কোচিং ক্লাসটা শেষ হতে বড্ড দেরি হয়ে গেল। স্টেশন রোড পর্যন্ত বন্ধুদের সঙ্গে দল বেঁধে যাবে। কিন্তু তার পর বাকি পথটুকু সাইকেল নিয়ে একাই পেরোতে হবে রূপসাকে। বাসব দত্তের ছেলেটা দলবল নিয়ে ক্লাবে বসে থাকে এই সময়। ছেলেটা অত্যন্ত বদ আর অভদ্র। চোখের দৃষ্টিটাও কেমন যেন, দেখলেই অজানা ভয় শিরদাঁড়া বেয়ে নেমে আসে।
ক্লাবের সামনে এসে আরও জোরে প্যাডেলে চাপ দেয় রূপসা। ভিতর থেকে একটা সম্মিলিত হল্লা কানে আসে, বুকের ভিতর দামামা বাজছে। সর্বশক্তি দিয়ে প্যাডেল করতে থাকে ও। কিছুটা এগোতেই পিছনে দুটো বাইকের হেডলাইট ঝলসে উঠল। আতঙ্কে হাত-পা কাঁপছে এবার। বাইক দুটো ঠিক ওর পিছন পিছন আসছে। কিছুতেই ওকে ওভারটেক করছে না। শিকারি যেন শিকারকে খেলাচ্ছে। রূপসা আর জোর পাচ্ছে না পায়ে।
******
‘‘লখা... ন, লখা... ন, এই শালা লখু, শুয়োরের অওলাদ।’’
‘‘এই তো দাদা, আমি এ দিকে। হাতটা দাও।’’
‘‘আমাকে মুরগি করছিস? শালা হারামখোর।’’
‘‘ছি ছি, দাদা কী যে বলেন! বাথরুমে যাবে?’’
‘‘চল।’’
আজকাল সকালে ঘুম ভাঙলেই মেজাজটা খিঁচড়ে যায় রনির। ঘুমোলেও অন্ধকার, চোখ খুললেও অন্ধকার। গত এক মাস ধরে সব কাজে লখানই ভরসা। ব্যবসাপত্তরও সব কালু আর হিমুর ঘাড়ে রেখে চালাতে হচ্ছে। অসহ্য লাগছে লাইফটা। মাঝে মাঝে মনে হয় চারপাশের লোকজন ওকে নিয়ে বোধ হয় মজা করছে। কবে যে চোখ দুটো ঠিক হবে! বাপি অবশ্য চারদিকে লোক লাগিয়ে দিয়েছে।’’
ব্রেকফাস্ট টেবিলে বসতেই বাপির গলা কানে এল।
‘‘এই লখু, বাপি কি বাড়িতে?’’
‘‘এই তো ঘণ্টাখানেক আগে ফিরলেন স্যর।’’
রনির ভ্রু দুটো কুঁচকে গেল। আজ আর কাল এই দু’দিন দিল্লিতে দলের বিক্ষোভ সমাবেশ হবে। বাপির তো এই দু’দিনই সেখানেই থাকার কথা। তা হলে?
******
দুটো বাইক হঠাৎ সামনে এসে এমন ভাবে দাঁড়িয়ে পড়ল যে টাল সামলাতে না পেরে রূপসা পড়ে গেল। এই জায়গাটা বেশ অন্ধকার, লোকজনও বিশেষ নেই। রাস্তার পাশেই একটা বন্ধ কারখানা। বাইক থেকে চারটে ছেলে ঝটপট নেমে এল। মুহূর্তের মধ্যে ওরা রূপসার মুখ চেপে ধরে টানতে টানতে নিয়ে চলল কারখানার পিছন দিকে। হাতের চাপে রূপসার গালদুটো বসে যাচ্ছে দাঁতের উপর। অসহ্য যন্ত্রণায় ছটফট করে উঠল ও, কিন্তু নড়তেও পারল না। হাত দুটো পিছন দিকে চেপে ধরে রেখেছে এক জন। পা দুটো ধরে রেখেছে আর এক জন। ছেলেগুলোর মুখ হেলমেট দিয়ে ঢাকা। ক্রমশ দমবন্ধ হয়ে আসছে ওর। সর্বশক্তি দিয়ে চেষ্টা করছে ছাড়া পাওয়ার। ওরা পালা করে ক্ষতবিক্ষত করতে লাগল ওর শরীরটা।
এক সময় মুখের উপর হাতের চাপটা একটু কমে আসতেই তীব্র চিৎকার করে উঠল রূপসা। সঙ্গে সঙ্গে মাথায় একটা ভারী পাথর জাতীয় কিছু দিয়ে মারল ওরা। একটা ছেলে হেলমেটটা খুলে ফেলল এই সময়। ছেলেটাকে দেখে চমকে উঠল রূপসা।
ওর দৃষ্টিটা আস্তে আস্তে ঝাপসা হয়ে আসছে। ওকে ফেলে রেখে ফিরে যাচ্ছে ছেলেগুলো। অতি কষ্টে একটা আঙুল তুলে রূপসা ওই হেলমেট ছাড়া ছেলেটার দিকে অস্ফুটে কিছু একটা বলল, তার পরই জ্ঞান হারাল।
******
মেয়ের ছবির সামনে স্থাণু হয়ে বসে আছে সাম্য আর রূপলেখা। ছবিতে একটা মোটা রজনীগন্ধার মালা ঝুলছে, সামনে একগুচ্ছ ধূপকাঠি জ্বলছে। সাম্যের ভিতরটাও এখন জ্বলেপুড়ে খাক হচ্ছে। কত সাধ করে দু’জনের নামের সাথে মিলিয়ে মেয়ের নাম রেখেছিল, ওদের একমাত্র সন্তান। পুরো একমাস লড়াই চালানোর পর গতকাল রাতে মেয়েটা চলে গেল। এখনও ওরা কোনও স্টেপ নিতে পারেনি ওই জানোয়ারগুলোর বিরুদ্ধে।
দিনটা ছিল ১১ জানুয়ারি। পাক্কা আড়াই ঘণ্টা ট্রেন অবরোধে আটকে পরে ফিরতে বেশ দেরি হয়েছিল সে দিন। বাড়ির ল্যান্ডলাইনটা সন্ধে থেকে শুধু বেজেই যাচ্ছিল। রাস্তা থেকেই দুশ্চিন্তা হচ্ছিল রূপলেখার। ইতিমধ্যে সাম্যও বহু বার চেষ্টা করেছে কিন্তু বারবার নিরাশ হতে হয়েছে আর দুশ্চিন্তা বেড়েছে।
রাতে ফিরেও বাড়িতে তালা ঝুলছে দেখে সাম্যর বুকটা কেঁপে উঠেছিল। তখনই ও গিয়েছিল কোচিং সেন্টারে। রূপলেখা ফিরেছিল একটু পরেই। তার পর তো রূপসার বন্ধুদের বাড়ি, আশেপাশের প্রতিবেশীদের বাড়ি, সব জায়গায় পাগলের মতো খোঁজাখুঁজি করেছিল দুজনে। অনেক রাতে বিস্কুট কারখানার পিছনে পরিত্যক্ত জমিতে পাওয়া গিয়েছিল ক্ষতবিক্ষত রূপসাকে। দারোয়ান লোকটা রোজ রাতের দিকে জোরালো টর্চের আলো ফেলে চারদিক দেখে। সে-ই পুলিশে খবরটা দিয়েছিল।
থানা প্রথমে একটা জেনারেল ডায়েরি করে ছেড়ে দিয়েছিল। বাসব দত্তের ইশারা ছাড়া এখানে গাছের পাতাও নড়ে না। সাম্যরাও তখন ঝামেলা করার মতো অবস্থায় ছিল না। ওদের মনে হয়েছিল মেয়েটাকে আগে সুস্থ করা দরকার। অপরাধীদের শনাক্ত করতে গেলেও তো রূপসার সাহায্য লাগবে। টানা দু’দিন অজ্ঞান অবস্থায় ছিল রূপসা। জ্ঞান ফেরার পরেও হাত পা নাড়াতে পারছিল না।
প্রেস ঠিক খবরটা জোগাড় করে ফেলেছিল। তার পর পুলিশও এফআইআর নিয়েছিল। নার্সিং হোমেও এসেছিল রূপসার সঙ্গে কথা বলতে। কিন্তু মেয়েটা তখন কথা বলার শক্তিটুকুও হারিয়ে ফেলেছিল। চোখের দু’পাশ দিয়ে অনর্গল জলের ধারা বইছিল। বোঝা যাচ্ছিল অসহনীয় এক কষ্ট সহ্য করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে ও। তার মধ্যেই মাঝে মাঝে চোয়াল দুটো শক্ত হয়ে উঠছিল।
******
মাসখানেক আগে এক দিন ভোররাতে স্করপিওটা নিয়ে বাড়ি ফিরছিল রনি। দিনটা এখনও মনে আছে, ১৩ জানুয়ারি। আগের রাতে সানির বার্থডে পার্টি ছিল। শীতের ভোরে হালকা কুয়াশার আস্তরণ ছিল চারদিকে। আচমকা একটা মেয়ে গাড়ির একদম সামনে চলে এসেছিল। রাতভোর পার্টির নেশায় নাকি অন্যমনস্কতায় রনি আগে খেয়াল করেনি মেয়েটাকে। মেয়েটা সম্ভবত রাস্তা পেরোচ্ছিল তখন। পরনে সাদা সালোয়ার কামিজ... না বোরখা... না সাদা চাদর... দূর ছাই মনেও পড়ে না ঠিক করে। এক ঝলকের দৃষ্টিতে যেটুকু দেখেছিল, গাড়ির সামনে এসে মেয়েটা ওর দিকে এক বার ঘুরে তাকাল, আঙুল তুলে কিছু একটা বলছিলও যেন। মুখটা একটু চেনা মনে হল। তার পরই তো গাড়িটা কেমন লাগামছাড়া হয়ে রেলিং-এ ধাক্কা মেরে উল্টে গেল।
আঘাত তো সারা শরীরেই লেগেছিল, তবে মারাত্মক ক্ষতি হয়েছিল চোখদুটোর। দুর্ঘটনার পর মেয়েটার কোনও খোঁজ পাওয়া যায়নি। হয়তো ওর তেমন আঘাত লাগেনি। তবে ওই মুখটা বড্ড চেনা চেনা লাগছে। কোথায় দেখেছে? কোথায়?...
******
এক দিনে রূপলেখা গুটিয়ে গিয়েছে নিজের মধ্যে। মাঝে মাঝেই বিড়বিড় করে নিজের সঙ্গে কথা বলছে, কাঁদছে, আবার কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়েও পড়ছে কখনও সখনও।
আজ সমস্ত স্মৃতিগুলো যেন হুড়মুড় করে ঝাঁপিয়ে পড়ছে চোখের সামনে। তীব্র একটা ব্যথা চারিয়ে যাচ্ছে মস্তিষ্কের কোষে কোষে।
হু-হু করে কেঁদে উঠল রূপলেখা। সাম্য ওকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল।
হঠাৎই একটা কথা মনে পড়ল রূপলেখার। “জানো সাম্য, রূপসার যাওয়ার দিন সকালে, আমি যখন ওর বেডের পাশে বসেছিলাম, তখন না ও একটা আঙ্গুল তুলে সিলিং-এর দিকে তাকিয়ে কিছু একটা বলছিল মনে হল।”
‘‘কিন্তু লেখা, ও তো আর কথাই বলতে পারছিল না।’’
‘‘বিশ্বাস করো, আমি স্পষ্ট দেখেছি ওর ঠোঁট নড়ছিল।’’
‘‘লেখা, তুমি আমাকে সে দিনও বলেছিলে কথাটা। কিন্তু তার পরে তো ও কোনও সাড়া দেয়নি। ডাক্তারও পজিটিভ কিছু পায়নি।’’
‘‘উফ্, তুমি আমার কথা কেন বিশ্বাস করছ না? কেন?... কেন?’’
‘‘শান্ত হও লেখা, প্লিজ। আমার বিশ্বাস-অবিশ্বাসে এখন কি আদৌ কিছু যায় আসে বলো? তুমি সব সময় এত ভেবো না। কষ্ট আমারও কিছু কম হচ্ছে? কিন্তু...’’
গলাটা বুজে আসে সাম্যর। ও বারান্দায় বেরিয়ে আসে।
শোকে কাতর রূপলেখাকে প্রবোধ দিল ঠিকই, কিন্তু ওর মনের মধ্যেও তো এখন একটা অদ্ভুত দোলাচল চলেছে।
******
প্রথম খটকাটা লেগেছিল সাম্যর, রূপসার চার বছর বয়সে।
রূপলেখার অফিসে কয়েক দিন ধরেই বিস্তর খাটুনি চলছিল। এর মধ্যেই খবর এল, লেখার মা খুব অসুস্থ। ওর ছুটি নেওয়ার উপায় ছিল না, খুব দুশ্চিন্তায় কাটছিল দিনগুলো।
সে দিন সকালে স্কুলে যাবে না বলে রূপসা খুব বায়না করছিল। সাম্য ওকে বোঝানোর চেষ্টা করছিল বারবার, কিন্তু ও কিছুতেই শুনছিল না। কিছু ক্ষণ পর অধৈর্য রূপলেখা বেশ জোরে ধমকে উঠেছিল মেয়েকে। প্রথমে বেশ চমকে গিয়ে কেঁদে উঠেছিল ও। তার পর ঠান্ডা চোখে মায়ের দিকে তাকিয়েছিল। ছোট্ট আঙুল তুলে অস্ফুটে কিছু একটা বলেওছিল যেন।
রূপসার হাত ধরে বেরোচ্ছিল রূপলেখা। মেয়েকে স্কুলবাসে তুলে দিয়ে ও অফিসে যায় রোজ। কাজের মেয়েটা ছুটির সময় বাস থেকে নামিয়ে আনে। সে দিন বেরোনোর সময় গেটটা ঠেলতেই কী ভাবে যেন সেটা আবার বন্ধ হয়ে গেল। মনে হল দেওয়ালের দিক থেকে গেটটা বাউন্স করে যেন আগের জায়গায় ফিরে এল। ফলে দুটো গেটের মাঝে রূপলেখার ডান হাতটা চাপা পড়ে গেল। অসহ্য যন্ত্রণায় ককিয়ে উঠলো রূপলেখা।
রূপসা কিন্তু তখনও এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল লেখার দিকে। ব্যাপারটা খুব অবাক করেছিল সাম্যকে। যদিও লেখা তখন ব্যথার চোটে কিছুই খেয়াল করেনি।
পরে মেয়েকে বোঝাতে গিয়েছিল সাম্য। ‘‘রূপসা মা, তুমি আজ স্কুলে যেতে চাইছিলে না কেন?’’
‘‘এমনি বাবা। ছুটি হলে কত ভাল হয়। কত্ত মজা হয়।’’
‘‘কিন্তু মা, ছুটি তো স্যাটারডে আর সানডে হয়। তাই না?’’
‘‘হুম।’’
‘‘আর অমন কোরো না। কেমন? দেখো তো তাড়াতাড়িতে মাম্মা ব্যথা পেল।’’
‘‘হুউ... আচ্ছা বাবা! মাম্মামের হাতটায় ওটা কী বেঁধে দিয়েছে ডাক্তারবাবু?’’
‘‘ওটাকে বলে প্লাস্টার।’’
‘‘মাম্মামের হাতটা কবে ঠিক হবে বাবা?’’
‘‘হবে মা। ক’দিন পরেই ঠিক হয়ে যাবে।’’
মেয়ের চোখে তখন স্পষ্ট ব্যথা ফুটে উঠতে দেখেছিল সাম্য।
******
বছর কয়েক পরের কথা।
রূপসা সবে ক্লাস টু’তে উঠেছে। স্কুল থেকে সাম্য আর রূপলেখার ডাক পড়ল এক দিন।
রূপসার ক্লাস টিচার ভদ্রমহিলা বেশ কড়া ধাঁচের মানুষ। তাঁর বক্তব্য, রূপসা নাকি ওর এক বন্ধুকে ছুটির সময় ধাক্কা মেরে মাটিতে ফেলে দিয়েছে। সেই মেয়েটা বেশ ভাল রকমের আহত হয়ে পড়েছে। মেয়েটার নাম মিলি দত্ত। মিলির বাবা-মা স্কুলে অভিযোগ জানিয়েছেন।
এ দিকে রূপসা বেশ জোরের সঙ্গেই অভিযোগ অস্বীকার করে চলেছে। ওর ক্লাস টিচার কিছুতেই রূপসার কথা শুনতে রাজি নয়।
সাম্য বেশ বুঝতে পারছে কোথাও একটা ভুল বোঝাবুঝি হচ্ছে। রূপসা কখনও মিথ্যে কথা বলে না। আর ধাক্কা দেওয়াটাও ওর স্বভাববিরুদ্ধ।
সাম্য আর রূপলেখা যথাসাধ্য চেষ্টা করছে ভদ্রমহিলাকে বোঝাতে কিন্তু তিনি নিজের বক্তব্যে অনড়। এক সময় রূপসা চুপ করে গেল। চোখ দিয়ে টপটপ করে জল পড়তে শুরু করল। সেই অবস্থাতেই ও মিসের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। রূপলেখা তখনও চেষ্টা করছিল ওঁকে বোঝাতে। সাম্য দেখছিল রূপসার ক্রমশ বদলে যাওয়া চোখদুটো।
মিস যখন পিছন ফিরে চলে যাচ্ছিল তখন রূপসা হঠাৎ মিসের দিকে একটা আঙ্গুল তুলে খুব আস্তে কিছু একটা বলল। সাম্য তত ক্ষণে মেয়ের হাত ধরে টানতে শুরু করেছে। আর তখনই আচমকা রূপসার মিস সিঁড়ি থেকে গড়িয়ে পড়ে গেল। অনেকেই হইহই করে সে দিকে দৌড়ল। শুধু সাম্য সেখানেই দাঁড়িয়ে পড়ছিল।
সে বারও সেই ঘটনার পর রূপসার মধ্যে কোনও পরিবর্তন দেখা যায়নি।
******
আজ এত দিন পরে লেখার কাছে হাসপাতালের ঘটনাটা শুনে সাম্যর আবার মনে পড়ে গেল পুরনো কথাগুলো। সেই সঙ্গে এক অদ্ভুত দোলাচলেও পড়ে গেল ও।
রূপসার কি সত্যিই কোনও বিশেষ ক্ষমতা ছিল? দূর,তাই বা কি করে হয়? ওর মন যা ভাবছে তা যদি সত্যি হত তা হলে কি এত কষ্ট সহ্য করে মাত্র কুড়ি বছর বয়সেই এ ভাবে চলে যেতে হত মেয়েটাকে?
কী জানি, বাবার মন তো! কত অসম্ভব সম্ভাবনাও আঁকড়ে ধরতে চায়। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সাম্য আবার দেখতে গেল রূপলেখাকে।
******
আজ পুরো এক মাস পর চোখে দেখতে পাবে রনি। আনন্দে একেবারে নাচতে ইচ্ছে করছে ওর। সত্যি যদি চোখদুটো ঠিক হয়ে যায় তো এই ডাক্তারটাকে একদম খুশ করে দেবে ও। বাপি তো টাকাপয়সা যা দেওয়ার দেবেই, ওর তরফ থেকেও একটা গিফট তো বনতা হ্যায়।
ডা. গুহ কে বাপি আগে থেকেই বলে রেখেছিল কর্নিয়া ট্রান্সপ্ল্যান্টেশনের জন্য ভাল কর্নিয়ার ব্যবস্থা করতে। কিন্তু কিছুতেই সেটা পাওয়া যাচ্ছিল না। সে দিন তাই ডা. গুহ টেলিফোনে কর্নিয়ার কথা জানাতেই বাপি দিল্লি যাওয়া স্থগিত করে দিয়েছিল। ওকে নার্সিং হোমে ভর্তি করিয়ে তার পরের দিন গিয়েছিল বিক্ষোভ সমাবেশে।
একটু পরেই ডা. গুহ এসে ব্যান্ডেজ খুললেন। একটা কালো চশমা পরিয়ে বললেন চোখ খুলতে। বাপি, মা, দিদি, হিমু, এমনকি লখুটাও আজ এসেছে ওকে নিয়ে যেতে।
কিন্তু এ কী! বাপির মুখটা কেমন ঝাপসা দেখাচ্ছে কেন? না না, আস্তে আস্তে পরিষ্কার হচ্ছে। এ তো একটা মেয়ের মুখ। আরে এটা তো সেই মেয়েটার মুখ, যে সে দিন গাড়ির সামনে চলে এসেছিল।
রনি এ বার ভয়ে ভয়ে মায়ের দিকে তাকাল। মা, দিদি, লখু, ডাক্তার... সব মুখগুলোই একই রকম... সেই মেয়েটা। রনির গলা শুকিয়ে আসছে। নার্সের কাছে একটা আয়না চাইল ও। কাঁপা কাঁপা হাতে সেটা তুলে নিজের মুখের সামনে ধরল। ওখানেও সেই মেয়েটা। এ বার আর চিনতে ভুল হয় না রনির। এই মুখটা সে দিন রাতে বিস্কুট কারখানার পিছনে সেই পরিত্যক্ত জমিটায় ফেলে এসেছিল সে।
‘‘আমি চোখে দেখতে চাই না ডাক্তার! প্লিজ আমাকে আগের মতো করে দিন! প্লিজ... প্লিজ... প্লিজ!’’
দু’হাতে মাথার চুল খামচে ধরে পাগলের মতো চিৎকার করতে থাকে রনি দত্ত।
‘‘আপনার কি প্রবলেম হচ্ছে আমায় বলুন তো। এক দম ফ্রেশ কর্নিয়া ছিল। অপারেশনের জাস্ট আগের দিনই মেয়েটা মারা গিয়েছে,’’ বললেন ডাক্তার গুহ।
‘‘কো...কো…কোন মেয়েটা?’’
‘‘সাম পুওর গার্ল। রেপ কেস ছিল। কথাও বলতে পারছিল না। তবে স্যরকে খুব রেসপেক্ট করত মনে হয়। মারা যাওয়ায় আগে চিরকুটে লিখে অনুরোধ করেছিল কর্নিয়া দুটো যেন আপনাকেই দেওয়া হয়।’’
আতঙ্কে রনির চোখদুটো ঠেলে বেরিয়ে আসছে। আর ছেলের দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে প্রভাবশালী নেতা শ্রীবাসব দত্ত।