Abosar

প্রেমনীলার সংসার

রাজশ্রী বসু

সাতসকালে পিলে-চমকানো কলিং বেল। কিন্তু বোঝার উপায় নেই কারও ঘুম ভেঙ্গেছে কি না। সারি সারি তিনখানা ঘরে পরিতোষবাবু ও তাঁর দুই ছেলে হাবলু ডাবলু যার যার অর্ধাঙ্গিনী-সহ গভীর নিদ্রামগ্ন। সকালে বেল বাজলেই তাদের কানের ওপর বালিশ চাপা পড়ে। 

ঘুম নেই শুধু পঁচাত্তর বছরের প্রেমনীলা দেবীর। ড্রয়িংরুমের ডিভানে তাঁর শোবার জায়গা। সেখান থেকে ঘরগুলোর দরজা দেখা যায়। খোলা থাকলে ভেতর পর্যন্তও। হাবলু-ডাবলুর বউ এ কালের মেয়ে। বিয়ে হয়ে এসেই ভারী ভারী পর্দা টাঙিয়েছে। তাদের দুনিয়া যেন আলাদা গোলার্ধ। সতৃষ্ণ নয়নে তাকিয়ে থেকেও মেরুন পর্দার মৃদুমন্দ সঞ্চরণ ছাড়া কিছুই দেখা যায় না। প্রেমনীলার ছেলে পরিতোষ, বউমা বরুণা। প্রেমনীলা  ধুমধাম করেই বউ এনেছিলেন। ক’টা অনুচ্চারিত শর্ত ছিল। কোনও দিনও মা আর ছেলের মধ্যে আসবে না ছেলের বৌ। ছেলের প্রতিটি দিনের ওপরে প্রেমনীলার একচ্ছত্র আধিপত্য থাকবে। সংসারের সব কিছুতেই বরুণাকে আগে প্রেমনীলার অনুমতি নিতে হবে। 

তা, বরুণার সংসারে বিশেষ মতি ছিল না, না কি সে বাধ্য হয়েই ঘাড় হেলিয়েছে, সেটা বোঝা যায়নি। শুধু দেখা গেছে, এত বছর এ বাড়িতে বাস করে এবং দুটি পুত্রের জননী হয়েও তার শেকড় আলগাই থেকে গেছে। আর প্রেমনীলা দাপটের সঙ্গে সংসার করে চলেছেন। 

বরুণা বোধহয় শুধু পরিতোষকেই চেয়েছিল। সংসারের কর্তৃত্ব সে কখনও চেয়েছিল কি না সে প্রশ্ন গৌণ। শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের জন্য যা যা করণীয় তা সে করেছে। এমনকি বিয়ে হয়ে এ বাড়ি আসা ইস্তক শাশুড়ির আপত্তিতে শোবার ঘরে পর্দা লাগায়নি সে। সারা দিন দরজার পাল্লা হা হয়ে থেকে ঘরের ঋতু-বদলের পুঙ্খানুপুঙ্খ চিত্র তুলে ধরে ডিভানাশ্রিত প্রেমনীলাকে। বয়সকালে দরজাটা রাতে নির্দিষ্ট সময়ে বন্ধ হয়ে যেত। এখন বহু কাল সেটারও দরকার পড়ে না, আলগা ভাবে ভেজানোই থাকে। মায়ের বাধ্য ছেলে পরিতোষ  চশমা-নাকে, ভুঁড়িতে ল্যাপটপ চাপিয়ে পৃথিবীর সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করেন। আর বরুণা  মেঝেময় ছড়ানো শাড়ি-ব্লাউজের ওপর ফ্যাব্রিকের ফুল তোলে। তার নিজের বুটিক আছে। রমরম করে চলে ছাদের ঘরের সেই দোকান। প্রেমনীলার সংসারের ছোঁয়াচ-বাঁচানো বাইরে থেকে ঘোরানো সিঁড়ি।  দোকান নিয়েই সময় কাটে বরুণার। শুধু খাওয়ার বিরতি। প্রেমনীলার তত্ত্বাবধানে চর্ব্যচোষ্য খেয়ে আবার নিজের রাজত্বে ফিরে যায়। আলাদা সিঁড়ি নিয়ে প্রেমনীলা উচ্চবাচ্য করেননি। বোধহয় বরুণা এবং বুটিক উভয়কেই সংসারের বাইরে রেখেছেন। 

বেশ চলছিল প্রেমনীলার সংসার। কিন্তু কিছু দিন থেকে সেই মালিকানায় অদৃশ্য ফাটল ধরছে। সাতসকালে মিউনিসিপ্যালিটির বাঁশি থেকেই শুরু হয় সেই ফাটলের অদৃশ্য চলন। 

সংসার, ছেলে, নাতিদের সর্বস্বত্ব চিরকালই প্রেমনীলার। বরুণার ইচ্ছা-অনিচ্ছার তোয়াক্কা না করে তিনিই খাইয়ে মাখিয়ে বড় করেছেন নাতিদের। যত বেশি ছেলে আর নাতিদের নিয়ে মেতেছেন তিনি, তত নিজের ব্যবসায় ডুবে থেকেছে বরুণা। হাবলু-ডাবলু ছক্কা মারল এক সঙ্গে যমজ বোন বিয়ে করে এনে। নাতিরা পড়াশোনা, খেলাধুলো, চাকরিবাকরি নিয়ে ব্যস্ত ছিল। প্রেমনীলা ইচ্ছে মতো সংসার করে গেছেন। মুখে বকবক করলেও মনে অশান্তি ছিল না। কিন্তু হঠাৎ এক জোড়া নাতবউ আসায় তিনি অবাক। দেখলেন, ব্যাপারটা তার বৌমার অজানা ছিল না। পরিতোষ ভাবলেশহীন। প্রেমনীলা বুঝলেন, ঠাকুমাকে বলেনি নাতিরা, কিন্তু বাবা-মাকে জানিয়েই এই কাগজের বিয়েটা হয়েছে। তা আর ফেরানোর নয়। মুখ গোঁজ করে মেনেই নিলেন নাতবৌদের। বরণডালা সাজিয়ে বরুণাকে দিয়ে বরণ করিয়ে ঘরেও তুললেন। তোলা হাঁড়ির মতো মুখ নিয়েও অস্তিত্বরক্ষার তাগিদে নিজেকে ঢুকিয়ে নিলেন অনুষ্ঠানে। 

ভেবেছিলেন, সব মিটলে  নাতবৌদের মনের মতো করে তৈরি করবেন। কিন্তু পার্টির পরের দিনই রিনি-চিনি সুটকেস থেকে বার করে ফেলল মোটা মোটা মেরুনরঙা পর্দা। আর টুলের ওপর উঠে হাতুড়ি ঠুকে ঠুকে ঠাকুমার নাকের ওপর দিয়ে সেই পর্দা টাঙিয়েও ফেলল বেহায়া বেশরম হাবলু-ডাবলু। মিস্তিরি ডাকারও তর সইল না। প্রেমনীলা আপত্তি করেছিলেন, “অ মা... তোদের মা যে কখনও পর্দা টাঙায়নি রে... ভেতরে আলো-বাতাস খেলবে কী করে?”

নাতবৌরা হেসেছিল, “এখন কিছু দিন আলো-বাতাস দরকার নেই ঠাকমা, অন্ধকারই দরকার।’’

বৌমার কাছেই দরবার করেছেন প্রেমনীলা। কিন্তু তার তো সময় নেই। কোনও দিকে মনও নেই। “ওরা থাকুক ওদের মতো,’’ বলে তিনি টংয়ে উঠে গেলেন। সে দিনই ঠিক করেছিলেন প্রেমনীলা, নিজের মাটি ছাড়া চলবে না এতটুকু। এই সংসার তাঁর নিজের। এখানে তাঁর কথায় সব চলে। বরুণাকে নিয়ে এ সব সমস্যা হয়নি। কিন্তু জীবনের শেষ প্রান্তে এসে এই গোড়ালি-সমান মেয়েদের সঙ্গে লড়াই করতে হবে, এ চিন্তা তাঁর দুঃস্বপ্নেও ছিল না। 

সকালে ময়লার ব্যাগ মিউনিসিপ্যালিটির ড্রামে ফেলার ডিউটি বরাবরই হাবলু-ডাবলুর।  প্রেমনীলারই দেওয়া দায়িত্ব। এত দিন কারও ঘুম ভাঙতে সমস্যা হয়নি। হাবলু বা ডাবলু চোখ ডলতে ডলতে ডাস্টবিন হাতে গেটে দাঁড়িয়েছে। চিনি বাদ সাধল কয়েক দিন পর সকালে। হাবলু বুঝি উঠতেই যাচ্ছিল। তাকে থামিয়ে নাইটি-পরা, আলুথালু-চুল চিনি বেরিয়ে এল। ঘাড় দুলিয়ে ছোট খুকিটির মতো আদুরে গলায় বলল, “ঠাকমা, এ বার থেকে এই কাজটা আর কাউকে দিয়ে করাও। ভোরবেলায় তোমার নাতি পাশ থেকে উঠলে আমার ভাল লাগে না।’’ উত্তরের অপেক্ষা না করেই আবার ঢুকে গিয়েছিল ঘরে। ডাবলুর দরজাও বন্ধ। বাধ্য হয়ে কোমর বেঁকিয়ে বেঁকিয়ে প্রেমনীলা ময়লার ব্যাগ নিজেই নিয়ে গেলেন বাইরে। নিজের ছেলেকে ডাকতে মন ওঠেনি। বড় কষ্টের ছেলে। পাঁচখানা গিয়ে ষষ্ঠীর ধন ছ’নম্বর। তাকে কাজ করতে বলেন কী করে! হ্যাঁ, বরুণা উঠলে কাজটা সহজে হত, কিন্তু তার আবার কুম্ভকর্ণের ঘুম! বেড টি না পেলে সে উঠবেই না। 

অবশ্য এই ঘুমের জন্য চিরকাল প্রেমনীলার সুবিধেই হয়েছে। কোনও দিন সাতসকালে উঠে রান্নাঘরে খবরদারি করেনি বরুণা। প্রেমনীলা নিজের খুশি মতো সংসার করেছেন। মাঝেমধ্যে এক-আধটু মুখদেখানি জিজ্ঞাসা করে নেন ঠিকই, তবে পছন্দ না হলে বরুণার মতামত পাল্টেও দেন। জানেন, সে টুঁ শব্দটিও করবে না। প্লেটে যা পড়বে, খেয়ে নেবে হৃষ্টচিত্তে। এখন আর এই সামান্য কাজের জন্য তাকে তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠতে বলা যায় না। এ কাজটা তাই নিজেকেই নিতে হয়েছে।

আজও কারও ওঠার তাগিদ নেই। বেল বেজেই যাচ্ছে। পঁচাত্তর হলে কী হবে, প্রেমনীলা বুড়ো হাড়ে ভেল্কি দেখাতে পারেন ইচ্ছে করলে। তবে হ্যাঁ, সেটা সব সময় স্বীকার করা চলে না। বেশির ভাগ সময়েই অপারগ ভাব দেখিয়ে শুয়ে থাকতে হয়। শুয়ে শুয়েই কাজের লোকের ওপর ছড়ি ঘোরাতে হয়। এখন কেউ দেখছে না, এই বেলা একটু কাজ এগিয়ে রাখি, মনে মনে ভাবেন। জঞ্জালের ব্যাগ বার করে দিয়ে আলু আর বঁটি নিয়ে বসেন মেঝেতে। অনেক দিন লুচির সঙ্গে কাঁচালঙ্কা কালোজিরে ফোড়ন দেওয়া সাদা আলুর তরকারি হয়নি জলখাবারে। সবার প্রিয় তাঁর হাতের এই তরকারি। 

চিরকাল বসেই রান্না করেছেন। এখন দাঁড়িয়ে রান্নার সিস্টেম। প্রেমনীলা কাঁপা হাতে আলুর তরকারি চাপান। রান্নার লোক আসার আগেই এক কড়াই তরকারি নেমে যাবে। এ বার লুচির ময়দাটা মেখে ফেলা যাক। হৃষ্টচিত্তে এক কাঁসি ময়দায় পরিমাণ মতো জল ঢেলে ঠাসতে থাকেন। 

কাজ করবেন শান্তিতে তার জো আছে? আবার ক্যাড়ারাং। কলিং বেল। কান খাড়া করে শোনার পর কোমর ভেঙে ওঠেন। দাঁত বার করে দাঁড়িয়ে আছে রান্নার লোক মহেশ আর রাধা। আগে শুধু রাধাই ছিল। কিন্তু সে আঁশ-নিরামিষ এক করে ফেলে বলে শুদ্ধপাকে নিরামিষ রান্নার জন্য মহেশকে বহাল করেছে বরুণাই। এই ক্ষেত্রে সে নিজের সিদ্ধান্তে অটল ছিল। অজ্ঞাতকারণে প্রেমনীলাও আপত্তি করেননি। 

ঘরে ঢুকেই রাধা দুই কোমরে হাত দিয়ে চেঁচিয়ে ওঠে, “এ কী গো ঠাকমা, রান্না চাপিয়ে দিয়েছ? আমরা আসছি সে তরটুকু সইল না? বাবা রে...।’’

“চুপ যা, ম্যালা বকিসনি। আলুর তরকারি হচ্চে। হাবলু-ডাবলু, পরি, সব্বাই ভালবাসে।’’

“আর বৌদিদি?” 

“আ মরণ! তার জন্যি কি আলদা ব্যবস্থা কত্তি হবে না কি?” প্রেমনীলা মহেশকে লুচি বেলতে দিয়ে নিজেই চা বসান।

“ঠাকুমা... আপনি ঘরে যান, আমি চা করছি,’’ মহেশ বলে।

“তুমি যা কচ্চ করো। এদের ওঠার টাইম হল। এর পর রান্না কখন চাপবে..” সসপ্যানে চামচ গুনে চিনি দিতে দিতে বলেন প্রেমনীলা। এর পর লিকার ভেজানো। তার পর আধখানা লেবুর রস চিপে দেওয়া। চা বড় ভাল করেন প্রেমনীলা। যতই বয়স হোক, সকালের চাটুকু বেশির ভাগ দিন তিনিই করেন। পরি খুশি হয় মায়ের হাতের চা পেলে। 

ছেলের ঘরের দরজা ভেজানোই থাকে। ডাকাডাকির তোয়াক্কা না করে প্রেমনীলা চা-বিস্কুটসুদ্ধ ঢুকে পড়েন। আগে নাতিদেরও তা-ই দিতেন। এখন ওদের ডাকতে হয় বন্ধ দরজার এ পার থেকে। ডাবলুর বৌ চুপচাপ। হাবলুরটা বড্ড ঠোঁটকাটা। সে বলেই দিয়েছে, সক্কালবেলায় ডাকাডাকি তার নাপসন্দ। এ রকম চাঁছাছোলা শোনার অভ্যেস নেই, চিরকাল তিনিই বলে এসেছেন সবাইকে। বরুণার কাছে দু’এক বার দরবার করতে গিয়েও লাভ হয়নি। তার সব ব্যাপারেই এক কথা, “ওরা থাক না ওদের মতো।’’ এক লাইন বলে দিয়ে সে নিজের দোকানে চলে যায়। পরিকে তো কোনও দিন সংসারের কোনও কিছুতে ধর্তব্যই করেননি প্রেমনীলা। সে আদরে-গোবরে মানুষ করা প্রেমনীলার ষষ্ঠ গর্ভের সন্তান। বয়স হলেও প্রেমনীলার চোখে পরির পজিশন পাল্টায় না। তাকে কিছুই বলেননি। কিন্তু এই যে বাড়ির সব নিয়মকানুন একটু-একটু করে পাল্টে দিচ্ছে নাতবৌরা, এটাও মেনে নেওয়া যায় না। তাই আপাতত মুখ বুজে সুযোগের অপেক্ষায় আছেন তিনি।

নিজের কাপখানা নিয়ে রোয়াকে আসেন প্রেমনীলা। লুচি-তরকারি নেমেছে। মহেশকে বলেছেন টেবিলে প্লেট বাটি সব সাজিয়ে দিতে। সবাই উঠে পড়েছে, টের পান। টেবিলে বসলে প্রেমনীলা নিজের হাতে খাবার বেড়ে দেবেন। এতগুলো বছর একই কাজ করেও তৃপ্তির আকাঙ্ক্ষায় ভাটা পড়ে না। নিজের মানুষজনকে খাওয়ানোর মধ্যে যে কী সুখ তা এখনকার মেয়েরা কেউ বুঝবেই না। নাতবৌদের কী বলবেন, তাঁর নিজের বৌমাই কখনও বুঝল না! 

সাতসতেরো ভাবেন কিন্তু এ কথা ভাবেন না, যদি বৌমাটিও একই সুখ পেতে চাইত, তা হলে তিনি অনেক আগেই বাতিলের খাতায় চলে যেতেন। ভাবেন না, হাতাখুন্তির লড়াইয়ে বরুণা কখনও ছিল না বলেই তিনি এখনও রাজত্ব চালিয়ে যাচ্ছেন। 

যথারীতি খাটে-বসা পরিতোষের ভুঁড়িতে ল্যাপটপ। বরুণা মেঝেয় লুটিয়ে শাড়ি-ব্লাউজে আঁকাজোখা করছে। হাবলু-ডাবলু ডাইনিং চেয়ারে বসে তারস্বরে চামচ দিয়ে প্লেট বাজিয়ে চলেছে খাবারের অপেক্ষায়। ছোটবেলা থেকেই টেবিলে বসলে ওদের এক সেকেন্ড দেরি সয় না। চাকুরে বাবু হয়েও, বিয়ে করেও স্বভাব পাল্টাল না। প্রেমনীলা ধমকান, “কী ব্যাপার মহেশ! হাবুডাবু বসে গেছে তো, আমাকে ডাকোনি কেন? বারান্দাতেই তো ছিলাম, আমেরিকা তো যাইনি।’’

কোন কালে ওঁর মামা আমেরিকা গিয়েছিলেন, সেই আলোয় আলোকিত হয়ে তিনি সারা জীবন সব কথায় আমেরিকার উল্লেখ করেন। মহেশ বেচারি কাঁচুমাচু মুখে বলে, “কী করব ঠাকমা... ডাকতেই তো যাচ্ছিলাম, নতুনবৌদিদিমণিরা বারণ করল যে!’’

“কী! বারণ করল? কেন বারণ করল শুনি? এতখানি বেলা হল, আমার ছেলে, নাতিরা কখন খাবে? আমি আসব তবে তো খেতে দেব? ওরা বলল আর তুমি শুনলে?” প্রেমনীলা রেগে ওঠেন মহেশের নির্বুদ্ধিতায়। মহেশ  মাথা নিচু করে। 

“ভালমানুষটাকে কেন বকছ গো ঠাকমা? চিনি বৌমণি তো বলল আজকে ওনারাই খেতে দেবেন, বলল যে ঠাকমা এ বার থেকে রেস্ট নিক, বয়স হয়েছে,’’ রাধা বলে। 

“কী! আমি রেস্ট নেব? আমার বয়স হয়েছে? এ বার থেকে ওরাই করবে সব? এই সংসারের কী জানে ওরা? কী রে হাবু-ডাবু? বৌয়ের ভেড়ুয়া হয়ে গেলি না কি তোরা? কিছু বলছিস না?” তীব্রকণ্ঠে বেজে ওঠেন রণরঙ্গিণী প্রেমনীলা। এ লড়াই চিরকালীন অস্তিত্বরক্ষার লড়াই।

হাবলু-ডাবলু হয়েছে ওদের বাবার মতো। ওদের কাছে পটপরিবর্তনের আলাদা কোনও গুরুত্ব নেই। খেতে পেলেই হল। কে দিচ্ছে, কী দিচ্ছে সেটা গৌণ। হাবলু রিমোট হাতে চ্যানেল ঘোরাচ্ছে। ডাবলু মোবাইলে ব্যস্ত। ছেলের ঘরের খোলা পাল্লা দিয়ে তাকিয়েও সেই একই রোজকার দৃশ্য। পরি, বরুণা, কারও কোনও হেলদোল নেই। নিজের সবচেয়ে বড় সম্পত্তি ছেলে আর নাতিদের দেখে প্রেমনীলা অবাক। এদেরই জন্য প্রাণপাত করলেন তিনি পঁচাত্তরটা বছর! 

ভেতরের ঘর থেকে হাসতে হাসতে বেরিয়ে আসে দুই বোন। রিনির দু’হাতে দুটো ক্যাসারোল। চিনি এগিয়ে আসে, “ঠাকমা প্লিজ় ডোন্ট মেক আস ভিলেনস।’’

“আহ, বাংলায় বল চিনি,’’ ক্যাসারোল থেকে গোল গোল, কাঠের টুকরোর মতো দেখতে কী সব বার করে হাবলু-ডাবলুর প্লেটে দিতে দিতে বলে রিনি।

“হ্যাঁ ঠাকমা, এখন থেকে আর তোমার নাতিদের ওই ফ্যাটি খাবারগুলো খাওয়া চলবে না। লুচি, আলুর তরকারি... উফফ, হরিবল! ফুড হ্যাবিট চেঞ্জ না করলে ওয়েট বেড়ে যাবে।’’

“অ... তা কী খাবে ওরা শুনি?”

“সেটা তুমি আমাদের ওপর ছেড়ে দাও। ইউ টেক রেস্ট। আমরাই কিচেনটা দেখে নেব।’’

“কী! তোমরা দেখবে? কে কী ভালবাসে না বাসে তোমরা জানো?’’প্রেমনীলা তর্ক চালিয়ে যান। কিন্তু তাঁর আঁতে ঘা লাগে হাবু-ডাবুর চুপ করে থাকা দেখে।

রিনির পার্সোনালিটি চিনির চেয়ে বেশি। এখুনি বেড়াল না মারলে পরে প্রবলেম হবে, বুঝে নিয়েছে। ক্যাসারোলের ঢাকনা খুলে এগিয়ে আসে, “এই যে ঠাকমা, এগুলো চিকেন নাগেটস, এয়ারফ্রায়ারে ভেজেছি। তেল লাগে না, হাওয়ায় ভাজা হয়। ফুল প্রোটিন। সঙ্গে ভেজ স্যুপ। দেখবে সবার হেলথ কেমন ভাল থাকে।’’

প্রেমনীলা নাক সিঁটকান, “হাওয়ায় ভাজা? এই অখাদ্য-কুখাদ্য খেয়ে পেট ভরবে হাবু-ডাবুর? গোছা গোছা লুচি খেতে পারে ওরা...’’ 

বলেন বটে, কিন্তু আড়চোখে দেখেও নেন, নাতিরা দাঁতে কাটছে ওই শক্ত শক্ত গুলি, চুমুক দিচ্ছে ট্যালটেলে ঝোলে। এমন একটা হতাশ ভাব আসে প্রেমনীলার মনে, যা তিনি পরির বিয়ে থেকে এত দিনের মধ্যে কখনও অনুভব করেননি। প্রেমনীলার মুখের ওপর কখনও কথা বলেনি বরুণা। নিজের পছন্দ-অপছন্দ নিয়ে থেকেছে এক কোনায়। আর এই দু’দিনের মেয়েরা তাঁকে গ্রাহ্যই করছে না। এমন ভাব করছে যেন এই সংসারে প্রেমনীলাই অনুপ্রবেশকারী। 

কিন্তু হাল ছাড়লে চলবে না। প্রেমনীলা গামলা থেকে এক হাতা আলু তুলে নিয়ে থ্যাপ করে দিয়ে দেন হাবলুর প্লেটে। সঙ্গে এক গোছা লুচি।

“ছাইপাঁশ না গিলে লুচি খা। দেখ তোদের সাধের তরকারি করেছি।’’ 

হাবলু নির্বিকারচিত্তে লুচিতে আলু পাকিয়ে মুখে তুলতে যাচ্ছিল। চিনি ছোঁ মেরে কেড়ে নেয় প্লেট। ‘‘না না... এ সব একদম খাওয়া চলবে না। ফেলে দাও এক্ষুনি!’’

নাতির মুখ থেকে খাবার সরিয়ে নেওয়া হয়েছে, এই দৃশ্যে প্রেমনীলা স্থবির হয়ে যাবেন না কি হাউমাউ চেচিয়ে উঠবেন, স্থির করতে পারেন না। উত্তেজনায় কাঁপতে থাকে হাঁটুদুটো। মনে হয় পড়ে যাবেন ঘরের মেঝেয়। এ তো অপমান!  রিনি সরিয়ে নিচ্ছে লুচি-আলুর দমের বাটি। আর কেউ খাবে কি না তা নিয়ে মাথাব্যথা নেই। 

আরও দেখা বাকি ছিল। যে বরুণা সংসারের কোনও ব্যাপারে কথা বলে না, সে উঠে এসেছে। রিনির হাত থেকে বাটিগুলো নিয়ে আবার রেখেছে টেবিলের মাঝখানে। খুব সহজ গলায়, যেন কিছুই হয়নি এমন ভাবে বলছে, “আজ এটাই খাওয়া হবে। মায়ের হাতের তরকারির পাশে আর কিছুর জায়গা নেই।’’ রিনি-চিনি মুখ লাল করে দাঁড়িয়ে থাকে। 

“কী হল? তোমরাও বসে পড়ো। আজ লুচি খাব সবাই। মহেশ, আরও প্লেট দাও। দাদাবাবুকেও ডাকো।’’

চিনি শাশুড়ির পাশে বসে পড়লেও রিনির মুখ গম্ভীর। প্ল্যানটা তারই ছিল। গত কালই দু’বোনে এয়ারফ্রায়ারটা কিনে এনেছে। বরুণা রিনির চেয়েও গম্ভীরমুখে ডাক দেয়, “কী হল, রিনি? বসে পড়ো। সবে তো বিয়ে হল, এখুনি এত দায়িত্ব নিতে হবে না। মা তো দেখছেন। যখন উনি পারবেন না, তখন দেখা যাবে।’’

রিনি বসে পড়ে তার নিশ্চুপ বরের পাশে। শাশুড়ির জন্য লুচি আলুর দম বেড়ে ডিভানের পাশে টেবিলে রেখে বরুণা বলে, “আপনারটা রাখলাম ছোঁয়াচ বাঁচিয়ে। এ বার আমাদেরকেও দিয়ে দিন মা, আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে দোকান খুলতে।

প্রেমনীলা শিরা বার করা হাতে চেপে ধরেন বরুণার হাত, “আজ তুমিই দাও মা। তোমারই তো রাজ্যপাট, আমার বয়স হয়েছে ...’’

বরুণা হাসে, “সেটা আর পারব না মা। আপনি না বেড়ে দিলে আমার খিদেই হবে না! চলুন, উঠুন। 

আমার রাজ্যপাট চাই না। এই সংসারটা আপনার, অন্তত যত দিন আমি আছি।’’ 

শিউরে ওঠেন প্রেমনীলা, “বালাই ষাট! ও কী কথা বৌমা!’’

পরির বিয়ের বহু বছর পর, বোধহয় এই প্রথম, লোকদেখানেপনা ছাড়াই বরুণার মাথায় ভালবাসার হাত ছোঁয়ান প্রেমনীলা।

 

ছবি: দীপঙ্কর ভৌমিক