আজ সত্যিই তাড়া আছে মেঘনার। সময় মতো না পৌঁছলে প্রেজেন্টেশন দিতে পারবে না। অন্য দিন এই সময় বেরোলেও হাতে সময় থাকে। টুক করে একটা রিকশা ধরে বাসস্ট্যান্ডে চলে যায়। তার পর গুচ্ছের বাস। কিন্তু টানা বাসে যেতে বেশি সময় লাগে। তাই সে স্টেশন অবধি বাসে গিয়ে ন’টা পাঁচ বা প্রয়োজনে আটটা চৌত্রিশের ট্রেন ধরে। ট্রেন থেকে নেমে হাঁটাপথে তার অফিস। এক ঘণ্টা পনেরো মিনিট হাতে নিয়ে বেরোলে খুব মসৃণ ভাবে পুরো জার্নিটা হয়ে যায়। আজ একটা গুরুত্বপূর্ণ দিন বলে সে দেড় ঘণ্টা হাতে নিয়ে বেরোল। কিন্তু সামনেই চেক পোস্ট। সারা দিন কি উনি দরজার সামনেই দাঁড়িয়ে থাকেন? এ প্রশ্ন মেঘনার মনে বহু বার জেগেছে। না হলে যতই সময়ের হেরফের হোক ঠিক বেরোবার মুখে দরজা খুলেই উল্টো দিকের ফ্ল্যাটের সরমাদির মুখোমুখি হতেই হবে। মুখে দিদি বললেও মনে মনে মেঘনা জানে যে দিদাটাই সঠিক সম্বোধন হয়! তবে ওই দিদা শোনার চেয়ে দিদি শুনতেই নিশ্চয়ই ওঁর বেশি ভাল লাগে। কখনও আপত্তি করেননি তো! আর মেঘনা তো বলার তেমন সুযোগই পায় না।
আজ সে অতি সন্তর্পণে দরজাটা খুলল। পায়েও কাপড়ের জুতো, যাতে বেড়ালের মতো নিঃশব্দ পায়ে সে চলে যেতে পারে। কিন্তু সরমাদির কাছে সে নেহাতই আনাড়ি। দরজা খুলে যতই নিঃশব্দে সে তালা লাগাক ঠিক কপাট খুলে হাজির সরমা বাড়ুজ্জে। আবার খালি হাতে নয়, একেবারে ঠাকুরের আশীর্বাদি ফুল নিয়ে হাজির। একটু দ্রব হল বটে মনটা মেঘনার। ঠিক হুঁশ তো আছে তার আজ বিশেষ দিন। স্মিত হাসি একটা না উপহার দিয়ে উপায় রইল না। ভদ্রতার খাতিরে হেসে বলতেই হল, ‘‘আপনার তো ঠিক মনে আছে দেখছি।’’ ব্যস! এটুকু শুভারম্ভই যথেষ্ট ছিল, ‘‘সে কী কথা বলছ তুমি! আজ ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে দাঁতটা মাজতে মাজতেই ভাবছি আজ পুজোটা একটু তাড়াতাড়িই সারতে হবে। না হলে মেঘনার যদি দেরি হয়ে যায়! তো চট করে দাঁত মেজে তোমার দাদার জন্য চায়ের জলটা চাপিয়েই বারান্দায় ছুটে গিয়ে খুঁজছি আজ বাগানে ঠাকুরকে দেওয়ার মতো কী কী ফুল আছে। বাগান বলতে তো বুঝতেই পারছ বারান্দায় আমার সারি সারি টব। ওই আমার সাধ্যের মধ্যে সাধের বাগান! গতকাল সন্ধেবেলা বেরিয়েই মিষ্টি কিনে এনেছি ঠাকুরের জন্য। ও আয়োজন নিয়ে আর চিন্তা নেই। কিন্তু সময়ে হবে কি না তাই নিয়ে একটু ভাবনা হচ্ছিল বইকি! তাই তো চা-টা খেতে খেতে কাপড়জামাগুলো সাবানে ভিজিয়ে দিলাম। আবার কখন মালতী কাজে চলে আসবে, তার তো আবার একটা ফাঁকির সুযোগ পেলে হল! কিন্তু আমিও সরমা বামনি। আমাকে ফাঁকি দেওয়াও অত সহজ নয়। দু’টো মানুষের সংসারে আর ক’টা বাসনই বা হয়। তা কত কথা শোনাবে তুমি জানো না! আচ্ছা বল দেখিনি, কথা শোনালেই হল! তুই কি আগুপিছু কিছু বিচার করবি না! তা যাক তার কথা। তোমার দাদার তো দয়ার শরীর। বেশি কিছু ওদের বলা চলে না। তবে কী বলো তো, তোমাদের দু’জনকে বড়ই স্নেহ করেন। বলেন ওরাও দু’টো, আমরাও দু’টো। আমাদের একটু নাহয় বয়স হয়েছে। রজতকে তো দেখতে পেলে কথাই নেই। এত ভালবাসে ওর সঙ্গে কথা বলতে! পার্টি-পলিটিক্স-বাজারদর নিয়ে তো এদের আড্ডা জমে যায়...’’
সে কী আর জানে না মেঘনা! রজত তো অন্য চোখে দেখে এই বর্ষীয়ান দম্পতিকে। কিছু বললেই বলবে, ‘‘এক দিন তোমারও ও রকম বয়স হবে। মানুষের সান্নিধ্য পাওয়ার জন্য ছটফট করবে। ছেলেমেয়ে আত্মীয়পরিজন যখন কাছে থাকবে না তখন বুঝবে। পাশের ফ্ল্যাটের লোকটাকেই তখন আপন মনে হবে। একটু কথা বলার জন্য বারান্দায় দাঁড়িয়ে ধন্যা দেবে। মনে মনে গজগজ করতে করতে মেঘনা ভাবল, যখন মনে হবে তখন মনে হবে। এখন যদি এই জন্য তার বাসটা মিস হয়ে যায় তার খেসারতটা তো তাকেই দিতে হবে! মেঘনার পারদ আস্তে আস্তে চড়ছে! অধৈর্য হয়ে পড়ছে সে! এই এক দোষ ভদ্রমহিলার। লঘু গুরু জ্ঞান নেই। কোথায় সে অফিস যাচ্ছে এখন, আর তিনি কিনা দুনিয়ার গালগল্প জুড়েছেন। আর ওই ভগবানের দোহাই দিল বলে কেন যেন পা’টাও আটকে যাচ্ছে তার। কিন্তু এ বার তাঁকে তৎপর হতেই হবে। না হলে সত্যি সত্যি সাংঘাতিক দেরি হয়ে যাবে। তাই জোর করে এক গাল হাসি মুখে টেনে এনে মেঘনা বলল, ‘‘আসলে আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে। পুজো কি আপনার হয়ে গিয়েছে?’’
‘‘হ্যাঁ... হ্যাঁ হয়ে গিয়েছে। তবে আর বলছি কী! সকাল থেকে তো সেই তোড়জোড়েই লেগেছি। কিন্তু কথায় কথায় দেখো, কেমন গুলিয়ে বসে আছি। এই নাও আশীর্বাদি ফুলটা মাথায় ঠেকিয়ে নাও। আর মুখটা হাঁ করো। আমি মিষ্টিটা বরং খাইয়ে দিই না হলে আবার হাত ধুতে হবে।’’ বিনা বাক্যব্যয়ে মেঘনা মুখ হাঁ করল। না জানি কথা বললে আরও কী কথার ফোয়ারা ছোটে! সে মুখে মিষ্টিটা নিতেই সরমাদি অতি দ্রুত টেবিল থেকে জলের বোতল নিয়ে এসে বলল, ‘‘যেতে যেতে খেয়ে নাও। সাবধানে যাও। রাস্তাঘাটের এখন যা অবস্থা! দুগ্গা দুগ্গা!’’ বলে মাথায় হাত ঠেকিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে কী সব বিড়বিড় করলেন কে জানে!
নামতে নামতে ঘড়িতে চোখ রাখতেই মেঘনার আক্কেলগুড়ুম! কী যে দেরি হয়ে গেল! আজ আর বাস-ট্রেনের ধান্দা করে লাভ নেই। আটটা চৌত্রিশ তো দূরস্থান, এখন ন’টা পাঁচ পাবে কি না সন্দেহ! আর ঝুঁকি না নিয়ে মেঘনা একটা ক্যাব বুক করে নিল সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতেই। একটু সময় হাতে নিয়ে বেরিয়েছিল বলে একদম কাঁটায় কাঁটায় ঠিক সময়ে পৌঁছে গেল এই যা! অফিসে ঢুকেই প্রথম যেটা করল সে— মোবাইলটা বন্ধ করে দিল। না হলে মনঃসংযোগ ব্যাহত হবে। বিদেশি ক্লায়েন্টের ক্ষেত্রে সময়টা খুব গুরুত্বপূর্ণ। গিয়ে নিজের কেবিনে বসে চোখ বুলিয়ে নিচ্ছিল পেপারগুলোতে। তখনই ডাক পড়ল বসের ঘর থেকে। কী ভাগ্যে ক্যাব ধরেছিল, না হলে প্রেস্টিজে গ্যামাক্সিন!
সারাটা দিন আজ বড় ঝক্কি গিয়েছে মেঘনার। সারা দিনে রজত হয়তো ফোন করেছিল। এত ব্যস্ত ছিল যে খোঁজই নিতে পারেনি সে। তবে প্রেজেন্টেশন তার ভাল হয়েছে। সবাই খুশি। ক্লায়েন্ট, বস এবং সে নিজেও। তার সহকর্মীরাও তাকে বাহবা জানিয়েছে। এখন এই সব কথা একটু রজতের সঙ্গে ভাগ না করলেই নয়! তার পর আচমকাই হুঁশ হল যে মোবাইলটাই তার বন্ধ। দ্রুত অন করতেই ঝাঁকে ঝাঁকে মেসেজ, মিসড কলের বন্যা বয়ে গেল। তার মধ্যে সে অফিসে ঢোকার পর থেকে রজতের প্রচুর মিসড কল। কিছু হয়েছিল নাকি! এখন ফোন করলে বেশি কথা বলা যাবে না। অনেক কথাই জমে আছে। তাই বেরিয়ে ট্রেন ধরতে যাওয়ার পথটুকু হাঁটতে হাঁটতে কথা বলতে বলতে চলে যাবে। অফিস থেকে বেরোবার মুখে রিসেপশনিস্ট দিয়াও বলল, ‘‘মেঘনা তোমার হাজ়ব্যান্ড ফোন করেছিল। কিন্তু তখন তুমি কনফারেন্সে ছিলে। পারহ্যাপস হি ইস মিসিং ইউ এ লট।’’ বলেই একটা অর্থপূর্ণ হাসি হাসল লাস্যময়ী দিয়া। মেঘনা তার দিকে একটা হাসি ছুড়ে দিয়ে রাস্তায় নামল। চারিদিকে নিয়ন বাতির মায়াজাল। বড্ড মায়াবী মনে হয় এই সময় কলকাতা শহরটাকে। একবার এই সময় পথে নামলে মনে হয় কোনও অজানা উদ্দেশ্যে সে পাড়ি দিয়েছে। হাতে হাত ধরে হাঁটতে ইচ্ছে করে। কাঁধে মাথা রেখে দুটো যদি কথা বলা যায়, বা মন উজাড় করে উদাত্ত কণ্ঠে গান! শহরের সেই জাদুর মায়ায় হাঁটতে হাঁটতে সত্যিই বড্ড রজতের কথা মনে হচ্ছিল। সে ব্যাগ থেকে মোবাইল নিয়ে রজতের নম্বরে যাওয়ার আগেই তার সুরেলা রিংটোন বেজে উঠল। নামটা দেখেই মাথা গরম হয়ে গেল মেঘনার। মুহূর্তে সব প্রেম ভেঙে খানখান। সরমাদি!
কিন্তু এখন না ধরলে তিনি ফোন করতেই থাকবেন। মেঘনা জানে তাঁকে এখন বিপুল ধৈর্যের পরীক্ষা দিতেই হবে। সকালে দাঁত মাজা দিয়ে শুরু করেছিলেন, এখন নিশ্চয়ই তার বেরোবার পর থেকে শুরু করবেন। বড় করে একটা শ্বাস নিল মেঘনা। নিয়ে মোবাইলটা সোয়াইপ করল। করতে না করতেই সেই পরিচিত কণ্ঠস্বর, ‘‘বাঁচলাম বাবা ফোনটা ধরলে। কী চিন্তাই না হচ্ছিল। তুমি সিঁড়ি দিয়ে নামছ আর আমি প্রার্থনা করছি। ঠাকুর মঙ্গল করো সবার। একটা ভাল কাজে যাচ্ছে মেয়েটা, যেন সফল হয়।’’ মেঘনা জানে তার বেরোবার মুহূর্ত থেকে যখন শুরু হয়েছে, তখন প্রতিটা আপডেট সেই তখন থেকে এখন পর্যন্ত দিতে খুব কম করে এক ঘণ্টা লাগবে। তাই ফোনটা সে কাটল না। হাতে নিয়েই একটা কাঠি রোল কিনে খেল। মেঘনা জানে সরমাদি তখনও নিশ্চয়ই নানা রকম বার্তালাপ চালিয়েই যাচ্ছেন। আর সে আলগোছে মুঠোফোনটা খানিক দূরত্বে ধরে আছে। তবু কী মনে হতে মোবাইলের স্ক্রিনে চোখ রাখল। রজত ফোন করছে। সে দ্রুত কানে লাগিয়ে বলল, ‘‘দিদি, রজত ফোন করছে।’’ ফোনটা নিতে না নিতেই অসম্ভব ঝাঁজ রজতের গলায়, ‘‘সকাল থেকে ট্রাই করছি। ফোন অন করার পরও কি একটা কল করতে নেই?’’
‘‘আরে বাবা! আজ কত চাপ ছিল তা তো জানো। তার পর তো অফিস থেকে বেরিয়েই সরমাদির ফোন। সকালে বেরোবার সময়ও তো আধ ঘণ্টা হাতে নিয়ে বেরিয়েছিলাম আটটা চৌত্রিশের লোকালটা ধরব বলে। তা বেরোতে না বেরোতেই ওঁর মুখোমুখি। আধা ঘণ্টা দিল নষ্ট করে চারটি বকবক করে। আবার কাটিয়েও আসতে পারছি না। আমার জন্য ফুল মিষ্টি দিয়ে ঠাকুরকে পুজো দিয়েছে। হয়েছে ভাল। এত ডিসগাস্টিং মহিলা! কোনও কাজ নেই। সারাক্ষণ বকবক করে। এর পরের দিন আমি একদম কোনও সৌজন্য দেখাব না। মুখের উপর বলে দেব, ‘আমার লেট হচ্ছে, আমি যাচ্ছি।’ জানো, তার পর বাধ্য হয়ে শেষে বেরিয়ে একটা ক্যাব ধরলাম।’’
‘‘এ দিকে চিন্তায় আমার প্রাণের পাখি উড়ে গিয়েছিল। কী অবস্থা! তোমার ফোন পাচ্ছি না। শেষে অফিসে ফোন করে খবর নিলাম। তবু মনে হচ্ছিল একদম তোমার মুখ থেকে যদি শুনতে পেতাম যে তুমি ঠিক আছ, তবে নিশ্চিন্ত হতাম। সরমাদিও সারা দিন ছটফট করেছেন। সঙ্গে দাদাও। দাদাই তো বেরিয়ে খবরটা জানতে পেরেছিলেন।’’
‘‘কী বলছ বলো তো! কিসের চিন্তা? কী ঘটনা! কই কিছু জানি না তো! কিছুই বুঝতে পারছি না।’’
‘‘আটটা চৌত্রিশের লোকালটা আজ অ্যাক্সিডেন্ট করেছে একটা মেল ট্রেনের সঙ্গে। বহু যাত্রী মারা গিয়েছে এবং আহত। সমানে টিভিতে দেখাচ্ছে। সরমাদি আজ বকবক করে তোমায় দেরি না করিয়ে দিলে...’’
রজতের কথা শুনে ধপ করে রোলের দোকানেই বসে পড়ল মেঘনা। আকস্মিক ঘটনাটা শুনে বড্ড ধাক্কা লেগেছে তার। একটু ধাতস্থ হয়ে ফোন করল সরমাদিকে। করতেই অন্য প্রান্ত থেকে ভেসে এল সেই গলা, ‘‘কথা হল কর্তার সঙ্গে? তোমার দাদা কী রাগ করছে। বলছে মেয়েটা একটা বড় পোস্টে চাকরি করে। তুমি যখন-তখন ফোন করে বিরক্ত করো। আসলে বড্ড চিন্তা হচ্ছিল।’’
‘‘না না ঠিক আছে। বলছিলাম যে আজ আমরা সবাই মিলে রাতে মাংস-ভাত খেলে কেমন হয়!’’ উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়ল সরমাদি, ‘‘সত্যি বলছ? আমার তো কত দিনের ইচ্ছে সবাই মিলে এক সঙ্গে খাব, গল্প করব, হাসব। কিন্তু তোমরা তো ব্যস্ত! কী আনন্দ হচ্ছে শুনে। ওগো শুনছ কী বলছে দেখো...’’ মেঘনা জানে, আজ বাড়ি ফিরে তার জন্য এক রাশ আনন্দ উচ্ছ্বাস অপেক্ষা করছে, যার জেরে নিমেষে তার সব ক্লান্তি ঘুচে যাবে। রাতে চোখে নামবে শান্তির ঘুম।