Abosar

প্রশাসক প্রস্তুত

রাজশ্রী বসু অধিকারী

এক দিকে কর্তৃত্বপূর্ণ ভারী গলা। অন্য দিকে সরু চিঁ-চিঁ টাইপ। দুই প্রধান যোদ্ধার আশপাশে খোল-কর্তাল সহ অনেক জন সঙ্গতকারী। রবিবারের সকাল এমনিতেই আসে মৃদু গতিতে। তার গায়ে আলসেমির আমেজ। তার হাওয়ায় পাশের বাড়ির লুচির গন্ধ, গরম তেলে কালোজিরে ফোড়নের গন্ধ। মাংসের গন্ধ কিছু দেরিতে, ঠিক দুপুরের মুখে। যতই গন্ধবিলাস থাকুক মায়া জড়ানো রবিবারের সকালে, সোমবারের ঘটিতব্য ইন্টারভিউ কুমুদিনীর শান্তিহরণের পক্ষে যথেষ্ট। বহু কষ্টে একটি শক্তপোক্ত সরকারি চাকরির প্রিলি এবং মেন দরজা ঠেলে অবশেষে শেষ ধাপে এসেছে সে। কাল পর্যন্ত মানসিক শান্তি, স্থিতি, ধৈর্য রাখার পরিস্থিতি খুবই দরকার। কিন্তু বেলা ন’টা না গড়াতেই জানলার পাশে তরজা শুরু। বালিশ বুকে বইয়ের পাতায় চোখ রেখেছিল কুমুদিনী। এ বাড়িতে এক তলার কোণের ঘরের সে পেয়িং গেস্ট। মাস আষ্টেক হল কলকাতায় এসেছে, ইছাপুর থেকে। চাকরি পেতে বদ্ধপরিকর। লেখাপড়া পরীক্ষা সব ওখানে থেকেই, কিন্তু ভাইভা কোচিংয়ের জন্য এখানে আসা। বাবারই এক জন কোলিগের আত্মীয়ের বাড়ি। দোতলার জেঠু-জেঠিমা নির্বিবাদী ভালমানুষ। তবে এক তলার সামনের ভাড়াটে বা প্রতিবেশীরা কে কেমন, তা কুমুদিনী জানে না। জানার প্রয়োজন পড়েনি। কেউ কারও সাতে-পাঁচে মাথা ঘামায় না। কিন্তু এখন চোখ দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের থিয়োরিতে আটকে থাকলেও কান তার সীমানায় ঢুকে পড়া নানা বিজাতীয় সাবজেক্ট আঁকড়ে ধরতে চাইছে। বইয়ে মন দেওয়ার চেষ্টা করে লাভ হচ্ছে না। অগত্যা কান খাড়া করে কুমুদিনী।

“আপনাকে তো বলছি তখন থেকে, কেন শুনছেন না… ’’ 

ভারী গলা।

“সেই তখন থেকে তো আপনিই বলে যাচ্ছেন, বলে যান... আপনারা বড় মানুষ, আপনারাই তো বলবেন। আমাদের কি আর বলার মুখ দিয়েছে ভগবান? তা হলে কি আর এত কথা শুনতে হয়?” চিঁ-চিঁ গলা যত দূর সম্ভব উঁচু তারে ইনিয়ে-বিনিয়ে বলেই যেতে থাকে বিলাপগাথা।

“আআআহ… কী আজেবাজে বকে যাচ্ছেন… আমার কথাটা শুনুন...’’ ভারী গলার ভারিক্কি ধমক ভেন্টিলেটর দিয়ে ঢুকে আসে কুমুদিনীর কানে। বিরক্ত হয়ে বইটা বন্ধ করে ও। এ বার সরু গলায় রীতিমতো প্রতিবাদ, “নিত্যানন্দ বাজে বকে না রায়মশাই। নিতাই মিস্তিরি সে পাত্তর নয়। এই বিশ বছর কাজ করছি এই এরিয়ায়। দরকারে সবাই নিতাইকেই ডাকে। নিতাই না থাকলে কোনও বাড়ির জলের সাপ্লাই ঠিক থাকত না। আপনি সেই নিতাইকেই ভালমন্দ বলছেন?” 

কুমুদিনী ‘নিতাই’ নামের কোনও এক মিস্ত্রিদাদার দীর্ঘ ভাষণ শুনে ভাবছে এ বার কী উত্তর আসতে পারে, তার আগেই কানের কাছে বাজখাঁই হুংকার, “দূর মশাই, ভারী আমার নিতাই মিস্তিরি এসেছেন! তখন থেকে বলছি কাল আপনি এ বাড়ির ড্রেনে কাজ করার পর থেকে আমার দোতলার কলে জল উঠছে না… কিছু খুলেটুলে গেল কি না দেখুন ভাল করে! তা নয়… সমানে হিস্ট্রি জিয়োগ্রাফি কপচে যাচ্ছেন…’’

এ বারে ঘটনা একটু স্পষ্ট হয়। কাল উপরের জেঠিমা নিতাইবাবুকে দিয়ে ড্রেনের কাজ করিয়েছিলেন। সে জন্য ওকেও বলা হয়েছিল সকাল ন’টার মধ্যে বাথরুমের কাজ সেরে নিতে। বাইরের দিকে ড্রেনের মধ্যে ওদের বাথরুমের যে আউটলেট আছে, সেখানেই কিছু সমস্যা হয়েছিল, ফলে জল সরছিল না। কুমুদিনী মনে-মনে ব্যাপারটা বুঝে নেয়। নিতাইয়ের কাজ করে যাওয়ার পর থেকে পাশের বাড়ির রায়বাবুদের দোতলার কলে জল পড়ছে না। এখন এটা নিতাইয়ের দোষ হতেও পারে, নাও হতে পারে। এর সমাধান হবে কী করে? দু’পক্ষই তো নিজের নিজের বক্তব্যে অনড়।

বইখাতা রেখে দিয়ে উপুড় হয়ে পা দোলাতে দোলাতে চোখ-কপাল কুঁচকে ভাবে কুমুদিনী। ভাবনার মাঝখানে বিবেকদংশনও হয়। কাল ইন্টারভিউ, এখন কোনও দিকে মন দেওয়া ঠিক নয়। পর মূহূর্তেই বিবেক শান্ত হয়। গম্ভীর মুখে ভাবে কুমুদিনী, এটাও একটা পারিপার্শ্বিক সমস্যা। প্রশ্ন শুধু বইয়ের কোর্স থেকেই করা হবে তা তো নয়। কোচিংয়ে বলাই হয়েছিল, ইন্টারভিউ মানে পার্সোনালিটি টেস্ট। যে-কোনও পরিস্থিতি কী ভাবে তুমি সামলাবে, সেটাই আসল পরীক্ষা। আর ওর পোস্টটা যখন অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ, তখন তো এ রকম প্রশ্ন করতেই পারে। অতএব ওর এখন কী করা উচিত? নিজেকে জিজ্ঞেস করে কুমুদিনী। আর সঙ্গে-সঙ্গেই পেয়ে যায় মনের মতো উত্তর। ঝগড়াটা নিজের চোখে দেখা উচিত।

এমনিতেও ঝগড়াঝাঁটি দেখতে খুবই ভালবাসে ও। সামনে প্রবল পরাক্রমশালী লড়াকু দুই পক্ষকে রেখে মন দিয়ে পর্যবেক্ষণ করে ঝগড়ার খুঁটিনাটি, ঠিক কোন-কোন প্রক্রিয়ায় একে অপরকে আক্রমণ করছে। নিজেকেও মনে মনে দাঁড় করিয়ে ফেলে কোনও একটা পক্ষের পাশে। তার পর শানানো যুক্তি দিয়ে ঘায়েল করে প্রতিপক্ষকে। স্কুল-কলেজে কত বার এ রকম হয়েছে! সে নিজে ঝগড়া না করেও, তার মনে-মনে সমর্থন করা বন্ধু জিতে যাওয়ায় বিজয়ীর আনন্দ উপভোগ করেছে। সবটাই মনে-মনে। তাই কুমুদিনীকে চিরকাল সবাই মুখচোরা ভাল মেয়ে বলেই জানে। যে শুধু অনেক-অনেক পড়ে আর পরীক্ষায় বেশি-বেশি 

নম্বর পায়। 

বাইরের চিৎকার-চেঁচামেচি ক্রমশ বাড়ছে। কুমুদিনী এক লাফে উঠে এসে বারান্দায় দাঁড়িয়ে উঁকি মারে। 

কিছু দেখা যাচ্ছে না। ওরা ঠিক দেওয়ালের সমান্তরালে দাঁড়িয়ে ঝগড়া করছে। পায়ে-পায়ে নেমে আসে বারান্দার নীচে ছোট্ট উঠোনটায়। দেওয়ালের কাছে এসে মাথা উঁচু করে দেখতে থাকে। 

ভারী গলার রায়বাবু বিকট চেঁচাচ্ছেন, “আমার কল আমি জানব না? বলা নেই কওয়া নেই খারাপ হয়ে যাবে? আপনি নিশ্চয়ই ড্রেনের পাইপে কিছু কারসাজি করেছেন। ঠিক করুন, এক্ষুনি ঠিক করুন…’’

এ বার নিতাইবাবুর তীক্ষ্ণ চিঁ-চিঁ, “সে তো আমার বাঁয় হাতকা খেল। আমি টাচ করলেই এখুনি আপনার কলে হড়হড় করে জল পড়বে। কিন্তু সাতশো টাকা লাগবে…’’

‘‘কী! সাতশো টাকা? সাত টাকাও দেব না আমি…’’ সিংহগর্জন করেন রায়বাবু। সঙ্গে-সঙ্গে সরু গলার সবেগ আপত্তি। সিড়িঙ্গে চেহারার লোকটা দু’হাত উপরে তুলে চরকিপাক ঘুরে কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়ায় সতেজে, “তা হলে আমিও কাজ করব না। থাকুন আপনার বন্ধ কল নিয়ে।’’ 

কুমুদিনী সবেমাত্র কপাল কুঁচকে ভাবতে শুরু করেছে কার পক্ষ নেবে, এমন সময় পিছন থেকে উপরের জেঠুর গলা, “এ কী? কী হচ্ছে এখানে? নিতাই? রায়বাবু? ছুটির সকালে এত হট্টগোল কিসের?’’

জেঠু বয়স্ক মানুষ, ইউনিভার্সিটির অঙ্কের প্রফেসর ছিলেন। পাড়ার লোক ওঁকে মানে। প্রবল পরাক্রান্ত রায়বাবু খানিকটা চুপসে যান। গোঁজমুখে ব্যাপারটা বলেন। আর নিতাই আবার নিজস্ব চিঁ-চিঁ সুর তুলে আবদার পেশ করে, সাতশো টাকা যদি নাও হয়, অন্তত পাঁচশো তো তার পাওয়াই উচিত। এ রকম তো কোনও প্রমাণ নেই যে, ড্রেনের কাজের জন্যই কল খারাপ হয়েছে। এটা একটা নতুন অ্যাসাইনমেন্ট। জেঠু এক কথায় সব আগুনে জল ঢেলে দেন। গম্ভীর গলায় বলেন, “অর্থই অনর্থের মূল। টাকা নিয়ে গন্ডগোল আমি সহ্য করব না আমার এরিয়ায়। নিতাই, তুমি কাজ করো। আমার কাছ থেকে টাকা নিয়ে যাবে।’’ 

রায়বাবু এবং নিতাইবাবু, বোধ হয় দু’জনেই কিছু লজ্জা পেয়ে থাকবেন। দু’জনেই হাঁ-হাঁ করে এগিয়ে এসেছিলেন। জেঠু হাত তুলে তাঁদের থামিয়ে দেন, “ড্রেন আমার, ড্রেনের সিউয়েজ আমার, ড্রেনে লুকনো পাইপও আমার। টাকাটাও আমিই দেব। এ নিয়ে আর কোনও কথা হবে না।” 

রায়বাবু আর নিতাইবাবুর মতোই কুমুদিনীও ভেবলে গিয়ে ভাবতে শুরু করেছিল, এটা কেমন হল! জেঠু নিজে যেচে কেন পাঁচশো টাকার বাঁশটা নিলেন! কিন্তু গম্ভীর গলার ধমকে ওর ভাবনা থেমে যায়, “কী ব্যাপার কুমু মা? তুমি এখানে কী করছ? তোমার না কাল ইন্টারভিউ? তোমার বাবা 

তো আমাকেই জিজ্ঞেস করবেন ফল ভাল না হলে, যাও ঘরে গিয়ে লেখাপড়া করো…’’

“হ্যাঁ-হ্যাঁ, জেঠু… যাই… আসলে ওঁরা এত জোরে-জোরে…’’

“আর কেউ চেঁচাবে না। চলো। নিতাই… কাজে লাগার আগে এক বার শুনে যাবে।”

নিজেদের সিঁড়ির দিকে এগোন জেঠু। কুমুদিনী নিজের ঘরে ঢুকে আসে। নিজের সাবজেক্ট ছাড়াও সামনে ছড়ানো জেনারেল নলেজ, কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স, ফাইভ ইয়ার্স প্ল্যানিংয়ের বইপত্র। কিন্তু সে-সবে মন বসে না ওর। মাথা থেকে প্রশ্নটা কিছুতেই যাচ্ছে না। হচ্ছিল অন্যদের ঝগড়া, জেঠু কেন সেই দায়টা নিজের ঘাড়ে নিলেন! এটা কি নেহাতই পারস্পরিক সুসম্পর্ক বজায় রাখার একটা পদ্ধতি? না কি অন্য কোনও কারণ আছে? সম্ভাব্য এক জন প্রশাসকের দৃষ্টিভঙ্গিতে চিন্তা করতে চেষ্টা করে কুমুদিনী। এই রকম একটা ঝামেলায়  পড়লে কী করা উচিত এক জন দক্ষ প্রশাসকের? সাধারণ লোক তো নীরব দর্শক হয়ে অপেক্ষা করবে, কী হয় দেখার জন্য। ও নিজেও তো তাই করছিল। 

ভাবনাটা মাথায় ঘুরছিল। খাওয়াদাওয়াটা উপরে গিয়েই করতে হয় দু’বেলা। জেঠিমার কোমরে ব্যথা। কাজের মেয়েও অর্ধেক দিন থাকে না। কুমুদিনী তাই নিজে থেকেই উপরে এসে খাওয়ার ব্যবস্থা করেছে। আজ দুপুরেও খেতে এল যথারীতি। এসেই নাক লম্বা করে শ্বাস নেয়। নাকে ভেসে আসছে অতি প্রিয় রবিবাসরীয় কচি পাঁঠার মাংসের গন্ধ। ভাল খাবারের সম্ভাবনায় কুমুদিনীর মন ভাল হয় চিরদিনই। এখানে আসার পর নিত্য দিনের ঝোলভাতের বদলে পরিচিত প্রিয় গন্ধ আজ তাই ওর মনটাকে খুশি-খুশি করে তুলেছে। এতটাই খুশি যে, ইন্টারভিউয়ের ভয়টাও আর লাগছে না।

জেঠিমা কাঁসার থালায় গরম ভাতের উপর ঘি ঢেলে সামনে দেন। সঙ্গে গরম বেগুনভাজা, আলুভাজা। একটু ভাত মুখে দেয় কুমুদিনী। একটা দু’টো লালচে ভাজা আলু। একদম মায়ের রান্না যেন! আজ বেলা একটু বেশিই হয়েছে। সকাল বেলার ঝামেলা মিটিয়ে জেঠু বাজার গেলেন। তার পরেও আবার নিতাইবাবুর সঙ্গে কী সব কথা বলছিলেন বাজারের ব্যাগ হাতে নিয়ে গেটের কাছে দাঁড়িয়ে। কুমুদিনী বারান্দায় জামা মেলতে গিয়ে দেখেছে। উপরে রান্না হতেও দেরি হয়েছে। খিদেটাও জোর পেয়ে গিয়েছিল। এখন ভাতের থালার পাশে বাটিভর্তি লাল টুকটুকে, ঘন, লঙ্কা দেওয়া কচি পাঁঠার ঝোল দেখে ওর মনটা আনন্দে ভরে যায়। ঝোল ঢেলে এক গ্রাস ভাত মুখে তুলতে তুলতে জিজ্ঞেস করে, “হ্যাঁ গো জেঠিমা, তোমরা বুঝি প্রায়ই মাটন খাও? খেয়ো না কিন্তু! এ বয়সে একদম বারণ…’’

“হ্যাঁ… তোর হাড়কিপটে জেঠু কিনবে মাটন! সারা জীবনে ক’দিন কিনেছে গুনে বলা যাবে।’’

কুমুদিনীর মুখ হাঁ অবস্থাতেই থেমে যায়, “জেঠু কিপটে?’’

“নয় তো কী? সারা জীবন আমি যা করে কাটালাম, আমিই জানি। ভাগ্যে বাড়িভাড়াটা ছিল তাই খেয়ে-পরে আছি। ঘরের কথা বলতে 

নেই, তাই…’’

মুখের মাংস-ভাতটুকু কোনও মতে এক ঢোক জল দিয়ে গিলে কুমুদিনী জিজ্ঞেস করে, “তবে যে জেঠু আজকে পাশের বাড়ির রায়বাবুর পাঁচশো টাকা নিজেই দিয়ে দেবেন বললেন? নিতাইবাবুকে বললেন ওঁর বন্ধ কল সারিয়ে দিতে?” 

জেঠিমা ও দিককার কাজকর্ম সেরে পানের ডিবে হাতে ডাইনিং টেবিলে গুছিয়ে বসে বলেন, “তুইও যেমন! ও দেবে টাকা, তাও আবার এমনি-এমনি! ভাল মানুষের ভেক ধরে থাকে। লোকে ওকে কিচ্ছুটি চেনে না, বুঝলি?”

“আমি কিছুই বুঝলাম না জেঠিমা। জেঠু নিজেই বললেন, নিতাইবাবু কাজ করে যেন টাকাটা জেঠুর কাছ থেকে চেয়ে নেন। রায়বাবুও লজ্জা পেয়ে গেলেন…’’

“শোন… তুই তো ঘরেরই মেয়ে বলতে গেলে। তোকে বলতে বাধা নেই। তুই পাঁচকান করবি না জানি। ও এমনি-এমনি কাউকে এক পয়সা দেওয়ার পাত্তর নয়, বুঝলি? ওই ড্রেনের তলার জয়েন্টটা খুলে দিয়ে এক্সট্রা পাইপ লাগিয়ে নিতাই এমন সিস্টেম করবে যে, ওরা মেশিন চালালে আমাদের ট্যাঙ্ক ভরে যাবে। তোর জেঠুর ইলেকট্রিকের খরচটা বেঁচে গেল।’’

কুমুদিনী হাঁ করে তাকিয়েই থাকে, “তুমি এ সব জানলে কী করে?”

“জানব না কেন? কানে তো আর ঠুলি নেই! সকালে ওদের চিৎকার শুনেই এই মতলব করে নীচে নামল। বলতে-বলতেই তো নামল। ওই রায়বাবুদের সঙ্গে তো বহু কালের শত্রুতা আমাদের। ওর ঠাকুদ্দার সঙ্গে আমার দাদাশ্বশুরের, ওর বাবার সঙ্গে আমার শ্বশুরের, ওর সঙ্গে আমাদের এঁর। এরা সুযোগ পেলেই চিরকাল একে অন্যকে জব্দ করে এসেছে। এখনও চলছে।”

কুমুদিনী অবাক হয়ে শুনে যায়। এ রকম বংশানুক্রমিক শত্রুতা তো খালিচোখে দেখলে কেউ বুঝতেই পারবে না। এত দিন এসে এখানে থেকে তো ও নিজেও বুঝতে পারেনি। কী সাংঘাতিক ব্রেন জেঠুর! মাংসের গোল হাড়টা চুষতে-চুষতে ওর মুখ দিয়ে একটাই প্রশ্ন বেরিয়ে আসে, “তা হলে আজ মাটন এল যে?’’

জেঠিমা পানের খিলি মুখে পুরে টোপলা গাল ফুলিয়ে হাসেন, “আ মরণ! আজ যে ঠকাতে পেরেছে রায়বাবুকে। এই তো ড্রেনের সঙ্গে পাইপ জুড়েছে। এখুনি ও-বাড়িতে পাম্প চলবে, আর এ-বাড়িতে তোর জেঠু আয়েশ করে খেতে বসবে। ও যে দিন পয়সা খরচ করে ভাল বাজার করবে, জানবি সে দিনই রায়বাবুদের কিছু না কিছু গাঁটগচ্চা গেল।’’

বাঃ! কী অপূর্ব সিস্টেম! খেয়ে ঘরে এসে আবার বই নিয়ে উপুড় হয়েও কুমুদিনীর মাথা থেকে ব্যাপারটা বেরোয় না। বরং আরও বেশি করে ঘোরে। কোচিংয়ে অঙ্কনস্যর বলেছিলেন, কী ভাবে প্রবল প্রতিকূল পরিস্থিতিতে নিজের কাজ উদ্ধার করে বেরিয়ে আসতে হয়, সেটা এক জন প্রশাসকের একটা গুরুত্বপূর্ণ চারিত্রিক দিক। এখন জেঠু যেটা করলেন, সেই পথটা কি সাধারণত গ্রহণযোগ্য, নাকি এটা সমূলেই পরিত্যাজ্য? এই বংশানুক্রমিক শত্রুতার কি কোনও শেষ নেই, না কি এই জেঠু আর রায়বাবুর থেকে সারা সমাজে ছড়িয়ে পড়ছে এই প্রতিশোধের আগুন! 

নাহ্! কুমুদিনী কখনও এই রকম ছলচাতুরির প্রশাসক হবে না। ওর রাজ্যে দ্বিচারিতা থাকবে না। একমাত্র তা হলেই তৈরি করা সম্ভব নতুন ভারত। কুমুদিনী উঠে দাঁড়ায়। দেওয়ালের পিছনের কাজকর্ম সেরে নিতাই মিস্ত্রি তখন হাসিমুখে মোবাইলে রিপোর্ট দিচ্ছিল কাউকে। কুমুদিনী ডাকে পিছন থেকে, “এই যে… ও দাদা… শুনছেন…’’

এ দিক-ও দিক তাকায় নিতাই। তার পর অবাক হয়ে বলে, “আমি?”

“হ্যাঁ… হ্যাঁ… আপনি… এ দিকে একটু শুনুন…’’

এইটুকু মেয়ের এ রকম হুকুমদারি গলা শুনে নিতাই অবাক হয়। পায়ে পায়ে এগিয়ে আসে বারান্দার সামনে। 

“শুনুন… এখুনি গিয়ে ও-বাড়ির পাইপের সঙ্গে এ-বাড়িরটা যেখানে জয়েন করেছেন, সেটা খুলে ওদের কলটা ঠিক করে আসুন। আর... এই টাকাটা আমি দেব।”

নিতাইয়ের মুখচোখ দেখার মতো হয়। সদ্য এই কুকর্ম করেছে সে জেঠুর নির্দেশে। তার জন্য টাকাও পেয়েছে। এই পুঁচকে মেয়ে জানল কী করে! 

“কী হল? যান তাড়াতাড়ি করুন আলো থাকতে-থাকতে। নইলে আমি কিন্তু পুলিশকে ইনফর্ম করব! 

আর, টাকাটা নিয়ে যাবেন আমার কাছ থেকে...’’

নিতাই চিঁ-চিঁ করে, “না না, টাকা তো পেয়েছি… আর লাগবে না! আমি... আমি খুলে দিচ্ছি এখুনি…’’

“ওই টাকাটা জেঠুকে ফেরত দিয়ে আসবেন। যান…’’ 

কুমুদিনী ঘরে ঢুকে আবার বুকে বালিশ দিয়ে উল্টে খাটে গড়িয়ে পড়ে। ঠোঁটে পেনসিল দিয়ে ভাবে, এটাই সঠিক প্রশাসন! দুই যুযুধান গোষ্ঠীর মধ্যে অশান্তি আটকাতে সরকারকে এন্ট্রি নিতে হবে, দরকারে ভর্তুকিও দিতে হবে। তবেই এলাকা আয়ত্তে থাকবে।

মোবাইল বেজে ওঠে। ও পাশে বাবা। “হ্যাঁ রে মা… ইন্টারভিউয়ের প্রিপারেশন ঠিক করে নিচ্ছিস তো?”

বালিশে মাথা ঠেকিয়ে কুমুদিনী রিপ্লাই দেয়, “হ্যাঁ বাবা, একদম!”

মাটনটা জেঠিমা খাসা রেঁধেছিল। এ বার একটু ভাতঘুম না দিলেই নয়।

 

রবিবাসরীয় বিভাগে ১৪০০-১৬০০ শব্দের মধ্যে ছোটগল্প পাঠান। ইউনিকোড ব্যবহার করা বাঞ্ছনীয়। পিডিএফ-এ নয়, ওয়ার্ড ফাইল সরাসরি ইমেল করুন। ইমেল: rabibasariya@abp.in সাবজেক্ট: Rabibasariya Golpo. পাণ্ডুলিপিতে ফোন নম্বর ও সম্পূর্ণ ঠিকানা থাকা আবশ্যক। সিদ্ধান্তের জন্য অন্তত সাত-আট মাস অপেক্ষা করতে হবে। মনোনীত হলে পত্রিকার পক্ষ থেকে জানানো হবে। প্রেরিত ছোটগল্পটি অবশ্যই মৌলিক ও অপ্রকাশিত হতে হবে। অনুবাদ বা অনুকরণ হলে চলবে না। অন্য কোথাও মুদ্রিত বা ডিজিটাল ইত্যাদি অন্য কোনও রূপে প্রকাশিত লেখা অনুগ্রহ করে পাঠাবেন না। এই নিয়ম কেউ লঙ্ঘন করলে তাঁর কোনও লেখাই এই পত্রিকার জন্য ভবিষ্যতে কখনও বিবেচিত হবে না।