাছের গায়ে শেওলা জমে পিছল হয়ে থাকে। এই সময় গাছে ওঠা বেশ ঝক্কির ব্যাপার। আর ব্যবসাও তেমন একটা জমে না এই দুটো মাস। আঁকশি দিয়ে উঠোনের পেয়ারা গাছটা থেকে ডাঁশা দেখে গোটা কয়েক পেয়ারা পাড়ল হারান। জ্বরের জন্যই মনে হয় ফুলির অরুচি হয়েছে খুব। পেয়ারা চিবোলে খানিক রুচি ফেরে যদি।
ফুলি হারানের অবস্থা দেখে করুণ গলায় বলে ওঠে, “তোমায় ভারী বেপদে ফেললুম যা হোক… কী যে মরণের অসুখে ধরল আমায়! এই অলক্ষ্মী দশার চেয়ে বরং যদি যমরাজ নেত তো বাঁচতুম।”
হারানের চোখে জল উপচে আসে। ফুলিকে দেখতে দেয় না। ডান হাতের পিঠ দিয়ে আলগোছে মুছে নেয়। তার পর ফুলির কাছে এসে বলে, “না-হয় তোর কোল খালিই রয়ে গেছে, আমারই দোষ হবে কিছু। তুই বাঁজা, এ আমি মানিনে। কিন্তু তা বলে আমি কি কেউই নই? ছেড়ে যাবার এতই তাড়া পড়েছে!”
এই ক’দিনেই মানুষটার চেহারাটা বেশ খারাপ হয়েছে। বুকের পাঁজর ক’খানা যেন গোনা যায় এমন… ফুলির বুকটা মুচড়ে আসে।
কানে হাত দেয় সে। শাশুড়িমায়ের দেওয়া আশীব্বাদি এই মাকড়িজোড়া এখনও অবশিষ্ট রয়েছে। ভয়ে ভয়েই সে হারানকে বলে, “এই কানের ফুল দুটো বাঁধা দিয়ে ক’টা ট্যাকা যদি… পরে না-হয় কখুনো ছাড়িয়ে এনে দিতে সময় সুযোগমতো।”
হারান এ বার ঝরঝর করে কেঁদে ফেলে। ফুলি ব্যস্ত হয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে বলে, “মাফ করো গো,
ট্যাকা লাগবেনি… আমারই ভুল, আমারই… তুমি এমন কান্নাকাটি করুনি, আমি যমেরও অরুচি, নেবেনে সে আমায়…”
অঝোরে বৃষ্টি আজ সন্ধে থেকেই। সঙ্গে তুমুল ঝোড়ো হাওয়া। টালির চাল ভেদ করে টুপটাপ জল পড়ছে। হারান হাঁড়ি-পাতিল বসিয়ে রেখেছে এখানে-ওখানে। রাতের দিকে ফুলির গায়ের তাপ বাড়ে। কাঁথাখানা ভাল করে টেনেটুনে দেয় হারান তার গায়ে। কপালে হাত রাখে। ফুলি তার ঠান্ডা হাতখানা নিজের গরম কপালে চেপে ধরে। হারান শিয়রে বসে রাধামাধবকে ডেকে চলে আর জলপট্টি বদলে বদলে দেয়। মেঘের হাঁকডাকে বুকের ভেতরটা কেমন জানি দুরুদুরু
করছে, কেন কে জানে! থেকে থেকে হড়হড় কলকল আওয়াজ। উঠোন জলে টইটম্বুর…
“উহহ মা গো… এ কী সব্বনেশে কাণ্ড… আগুন কেন এত! আগুন কেন…” হঠাৎ কেমন আর্তনাদ করে ওঠে ফুলি।
মারাত্মক জোরে পড়ল বাজখানা। ফুলি জ্বরের ঘোর থেকে ছিটকে উঠেছে আতঙ্কে। বড় কু ডাকছে যেন মনটায়! হারান ফুলিকে আশ্বস্ত করে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। বলে, “আগুন কই রে! জল… জল…”
ফুলি জল খায়। গলা শুকিয়ে উঠেছে তার। শুকনো বুকদুটো টনটন করে উঠছে খুব। হারানের হাতটা মুঠোয় নিয়ে সে এক সময় ফের ঘুমিয়ে পড়ে, গভীর ক্লান্তি বাসা বেঁধেছে তার শরীর জুড়ে।
হারান জেগে থাকে। সারা রাত। আগুনের এক চিলতে রেখা কোথাও কি সত্যিই… একটা পোড়া গন্ধ ঝাপটা দেয় কেন থেকে থেকে!
ভোর হবে খানিক বাদেই। পুবের আকাশ খানিক পরিষ্কার হয়ে আসছে। ফুলির গা এখন ঠান্ডা। জ্বর ছাড়ল বুঝি। বৃষ্টিটাও ধরে এসেছে প্রায়। কাঞ্চন গাছটার পাতায় জমা জল কাচের মত ঝকঝক করছে। উঠোনের জল বেশ খানিকটা নেমে গেছে। শিকভাঙা ছাতাটা নিয়ে হারান বেরিয়ে পড়ে কোনও শব্দ না করেই। ফুলি ওঠার আগেই চলে আসবে ঠিক। ছেলেপুলেগুলো বড় টানছে।
চৌধুরীবাড়িতে আজ এত ভোর-ভোর সবাই উঠে পড়েছে! কোনও বিপদ-আপদ হল না তো? পোড়া গন্ধটা নাক থেকে যাচ্ছেনে কেন!
বাগানের দিকে দ্রুত পায়ে এগোয় হারান। ওই তো তার লম্বু, ওই তো ঝুপ্পুস ভিজে দাঁড়িয়ে মধু… চড়ুই…
ওই তো…
হারান ছুটে যায় পাগলের মতো… পোড়া গন্ধটা আরও, আরও জড়িয়ে ধরে তাকে…
বোবা চোখ শুকনো খটখট করে। একটা আদ্যোপান্ত জ্বলেপুড়ে খাক-হয়ে-যাওয়া শরীরের মড়া চামড়ায় হাত বুলিয়ে বুলিয়ে বার বার দেখে, কোথাও কি একটুও প্রাণ অবশিষ্ট আছে এখনও!
“কালকের বাজখানা খেয়ে নিল গো ফলন্ত গাছটাকে…”
বলাইয়ের গলা পেয়ে হারান ফ্যালফ্যাল করে তাকায়।
যেন এক বিশ্রী বান মেরে কোনও গুনিন খেয়ে নিয়েছে তার সোহাগকে। শুধু ছাইটুকু পড়ে আছে বুক জুড়ে।
ফিরে যাচ্ছে এক হেরো বাপ। খালি হাতে। বলাই পেছন থেকে ডাক দেয়, “ও কাকা… একটা খবর তো দেওয়াই হল না। ছোট বৌমণির কাল রাত্তিরে একখান চাঁদপানা মেয়ে হয়েছে গো! সবাই বলছে লক্ষ্মী এয়েছে ঘরে। পরে এসে মিষ্টি খেয়ে যেয়ো কিন্তু। যা ঝকমারি গেল কাল! এই দুর্যোগের মধ্যে হাসপাতাল যাওয়া আসা… উফ্ফ্…”
হারান এক বার ফের তার মেয়েটার দিকে চায়। তার চোখ ভিজে আসে। বিড়বিড় করে বলে ওঠে, “সোহাগ…”
কেউ শুনতে পায় না। ভিজে বাতাসে দু’-এক টুকরো ছাই শুধু উড়ে আসে, এমনিই।