অফিস থেকে বাড়ি ফিরেই মেজাজটা খিচড়ে গেল। বসার ঘরে সোফায় দাদা বসে আছে। পরমা দাদাকে চা করে দিয়েছে, দাদা আয়েশ করে সেই চায়ে চুমুক দিচ্ছে।
আয়েশ করে চায়ে চুমুক দিলে কী হবে, দাদার মুখে-চোখে একটা বেশ অপরাধী-অপরাধী ভাব। এ জিনিস আমি অফিস-কাছারি বা হাটে বাজারে অনেকবার লক্ষ করেছি। মনের মধ্যে হয়তো দারুণ ঝড় চলছে, প্রবল দুশ্চিন্তা কুরে কুরে খাচ্ছে অথবা দুর্দান্ত এক অপরাধবোধে ডুবে আছে, এমন অবস্থায়েও কিছু মানুষ চায়ের কাপে বেশ আয়েশ করেই চুমুক দেয়। দাদার মতো আত্মসুখী মানুষ যে
সেই গোত্রভুক্ত হবে তাতে আর আশ্চর্য কী?
আজ প্রায় মাস তিন হল আমি আর পরমা এই ভাড়াবাড়িতে উঠে এসেছি। হ্যাঁ, নিজের পৈতৃক বাড়ি ছেড়েই। আমার দাদাটি মানুষ তেমন সুবিধের না হলেও আমাদের বাড়ি ছেড়ে ভাড়াবাড়িতে উঠে আসার পিছনে তার তেমন কোনও দায় বা অবদান নেই। আমাদের প্রায় শতাব্দীপ্রাচীন বাড়িটায় কয়েকদিন আগে থেকে ভাঙার কাজ শুরু হয়েছে, আর কয়েকদিনের মধ্যে সেখানে একটা বহুতল ফ্ল্যাটবাড়ি গজিয়ে উঠবে। যত দিন না নতুন ফ্ল্যাট পাওয়া যাচ্ছে, তত দিনের জন্য এই ভাড়াবাড়িটাই আমাদের স্বামী–স্ত্রীর অস্থায়ী আস্তানা। তবে বাড়িটা প্রোমোটার ভালই দিয়েছে, বেশ প্রশস্ত ডাইনিং হল, বেশ আলো-হাওয়া চলাচল করে এমন দুটো বেডরুম, রান্নাঘর আর বাথরুমও বেশ ঝকঝকে তকতকে। আমি আর পরমা মাঝে মাঝে আলোচনা করি আমাদের নতুন ফ্ল্যাটটাও যেন এমনই সুন্দর হয়।
তবে অস্থায়ী ঠিকানা হলেও পরমা কয়েকদিনের মধ্যেই এই ভাড়ার ফ্ল্যাটটাকে এমন ভাবে সাজিয়ে নিয়েছে যেন এটাই তার নিজের বাড়ি। শোওয়ার ঘরের টিভি সেটের পাশে যত্ন করে সাজিয়েছে ঢাউস পোড়ামাটির ফুলদানি। সেই ফুলদানি থেকে মাথা তুলে বুড়ো হতে চলা দম্পতির সংসারে নজর রাখে খান পনেরো কাগজের লম্বা লম্বা ফুলের দল।
দাদা সচরাচর এ বাড়িতে আসে না, আজ কী মতলবে তার আগমন ভাবতে ভাবতে আমি অফিসের কাপড় ছাড়ছিলাম। পরমা যেন আমার মনের কথা বুঝতে পারল, সেই লম্বা ফুলদানির সামনে দাঁড়িয়ে সে ষড়যন্ত্রীর গলায় বলল, “ঠিক বুঝতে পারছি না জানো তো, আধঘণ্টার ওপর বসে আছেন, একটাও কথা বলেননি। কখন থেকে উশখুশ করছেন। দু’বার শুধু জানতে চেয়েছেন তোমার আজ ফিরতে দেরি হবে কি না। আবার কি ঘোঁট পাকাতে চলেছেন কে জানে?”
তোয়ালে কাঁধে ফেলে দাদার সামনে দিয়েই আমি স্নানঘরে ঢুকলাম। দাদা একবার নড়েচড়ে উঠল, তার পর আবার আজকের খবরের কাগজে মন দিল।
একজন দাদা তার ভাইয়ের বাড়ি এলে ঘোঁট পাকার আপাতভাবে কোনও সম্ভাবনা থাকার কথা নয়, কিন্তু আমার দাদা ভদ্রলোকটি একটু অন্য রকম। দাদার সঙ্গে আমার কোনও দিনই খুব সদ্ভাব ছিল না। মা মারা যাওয়ার পর জমানো টাকা হাতানোই হোক আর প্রমোটারের সঙ্গে স্কিম করে ছোট ভাইকে এক কোণে ঠেলে নিজে সাউথ ফেসিং ফ্ল্যাট আর অতিরিক্ত কয়েকশো স্কোয়ার ফিট বাগিয়ে নেওয়াই হোক, আমার দাদার জুড়ি মেলা ভার। আর এর সবটাই দাদা করে মুখে একটা অনাবিল হাসি ঝুলিয়ে রেখে। তাই দাদাকে আশেপাশে দেখলেই আমি, পরমা বা আমাদের একমাত্র মেয়ে রশ্মিরও পর্যন্ত আজকাল একটা অজানা আশঙ্কায় ভুরু কুঁচকে যায়।
আমাদের ছোট শহরে আমাদের পাল ভিলার নাম জনতা একটা বিশেষ সম্মানের সঙ্গে উচ্চারণ করত। এ অঞ্চলে আমাদের থেকে পুরনো আর ঐতিহাসিক বাড়ি দ্বিতীয়টি ছিল না। একটা সময় এমন দিয়েছে, এই বাড়ি অনেক ফিরিঙ্গি আধিকারিকদের আনাগোনা দেখেছে, স্বাধীনতার আগের অশান্ত দিনগুলোতে কত বিপ্লবীদের গা ঢাকা দিয়ে থাকার রোমাঞ্চকর গল্প আজও এই শহরের চায়ের দোকান আর সান্ধ্য আড্ডা মাতিয়ে রাখে। আমার ঠাকুরদা নিজে একজন নামকরা স্বাধীনতা সংগ্রামী ছিলেন, তাঁর উদ্যোগে এ শহরে অনেক তাবড় তাবড় দেশনেতার পায়ের ধুলো পড়েছিল।
এহেন ঐতিহাসিক পুরনো বাড়ি ঘিরে সাধারণত মানুষের প্রচুর কৌতূহল থাকে। হাওয়ায় হাওয়ায় কত যে জনশ্রুতি ছিল আমাদের পুরনো বাড়িটাকে ঘিরে! তাদের মধ্যে যে গুজবটা সবচেয়ে বেশি ডানা মেলেছিল সেটা হল পাল ভিলার বাগানে বা অন্য কোনও গুপ্ত কুঠুরিতে লুকিয়ে থাকা অঢেল ধনরাশির সম্ভাবনার কথা। আমরা পরিবারের সদস্যরা এ নিয়ে নিজেদের মধ্যে হাসাহাসি করতাম। তবু এরই মধ্যে কোনও কোনও সকালে আমরা চমকে উঠতাম, অত্যুৎসাহী কিছু মানুষের রাতভর খোঁড়াখুঁড়ির চিহ্ন পাওয়া যেত বাড়ির পিছনের বাগানে। কেউ কোনও দিন ঘড়া-ঘড়া মোহর পেয়েছে এমন খবর কোনও দিন শোনা যায়নি কিন্তু তার পরেও আমাদের ছোট্ট শহরের হাওয়ায় শিমুল তুলোর মতো ভেসে বেড়াত পাল ভিলার লুকোনো গুপ্তধনের উপকথা।
বাবা বরাবর দাদার চেয়ে আমাকে একটু বেশি স্নেহ করত। কারণটা স্পষ্ট ছিল না। আমার কাছে না, সম্ভবত দাদার কাছেও না। বাবার মতো আদর্শবাদী মানুষের কাছ থেকে এ ধরনের পক্ষপাত সাধারণত আশা করা যায় না, তবু আমার উপরে বাবার একটা অজানা দুর্বলতা ছিল। মা আমাদের দুই ভাইকে সমান চোখে দেখলেও বাবাকে অনেক ক্ষেত্রেই সেরা জিনিসটা দাদাকে না দিয়ে আমার হাতে তুলে দিতে দেখেছি। দাদা বাবাকে খুব ভালবাসত, আমরা তখন অনেক ছোট তবু তার মুখ দেখে বুঝতে পারতাম, আমার প্রতি বাবার ভালবাসা আর অহেতুক প্রশ্রয় তাকে বেশ কষ্ট দিত। অনেক সময় গুমরে গুমরে থাকত দাদা, খেলতে খেলতে আমাকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিত অথবা কারণে-অকারণে আমার পিঠে দু’ঘা লাগিয়ে দিয়ে হিসেব মিলিয়ে নিত সে।
আজ দাদা ষাট ছুঁই-ছুঁই, আমি চুয়ান্ন, বাবা চলে গিয়েছে বহু দিন, কিন্তু দু’জনের মধ্যের সেই বরফের পাহাড়টা রয়ে গিয়েছে।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পুরনো একান্নবর্তী পরিবারগুলো ভেঙে গেল, অবশেষে সময় এল পাল ভিলার। দু’দিন আগে চোখের সামনে একটু একটু করে ভেঙে ফেলা শুরু হল আমার সাধের ছোটবেলার স্মৃতির বাড়িটা। ভেঙে গেল গুণীজনের পায়ের ধুলো-পড়া সেই বৈঠকখানা, চুরমার হল উৎসব অনুষ্ঠানে মুখর হয়ে থাকা পাল ভিলার বিশাল আকাশ দেখা ছাদ। এলোমেলো আর অনিয়মিত ভাঙচুর আজ পাল ভিলার শরীর জুড়ে। সে দিন অফিস সেরে স্টেশন থেকে ফেরার পথে সাইকেল থামিয়ে কয়েক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে ছিলাম পাল ভিলার সামনে, পুরনো দিনের গল্প-বলা, পাঁজরের হাড় বার করা বুড়ো মানুষদের মতো দেখায় এখন আমাদের পাল ভিলাকে। সন্ধের মুখে আশেপাশের বাড়িগুলোয় শাঁখ বেজে উঠছিল, মা এই সময় সন্ধে দিত, ছোট্ট একটা প্রদীপ রাখত তুলসীতলায়। এ বাড়িতেই বউ হয়ে প্রথম এসে উঠেছিল পরমা, সদ্যোজাত রশ্মিকে কোলে হাসপাতাল থেকে প্রথম বার বাড়িতে ঢোকার আগে তার কানে ফিসফিস করেছিলাম, ‘‘বাড়ি এসে গেলি রে খুকি।’’
সেই মেয়ে এখন পুণেতে মাস্টার্স করছে। কয়েকদিন আগে ফোন করে বাড়ি ভাঙার খবর দিলাম তাকে। রশ্মির গলা ভেঙে এল, ‘‘অন্য কথা বলো বাবিন, একদম ভাল লাগছে না শুনতে।’’
আগামীকাল থেকে সেই বাড়ির ভিত খোঁড়া শুরু হবে।
চায়ের কাপ হাতে দাদার পাশে সোফায় বসে নিউজ চ্যানেলটা চালিয়ে দিলাম আমি। দাদা খবরের কাগজ নামিয়ে রাখল, “রশ্মি কেমন আছে রে বাম্পি?’’
টিভি থেকে চোখ সরালাম না। “ভাল। ফাইনাল ইয়ার, তাই একটু চাপে আছে।”
রশ্মির কুশল জানতে দাদা যে আজ আসেনি এটা আমি আর দাদা দু’জনেই ভাল করে জানি। কিছুক্ষণ দু’জনেই চুপ, ঘর জুড়ে অস্বস্তিকর নিস্তব্ধতা। অপ্রতিভ হয়েই খুব সম্ভবত নিউজ-রিডার ভদ্রলোকও কমার্শিয়াল ব্রেক নিয়ে নিলেন। আমি রিমোটে মিউট বাটন চাপলাম।
“তোর সেভেন্টি টু’র নাইন্থ সেপ্টেম্বরের কথা মনে আছে বাম্পি?’’
চায়ে চুমুক দিয়ে চমকে উঠলাম। সে দিনের কথা কেউ ভুলতে পারে? বাবা সে দিন অফিস থেকে ফেরার পথে ডালহৌসি থেকে আমার জন্যে রোমানিয়ার কয়েন নিয়ে এসেছিল। কয়েন কালেকশনের শখ ছিল আমার, আর বাবা ছিল আমার সবচেয়ে বড় পৃষ্ঠপোষক। আমার প্রতি বাবার পক্ষপাত দাদা কোনও দিনই ভাল চোখে দেখেনি, সে দিনও লোলুপ চোখে সে তাকিয়ে ছিল কয়েনটার দিকে।
সেই রাতে দু’দুটো গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে। রাতে খাওয়ার পর থেকে ওই কয়েনটা কোথাও খুঁজে পাওয়া গেল না। দ্বিতীয় ঘটনাটা একটু বেশি গুরুত্বপূর্ণ, গভীর রাতে একটা মেজর কার্ডিয়াক স্ট্রোকে বাবা আমাদের ছেড়ে চলে গেল। বাবার শ্রাদ্ধ-শান্তি মিটলে পরে দাদাও হোস্টেলে ফিরে গেল। কিন্তু হঠাৎ আজ এই প্রশ্ন!
‘‘বাম্পি, আমি একটা ভুল করে ফেলেছি রে।”
মেঝের দিকে তাকিয়ে রইলাম। ভাল। বয়স বাড়ছে, এই বয়সে নিজের ভুলভ্রান্তিগুলো একে একে সামনে আসে মানুষের, বিচিত্র কিছু না। এমন হওয়া স্বাভাবিক।
দু-তিন বার হাল্কা কেশে নিয়ে গলা পরিষ্কার করল দাদা, তার পর খুব সাবধানে বলল, “বাম্পি, বাবা তোর জন্য যে কয়েনটা এনেছিল, আমি সেটা একটা স্টিলের পাত্রে করে বাগানের উত্তর দিকের নারকেল গাছটার নীচে পুঁতে ফেলেছিলাম।’’
বিজ্ঞাপন-বিরতি শেষ হয়েছে, নতুন উদ্যমে খবর পড়তে শুরু করেছেন সংবাদপাঠক! আমি রিমোটের মিউট সরালাম না। অনেক ক্ষণ কোনও কথা বলতে পারলাম না, আমার হাতের মুঠোয় চায়ের কাপ জুড়িয়ে এল। গলার কাছটা জ্বালা করতে লাগল আমার। ভুলে যাওয়া ব্যথার জায়গায় কেউ হাত রাখলে এ ভাবে জেগে ওঠে স্নায়ুপ্রান্ত!
চোখের কোণ দিয়ে আমায় দেখে নিয়ে দাদা আবার বলল, “বাম্পি, কাল প্রোমোটার ভিত খুঁড়বে, ওই কয়েনটাই তোকে দেওয়া বাবার শেষ উপহার ছিল রে।’’
কী বলতে চায় দাদা! যে চরম বিষয়ী মানুষ নিজের ভাইকে ঠকিয়ে নিতে পারে নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য, তার পক্ষে সম্ভব এমন অবাস্তব ইঙ্গিত দেওয়া! বিরক্ত লাগে আমার।
দাদার দিকে তাকালাম, দাদা চোখ সরিয়ে নিল। কিছু সময় পরে দেখলাম দাদা আমার দিকে তাকিয়ে আছে, এ বার আমি চোখ সরিয়ে নিলাম। শেষমেষ দুই ভাইয়ের চোখাচোখি হল, এ বার আর দু’জনের কেউই চোখ সরিয়ে নিলাম না। বহু, বহু বছর পরে আজ আমরা দুই ভাই পরস্পরের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলাম।
******
এখন অনেক রাত। শাবলটা দিয়ে মাটিতে সজোরে কোপ মারলেন এক প্রৌঢ়। পাশ থেকে আরও বয়স্ক এক জন টর্চ হাতে বলে উঠলেন, “ওখানে না বাম্পি, ওখানে না, আর একটু বাঁ দিকে।”
দু’দিন পর পূর্ণিমা। চাঁদের আলোয় শতাব্দীপ্রাচীন পাল ভিলার ধ্বংসস্তুপে স্মৃতির মণিমুক্তোর জোয়ার।
আরে ওই তো, ওখানে ঠাকুরঘর ছিল না! মা দুলে দুলে লক্ষ্মীর পাঁচালি পড়ত আর দু’ভাই হাতজোড় করে তাকিয়ে থাকত সন্দেশের থালার দিকে। ওই বারান্দাটা থেকে পড়ে গিয়েই তো সে বার মাথা ফাটল ছোটজনের, দাদা তাকে কোলে তুলে ছুটেছিল সুধীন ডাক্তারের বাড়িতে। ওইখানে দাঁড়িয়ে থাকা অ্যাম্বুল্যান্সে চেপেই তো শেষ বারের মতো বাবা চলে গেছিল...
কান্না থামা আঁখিপল্লবের মতো তাদের বাবার হাতে পোঁতা নারকেল গাছের পাতায় শিশির চমকে ওঠে চাঁদের আলোয়। হালকা হাওয়ায় নড়ে উঠে গাছের পাতা।
তাঁদের অবশ্য অত কিছু দেখার সময় ছিল না। দুই প্রৌঢ় তখন পাগলের মতো আঁতিপাতি করে গুপ্তধন খুঁজছিল। পাল ভিলার গুপ্তধন।