Abosar

পেরেন্টিং

নবনীতা দত্ত

সবে কড়াইয়ে ফোড়ন দিয়েছেন, কলিং বেল বেজে উঠল। তরকারিটা আর হল না। গ্যাস অফ করে সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেলেন চিত্রা। একে পায়ে ব্যথা, তার উপরে এই বারেবারে সিঁড়ি ভাঙা, মনে হয় যেন পা-টা ভেঙে যাবে এক্ষুনি, মটমট করে আওয়াজ হয়। কোনও রকমে বাঁকা পায়েই সিঁড়ি ভেঙে আস্তে আস্তে নেমে আসছেন। কিন্তু কলিং বেলটা বেজেই চলেছে। 

দরজা অবধি কোনও রকমে পৌঁছে গায়ের জ্বালা উগরে দিলেন, ‘‘এত বার বাজাচ্ছিস কেন? একে খোঁড়া পা, তার উপর আজকে সুনীতা আসেনি। বাড়িতে একটা লোক 

নেই। এত তাড়াতাড়ি কি আমি নামতে পারি?’’

‘‘রোজই তো এসে আধঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। সব সময়ই তোমার পায়ে ব্যথা, নইলে কোমরে ব্যথা। আমার অফিস দেরি হয়ে যাবে না?’’ মুখের ঝাল কিছু কম নয় চৈতিরও। তাড়াতাড়ি নিজের মেয়েকে এগিয়ে দিল চৈতি, ‘‘এই নাও, ওকে ধরো,’’ মেয়ের গালে আদর করে পিছন ফিরে দরজাটা ধমাস করে টেনে দিয়ে গাড়িতে উঠে বসল।

‘‘এসিটা একটু বাড়াও তো!’’ বলে ফোনে দীপের নম্বর ডায়াল করল, ‘‘হ্যালো, অফিস পৌঁছে গিয়েছ?’’

‘‘হ্যাঁ! অনেক ক্ষণ।’’

‘‘টিফিনটা নিয়ে যাওনি তো!’’

‘‘তোমাকে বলেছিলাম না আজকে মিটিং আছে। মিটিং মানেই তো ইটিং। টিফিন এনে করব কী? তুয়াকে নামিয়েছ?’’

‘‘হুমম!’’

‘‘কী হল? আবার ঝগড়া করেছ নাকি?’’

‘‘তা কী করব! রোজ জানে এই সময় মেয়েকে নামাব। সেই রোজ আমাকে কলিং বেল বাজিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। তার পর দরজা খুলেই মুখঝামটা। পায়ে ব্যথা, কোমরে ব্যথা... আর তোমাকে বলেই বা কী করব? তোমার মাকে বললাম ক’টা দিন এসে থাকতে। সে তো দায়িত্ব নেবে না। সব কিছু তো শুধু আমার মা-বাবার উপর।’’

‘‘উফ! তুমি আবার শুরু কোরো না। বলছি আজকে মিটিং আছে। মাথাটা খিঁচিয়ে দিয়ো না তো!’’

‘‘তোমার তো একারই মিটিং থাকে। আমাকে কী নিয়ে ডিল করতে হয় জানো? সারা দিন ব্যাঙ্কের হাজার রকম কাস্টমার। কেউ কথা শুনতে চায় না। বাড়ির জ্বালা।’’

‘‘উফ! চৈতি এ বার ছাড়ো। ভাল লাগছে না। হাতে গুচ্ছের কাজ। বাড়ি গিয়ে শুনব।’’

ফোনটা কেটে দিল।

******

ফোনটা ধরলেন চিত্রা, ‘‘তুমি এত বার ফোন করো কেন বলো তো?’’

অবন ফোনের ও পারে গদগদ গলায়, ‘‘তুমি বলছিলে না ক’দিন আগে কাঁকড়ার কথা। আজকে খুব ভাল কাঁকড়া উঠেছে বাজারে। নেব নাকি কয়েকটা? বেশ কষা-কষা করে ঝাল করবে।’’ কথাটা বলতে-বলতেই যেন খানিকটা স্বাদ এসে গিয়েছে জিভের তলায়। 

‘‘হ্যাঁ, ঝাল করবে?’’ ভেঙিয়ে বললেন চিত্রা, ‘‘আজকে সুনীতা আসেনি। সকাল থেকে হেঁশেল ঠেলছি। সারা বাড়ি নোংরা হয়ে পড়ে আছে। তুয়া এসে গিয়েছে। আর তোমার মেয়ের যা মুখ হয়েছে! সক্কালবেলা এসে আমাকে মুখ করে গেল। বলল আমার নাকি সারা দিন পায়ে ব্যথা, কোমরে ব্যথা!’’

অবনের জিভের তলার রসটা কেটে গেল। ঢোঁক গিলে নিলেন, ‘‘ঠিক আছে। তা হলে আজকে আর নিচ্ছি না। তোমাকে আবার কাটতে-বাছতে হবে। অনেক হ্যাপা।’’

‘‘তুমি শুধু মনে করে তুয়ার দুধটা নিয়ে এসো। দুধটাও যে ফুরিয়ে গিয়েছে সে দিকেও তো ওর মায়ের খেয়াল নেই। সারা দিন খালি অফিস করছে। তা হলে আর তোদের বাচ্চার কী দরকার ছিল? অফিসই করতে...’’

কাঁকড়ার ঝালের জায়গায় বেশ খানিকটা মুখের ঝাল খেয়ে অবন ফোনটা নামিয়ে রাখলেন।

কথা শেষ করে তুয়াকে কোলে নিলেন চিত্রা, ‘‘আমার দিদিন, কী খাবে তুমি আজকে?’’

তুয়া আধো-আধো গলায় বলল, ‘‘দাম্মা, আমি কওয়া কাব, লজেন কাব।’’

চিত্রা নাতনিকে কোলে নিয়ে খুঁড়িয়ে-খুঁড়িয়ে ফ্রিজের কাছে গেলেন। ফ্রিজ খুলে একটা কলা বার করে তুয়ার হাতে ধরিয়ে দিলেন। 

তুয়া কলাটা ছাড়িয়েই চিত্রার মুখের কাছে ধরলেন, ‘‘দাম্মা কায়, 

দিদিন কায়।’’

‘‘ওরে আমার সোনা রে! তুই এই বুড়িটাকে সব চেয়ে বেশি ভালবাসিস,’’ বলে তুয়াকে কোলের মধ্যে আরও খানিকটা জড়িয়ে ধরলেন। তুয়াও ওর দাম্মাকে চুমু খেল মুখে, ঠিক কানের পাশে।

 

******

কানের কাছে ফোনটা ধরতেই একটা বিরক্তিমাখা চিৎকার ভেসে এল ও পাশ থেকে, ‘‘হ্যালো!’’ 

অবন ভীষণ অপরাধীর মতো কাঁচুমাচু স্বরে বললেন, ‘‘হ্যাঁ, বুড়ি বলছিস?’’

‘‘তুমি তো আমাকেই ফোন করেছ বাবা, আমি বলব না তো কে বলবে? যা বলবে তাড়াতাড়ি বলো। সামনে কাস্টমার দাঁড়িয়ে আছে।’’

‘‘হ্যাঁ, না, মানে তোর মা আজকে ছাদে পড়ে গিয়েছে। এক বার হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। তুই কি আসতে পারবি এখন?’’

‘‘এখন? অসম্ভব। এই তো ঘণ্টাখানেক হল ঢুকলাম অফিসে... আর সকালেই তো দেখে এলাম ঠিক আছে। এর মধ্যে আবার পড়ে গেল কী করে?’’

‘‘পড়ে গেল কী করে মানে! মানুষ কি ইচ্ছে করে পড়ে যায় না কি? একে সুনীতা আসেনি আজকে। রান্নার লোকও নেই এক সপ্তাহ হল। বাড়ির কাজ কি কম? আমাদের বয়স...’’

অবনের কথা থামিয়ে দিলেন চৈতি, ‘‘উফ বাবা! এই রোজ অফিসে এলেই ফোন করে তোমাদের কাজের লোকের সমস্যা আর শুনতে পারছি না। আমি দেখছি কী করা যায়।’’

‘‘তোদের শুনতে হবে না। তোরা সারা দিন অফিস কর। আমরা তোদের মেয়ে নিয়ে বসে থাকি। আর কী!’’ এ বার অবনের গলা থেকেও বিরক্তি উপচে পড়ল। 

‘‘হ্যাঁ। আমারই হয়েছে জ্বালা। আর আমি তুয়াকে ও বাড়িতে রাখব না। ক্রেশে রেখে অফিস আসব। তখন তোমরা বলতে আসবে না কিন্তু! এখন রাখো। আমি বসের সঙ্গে কথা বলে দেখছি...’’

‘‘তা হলে তুই আসতে পারবি 

না তো?’’

‘‘এখনই কী করে বলব? আমি কথা বলি আগে। তুমি তুয়া সমেত মাকে নিয়ে চলে যাও হাসপাতালে। আমি অফিস থেকে বেরিয়ে সোজা হাসপাতাল পৌঁছচ্ছি।’’

খটাস করে ফোনটা কেটে দিল দু’জনেই। কে যে আগে কাটল বোঝা গেল না। সম্পর্কটাও যেন কটকট করে কেটে যাচ্ছে, টের পেলেন অবন। 

******

হাসপাতালের কাচের দরজা দিয়ে চৈতিকে ঢুকতে দেখেই দাদুর কোল থেকে লাফিয়ে নেমে সে দিকে ছুটে গেল তুয়া।

অবনের সবে একটু ঝিমুনিমতো এসেছিল। চটকা কেটে যেতেই নাতনির পিছনে কাঁপা-কাঁপা পায়ে এগিয়ে গেলেন, ‘‘তুয়া, তুয়া, ও দিকে যায় না।’’

তুয়া মাঝপথে একবার শুধু থেমে পিছন ফিরল, ‘‘মাম্মা, এতে গ্যাতে।’’

অবন বুকপকেট থেকে চশমাটা বার করে চোখে পড়লেন, বুড়ির চেহারাটা ঝাপসা থেকে একটু স্পষ্ট হল, ‘‘এসেছিস?’’

‘‘ডাক্তার কী বলল বাবা? এক্স 

রে করেছ?’’

‘‘হ্যাঁ, টেস্ট যা করার ছিল, সব করা হয়ে গিয়েছে। রিপোর্ট দেখে ডাক্তার জানাবেন। ওয়েট করতে বলেছেন।’’

‘‘মা কোথায়?’’

‘‘অর্থোপেডিক ওয়ার্ডে।’’

‘‘মাকে অ্যাডমিট করেছ না কি?’’ চোখগুলো বড়-বড় হয়ে গেল চৈতির। মেয়ের চোখ থেকে চোখ নামিয়ে নিলেন অবন, ‘‘হুম!’’

চৈতি খানিক ক্ষণ গোঁজ হয়ে বসে রইল। মাথার মধ্যে হাজারটা চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে। দীপের মিটিংটাও মনে হয় এত ক্ষণে শেষ হয়ে গিয়েছে। দীপকে একটা মেসেজ করল, ‘ফ্রি হলে কল কোরো।’

পাঁচ মিনিটের মধ্যেই দীপের ফোন এল, ‘‘হ্যাঁ, বলো। খবর কী?’’

চৈতি বাবার কাছ থেকে অনেকটা দূরে চলে এল, ‘‘এই হাসপাতালে এলাম, মিনিট দশেক হল। মায়ের পায়ের অবস্থা খারাপ। টেস্ট করেছে। দেখা যাক! ভর্তি করতে হবে কি না...’’

‘‘অ্যাডমিট করতে হবে?’’ 

‘‘জানি না। বাবা বলল, ডাক্তার টেস্টের রিপোর্ট দেখে জানাবে কী হয়েছে। দরকার থাকলে ভর্তি...’’

‘‘এব্বাবা! তা হলে তো চাপ।’’

‘‘কী অদ্ভুত কথা বলছ তুমি। অসুস্থ হলে কী করবে?’’

তাড়াতাড়ি নিজেকে সামলে নিল দীপ, ‘‘না, আমি সে ভাবে বলতে চাইনি। উনি ভর্তি হলে তুয়াকে তো দেখার জন্য কাউকে বাড়িতে থাকতে হবে? তুমি কি তা হলে ছুটি নেবে?’’

‘‘আমি এখন কী করে ছুটি নেব? ব্যাঙ্কের ইয়ার এন্ডিং। এখন আমার ছুটি নেওয়া সম্ভব?’’

‘‘তা হলে তুয়া কোথায় থাকবে?’’

‘‘তুমি তো অনেক দিন ছুটি নাওনি। তুমি নাও।’’

‘‘ইমপসিব্‌ল। সামনে অ্যাসেসমেন্ট। অনেক কষ্টে সব কিছু ঠিক জায়গায় নিয়ে এসেছি। এবার প্রোমোশনের হাই চান্স। রিস্ক নেব না। কে কোথায় কাঠি করবে, সব 

ঘেঁটে যাবে।’’

‘‘তা হলে তুমি ক্রেশে কথা বলে রাখো।’’

‘‘ক্রেশে রাখবে মেয়েকে?’’

‘‘তো কী করব? তোমার মা-বাবাও তো হাত তুলে বসে থাকেন। শুধু আদর করতে আসেন নাতনিকে।’’

‘‘এর মধ্যে আবার মা-বাবা এল কোত্থেকে? তারা কি কলকাতায় থাকে?’’

‘‘কেন? তাঁদের থাকতে কে বারণ করেছে?’’

‘‘বাহ! এত দিন তো তুমিই চাইতে দু’জনের সংসার। মা-বাবা মাঝেসাঝে বাড়িতে এলেই তো বিরক্ত হতে।’’

‘‘আমি বিরক্ত হতাম না। তুমি জানো আমার ব্যাঙ্ক থেকে ফিরতে দেরি হত বলে ওঁরাও নানা রকম কথা বলতেন।’’

‘‘সেটা তো তোমায় নিয়ে নয়, চাকরির ব্যাপারে জিজ্ঞেস করতেন!’’

‘‘তা হলে আর কী? চাকরি ছেড়ে দিয়ে বসে থাকি? তুমি একা আমাদের লাইফস্টাইলটা মেনটেন করতে পারবে তো?’’ 

‘‘আমার চাকরিতে যে ভাবে চলবে, সে ভাবে তুমি থাকতে 

পারবে তো?’’

‘‘আমি কেন আপস করব? এখন যে ভাবে আমরা চলি, তুমি সেটা চালাতে পারবে তো? সেটা আগে বলো? সে না হয় ছেড়েই দিলাম। তুয়া ক’বছর বাদেই বড় স্কুলে ভর্তি হবে। তখন অ্যাডমিশনের টাকার অ্যামাউন্টটা পারবে তো একা দিতে? সামন্তদার বৌয়ের কাছে সে দিন তো শুনলে স্কুলগুলো এখন ভর্তি হতে কত টাকা নেয়।’’

‘‘বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে অত বড় বড় স্কুলে ভর্তি না করলেই হয়। আমরাও তো পাড়ার স্কুলে পড়ে বড় হয়েছি। আমরা কি মানুষ হইনি? খেয়েপরে বেঁচে আছি তো!’’

‘‘আমাদের যুগ আর এ জেনারেশনে বিস্তর ফারাক দীপ। ফালতু ঝগড়া কোরো না। সকাল থেকে বাড়ি ঠেলে, বাচ্চা সামলে অফিস কোরো, তখন বুঝবে। আগে তো মায়েদেরও রোজগার করতে বাইরে বেরোতে হত না।’’

‘‘কেন? মুখে নারীস্বাধীনতার বুলি। এ বার ব্যালান্স করো...’’

‘‘ব্যালান্স করার দায় কি শুধু আমার? কেন আমি ব্যালান্স করব? মুশকিলটা হচ্ছে আগেকার দিনে মেয়েরা তা-ও একটা জায়গায় ছাড় পেত, বাইরে বেরোতে হত না। আর এখন হচ্ছে বাইরেও খাটো, বাড়িতেও। তোমার মা তো জীবনে এক পয়সাও রোজগার করেননি। তোমার বাবা সারা জীবন তাকে টাকা জুগিয়ে গিয়েছে। তুমি দাও আমায়?’’

‘‘সক্কাল সক্কাল কী নিয়ে পড়লে বলো তো? তোমার সঙ্গে কথা বলা মানেই ঝগড়া।’’

‘‘ওই তো! নিজের মা-বাবার প্রসঙ্গ উঠলেই তখন ট্র্যাক চেঞ্জ। বাড়ি, বাচ্চা, অফিস... নিজে সামলে দেখো না এক দিন! তোমায় এখন যদি জিজ্ঞেস করি, তোমার মেয়ে সকালে ঘুম থেকে উঠে কী খায়? সন্ধেবেলায় কী করে? আজকে পটি করেছে কি না? বলতে পারবে?’’

‘‘আচ্ছা, আচ্ছা। আবার শুরু কোরো না। আমি ক্রেশে ফোন করছি। তুমি ও দিকটা দ্যাখো। যদি ম্যানেজ করতে পারো। ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলে দেখো না যদি বাড়িতে রেখে ট্রিটমেন্ট করা যায়! তা হলে আর কাউকে ছুটি নিতে হবে না।’’

চৈতি আর কথা বাড়াল না। বাবার দিকে এগিয়ে গেল।

******

বাবার হাতটা ধরে ফেলল, ‘‘আর একটু হলেই তো পড়ে যেতে।’’

ভিজ়িটিং আওয়ারে মায়ের সঙ্গে দেখা করে নীচে নামছিল ওরা। লিফ্‌টের বাইরে পা রাখতে গিয়ে হোঁচট খেলেন অবন।

তিনি হাতটা ছাড়িয়ে এগিয়ে গেলেন, ‘‘কিচ্ছু হবে না।’’

নীচে নেমে পিছন ফিরে বললেন, ‘‘তুই বরং তুয়াকে নিয়ে বাড়ি চলে যা। আমি ডাক্তারের সঙ্গে কথা 

বলে ফিরব।’’

‘‘আমিও দেখা করব।’’

‘‘আরে! তোর কোনও দরকার নেই তো!’’ বিরক্ত হলেন অবন, ‘‘আমি কথা বলে চলে যাব। বেকার তুয়াকে নিয়ে এত ক্ষণ বসে থাকবি কেন? দেখছিস তো মেয়েটা কেমন ঘুমিয়ে পড়ছে। সারা দুপুর হাসপাতালে, ও আর পারে?’’

‘‘আমি দেখা করেই যাব,’’ জেদ ধরে বসে থাকে চৈতি।

ডাক্তারের ঘরে ডাক পড়ে অবনের।

পিছন-পিছন ঘুমন্ত মেয়েকে কোলে নিয়ে ঢোকে চৈতি।

ডাক্তারবাবু রিপোর্ট দেখে বলেন, ‘‘ভাঙেনি। হালকা মচকেছে। তবে লিগামেন্ট ছিঁড়েছে। বয়স হয়েছে তো! ক’দিন বিশ্রাম নিতে হবে।’’

অবন ঘোলাটে চোখে ডাক্তারের দিকে তাকিয়ে থাকে, ‘‘তাও কত দিন?’’

তার আগেই মেয়ের গলা অবনের স্বরকে ছাপিয়ে যায়, ‘‘হাসপাতালে কি ভর্তি থাকতে হবে? বাড়িতে রাখা যাবে না?’’

ডাক্তারবাবু হাতের এক্স রে প্লেটগুলো নামিয়ে রাখলেন, ‘‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, কালকে সকালেই বাড়িতে নিয়ে যেতে পারেন। বাড়িতে শুয়ে থাকলেই চলবে।’’

চৈতি হাঁপ ছেড়ে বাঁচল। অবন আরও কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন। কিন্তু মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে আর বলতে পারলেন না। ডাক্তারের ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বললেন, ‘‘তুই বাড়ি যা। আমি এক বার তোর মায়ের সঙ্গে দেখা করে আসি।’’

‘‘ঠিক আছে, আমি বসছি। এক সঙ্গেই যাব।’’

‘‘না, তুই যা,’’ দৃঢ়কণ্ঠে কথাটা বলে আর দাঁড়ালেন না অবন। কাঁপা-কাঁপা পায়ে এগিয়ে গেল লিফ্‌টের দিকে। 

অবনের টি-শার্টের হাতা দিয়ে হাত দু’টো শরীরের দু’পাশে ঠিক সামঞ্জস্য রেখে ঝুলতে পারছে না। একটা আগে-পরে করে এগিয়ে চলেছে। চৈতির সে দিকে তাকিয়ে হঠাৎ যেন মনে হল হ্যাঙারে যখন ও দীপের শার্টগুলো কেচে মেলে দেয়, ঠিক এ ভাবেই হাওয়ায় ওড়ে। একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ছেড়ে সে মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধরল...

******

চিত্রার ঘরের দরজাটা ঠেলে ঢুকলেন অবন। 

চিত্রা হেলান দিয়ে শুয়ে ছিলেন। নড়েচড়ে উঠল, ‘‘কী গো! ডাক্তারবাবু কী বললেন?’’

বৌয়ের দিকে পরাজিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন, ‘‘কাল 

ছেড়ে দেবে।’’

চিত্রারও মুখটা করুণ হয়ে গেল, ‘‘কালই? ইস! প্রাইভেট রুমটা বুক করার দরকার ছিল না। কতগুলো টাকা গুনতে হবে তোমায় শুধু-শুধু।’’

‘‘আমি তো ভেবেছিলাম একটা সপ্তাহ থাকব। সুনীতা আসছে না, রান্নার লোকও জোগাড় হয়নি। বাড়ি গেলে তোমারই তো খাটনি। এখানে থাকলে তোমার রেস্ট হত। আমিও একটু বিশ্রাম নিতে পারতাম। খাওয়ারও ঝামেলা নেই। কিন্তু বুড়ি যে ডাক্তারকে সোজাসুজি জিজ্ঞেস করে বসল।’’

‘‘তুমি ওকে নিয়ে গিয়েছিলে ডাক্তারের কাছে?’’

‘‘কী করব? ও কিছুতেই শুনল 

না যে!’’

দু’জনেই দু’টো গভীর দীর্ঘশ্বাস গিলে নিলেন। চিত্রা পড়ে গিয়েছিল ঠিকই, কিন্তু অতটাও যে লাগেনি সেটা জানতেন। একটা সপ্তাহ সংসার থেকে ছুটি পাওয়া যাবে ভেবেই পুরো পরিকল্পনাটা করেছিলেন অবন। ভেবেছিলেন ডাক্তারকে বলে এক সপ্তাহ অ্যাডমিশন করিয়ে নেবে প্রাইভেট রুমে। তা হলে স্ত্রীর সঙ্গে তাঁরও থাকা-খাওয়ার বন্দোবস্ত হয়ে যাবে। কিন্তু সংসার থেকে বুঝি ছুটি নেই তাঁদের!

ওয়ার্ড বয় এসে দরজায় টোকা মেরে গেল, ‘‘আপনি কি থাকবেন? না হলে পেশেন্টকে এখনই আমরা ডিনার দিয়ে দেব।’’

এক রাতের জন্য এখানে থেকে আর লাভ কী! 

অবন উঠে আস্তে-আস্তে লিফ্‌টের সামনে এসে দাঁড়ালেন। তাঁর পাশেই এসে দাঁড়িয়েছে আর একটি পরিবার। বয়স্ক মহিলার কোলে সদ্যোজাত ঘুমন্ত শিশু আর তার পাশে ব্যাগ হাতে তারই মতো আর এক জন ভদ্রলোক, তাদের পিছনে কমবয়সি  এক দম্পতি।

অবনের দিকে তাকিয়ে ভদ্রলোক হাসলেন, ‘‘মেয়ের ঘরের নাতি। আজকে ছেড়ে দিয়েছে। বাড়ি 

নিয়ে যাচ্ছি।’’

অবনের মুখে একটা করুণ হাসি ছড়িয়ে গেল, ‘‘ভাল থাকবেন নাতিকে নিয়ে।’’

লিফ্‌ট-এর দরজাটা খুলতেই সকলে তড়িঘড়ি ঢুকে গেল ওই ছোট্ট নিশ্ছিদ্র ঘরটায়। সকলের শেষে দাঁড়িয়ে অবন। দৃষ্টি সদ্যোজাতের দিকে, মুখে সেই করুণ হাসি। অবন জানেন, এ বার ওরা সকলে এক সঙ্গে খুব তাড়াতাড়ি নীচে নেমে যাবে...

এবার শুধু খবর পড়া নয়, খবর দেখাও। সাবস্ক্রাইব করুনআমাদেরYouTube Channel - এ।