আজ বাড়িতে মিটিংটা সাকসেসফুলই হয়েছে বলতে হবে।
অনিকেত ভীষণ খুশি। থেকে থেকেই বেসুরো গলায় গেয়ে উঠছে— আজ ম্যায় উপর/ আসমা নীচে… বার বার বলছে, ‘‘চল ইন্দু, সেলিব্রেট করি! সবই তোর ভেটকি পাতুরির কামাল! নিদেনপক্ষে তোর প্রিয় চেলো কাবাব হয়ে যাক!’’
ইন্দ্রাণীকে জড়িয়ে ধরে কাঁধে মুখ ডুবিয়ে দিল অনিকেত। ইন্দ্রাণী কেন যে এতটা খুশি হতে পারছে না! খুশির অভিনয়টাও ঠিকমতো হচ্ছে না যেন। আজকের দিনটা তাকে বড্ড উথালপাথাল করে তুলেছে… আজ সৌগতকে মনে পড়ছে খুব।
সৌগত যে দিন ছেড়ে গেল ইন্দ্রাণীকে, এত দিন পর বড্ড মনে পড়ছে সে দিনটার কথা। তিন বছরের একটা সম্পর্ককে কেমন করে ছিঁড়ে ফেলেছিল সৌগত। রাগ নয়, ঝগড়া নয়, কিছুই ছিল না সে দিনটায়, তবু ভেঙে গেল সম্পর্কটা। সে দিনই সিদ্ধান্ত নিল সৌগত, আর দীর্ঘায়িত করবে না সম্পর্কটাকে।
অনেক কারণ নিশ্চয়ই ছিল, তবু শেষ কারণটিই যে একমাত্র অসহনীয় ছিল, তা কিন্তু নয়। ইন্দ্রাণী যে এই রকমই, তা কি জানত না সৌগত? সৌগতর বাড়ি যাওয়ার কথা ছিল, কিন্তু ক্যামেরা ঘাড়ে করে চলে গিয়েছিল রূপান্তরকামীদের অনুষ্ঠানে। যখন সৌগতদের বাড়ি গিয়ে পৌঁছল, সন্ধে গড়িয়ে গিয়েছে। গায়ের টপটা যেন কিসে খোঁচা লেগে ছিঁড়ে গিয়েছে। সৌগতর মা তো ভাল করে কথাই বললেন না। ব্যারিস্টার বাবা বললেন, ‘‘বোসো, এত রাতে এ ভাবে এলে, বাড়িতে কিছু বলবে না?’’ বলে উত্তরের অপেক্ষা না করেই চেম্বারে চলে গেলেন। সে দিন ইন্দ্রাণী ফিসফিসিয়ে ‘স্যরি’ বলেছিল সৌগতকে। তবে ওই শব্দটার আর কোন গুরুত্ব সৌগতর কাছে ছিল না। সেটা বোঝা গেল পরে। কিন্তু ও কি জানত না, ওর ছবি কত এগজ়িবিশনে যায়! কত পুরস্কার পায়! এটা যদিও ওদের কাগজের অফিসের তরফ থেকেই যেতে হয়েছিল, হঠাৎ ঠিক হয়েছে বলে সৌগতকে জানানো যায়নি। আসলে, গৌতমদা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে গেল বলে বাধ্য হয়েই ওকে যেতে হয়েছিল। কিন্তু এ সব কিছুই বলা হল না সৌগতকে। অবশ্য ওকেই বা ইন্দ্রাণী দোষ দেয় কী করে! ইন্দ্রাণী তো অনেক বারই কথা রাখতে পারেনি। বলেছিল, লাল সালোয়ার-কামিজ়ে সেজে সৌগতর সঙ্গে সিনেমা যাবে। সিনেমা শুরু হয়ে যাবার পর দৌড়তে দৌড়তে যখন এল, পরনে সেই এক জিন্স! কী না, পাড়ার কার কুকুরের হঠাৎ শরীর খারাপ, বেলেঘাটায় যেতে হয়েছিল, নইলে মরেই যেত বেচারা। ইন্দ্রাণী হাত জড়িয়ে ধরে ‘স্যরি’ বলতেই ঝটকা দিয়ে হাত সরিয়ে টিকিট ছিঁড়ে ফেলে দিয়েছিল সৌগত। দাঁতে দাঁত চেপে বলেছিল, ‘‘হাততালি কুড়োতে খুব ভাল লাগে, তাই না?’’
ইন্দ্রাণী বলেছিল, ‘‘তুমিও তো সে দিন আসবে বলে আসতে পারোনি, বন্ধুদের হঠাৎ আড্ডায় যোগ দিতে চলে গেলে, আমি তো রাগ করিনি, বলো! তুমি আগে জানতে, তবু ভুলে গিয়েছিলে! আমি সেই কোন বারাসাত থেকে এসে অপেক্ষা করেছিলাম… আমি কি রাগ করেছি, বলো?’’
‘‘তুলনা হচ্ছে? তুলনা?’’ হিসহিসিয়ে কথাগুলো বলেই দ্রুত পায়ে হেঁটে রাস্তা পেরিয়ে চলে গিয়েছিল সৌগত। ইন্দ্রাণী অবাক হয়ে ভাবছিল, এই লোকটার সঙ্গেই তো বাউল-ফকির মেলায় প্রথম দেখা হয়েছিল। ছবি তুলতে না তুলতেই স্ক্রিনে সেই ছবি দেখার জন্যে ব্যস্ত হয়ে উঠছিল। ইন্দ্রাণীর এই অসাধারণত্বে আকৃষ্ট হয়েই প্রেম নিবেদন করেছিল সৌগত, অন্তত সে দিন ও সেটাই বলেছিল। কী ভাল গান গায় সৌগত! গানে গানেই ভালবাসার প্রকাশ করেছে কত বার। ইন্দ্রাণীও ভাল তবলা বাজাত, স্কুলের ফাংশনে বরাবর বাজিয়েছে। ও মা! সৌগত যখন জানতে পারল সে কথা, কী হাসি! বলেছিল, ‘‘মেয়েরা তবলা বাজালে কেমন যেন পুরুষালি হয়ে যায়।’’ যেন তবলা বাজানো পুরুষেরই একচ্ছত্র অধিকার, ইন্দ্রাণী সেখানে অনুপ্রবেশকারী!
হুঁহ্! সে দিনই রাতে এসে তবলা বাজাতে বসেছিল, অনেক দিন পরে। মা আন্দাজ করেছিল কষ্টের গন্ধ, বলেছিল, ‘‘এমন দুমদাম বাজাচ্ছিস! কারও সঙ্গে রাগারাগি করে এলি বুঝি? তোর যে কী হবে ইনা! শ্বশুরবাড়িতে একটা দিন টিকতে পারলে হয়। মেয়েদের কত সহ্য করতে হয়! পইপই করে বলেছিলাম তোর বাবাকে, গান-নাচ শেখাও মেয়েকে! তা নয়, মেয়ে কোন গুঁড়ি বয়েসে কাঠি দিয়ে তালে তালে ড্রাম পিটত, তাই তালবাদ্য শেখাতে হবে! সবেতে বাড়াবাড়ি! বাপের আদিখ্যেতাতেই …’’
তিনটে বছরের শেষ দু’বছর ভুল বোঝাবুঝিতেই কাটছিল। কত যে চাওয়া আর কত যে না দিতে পারা! ইন্দ্রাণী একটা পত্রিকায় কাজ করত, সে কাজ না-পসন্দ সৌগতর। তেমন নামী পত্রিকা তো নয় যে, চাকরি করতেই হবে! রোজগার করার ইচ্ছে থাকলে সৌগতদের পারিবারিক ব্যবসায় যোগ দিতে পারে! এমন একটা কাজ, যার সময়-অসময় নেই, সে কাজ করার দরকার কী ইন্দ্রাণীর! ইন্দ্রাণীই বা কী করত! ও ছেড়ে গেলে অপূর্বাদি একেবারে অসহায় হয়ে পড়ত না! হঠাৎ সুমনদার ক্যান্সার, তার পর কয়েক মাসেই সব শেষ! পুপু তখন ছোট। সুমনদাকে কথা দিয়েছিল, অপূর্বাদির পাশে থাকবে… সবই তো জানে সৌগত, তবু কেন যে কথা শোনায়!
তবু চাওয়া আর না-পাওয়া নিয়ে চলছিল। কিন্তু যে দিন ওদের বাড়িতে যেতে দেরি হল, তার চেয়েও বড় কথা, যে কারণে দেরি, সেই কারণটাই সৌগতকে সবচেয়ে বিমুখ করে তুলল। পনেরো দিন ভাবনাচিন্তা করার সময় দিয়ে এবং নিয়ে জানিয়ে দিল, এই সব ছন্নছাড়া চালচলন ত্যাগ না করলে সে আর ইন্দ্রাণীর সঙ্গে থাকতে পারবে না। ইন্দ্রাণীও অবাক হয়ে ভাবল, যে ধরনের কাজকর্ম এক দিন তাকে বাকিদের চেয়ে আলাদা করে তুলেছিল, সেই কাজগুলোই আজ ‘ছন্নছাড়া’!
সৌগত বুঝেছিল, এ মেয়ে সংসার করার উপযুক্ত নয়। ইন্দ্রাণীও বুঝেছিল, ভাল বৌ সে কখনওই হতে পারবে না, অন্তত সৌগত যেমনটি চায়। তাই বন্ধুত্বে ইতি, সম্পর্কে পূর্ণচ্ছেদ। সে বিচ্ছেদে কষ্ট ছিল বটে, তবে আক্ষেপ ছিল না কারও।
সৌগত-বিহীন জীবনটার সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে কাগজের অফিসটায় সর্বস্ব নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল ইন্দ্রাণী। হইচইপূর্ণ সে জীবনের মনখারাপ করা কোনও ভোরে বা ক্লান্তি-মাখা কোনও সন্ধ্যায় সৌগত যে কখনও এসে দাঁড়ায়নি, তা নয়। তবে সুন্দরী বৌয়ের সঙ্গে তার প্রোফাইল পিকচার দেখে হাতের উল্টো পিঠে মনখারাপ মুছে ফেলেছে ইন্দ্রাণী।
এর মধ্যেই কখন অনিকেত নামের এক ঝোড়ো হাওয়া জীবন এলোমেলো করে দিল। ভাল করে বোঝার আগেই বুকের ভিতরের জমাট কান্নাগুলো অনিকেত-ঝড়ে উধাও। অফিসে কাজের সূত্রেই আলাপ অনিকেতের সঙ্গে। অনিকে সে ভালবেসেছিল কি না, বুঝে ওঠার আগেই অনি ঘোষণা করেছিল, সে ইন্দুর উপর অত্যন্ত নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। ইন্দ্রাণীর প্রতিটি কাজেই তার বিপুল উৎসাহ। শুধু তা-ই নয়, ইন্দ্রাণীর সুপ্ত বাসনাগুলোর ঘুম ভাঙিয়ে, তাদের আদর করে সাজিয়ে-গুছিয়ে যত্ন করতেও অপরিসীম আগ্রহ তার। ইন্দ্রাণী ছবি তুলবে বলে আশ্চর্য সব বিষয় বা জায়গা সে ভেবে ভেবে বার করে। ঝড়ে আধমরা পায়রাকে সারিয়ে তোলে দু’জনে। ইন্দ্রাণী তবলা বাজায় জেনে দুষ্প্রাপ্য সব সিডি জোগাড় করে আনে। তবলা শুনতে চেয়ে যখন দেখে টিউন করা নেই, তক্ষুনি তা নিয়ে ছোটে ঠিক করাতে… সে তো ঝড়… মাটি থেকে উড়িয়ে নেওয়াই তার কাজ! হ্যাঁ, ইন্দু উড়ে গিয়েছিল, আর অনিকে সঙ্গে নিয়েই পড়ল এক স্বপ্ন-জীবনে।
এরও একটা পর আছে। অনিকেত আর ইন্দ্রাণীর বিয়ে হল। সে বিয়েও এক অনন্যসাধারণ বিয়ে। রেজিস্ট্রি ম্যারেজে বন্ধুদের মিষ্টিমুখ আর পরিজনদের সঙ্গে নরনারায়ণ ভোজ। লাল শাড়িতে অন্য রকম ইন্দুকে দেখে মুগ্ধ অনি, ‘‘তুই তো এতেও ফাটাফাটি গুরু! তবে ওই জিন্স আর টপ না পরলে তোকে কেমন যেন অচেনা লাগে!’’ ছোট্ট সংসারে শাশুড়ির আদরে-প্রশ্রয়ে ভালই কাটছে ইন্দুর। সৌগতকে আর মনেই পড়ে না।
সে দিন ফিরতে দেরি হয়েছিল। দু’জনের একটা জয়েন্ট টুরিজ়ম বিজ়নেস খোলার ইচ্ছে। সে ব্যাপারেই অনির সঙ্গে অফিসের পরে যেতে হয়েছিল কিছু জায়গায়। ফিরে ডোরবেল বাজাতে মামণি এসে দরজা খুলেই ইন্দুকে প্রায় টেনেই নিয়ে যায় ওদের ঘরে, ‘‘ইনু-মা, এই প্যান্ট-শার্ট পাল্টে একটা শাড়ি বা সালোয়ার পরে আয় তো মা আমার ঘরে। হলদিয়া থেকে হঠাৎ বেণুদা-বৌদি এসে হাজির। বাবু, তুই এ ঘরে আয়। পরে জামা ছাড়িস। আর ওদের সামনে তুই-তোকারি কোরো না যেন দু’জনে!’’ বলে মা বেরিয়ে যেতেই চকিতে অনির দিকে তাকায় ও। অনি বলে, ‘‘আরে শাড়িই পরে নে, ওই সবুজ-লাল শাড়িটায় হেব্বি লাগে তোকে!’’
ক্লান্ত ইন্দ্রাণী বলতে গিয়েছিল, ‘‘উহ্! সারা দিন পরে…’’ কথা শেষ করতে না দিয়ে অনিকেত হিসহিসিয়ে বলে ওঠে, ‘‘মা বলছে, কর না! তোর কিছুতে তো বাধা দেয় না! এত স্বাধীনতা দেওয়া হচ্ছে…’’ বিরক্তির সঙ্গে বলা কথাগুলো শেষ না করেই দরজা বন্ধ করে বেরিয়ে যায়। অচেনা স্বরে চমকে যায় ইন্দু। বিয়ের বছরখানেক পর এই প্রথম সৌগতকে মনে পড়ল ইন্দ্রাণীর।
বছর চারেক পর, ব্যবসা বেশ জমে উঠেছে, চাকরি দু’টো আর টানা যাচ্ছে না। কী করে ম্যানেজ হবে, ক্রমাগত আলোচনার শেষে ইন্দ্রাণীর চাকরির প্রাত্যহিক সময়সীমা বেশি, এই অভিযোগে ইন্দ্রাণীকেই সম্পূর্ণ আত্মনিয়োগ করতে হয় তাদের দু’জনের ব্যবসায়। সঙ্গে যোগ হয়, ‘‘পরের ব্যবসা তো সামলালি অনেক দিন। পুপুও বড় হয়ে গিয়েছে, এখন তোকে তো আর দরকার নেই তত!’’
ওদের কতটা দরকার জানে না ইন্দ্রাণী, কিন্তু সন্তানস্নেহে যা গড়ে তুলেছে, বিচ্ছেদ যন্ত্রণা ভুলতে যাকে প্রাণপণে জড়িয়ে ধরেছে, সে কি শুধুই পরের ব্যবসা? অনির অজানা তো নয় কিছুই! তবু ছাড়তেই হল কাগজের কাজটা। অনির চাকরি বজায় থাকল সংসারে অর্থজোগানের দাবিতে। যদিও ইন্দ্রাণীর বেতন ছিল ওর কিছু বেশিই। আবার সৌগতকে মনে পড়ে গিয়েছিল ইন্দুর।
আজ সফল ব্যবসায়ী দম্পতির কাছে আছে তাদের একমাত্র সন্তান তিতি। তিতির তখন বছর তিনেক বয়স, নাতনি-ঠাকুমা গিয়েছে পার্কে। অনেক দিন পর দু’টিতে আজ অলস গল্পে মেতেছে। ল্যাপটপে ছবি দেখতে দেখতে হারিয়ে যাওয়া দিনে ফিরে যাওয়া, খুনসুটির পুরনো বর্ণে-গন্ধে ম-ম করছে ঘরটা। গেট খোলার শব্দ, তিতি ফিরল বুঝি! উত্তেজিত ঠাকুমার হাতে একটি কাগজ। পাড়ায় সদ্য জন্মানো নাচ-গানের স্কুলের ফর্ম। কিসে দেবে মেয়েকে? ঠাকুমা চায় নাচ শিখুক নাতনি, মা বলে, ‘‘নাচটা চালিয়ে যাওয়া বড্ড কঠিন, তার চেয়ে বরং গান বা আঁকা শিখুক।’’
অনিকেত কম্পিউটারে কী করতে করতে ফিচেল হেসে বলে, ‘‘যা-ই শেখাও বাপু, তবলাটবলা শেখাতে যেয়ো না, ও ব্যাপারটা যেন কেমন ছেলে ছেলে…’’ বলেই বুঝি অস্বস্তি হয়, তাড়াতাড়ি বলে, ‘‘তোর মতো সবাই পারে না, ইন্দু!’’ যেন বলার জন্যেই বলা! প্রাণহীন শব্দ শুধু! অনির মুখের উপর সৌগতর ছায়া! চমকে গেল ইন্দ্রাণী। আড্ডা তার রূপ-রস-গন্ধ সব হারিয়ে ফেলল।
কিছু বিশেষ টুরে ওদের নিজেদের যেতে হয়। ইন্দ্রাণী কমই যায়। তবে, সে বার দু’জনকেই যেতে হয়েছিল বাইরে। ইন্দ্রাণীকে রাজস্থানে আর অনিকেতকে পুরুলিয়া। আয়া এবং শাশুড়ির কাছে তিন বছরের তিতিকে রেখে যেতে কষ্টই হচ্ছিল ইন্দ্রাণীর, কিন্তু কী করা! ব্যবসাটাকেও যে সন্তানস্নেহে তৈরি করেছে ও। দু’দিন যেতেই হঠাৎ খবর, তিতির দারুণ জ্বর। অনিকেত বিদেশিদের ফেলে যেতে পারছে না। শাশুড়ি ফোনে কাঁদছেন, ‘‘তুই চলে আয় ইনু, আমার ভয় লাগছে।’’ অনিকেত ফোনে বলছে, ‘‘তোমাকে যেতে বারণ করেছিলাম! মেয়ের কিছু হলে কিন্তু আমার চেয়ে খারাপ… তুমি ফিরে এস শিগ্গিরই।’’
তুই থেকে তুমি হয়ে যায় ইন্দু। ফোন কেটে দিয়ে রাতারাতি লোকাল গাইড জোগাড় করে, সঙ্গীদের, কর্মীদের বুঝিয়ে রাতের ফ্লাইট ধরে। বাড়ি ফিরে ঘুমন্ত মেয়ের কপালে হাত রেখে দেখে জ্বর ছেড়েছে। উত্তেজিত অনি ফোনের ও পার থেকে বলে, ‘‘যাক বাবা! তুই এসে গিয়েছিস, নিশ্চিন্ত! আমি তা হলে ট্রিপটা শেষ করেই আসছি…’’
কোনও রকমে ‘‘হুঁ…’’ বলেই ফোনের বোতাম টিপে অনির কণ্ঠরোধ করে ইন্দু। আবার সৌগতকে মনে পড়ে যায়।
ব্যবসা বেড়েছে, শাখাপ্রশাখা বিস্তৃত হয়েছে অনেক দূর। ওরা ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের কাজও করছে এখন। সেই সূত্রে নানা বিশিষ্ট ব্যক্তির সঙ্গে পরিচয় হয়েছে। পার্টির সঙ্গে মিটিং সাধারণত অফিসেই হয়। সে দিন এক বিশেষ পরিচালককে বাড়িতেই ডেকেছে ওরা, সংস্থার কোর টিমের সঙ্গে তাঁর আলোচনা। সে টিমে আছে ইন্দ্রাণী, অনিকেত, সন্দীপ আর নীল। হঠাৎ সকালবেলা এক রাশ ভেটকি মাছ নিয়ে এসে অনি বলে, ‘‘ওদের খেতে বলেছি ইন্দু। ভেটকির পাতুরিটা তুই হেভি করিস, আজ কর। ওঁকেও খাওয়াব।’’
‘‘ওঁদের আসার সময় তো হয়ে গেল, আমি কখন করব এ সব?’’ ঝেঁঝে ওঠে ইন্দ্রাণী। অনি নির্বিকার, ‘‘আরে, আমি তো আছি বস! তুই মাঝে মাঝে এসে যোগ দিলেই হবে…’’ হালকা করে অনিকেত।
‘‘মালতীদিকে বললেই তো হত!’’
‘‘আরে ও কি পারে এ সব? আর বৌয়ের হাতের রান্না খাওয়ানোর ব্যাপারটাই আলাদা।’’
‘‘তুইও তো পারতিস তোর স্পেশ্যাল নবরতন কারি বানাতে!’’
‘‘উহ্! তা হলে আর কী! চল সবাই মিলে রান্নাঘরে ঢুকেই বসে থাকি!’’ বিরক্তি মিশে যায় অনির স্বরে। আর কথা বাড়ায় না ইন্দ্রাণী, রান্নাঘরে ঢোকে। শুনতে পায় সন্দীপের গলা, ‘‘দিদি কই? নীল তো ওঁকে নিয়ে রওনা হয়ে গিয়েছে, পাঁচ মিনিটের মধ্যে এসে যাবে।’’
‘‘দিদি তোদের জন্যে হেব্বি একটা ডিশ প্রিপেয়ার করছে।’’
‘‘ও মা, সে কী! দিদি থাকবে না মিটিং-এ?’’
‘‘আমিই তো আছি! দিদি আসবে, মাঝে মাঝে যোগ দেবে তো। পতির পুণ্যে সতীর পুণ্য, বুঝলে বাবু! আমার অবশ্য সতীর পুণ্যে পতির পুণ্য!’’ স্বভাবসিদ্ধ হা-হা হাসিতে ভরে যায় ঘর। সতী-পতি-পুণ্য শব্দগুলো ইন্দ্রাণীর মাথার ভিতর হুটোপাটি করে। গাড়ি এসে থামল, মিটিং শুরু হয়ে গিয়েছে। তাওয়ার উপর কলাপাতার পোঁটলাটা উল্টে দিচ্ছে ইন্দ্রাণী, শুনতে পায় অনির গলা, ‘‘…আমার এই উত্থান, উন্নতি সবের মূলেই আমার স্ত্রী।’’
তবু চোখ ভিজে যায় ইন্দ্রাণীর, আবার সৌগতকে মনে পড়ে যায়।
এ ভাবে সারা জীবনে অনেক বার সৌগতকে মনে পড়েছে ইন্দ্রাণীর। অনিকেতরাই সৌগতদের ভুলতে দেয় না, বার বার মনে করিয়ে দেয়।