যারা এসেছিল, তারা একে একে সবাই চলে গিয়েছে। কেমন নিস্তব্ধ হয়ে আছে বাড়িটা। হইচইয়ের পর নির্জনতাবোধ আরও বেশি করে পেয়ে বসে। কেবল ঝিঁঝিঁপোকাই ডেকে যাচ্ছে। একটানা। ভরা পূর্ণিমা। চাঁদের আলোর বান ডেকেছে চার পাশে। হাসছে বসুন্ধরা। এত আলো, যে সামনের গাছপালার সবুজও বোঝা যাচ্ছে। প্রতি পূর্ণিমাতেই অনেকে আসে। কেউ চন্দ্রাণীর চেনা, কেউ অগ্নির। কেউ নতুন করেই চেনা হয়।
পূর্ণিমা-আসরে প্রতি পূর্ণিমাতেই স্বরচিত কবিতা পাঠের আসর বসে। আজও বসেছিল। চেনাজানা বন্ধুবান্ধব এসেছিল। হইহুল্লোড় হল, সঙ্গে কবিতা পড়া। চন্দ্রাণী আজ অনেক কবিতা পড়েছে। নতুন লেখা। জ্যোৎস্না-প্লাবিত বসুন্ধরার বুকে ছোট্ট এক খণ্ড খোলা ছাদে দাঁড়িয়ে নিজের কবিতা পাঠের কথা মনে পড়ে, হাসি পেল চন্দ্রাণীর। তবুও সে লিখে যাচ্ছে। এত সমস্যা ও অভাবের মধ্যেও।
পাশ ফিরে, ছাদের অন্য প্রান্তে দাঁড়িয়ে নির্বিকার সিগারেট টানতে দেখা যাচ্ছে অগ্নিকে। কিছু ক্ষণ আগেই রাতের খাওয়া সেরেছে। খালি গা অগ্নির। পায়জামা পরা। নির্লিপ্ত অন্যমনস্কতায় ধোঁয়া ছেড়ে যাচ্ছে। সারা দিনে এই একটি বার, একটিই সিগারেট খায় ও। এমনিতে নেশা নেই। অগ্নির ভুঁড়িটা একেবারেই কমে গিয়েছে। যদিও তেমন ভাবে ছিল না কোনও দিনই। মাঝখানে একটু বোঝা যাচ্ছিল। সে দিকে চেয়ে চন্দ্রাণীর মনে পড়ল, কত দিন শরীরী সম্পর্ক হয়নি ওদের। অথচ একই ছাদের নীচে রাতের পর রাত কাটছে। এটাই যেন অভ্যেস হয়ে গিয়েছে এখন।
প্রতিদিনের মতো কালও ভোরে বেরিয়ে পড়বে অগ্নি। সারা দিন হন্যে হয়ে ঘুরে ঘুরে রাতে ফিরে আসবে। পেশা, অন্নসংস্থানের নিরুপায় প্রচেষ্টা মানুষের শিল্পবোধ ও সৃষ্টিশীলতা যে কতটা কেড়ে নিতে পারে, অগ্নি তার উদাহরণ। চন্দ্রাণী লক্ষ করে, ইদানীং অগ্নি একদমই লিখছে না। লেখার চেষ্টাও করে না। অথচ একটি কবিতার জন্য অগ্নি কেমন ছটফট করত, চন্দ্রাণী তো দেখেছে! অন্ধকার রাস্তায় বেরিয়ে পড়ত, সারা রাত উন্মাদের মতো ঘুরে ঘুরে ভোরবেলায় ফিরত মাথা-ভর্তি শব্দের সম্ভার নিয়ে। এসে লিখতে বসত। যত ক্ষণ চাইত, লিখত। চন্দ্রাণী বিরক্ত করত না একটুও। হাটবাজার নিজেই সামলে নিত।
তবু অভাব তো মেটেনি। আজ কাটল, কাল কী হবে, চিন্তা করতেই হয়। চন্দ্রাণী নাচ জানে। একটা নাচের স্কুল খুলেওছিল, কিন্তু এই প্রত্যন্ত পল্লিতে তা চলেনি। কয়েকটা টিউশনি আছে, বাড়ি গিয়ে পড়াতে হয়।
অগ্নি যাযাবর। বোহেমিয়ান। কোথাও থিতু হওয়া তার স্বভাবে নেই। পুরুষরা এমনই। নারীই পুরুষকে ঘর বাঁধা শিখিয়েছে।
চন্দ্রাণী যেন নদীর নীচে জমে ওঠা কোনও গোপন চর, আর তাতেই পালহীন, মাঝিহীন, লক্ষ্যহীন অগ্নি নামক এক নৌকো আটকে গিয়েছে। চন্দ্রাণী মনে মনে কষ্ট পায়। অগ্নির জন্য খারাপ লাগে। অথচ চন্দ্রাণীরও একটু আশ্রয়ের প্রয়োজন ছিল। উত্তাপের দরকার ছিল।
অতীতকে ছাড়তে চাইলেও সে ছাড়ে না সহজে। খারাপ হলেও, যন্ত্রণার হলেও সেই অতীত নিয়েই মানুষ বাঁচে। পুরোপুরি মোছেও না কখনও। সেই বিবাহিত জীবনে ছিল শুধু অত্যাচার, অবিচার, লাঞ্ছনা। সে এক দীর্ঘ যন্ত্রণাপর্ব। জ্বলন্ত মোম গায়ে ফেলে, সিগারেটের আগুন ছুঁইয়ে স্বামী তাকে লালসায় পুড়িয়েছে।
রূপসী নয় চন্দ্রাণী। কিন্তু আর কোনও দিকে ঘাটতি ছিল না তার। না শরীরে, না মনে। পালিয়ে না এলে অনেক দিন আগেই খুন হয়ে যেত সে। প্রথমে ভেবেছিল, পালিয়ে এসে বাঁচল বুঝি! বেঁচে গেল ঠিকই, কিন্তু পেটে এসে গেল সন্তান। তীব্র ঘেন্নায় নষ্ট করে ফেলতে চেয়েছিল ভ্রূণ। পারেনি। মাতৃত্বের দাবির কাছে হার মেনে কন্যাসন্তানের জন্ম দিয়েছে সে।
অগ্নি এসেছে অনেক পরে। উন্মাদের মতো। একমুখ অযত্নের দাড়ি। দু’চোখের দৃষ্টি বহু দূরের কোনও গন্তব্যে। অথচ অজানা। সাহিত্যবাসর থেকেই পরিচয়। চার পাশে এত জনঅরণ্য, সেখানে একা বাস করা খুবই কষ্টের। অগ্নির সঙ্গে পরিচয় হওয়ার পর থেকে কষ্টটা টের পেতে শুরু করল চন্দ্রাণী।
মেয়েরা হল আশ্রয়। ক্লান্ত পথিকের কাছে স্নিগ্ধ ছায়াদানকারী গাছের মতো। এই উপলব্ধি ছুঁয়েছিল অগ্নিকেও। পিছনের সব টান ফেলে চন্দ্রাণীও যাযাবরের সঙ্গে বেরিয়ে পড়েছিল। সঙ্গে চন্দ্রাণীর মেয়ে রয়েছে তার অতীত হয়ে।
দু’-তিন বছরের মধ্যে কত বার যে বাড়ি বদল করেছে অগ্নি, তার হিসেব নেই। ওর ভাল লাগে না এক জায়গায় বেশি দিন থাকতে। চন্দ্রাণীরও সয়ে গিয়েছে। কোনও পরিবেশেই মনের শিকড় সহজে গেঁথে যায় না আর।
শহর থেকে দূরে এই প্রান্তিক ভূমিতে অবশেষে দু’কাঠা জমি নিল অগ্নি। খুশি হয়েছে চন্দ্রাণী। এই বিরাট পৃথিবীতে তাদেরও নিজেদের মতো এক খণ্ড দাঁড়ানোর জায়গা হল ভেবে। হোক স্বজন ছেড়ে থাকা। হোক প্রতিবেশীহীন বসবাস। তবুও তো নির্জনতা থাকবে।
নিজের যা সম্বল ছিল, তা দিয়ে কোনও রকম একটা ঘরবারান্দা আর ছাদে ওঠার সিঁড়ি হল। ভিতরে বাইরে প্লাস্টার পর্যন্ত হয়নি। হোক, তবুও তো নিজের। ঘিঞ্জি এলাকার ভাড়াবাড়ির চেয়ে ঢের ভাল। চার পাশে ফসলের মাঠ। যত দূর চোখ যায়, দিগন্তবিস্তৃত ধান খেতের বিন্যাসে সবুজ হয়ে থাকে। দূরে গাছের সারিতে বড় সড়কের আভাস আন্দাজ করা যায়। একটু একটু করে পরিবেশের সঙ্গে নিজেকে একাত্ম করে নিয়েছে চন্দ্রাণী। এরই মধ্যে কাছাকাছি দু’-এক জন মানুষের সঙ্গে আলাপও হয়েছে ওদের। মেয়েকে স্কুলেও ভর্তি করে দিয়েছে। অগ্নি আগের মতোই আছে। মাঝে মাঝে চন্দ্রাণীকে কিছু না জানিয়েই বেপাত্তা হয়ে যায় এখনও। ফিরতে মাস পেরিয়ে যায়। সেই সময় চন্দ্রাণীকেই চালাতে হয় সংসার। সময় হলে অগ্নি ফিরে আসে। চন্দ্রাণী ওর এই যাযাবরি উপভোগ করে। জানে, যেখানেই সে যাক, ফিরে আসবে ঠিকই। এই ফিরে আসাটুকুই কেবলমাত্র পরিবর্তন অগ্নির যাযাবর জীবনে। তবে এখানে আসার পর বেপাত্তা হয়ে থাকার প্রবণতাও কিছুটা কমে এসেছে। এরই মধ্যে এক দিন সকালে, অগ্নি বাড়ি ছিল না, এক জন মানুষকে উঠোনে এগিয়ে আসতে দেখল চন্দ্রাণী। দেখামাত্রই সারা গায়ে শিহরন বয়ে গেল ওর। অজান্তেই মুখ এসে গিয়েছিল, ‘‘তুমি?’’
মানুষটি ওর প্রাক্তন স্বামী। এক লহমায় সমস্ত মুহূর্ত মনে পড়তে লাগল। দ্রুত নিজেকে সংযত করে নিল চন্দ্রাণী। মানসিক দৃঢ়তা বোঝাতে চোয়াল শক্ত করে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে মানুষটিকে বুঝে নিতে চাইল। লোকটিও শান্ত, নির্বিকার। ভীষণই মাত্রাজ্ঞান সচেতন যেন। কোনও রকম অনধিকার চর্চায় না গিয়ে মেয়ের কাছে এসে বসল। মেয়ে শুয়েছিল। চন্দ্রাণীর মুখ থেকেই শুনল পরশু থেকে ওর জ্বরের কথা এবং জানতে চাইল, কোনও ওষুধপত্র দিয়েছে কি না। এই রকমই দু’-একটি কথার পর উঠে এসেছে মানুষটি। তার এমন আচরণে ভীষণ অবাক হয়েছে চন্দ্রাণী। অতীতের সেই মানুষ নিজেকে এত পালটে নিয়েছে! না কি পুরোটাই নকল! অভিনয়!
মুখ আর মুখোশের পার্থক্য খুঁজতে চেয়েছে চন্দ্রাণী অনেক বার। এত দিন পরে মানুষটির আসার কারণ খুঁজে পায়নি সে। মাথার ভিতর অযথা যন্ত্রণা তৈরি হয়েছে। অগ্নির কোনও চাকরি নেই, লেখাটাই সম্বল ছিল। তাকে নিয়ে এত অভাবের মধ্যেও মুক্তির যে আনন্দ পেয়েছিল, তা যেন মুহূর্তে ম্লান হয়ে গেল। হাওড়া থেকে এসেছিল অরিজিৎ, বিদ্যুৎ, বিকাশ, সুনেত্রা, সুজিতদা। কলকাতার বেলাদি, দীপশিখা, অরিত্র, সোম। খড়দহ থেকে নির্মলেন্দু, আরও অনেকে এসেছিল কবিতা পাঠে। পূর্ণিমা আসরে। সবাই বলল, বাড়ির সামনে সবুজ ঘাসের ছোট মাঠটাতেই বসা হোক। সেখানেই পাতা হল শতরঞ্চি। ঠিক তার পর থেকেই ধানখেতের শুরু। কবিতা পাঠ চলতে চলতে কখন যে বিকেল ফুরিয়ে গিয়েছে, খেয়ালই করেনি কেউ। আসলে পূর্ণিমায় সন্ধেটা অনেক সময় ঠিক আঁচ করা যায় না। ধানখেতের মধ্য থেকে দুটো বক উড়ে গেল একেবারে কবি সম্মেলনে সম্মিলিত কবিদের মাথা ছুঁয়ে। ডানার বাতাস মুখে লাগতেই চন্দ্রাণীর সংবিৎ ফিরল। ঘর থেকে আলো নিয়ে এল। হ্যারিকেনের হলুদ আলোর সঙ্গে মাখামাখি হয়ে গেল চাঁদনি। কবিদের মুখগুলো কেমন যেন ধাতব মূর্তির মতো লাগছিল।
আসর শেষে ওরা সবাই চলে গেল। অগ্নি স্টেশনে এগোতে গিয়েছে। এই সময় এসেছে মানুষটি। আবার। চন্দ্রাণী সোজাসুজি চোখ রেখে জিজ্ঞেস করেছে, ‘‘কেন এখানে আসেন আপনি? আমাদের শান্তি বিঘ্নিত হয়। অতীতের কোনও কিছু মনে করতে চাই না আর।’’
মানুষটি নিঃশব্দে মাথা নিচু করে বসেছিল। চন্দ্রাণী বসতেও বলেনি। নিজেই বসেছে। কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলেছে, ‘‘আমি বালিগঞ্জে ফ্ল্যাট নিয়েছি চন্দ্রাণী।’’
চন্দ্রাণীর রাগ আরও বেড়েছে, বলেছে, ‘‘তাতে কী হল?’’
মানুষটি এ বার মুখ তুলে বলেছে, ‘‘এখানে কী আছে! আলো নেই, পাখা নেই, অজ পাড়াগাঁ। এত অভাবের মধ্যে আছ…’’
চন্দ্রাণী কোনও কথা বলতে পারেনি। রাগে, বিস্ময়ে, কিছুটা অভিমানেও। কিন্তু অভিমানের উপলব্ধিটাকে পাত্তাই দিতে চাইল না ও। অভিমানের আড়ালেই কি আপসের ইচ্ছে জন্ম নেয়!
মানুষটি বলেই চলেছে, ‘‘অনেক খুঁজেছি তোমাদের। অনেক দিন ধরে। আমায় ভুল সংশোধনের সুযোগ দাও। আমার সঙ্গে ফিরে চলো।’’
উত্তর দিতে ইচ্ছে করল না চন্দ্রাণীর। নিজেই বলে যাচ্ছিল মানুষটি, ‘‘সিঁদুর মুছে ফেলে, আর পরোনি। অথচ এক জনের সঙ্গে সংসার করছ। আমাদের কিন্তু মন্ত্র পড়ে বিয়ে হয়েছিল। সেটাই ঠিক।’’
শেষের কথাগুলো অপমানের মতো বিঁধছিল। অবশেষে বলতে বাধ্য হল, ‘‘আপনি অযথা চেষ্টা করছেন। ভুল সংশোধনের আর জায়গা নেই।’’
‘‘তোমাকে এক্ষুনি, এই মুহূর্তে সিদ্ধান্ত নিতে বলছি না। প্রত্যেককেই তার ভাবনার জন্য সময় দিতে হয়…’’
মানুষটি চলে গিয়েছে। রেখে গেছে কথাগুলো। নিস্তব্ধতা খানখান করে কথাগুলো বার বার ফিরে আসছে। অসহ্য যন্ত্রণার মুহূর্ত। হৃদয় দিয়ে গড়া শান্তির নীড়ে যেন একটা সাপ ঢুকে পড়েছে। রাতে খেতে খেতে কথাগুলো বলল অগ্নিকে।
অগ্নি মন্তব্য করেনি। শুনেছে। সেই জন্যই আরও অস্বস্তি হচ্ছে। ওর বক্তব্যটা জানা দরকার। কিন্তু ও অগ্নিকে জানে, এ ব্যাপারে হাজার জোর করলেও ও কিচ্ছু বলবে না। অগ্নি কোনও দিন শুনতেও চায়নি চন্দ্রাণীর পূর্বতন স্বামী, সংসারের কথা। চন্দ্রাণীই শুনিয়েছে।
এই চন্দ্রালোকিত রাতে ছাদে এসে চিন্তার আঁকাবাঁকা গলি থেকে বেরিয়ে আসতে চাইল ও। মানুষ এমনিই ভুলে যায়। ভোলার চেষ্টা করলেই বরং মনে গেঁথে যায় আরও। চন্দ্রাণীরও তাই তাই হচ্ছে। হাজার দুশ্চিন্তা মাথায় জমা হতে থাকল।
ছাদের উপর দু’প্রান্তে দাঁড়িয়ে দুজন। নিঃশব্দ। ঘরে ঘুমোচ্ছে চন্দ্রাণীর মেয়ে। চন্দ্রাণীরই মেয়ে। অগ্নিকে সে প্রথম থেকেই কাকু বলে ডাকে। চন্দ্রাণী চেয়েছিল। অগ্নিও বলেছে, ‘‘থাক না। দরকার কী, ও যে ভাবে প্রথম থেকে ডেকেছে, সে ভাবেই ডাকুক।’’
মেয়ে যখন বড় হবে, এই সত্যি তাকে জানাতেই হবে। চন্দ্রাণীই নিজে থেকে জানাবে। অগ্নি কেন ওর বাবা হয়ে থাকবে, অগ্নি নিজেও চায়নি যখন। অবশেষে সত্যিকে তার নিজের নিয়মে চলতে দিয়েছে দুজনেই।
অগ্নি-চন্দ্রাণীর কোনও বৈবাহিক আচারের প্রয়োজন হয়নি। মনের সমঝোতাকেই প্রাধান্য দিয়েছে পরস্পর। কিন্তু মানুষটি ওদের এই অবস্থান সম্পর্কে বিশ্রী ইঙ্গিত করে গেল। চন্দ্রাণীর বুকে ভেঙে থাকা কাঁটার মতো যন্ত্রণা চিনচিন করে উঠল। অগ্নি বিশ্বাস করে না, নারী-পুরুষ এক সঙ্গে থাকতে হলে বৈবাহিক আচার-অনুষ্ঠানের আদৌ প্রয়োজন আছে। চন্দ্রাণীও ওর এই বিশ্বাস স্বীকার করে নিয়েছিল। কিন্তু এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে ভীষণ দরকারি ওইটুকু সংস্কারও। ওদের এই বসবাস আইনের চোখেও স্বীকৃত নয়। অথচ অগ্নি এ ব্যপারে সম্পূর্ণ উদাসীন। ইচ্ছাকৃত ভাবেই। কাজেই চন্দ্রাণীকে একাই ছুটতে হবে উকিলের কাছে। তারই পরামর্শে কাগজ তৈরি করতে হবে। সময় মতো হাজিরা দিতে হবে। সব দিক সামলে, তার পক্ষেও
কি সম্ভব!
মানুষটি সহজে ছেড়ে দেবে না নিশ্চয়ই। এত দিন পর ঠিক খুঁজে খুঁজে বার করেছে। সোজা পথ ছেড়ে বাঁকা পথে নামতেও ওর দ্বিধা হবে না এতটুকুও। বিপদে পড়ে যাবে অগ্নি। যদিও চন্দ্রাণী জানে, অগ্নি বিন্দুমাত্র বিচলিত নয় এতেও। তবু তার জন্য অগ্নির বিপদ বাড়ুক, চন্দ্রাণী চায় না। অগ্নির এই উদাসীন ভাবটি ভীষণ অসহ্য লাগছে চন্দ্রাণীর। উত্তেজনায় এ পাশে অগ্নির কাছে ছুটে এল ও। বাহ্যিক ভাবে অগ্নিকে উদাসীন মনে হলেও ওর উপলব্ধি যথেষ্ট গভীর। চন্দ্রাণীর মনের অবস্থা ও আন্দাজ করে নিতে পারে। অনেক দিন পর ইচ্ছে হল একটু আদর করতে। চন্দ্রাণীও সেই মুহূর্তে অগ্নির সুঠাম বাহুর ডোরে সহজেই কুঁকড়ে যেতে লাগল। টুকরো একটি মেঘও সরে গিয়ে আলোর তীব্রতা হঠাৎই বাড়ল যেন। আলোর বন্যায় পৃথিবীর মাটি ধুয়ে যাচ্ছে। তীব্র ভাল লাগায় কেঁপে উঠল চন্দ্রাণী। অনেক ক্ষণ সেই ভাললাগার উপলব্ধিতে স্তব্ধ থেকে স্বাভাবিক হয়ে আসতে আসতে চন্দ্রাণীই প্রথমে শুরু করল, ‘‘এখানে আর এক মুহূর্তও থাকতে ইচ্ছে করছে না।’’
অগ্নির লোমশ বুকে শৈল্পিক ভঙ্গিমায় চন্দ্রাণীর হাত ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছে তখনও।
অগ্নি বলল, ‘‘কোথায় যাবে?’’
চন্দ্রাণী বলল, ‘‘কোথাও না, আর কোথাও নির্দিষ্ট করে থাকব না। যেখানে যত দিন ভাল লাগবে… ভাল না লাগলে, আবার অন্য কোথাও।’’
‘‘যাযাবরের মতো?’’
‘‘হুম।’’
চন্দ্রাণী আর কোনও কথা বলল না। অগ্নির বুকে মুখ গুঁজে দিল।
ঠিক সেই মুহূর্তেই চাঁদ গিয়ে দাঁড়াল একটি মেঘের আড়ালে।