Abosar

প্রতিশ্রুতি

সুদীপ সরকার

আবহাওয়া খারাপ হবে ধরে নিয়েই আজকের ভিডিয়ো কনফারেন্স বাতিল করেছে ম্যানেজমেন্ট। লকডাউনের বাজারে ওয়ার্ক ফ্রম হোমে বেশ অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছি। ম্যানেজমেন্টের টপ অর্ডারের কয়েক জন ছাড়া অফিসে কেউ আসছে না। আট মাস হল কোম্পানির এজিএম হিসেবে জয়েন করেছি হলদিয়াতে, পূর্বাঞ্চলের জ়োনাল হেড অফিসে। এখানে আমাদের অফিস যেমন সুন্দর করে সাজানো, তেমনই সুন্দর আমার বাসস্থান। একেবারে হলদি নদীর পাশে। মনোরম পরিবেশে ছবির মতো লোকেশনে আমার বাংলো। ওয়ার্ক ফ্রম হোম চালু থাকলেও আমি প্রায় রোজই অফিসে আসছি। বেরনোর আগে মেয়ে মিনি হুকুম করেছে তাড়াতাড়ি ফিরতে, “ঝড় আসছে, তুমি না ফেরা পর্যন্ত আমার ভয় করবে খুব, বিকেলের আগে ফিরবে কিন্তু।” মিনির মা মেয়েকে সঙ্গত করে বলেছে একই কথা। 

সকাল থেকে আকাশের মুখ ভার, যেন অনেক অভিমান বুকের গভীরে নিয়ে অপেক্ষায় আছে মানিনী, সময় হলেই সমস্ত অভিমান ঝরে পড়বে বৃষ্টি হয়ে। আমার সুসজ্জিত চেম্বারের কোণে রাখা এলইডি-তে সকাল থেকেই ঝড়ের আপডেট, পারাদ্বীপ আর দিঘা থেকে আমপান কত দূরে অবস্থান করছে, ল্যান্ডফল কখন হবে, কোথায় হবে তাই নিয়ে গবেষণা। ডেপুটি জিএম স্যর সকালে ডেকেছিলেন চেম্বারে। ভিডিয়ো কনফারেন্স বাতিল করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হল বটে, কিন্তু ঝড়ের প্রভাব এ দিকে তেমন পড়বে না বলেই ওঁর অনুমান। ওয়েদার ফোরকাস্ট নিয়ে চিন্তা করতে বারণ করে বললেন, “দে জাস্ট ক্রিয়েট আ প্যানিক, বে অব বেঙ্গলে উদ্ভূত সাইক্লোন চিরকাল বাংলাদেশের দিকেই ঘুরে যায়। ছেলেবেলায় পড়োনি, ফেরেলস ল, নর্মাল কোর্সেই ডানে বাঁক নিয়ে ও মূল ভূখণ্ড থেকে সরে যাবে আমাদের প্রতিবেশী দেশের দিকে। ওর প্রেডিক্টেড ট্র্যাজেক্টরি তো সেটাই হিন্ট করছে। ফণী ফণী করে অনেক সতর্কতা নেওয়া হয়েছিল, ইট ওয়েন্ট ওভার উইথ নো ইমপ্যাক্ট। প্রেডিকশন কান্ট অলওয়েজ় বি কারেক্ট। তবে সুন্দরবনের ক্ষতি হবে নিশ্চিত।’’ 

ডিজিএম স্যরের কথায় কিছুটা সাহস পেলাম। কিছু পুরনো ফাইল নিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে, টিভির নিউজ় চ্যানেলগুলোর লাগাতার আপডেট শুনতে লাগলাম।

মিউট করে রাখা স্মার্টফোনটা ভোঁ ভোঁ করে টেবিলে মৃদু কম্পন তৈরি করে কেঁপে উঠল। অচেনা নম্বর দেখে ধরব না ভেবেও ধরলাম, ‘হ্যালো’ বলতেই চিনতে পারলাম, “স্যর, বারোটার সময় গাড়ি ছাড়বে, যদি একটু বলে দেন স্যর, আমার ফেরাটা খুব দরকার স্যর। আপনি এক বার বলে দিলে ম্যানেজারবাবু আর না করতে পারবেন না।”  

“হ্যাঁ সাধন, আমি বলে দেব, বার বার ফোন করার দরকার নেই, এখন ছাড়লাম, মিটিংয়ে আছি,” ফোনটা রেখে বিরক্ত হলাম, কোথাকার কোন কনট্রাকচুয়াল স্টাফ সরাসরি এজিএম-কে ফোন করছে! ফোন নম্বরটা দেওয়াই উচিত হয়নি। বিদিশা ঠিকই বলে, যার তার সঙ্গে না মেশাই ভাল। সকালে অফিস বেরনোর আগেই ফোন করেছিল ছোকরা। আমার বারান্দা থেকে পরিষ্কার নদী দেখা যায়। এক্কেবারে শান্ত নদীটি, পটে আঁকা ছবিটি। এঁকেবেঁকে চলে গিয়েছে বহু দূরে, তার পর অনেকটা পথ পেরিয়ে শেষে আত্মসমর্পণ হুগলি নদীতে। হুগলি নদীর উপর খানিক দূরে জেগে থাকা বিচ্ছিন্ন দ্বীপ নয়াচর। বাংলোর ছাদ থেকে দেখা যায়। ভোরবেলা উঠে এই বারান্দায় বসেই বেশ কিছুটা সময় কাটাই আজকাল। খবরের কাগজ দেখতে যাব, ফোন বেজে উঠল। প্রথমটায় চিনতে পারিনি, তবে সাধনের রেফারেন্স শুনে মনে পড়ে গেল। এখানে আসার পর দু’দিনের জন্য দিঘা গিয়েছিলাম উইকএন্ডে। আমাদের কোম্পানির দারুণ গেস্ট হাউস আছে দিঘায়। সাধন সেখানকার রিক্রুট, খুব ভাল সার্ভিস দিয়েছিল, চলে আসার সময় শ’পাঁচেক টাকা দিয়ে এসেছিলাম হাতে। ফোনে বলল, “স্যর, দিঘায় দারুণ জলোচ্ছ্বাস হচ্ছে, ভিডিয়ো তুললাম, আপনার নম্বরে ফরোয়ার্ড করার চেষ্টা করছি, যাচ্ছে না, নেটওয়ার্ক থাকছে না।” 

জিজ্ঞেস করলাম, “বৃষ্টি শুরু হয়েছে নাকি? উইন্ড স্পিড কেমন? তোমরা কেমন আছ?”

“ভাল আছি স্যর, হাওয়া চলছে, জল রাস্তার উপর উঠে আসছে। স্যর, একটু ডিস্টার্ব করলাম, আজ একটা গাড়ি যাবে হলদিয়ায়, বনমালীদা আর রাজকুমার দুজনেই বাড়ি ফিরবে শুনছি, আমার এখন বাড়ি ফেরাটা খুব দরকার। মা একদম একা, ঝড়ে ঘরদোরের ক্ষতি হয়ে গেলে দেখার কেউ নেই স্যর। রাজকুমারের বাড়িতে ওর দুই দাদা আছে, কিন্তু ম্যানেজারবাবু ওদের দুজনকে ছেড়ে আমায় থাকতে বলেছে। আমি কনট্রাকচুয়াল বলে আমার কথা শুনতে চাইল না স্যর। আপনি একটু বলে দিলে খুব উপকার হত স্যর।” 

“আচ্ছা আচ্ছা, দেখছি…” বলে ফোন ছেড়ে দিলাম। যত সব আবদার, কে বাড়ি যাবে তার জন্য কি না আমাকে বলতে হবে ম্যানেজারকে। হ্যাঁ, আমি জাস্ট এক বার একটা মেসেজ করলেই কাজ হয়ে যাবে, তবে এজিএম-এর ফোন থেকে কোনও মেসেজ যে এ ভাবে করা প্রোটোকলে আটকায়, সেটা সাধনকে বোঝানো সম্ভব নয়। তবে ছেলেটা চটপটে আর অনুগত, বুদ্ধিমানও বটে। প্রথম জীবনে সেল্স-এ চাকরির সুবাদে মানুষের সঙ্গে চট করে মিশে যাওয়ার অভ্যেস আছে আমার, সাধনের সঙ্গেও বেশ মিশে গিয়েছিলাম। কথায় কথায় ও বলেছিল, ওদের বাড়ি গেঁওখালিতে। হুগলি নদীর ধারে ছোট্ট জনপদ, ওপারে এক দিকে হাওড়ার গাদিয়াড়া আর এক দিকে নূরপুর। এখানে হুগলি নদী আর রূপনারায়ণ এসে মিশেছে। এর পর রূপনারায়ণ তার অস্তিত্ব হারিয়েছে। মজার কথা হল, এই রূপনারায়ণ আসলে দামোদর নদ, মেদিনীপুরে ঢোকার পর থেকে সে হয়ে গেল রূপনারায়ণ। নদের নাম পাল্টে গেলেও তার লিঙ্গ পরিবর্তন করেনি মানুষ। রূপনারায়ণ আর গঙ্গার মিলন যেন আসলে পুরুষ ও প্রকৃতিরই মিলন। একটি সাধারণ, সামান্য লেখাপড়া করা ছেলের মুখে এই ব্যাখ্যা শুনে বিস্মিত হয়েছিলাম। ভালও লেগেছিল ওর ব্যবহার। ফেরার সময় ও চাইতেই ফোন নম্বরটা দিয়েছিলাম, বলেছিলাম, “কোনও দরকার থাকলে ফোন কোরো।” 

চারটে নাগাদ বেরিয়ে পড়ব ঠিক করে রেখেছিলাম, কিন্তু আড়াইটের পর থেকে শান্ত প্রকৃতি অস্থির হয়ে উঠল। চেম্বারে বসেই বুঝতে পারছি হাওয়ার গতিবেগ বাড়ছে। কেব্ল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় খবরের লাইভ আপডেট আর দেখতে পাচ্ছি না। মোবাইলে আবহাওয়ার অ্যাপ খুলে দেখলাম সাইক্লোনের আই সোজা সাগরদ্বীপের দিকে ধাবমান। কাচের জানলা দিয়ে দেখছি, বিশাল বিশাল গাছ মাটির কাছাকাছি নুয়ে পড়ছে, আবার প্রবল বাতাসে উঠে দাঁড়াচ্ছে। অফিসের কোনও কাচের জানলা ঝনঝন শব্দে ভেঙে পড়ল। ফোনটা বাজতেই দেখি বিদিশার কল, প্রচণ্ড সন্ত্রস্ত গলায় উদ্বেগ, “আমাদের বাগানের বিশাল আমগাছটা উপড়ে গেল, এ রকম ঝড় কোনও দিন দেখিনি! দোতলার ঘরের সমস্ত কাচের জানলা বোধহয় গুঁড়িয়ে গিয়েছে, শুধু ঝনঝন আওয়াজ পাচ্ছি। তুমি ঝড় থামলেই বেরবে।” 

কিছু বলার আগেই লাইন কেটে গেল। প্রায় এক ঘণ্টা হল, ঝড় থামার কোনও লক্ষণ দেখছি না। তীব্র আক্রোশে প্রকৃতি আঘাত করে চলেছে একের পর এক। জানি না কত মানুষের মাথার ছাদ উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে এই ঝড়, কত মহীরুহ এর ভয়ানক বেগের কাছে মাথা নত করে উৎপাটিত হচ্ছে সমূলে। 

চারটে নাগাদ আবহাওয়া অ্যাপে চোখ রাখলাম, বুকের ভিতরটা ধক করে উঠল। নিজের চোখকে বিশ্বাস হল না! সাইক্লোনের আই পুরোপুরি হলদিয়ার উপর! তা হলে কি আমপান তার গতিপথ একটু পরিবর্তন করল? এই প্রেডিকশন তো ছিল না! না কি অ্যাপ ভুল তথ্য দিচ্ছে! মোবাইলের নেটওয়ার্ক এখনও কাজ করছে, কয়েকবারের চেষ্টায় এবিপি লাইভ খুলতে পারলাম। দেখলাম বলছে, আমপানের গতিপথ হলদিয়ার উপর দিয়েই। কলকাতার পরিস্থিতি খুব খারাপ, হাজার হাজার গাছ উপড়ে সমস্ত যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। 

ছ’টার পর ঝড়ের দাপট কমতে অফিস ছেড়ে বেরোলাম। গাড়িতে মিনিট দশেক দূরে বাংলো, কিন্তু গাছ পড়ে প্রায় সমস্ত রাস্তা অবরুদ্ধ। হেঁটে বাংলো পর্যন্ত পৌঁছতে বেগ পেতে হল। বাংলোর সামনে দণ্ডায়মান বিশাল বটের অনেকগুলো বড় ডালপালা ভেঙে পড়ে ঢোকার মুখ প্রায় আটকে আছে। অন্ধকারে কিছু বোঝা যাচ্ছে না, মোবাইলের সামান্য আলোয় ভরসা করে কোনও ক্রমে ভিতরে ঢুকলাম। মিনি আর বিদিশা আমাকে দেখে যেন প্রাণ ফিরে পেল। নদীর দিক থেকে জোরে হাওয়া বইছে এখনও, শান্ত নদীটি আর সেই পটে আঁকা ছবিটি নেই, নিকষ কালো অন্ধকারের মধ্যে দিয়ে তাকে আর চাক্ষুষ করা যাচ্ছে না এখন। আন্দাজ করলাম তার দুরন্ত কল্লোলিনী চেহারা, খেপা হাওয়ার তালে তালে তার নৃত্যরতা রূপ। কালান্তক এই ঝড়ের রাতে নিজেকে বড্ড অসহায় লাগল। অর্থ, প্রতিপত্তি, সমৃদ্ধি সব কিছুই কেমন যেন অর্থহীন মনে হল। এই দুর্যোগ কাটিয়ে কখন ভোরের আলো ফুটবে, সুন্দর একটা দিনের বার্তা নিয়ে, তাই ভাবছিলাম। 

ক্ষয়ক্ষতির একটা হিসেব করতে হবে ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যে, পাঠাতে হবে বোর্ড অব ডিরেক্টর্সে, তারই একটা রিপোর্ট তৈরিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছি সকাল থেকে। নেট মাঝে মাঝে আসছে, আবার একদম বেপাত্তা হয়ে যাচ্ছে। বন্দর এলাকায় আমাদের যে সমস্ত পরিকাঠামো রয়েছে, তার ক্ষয়ক্ষতি সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহ করতে এক প্রস্থ ঘুরে আসার ইচ্ছে ছিল, কিন্তু প্রায় সব রাস্তাতেই গাছ কিংবা বিদ্যুতের খুঁটি-তার পড়েছে। গাড়ি চলার সুযোগ নেই। ফিল্ড স্টাফদের থেকে কোনও ভাবে ফোনে যোগাযোগ করে খবর নিতে হচ্ছে। আমাদের সুপারভাইজ়ার সাধনবাবু ফোনে কিছু গুরুত্বপূর্ণ খবর দিলেন। সাধনবাবুর ফোন পাওয়ার পরেই আমার সাধনের কথা মনে পড়ল! বেচারি কাল দু’বার ফোন করেছিল কত ভরসা করে, কিন্তু ওকে ফেরানোর কোনও চেষ্টাই করিনি। আমার স্টেটাস, আমার ইগো কোথায় যেন বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল একটা ফোন করার পথে। ম্যানেজারকে এক বার বলে দিলেই ছেলেটা হয়তো ফিরতে পারত ওর মায়ের কাছে। কী জানি, ওদের বাড়ির কী অবস্থা হয়েছে কালকের ঝড়ে! মন ভারী হয়ে উঠল, ফোনের কল লিস্ট দেখে কল করেই ফেললাম সাধনের নম্বরে। এক বার কথা বললে মনের বোঝা কিছুটা হালকা হবে। দু’বারের চেষ্টায় ফোন লাগল। উৎকণ্ঠা নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “সাধন, বাড়ির খবর কী?” সাধনের গলায় আবেগ ঝরে পড়ল, “স্যর, আপনি কাল ম্যানেজারবাবুকে বলে না দিলে আমার ফেরা হত না, হেড অফিসের ফোন না এলে ম্যানেজারবাবু কিছুতেই ওঁর সিদ্ধান্ত বদলাতেন না। স্যর, আমাদের ঘরের অনেক ক্ষতি হয়েছে, ছাদ উড়ে গিয়েছে, আমি না থাকলে মা যে কী করত! আপনার কাছে কৃতজ্ঞতার শেষ নেই আমার…’’ সাধন আরও কিছু বলছিল, আমার কানে ঢুকল না। একটা মেকি ভাব গলায় এনে বললাম, “ঠিক আছে সাধন, এত বলার কিছু নেই, তুমি আগে ঘর ঠিক করার ব্যবস্থা করো। সামলে উঠে এক বার অফিসে দেখা কোরো, কী করা যায় দেখব।” 

জানি না কী করে ম্যানেজারের সিদ্ধান্ত বদল হল, কী করে কাল সাধন ফিরতে পারল, কেউ আদৌ হেড অফিস থেকে ফোন করেছিল কি না অথবা ওর কৃতজ্ঞতা আমার আদৌ পাওনা হয় কি না। কিন্তু অনেক না জানার মধ্যেও একটা উপলব্ধি হল। পেশাগত উচ্চতার আঁচে, মানুষ হিসেবে আমার মনন বোধহয় হারিয়ে গিয়েছে, হয়তো আসল আমিটাও এক দিন এই ভাবেই হারিয়ে যাব, নিজের অজান্তেই। 

ভাবনার জাল ছিঁড়ে ইন্টারকমের ফোন বেজে উঠল। ও পার থেকে ডিজিএম সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, “কত দূর এগোলেন?”