Abosar

পাখসাট

নন্দিতা বাগচী

অতলান্ত আবার বেরিয়েছে সমুদ্র-অভিযানে। এ বারে মাস তিনেকের ধাক্কা। চেন্নাই থেকে শ্রীলঙ্কা, সুমাত্রা, জাভা, ইন্দোনেশিয়া ছুঁয়ে অস্ট্রেলিয়া পাড়ি। আবার একই পথে ফেরা। উত্তর কলকাতার এত বড় ফ্ল্যাটে একা-একা হাঁপিয়ে ওঠে শাল্মলী। এ শহর তার খুব অচেনা।

মফস্‌সলের ছোট্ট গঞ্জ জয়ন্তীতে বেড়ে ওঠা শাল্মলী একাত্ম বোধ করত সেখানকার প্রকৃতির সঙ্গে। তিরতির করে বয়ে চলা জয়ন্তী নদীতে, ভুটান পাহাড়ের সবুজে, আকাশের নীলে বর্ণময় ছিল তার জীবন।

বেলা এগারোটা বাজে। কাজের লোক বন্দনা কাজকর্ম সেরে চলে গিয়েছে। আবার আসবে বিকেলে। অবসর আর অবসাদকে সঙ্গী করে ঝুলবারান্দার বেতের চেয়ারটায় বসে আছে শাল্মলী। আশপাশের জরাজীর্ণ বাড়িগুলোর নোনা-ধরা ইটের দেওয়ালে বট-অশ্বত্থের হামলা। বসন্ত সমাগমে তাদের কচি কচি তাম্রাভ পাতাগুলো যেন শাল্মলীকে বলছে, বর্তমান ক্ষণস্থায়ী, ভবিষ্যৎ আসছে। 

চৈত্রের দাবদাহে জ্বলছে শহর। আশপাশের বাড়িগুলোর জানলা-দরজা কাঠের খড়খড়িগুলোও আষ্টেপৃষ্ঠে এঁটে দেওয়া। বাড়ির সামনের গলিতেও কোনও মানুষের দেখা নেই। বুকের ভিতরটা খাঁ-খাঁ করছে শাল্মলীর। যত ক্ষণ বন্দনা থাকে, সময়টা দিব্যি কেটে যায়। কাল রাতে তার বর মদে চুর হয়ে কী ভাবে মেরেছে, তার ট্রাঙ্কের তালা ভেঙে জমানো টাকাগুলো বার করে নিয়ে জুয়ায় হেরে এসেছে, কিংবা বেপাড়ার মেয়েছেলের সঙ্গে প্রেম-পিরিতের কাহিনি। কিন্তু শাল্মলীর জীবনটা এখন কেমন যেন সাদা কাগজের মতোই বর্ণহীন।

অথচ অতলান্ত যখন তার সমুদ্র অভিযান শেষে ঘরে ফেরে শরীর ভরা নোনা জল নিয়ে, দিব্যি পুনর্জীবিত হয়ে ওঠে শাল্মলী। সেই সেচনে কচি কচি পাতায় ভরে ওঠে তার শরীর, কুঁড়িগুলোও চনমনে হয়ে ওঠে ফুল ফোটাবার সম্ভাবনা নিয়ে।

নিজের ভাবনায় বিভোর হয়ে ছিল শাল্মলী, হঠাৎ একটা দমকা হাওয়া এল গলিটার ভিতরে। শুকনো পাতা আর খড়কুটোয় ভরে উঠল গলিটা। পাতলা-স্বচ্ছ পলিথিনের প্যাকেটগুলো জেলিফিশের মতো সাঁতরাতে লাগল শূন্যে। যেন ওদের এই গলিটাও এক টুকরো সমুদ্র।

হাওয়ায় ক্রমশ তাপ বাড়ছে, বেলা সাড়ে এগারোটাতেই কী ভয়ানক আগ্নেয় উত্তাপ। এ বছরে নাকি সব রেকর্ড ভেঙে ফেলবে গ্রীষ্মকালীন আবহাওয়া। শাল্মলী ঘরের ভিতরে যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়াল। দরজায় ছিটকিনি তুলে দিয়ে শুধু একটা বোতাম টেপার অপেক্ষা। মুহূর্তে তাদের ঘরগুলো হয়ে যাবে কুমেরু অঞ্চল। 

একটা পাখা ঝাপটানির আওয়াজ শুনে থমকে দাঁড়াল সে। এক জোড়া গোলা পায়রা এসে বসেছে ওদের ঝুলবারান্দার কার্নিশটার উপরে। কালো গ্র্যানাইট পাথরের এই চওড়া কার্নিশটা ভারী ভাল লাগে শাল্মলীর। ধবধবে সাদা গ্রিলের তলায় চকচকে কালো পাথরের যুগলবন্দিটা যেন এক লিখিত কাহিনি।

সেই কাহিনিটি মুহূর্তে প্রেমময় হয়ে ওঠে কবুতর-দম্পতির আলাপচারিতায়। বকবকম-বকবকম। গুটুর গুটুর-গুটুর গুটুর। স্ত্রী-পায়রাটি যেন কোনও একটা ঘটনা ঘটার অপেক্ষায় রয়েছে। চোখ দু’টো বুজে উপভোগ করছে তার সুদর্শন তেজি পুরুষসঙ্গীর খুনসুটিটুকু। সে চোখ মেলে চাইতেই পুরুষ সঙ্গীটি আলতো করে তার ঠোঁটে ঠোঁট ছোঁওয়াল। এক বার-দু’বার-তিন বার। তার পর তার পিঠের পালকের ভিতরে নিজের ঠোঁট দিয়ে বিলি কাটতে লাগল। স্ত্রী পায়রাটি আবারও চোখদু’টো বুজে ফেলল। যেন তার খুব আরাম বোধ হচ্ছে এবং পরবর্তী ঘটনাটি ঘটার জন্য সম্মতি দিচ্ছে।

শাল্মলী দাঁড়িয়ে আছে প্রস্তরীভূত এক বৃক্ষের মতো। যেন আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতে শিলীভূত হয়ে গিয়েছে সে। আবারও ডানা ঝাপটানির আওয়াজে ঘোর ভাঙে তার। পুরুষ কবুতরটা ডানা ঝাপটাচ্ছে ঘন ঘন। সেই প্রতীক্ষিত ঘটনাটি ঘটছে।

ঘরের ভিতর ঢুকে বিছানাটার উপরে আছড়ে পড়ল শাল্মলী। তার শরীর ভরে যাচ্ছে নবপত্রিকায়। ছোট ছোট কুঁড়িগুলোও ছটফট করছে ফুল ফোটাবার তাগিদে। খোলা দরজাটা দিয়ে আগুনের হলকা ঢুকছে, হুঁশ নেই শাল্মলীর। 

 

*****

মুঠোফোনের পর্দায় অতলান্তর নামটা দেখে নেচে ওঠে শাল্মলীর মনটা। ফোন ধরে জিজ্ঞেস করে, ‘‘কদ্দূর পৌঁছলে?’’

‘‘এই তো শ্রীলঙ্কায় পৌঁছে গেলাম।’’

‘‘আর কত দিন লাগবে অস্ট্রেলিয়ায় পৌঁছতে?’’

‘‘সবে তো দেড় দিন কাটল। এখনও পঁচিশ-ছাব্বিশ দিনের ধাক্কা। অবশ্য যদি ওয়েদার ভাল থাকে। ঝড়-টড় উঠলে তো...’’

‘‘অশুভ কথা বলছ কেন?’’

‘‘শুভ-অশুভ বলে কিছু হয় না মলি, বি প্র্যাকটিক্যাল। সামুদ্রিক ঝড় ভয়ানক ব্যাপার, কত জাহাজ তলিয়ে যায় জানো?’’

বুকটা কেঁপে ওঠে শাল্মলীর। মনে-মনে দুর্গানাম জপতে-জপতে সে বলে, ‘‘তোমার আর কিছু বলার আছে?’’

‘‘কেন, এক বছরেই বোর হয়ে গেলে? বরের কথা আর ভাল লাগছে না? এক্সট্রাম্যারিটাল কিছু চলছে না কি?’’ কৌতুকপূর্ণ গলায় বলল অতলান্ত।

‘‘অতলান্ত নামের অস্থির সমুদ্রটাকে সামলাই আগে, তার পর না হয় পরকীয়ার কথা ভাবা যাবে। এই শোনো, তোমার নামটা কে রেখেছিল বলো তো?’’

‘‘কেন, আমার বাবা। তাঁর প্রশান্ত নামের সঙ্গে মিলিয়ে। তা কী দোষ করল আমার নামটা?’’

‘‘না-না, দোষের কথা বলছি না, খুব অ্যাপ্রোপ্রিয়েট। একে তো সমুদ্রই তোমার বাড়ি-ঘর, তার উপরে বড়ই অস্থির তুমি।’’

‘‘তোমার নামটাও খুব অ্যাপ্রোপ্রিয়েট...’’

‘‘যেমন?’’

‘‘শরীর ভরা থোকা থোকা ফুল ফোটাও যে। লাল টুকটুকে ফুল।’’ 

‘‘যাঃ!’’ লজ্জায় লাল হয়ে বলে শাল্মলী।

‘‘সত্যি বলছি, বসন্তের তোয়াক্কা করো না তুমি, আমি বাড়িতে গেলেই ফুটে ওঠে ফুলগুলো। আমি ঠিক বুঝতে পারি।’’ 

হঠাৎ একটা ঘড়ঘড়ে আওয়াজ। গলার স্বরটাও জড়িয়ে যাচ্ছে অতলান্তর। টেনে-টেনে সে বলল, ‘‘নেটওয়ার্কে ডিসটার্বেন্স হচ্ছে... জাভার বন্দরে পৌঁছে ফোন করব... মেসেজ কোরো...’’

ফোন বন্ধ করে শাল্মলী অনুভব করল, ফুলগুলো যেন পাপড়ি মেলছে কোথাও। চোখদু’টো বন্ধ করে চিবুকে ফোনটা ঠেকিয়ে বসে রইল সে। কাজের লোক বন্দনা মুচকি হেসে জিজ্ঞেস করল, ‘‘কার ফোন গো বৌদি? দাদার?’’ 

শাল্মলী একটা গাম্ভীর্যের মুখোশ এঁটে নিল। আরোপিত স্বরে বলল, ‘‘হ্যাঁ।’’

এই একটি শব্দই যথেষ্ট বন্দনার মুখ বন্ধ করার জন্য। তবে সরস আলোচনাটা থেকে বঞ্চিত হয়ে বেজার হয়ে উঠল তার মুখ। 

বন্দনাকে কাজের নির্দেশ দিয়ে ঝুলবারান্দায় এসে বসল শাল্মলী। পর পর দু’টো কালবৈশাখী ঝড়ে উষ্ণতা কমেছে শহরের। গলিটাও যেন হোলি খেলছে। কৃষ্ণচূড়ার লালে, অমলতাসের হলুদে, জারুলের বেগুনিতে বর্ণময় হয়ে উঠেছে সে। শাল্মলীর শরীরেও ঘণ্টাখানেক আগে ফোটা ফুলটা বিবশ করে রেখেছে তাকে। পাপড়িগুলো এখনও সতেজ। রঙের তুলিগুলো নিয়ে খেলা করছে শাল্মলীর মন। গলিটা থেকে কখনও মাখিয়ে নিচ্ছে লাল রং, কখনও হলুদ, কখনও বেগুনি।

বকবকম বকবকম... বক-বক বকম। পায়রাদু’টো আবার এসেছে বারান্দার কার্নিশটায়। ওদের ঠোঁটে ঠোঁট ছোঁয়ানো, পিঠের পালকের ভিতরে সুড়সুড়ি দেওয়া দেখতে দেখতে বিরক্তিতে মনটা ছেয়ে যায় শাল্মলীর। পুরুষ পায়রাটা পাক খাচ্ছে তার সঙ্গিনীটির চারপাশে। সে যখন তোড়জোড় করছে মেয়েটার পিঠে চেপে বসার, তখনই হুস হুস করে তাদের তাড়িয়ে দিল শাল্মলী।

অসমাপ্ত খেলাটা মুলতুবি রেখে পাখসাট দিল তারা। কালো গ্র্যানাইটের উপর এঁকে রেখে গেল সাদা পুরীষের আলপনা। ভর্ৎসনা স্বরূপ। বিরক্তিতে, ঘেন্নায় ফেটে পড়ল শাল্মলী। চেঁচিয়ে উঠে বলল, ‘‘বন্দনাদি, শিগগির এস। এই নোংরাটা মুছে দিয়ে যাও।’’

বন্দনা গজগজ করে, ‘‘হেগে-হেগে নাশ করছে গা, কপ্পোরেশনে খবর দাও গো বৌদি। জাল ফেলে ধরে নিয়ে যাক ওদের।’’

শাল্মলী ইন্ধন জোগায় তাকে, ‘‘কর্পোরেশনের কোনও দরকার নেই। কাল একটু ইঁদুর মারার বিষ নিয়ে এসে ডালের দানার সঙ্গে মিশিয়ে রেখো তো।’’

কার্নিশটা মুছে দিয়ে ঘাড় কাত করে রান্নাঘরে চলে গেল বন্দনা।

 

*****

ভোরের দিকে একটা স্বপ্ন দেখছিল শাল্মলী। ছাড়া-ছাড়া, ভাসা-ভাসা। কী যেন হারিয়ে গিয়েছে তার। খুঁজে পাচ্ছে না কিছুতেই। কারা যেন তারস্বরে চেঁচাচ্ছে। চোখদু’টো খুলতেই সে বুঝতে পারল, অনেকগুলো কাক এক সঙ্গে কা-কা-কা করে গলা ফাটাচ্ছে। এ কী উপদ্রব! ভাবে শাল্মলী। এত সকালে আবার এদের কী হল?

দরজাটা খুলে ঝুলবারান্দায় এসে দাঁড়াতেই চমকে উঠল সে। গ্র্যানাইট পাথরের কালো কার্নিশটার উপর পড়ে আছে দুটো ধূসর রঙের পাখনা আর লালচে এক জোড়া পা। মেয়ে-পায়রাটা গলির উল্টো দিকের বাড়িটার ভাঙা ঘুলঘুলিতে বসে আছে একা। চোখদুটো বোজা, ঠোঁটটা পালকের ভিতরে ডোবানো। বকবকম নেই। গুটুর-গুটুর নেই। নিশ্চুপ। 

হুহু করে ওঠে শাল্মলীর বুকের ভিতরটা। তার দু’চোখ ছাপিয়ে নামে নোনা জলের ধারা। ও দিকে বন্দনা সদর দরজায় বেল বাজিয়ে-বাজিয়ে হয়রান। 

কোলাপসিবল গেটের তালাটা খুলে দিতেই বন্দনার মুখের আগলটি খোলে, ‘‘দশ বাড়ি ছুটে ছুটে কাজ করতে হয় গো আমাদের বৌদি, এক বাড়ির গেটে এত ক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলে চলবে?’’

তার পর শাল্মলীর মুখের দিকে তাকিয়ে পাকা গোয়েন্দার মতো বলে ওঠে, ‘‘দাদার জন্য মন খারাপ লাগছে, না গো বৌদি?’’ পরক্ষণেই দার্শনিক হয়ে যায় সে, ‘‘ভাতারের বড় জ্বালা গো বৌদি। এই দেখো না ঘরে থেকেও আমাকে মেরে রেখেছে আমার জন, আর তোমার জন তো ঘরছাড়া বিবাগী মানুষ।’’

মুখে কিছু না বলে বন্দনার হাত ধরে টেনে ঝুলবারান্দাটায় নিয়ে যায় শাল্মলী। ফুঁপিয়ে-ফুঁপিয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘‘তুমি কি সত্যি করেই ইঁদুর মারা বিষ দিয়েছিলে ওদের?’’

চোখ কপালে তুলে বন্দনা বলে, ‘‘তুমি তো কাল বিকেলেই আমাকে বিষের কথা বললে বৌদি। তার পর এই এলাম আজ সকালে। এ নিঘ্ঘাত ধেড়ে ইঁদুরের কাণ্ড। দেখেছ তো, কেমন ধড়-মুণ্ডু খেয়ে পাখনা আর পা দু’খানা ফেলে রেখেছে!’’

ইতিমধ্যেই কাকের দল এসে সেই পাখনা আর পা দু’খানা নিয়ে টানাটানি শুরু করেছে। 

ঘুলঘুলিতে বসে থাকা মেয়ে-পায়রাটার দিকে তাকিয়ে হাপুস নয়নে কেঁদে চলেছে শাল্মলী। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বলছে, ‘‘ওদের জোড় তো ভাঙতে চাইনি আমি, বন্দনাদি!’’

বন্দনা শাল্মলীর দিকে তাকিয়ে ব্যঙ্গ ভরে বলল, ‘‘তুমিও যেমন বৌদি, জন্তু-জানোয়ারদের আবার জোড় কী? আজ এর সঙ্গে, কাল তার সঙ্গে। সব বেবুশ্যের কি আর বাঁধা বাবু থাকে, বলো? গতরের খিদে বড় খিদে বৌদি। দু’দিন একটু কষ্ট হবে, তিন দিন বাদে দেখবে ঠিক নতুন সঙ্গী জুটিয়ে নেবে।’’ 

আবারও দার্শনিক হয়ে যায় বন্দনা।

তবে তিন দিন নয়, দিনসাতেক বাদেই আবার ঝুলবারান্দার কার্নিশে বকবকম-বকবকম। গুটুর-গুটুর, গুটুর গুটুর। এ বারের পুরুষ সঙ্গী আরও সতেজ, আরও বর্ণময়। ঠোঁটে ঠোঁট, পালকে সুড়সুড়ি, অস্থির পায়ে সঙ্গিনীর চার পাশে চক্কর, পিঠের উপর চড়ে বসে ডানা ঝাপটানো... সব ঠিক আগের মতো। একই রকম সাদা পুরীষের আলপনায় ভরে ওঠে কালো পাথরের কার্নিশ। আজকাল তাদের প্রশ্রয় দেয় শাল্মলী।

 

*****

এই ভয়ঙ্কর একাকিত্বের হাত থেকে বাঁচতে একটা সোশ্যাল নেটওয়ার্কের শরণাপন্ন হয়েছে শাল্মলী। পুরনো বন্ধুদের খুঁজে বার করেছে। সংবাদ আদান-প্রদান, ছবি চালাচালি চলছে। ভোরের দিকে ঘুমিয়ে বেলা করে উঠছে আজকাল সে। ডুপ্লিকেট চাবি দেওয়া আছে বন্দনাকে। একঘেয়েমি থেকে মুক্তি খুঁজছে শাল্মলী।

আজ ঝুলবারান্দায় বসে চা খেতে-খেতে শাল্মলী লক্ষ করল, গলির ও পাশের ভাঙাচোরা বাড়িটার ঘুলঘুলি খড়কুটোয় ভরে উঠেছে। নতুন পুরুষ সঙ্গীটি ঠোঁটে করে বয়ে আনছে শুকনো গাছের ডাল, শুকনো পাতা, শুকনো দুব্বোঘাস। দিব্যি একটা নীড় বেঁধে ফেলেছে তারা। তার মানে ডিম্বাণু নিষিক্ত হয়ে গিয়েছে।

টুংটাং শব্দে নানা খবর আসছে শাল্মলীর ফোনটা জুড়ে। ব্যস্ত হয়ে পড়ে সে বহুমুখী আলাপচারিতায়। সেখানে তার বন্ধুত্বপ্রার্থীদের লম্বা লাইন। কিন্তু কয়েকজন কমন ফ্রেন্ড না থাকলে বন্ধুত্ব করে না সে। প্রোফাইলগুলোও দেখে নেয় খুঁটিয়ে। কী করে, কোথায় থাকে, কেমন ছবি বা খবর আদান-প্রদান করে অন্য বন্ধুদের সঙ্গে, ইত্যাদি।

নীল নামের একটা ব্রিটিশ ছেলে কয়েক দিন আগে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছে ওকে। মেসেজও পাঠাচ্ছে। ছবি পাঠায়, ভিডিয়ো পাঠায়, কিন্তু শাল্মলী তার বন্ধুত্ব গ্রহণ করে না। যদিও প্রোফাইলে লেখা আছে কোনও একটা ইউনিভার্সিটিতে মাস্টার্স করছে সে ইন্টারন্যাশনাল রিলেশনস-এর উপরে। ভারতীয় সংস্কৃতি খুব পছন্দ করে সে। ভারতীয় নারীদের সৌন্দর্যও। শাল্মলীর গমের মতো গায়ের রং, আয়ত চোখ, মেঘের মতো এক ঢাল চুল নাকি মোহমুগ্ধ করে রেখেছে তাকে। কিন্তু শাল্মলীর মন সায় দেয় না। ছোট-ছোট ইচ্ছেগুলো সে বরং দমিয়ে রাখে বর্ণহীন এক ক্যানভাসের আড়ালে।

আজ সন্ধেবেলা ইন্দোনেশিয়া থেকে ফোন করেছিল অতলান্ত। সেখানে তখন রাত গভীর। বালির একটা নাইট ক্লাবে ড্রিঙ্ক অ্যান্ড ডান্সে মত্ত ছিল সে। তারই ফাঁকে জড়ানো গলায় মিনিট দশেকের বার্তালাপ। শাল্মলীকে খুব মিস করছে সে। বিশেষ করে বিছানায়। পাশবালিশটা জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদল শাল্মলী। সারাটা রাত। 

সকালে উঠে ঝুলবারান্দায় গিয়ে শাল্মলী দেখল, মেয়ে পায়রাটা পাখনা ছড়িয়ে বসে পড়েছে তার গৃহকোণে। ডিমে তা দিচ্ছে। তার নতুন পুরুষ সঙ্গীটি শাল্মলীদের কার্নিশের উপর। মাঝে-মাঝে ঠোঁটে করে নিয়ে আসছে তার সঙ্গিনীর পছন্দসই খাবার।

হঠাৎ বুকটা ধড়াস করে ওঠে শাল্মলীর। কাল রাতে অতলান্ত কার সঙ্গে ডান্স করছিল ওই নাইট ক্লাবে? কোনও চেনা মেয়ে তো নেই সেখানে? তাকে কি যত্ন করে ডিনার খাইয়েছিল সে? তার পর কি হোটেলের ঘরে নিয়ে গিয়েছিল? মাসের পর মাস কি উপোসি থাকতে পারে মানুষ? পছন্দসই সঙ্গী পেলেও?

তবে? তবে কেন ও এমন একটা বিবর্ণ, নিঃসঙ্গ জীবন যাপন করবে? এই যে এত ভার্চুয়াল বন্ধু ওর, তারা কত ডাকাডাকি করছে দেখা করার জন্য। শুধু দেখা করা, আড্ডা দেওয়া, কফি খাওয়া, দুটো কথা বলায় তো কোনও দোষ নেই! হোক না সে অচেনা পুরুষ। তার ডিম্বাণু নিষিক্ত করতে তো সে আমন্ত্রণ জানাচ্ছে না তাদের, শুধু একটু উজ্জীবিত হতে চায় শাল্মলী।

ওই মেয়ে পায়রাটা কি একটু নড়েচড়ে বসল? ঘাড় ঘুরিয়ে শাল্মলীর দিকে এক চোখ দিয়ে তাকিয়ে আছে কেন সে? তার ঠোঁটের কোণে যে মুচকি হাসিটা দেখছে শাল্মলী, সেটা কি ভ্রম? শাল্মলী যেন শুনতে পাচ্ছে, “ভয় পাচ্ছ কেন? এগিয়ে যাও। বেনিয়মেরও তো একটা আলাদা রং আছে।”

কিংকর্তব্যবিমূঢ় শাল্মলী বসে আছে ঝুলবারান্দায়। হাতে মুঠোফোন। পুরুষ-পায়রাটা আবারও খানিকটা পুরীষ ত্যাগ করল কালো পাথরটার উপরে। শাল্মলীর মনে হয় যেন ভর্ৎসিত হল সে আর-এক বার। এ বারে জোড় ভাঙার জন্য নয়, তার ডানার জোর না থাকার জন্য।

পুরুষ-পায়রাটার চোখে চোখ রেখে ফোনটা অন করল শাল্মলী। নিজের পাসওয়ার্ডটা টাইপ করল। খুল যা সিম সিম। আলিবাবার রত্নগুহা উন্মুক্ত। তর্জনী আর বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠের ডগা দিয়ে সে তুলে নিল নীলকান্ত মণিটিকে। আলতো আঙুলে চাপ দিল ‘কনফার্ম’ শব্দটিকে। নীল ইনবক্সে লিখল, ‘শাল্মলী, অসংখ্য ধন্যবাদ তোমাকে। তোমার মতো এক জন ভারতীয় সুন্দরী আমার বন্ধু ভেবে গর্ববোধ করছি।’

ভাল লাগছে শাল্মলীর এই বার্তালাপ। গা শিরশির করছে। তার শরীরের বীজভাণ্ডারে যেন ফাটল ধরছে একটু-একটু করে। সেই ফাটল গলে রেশমি তুলোগুলো বেরিয়ে এসে ডানা মেলে দিল আকাশে। একেবারে বাধাবন্ধনহীন হয়ে উড়তে লাগল তারা।