Abosar

পণ

কৌস্তুভ বন্দ্যোপাধ্যায়

যখনই কোথাও আগুন জ্বলে, একটা পোড়া গন্ধ পায় দীনু। সেই যে দিন ওর একমাত্র ছেলে হরি পুড়ে মারা গেল, সে দিন থেকেই।

আজ থানার উলটো দিকের চায়ের দোকানে বসে আবার পেল গন্ধটা দীনু। শরীরটা পাক দিয়ে উঠল ওর। সামলে নিল কোনও রকমে।

হরির মায়ের একেবারেই ইচ্ছে ছিল না যে ছোট্ট ছেলে মা-বাবাকে ছেড়ে এত দূরে কাজ করতে যায়। বরং দীনুই জবরদস্তি করল। ঘরে অভাব, মেয়েগুলো বড় হচ্ছে, তাদের বিয়ের ব্যবস্থা করা, এই সব ভেবেই ও শহরে কাজ করতে পাঠাল হরিকে। তখন কেউ জানত তার এমন ফল হবে? দীর্ঘশ্বাস ফেলল দীনু।

‘সকাল থেকে তো কিচু খাসনি। একটু কিচু খেয়ে নে,’ সুবলের কথায় দীনু খেয়াল করল, সঞ্জিত সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। ‘আর একটু কাজ বাকি আচে। ওটুকু শেষ করেই খাব,’ বলল সঞ্জিত।

ছেলেটাকে দেখে কৃতজ্ঞতায় মাথা ঝুঁকে আসে দীনুর। সম্পুর্ণ অনাত্মীয় হয়েও দীনুর জন্য সঞ্জিত যা করছে, নিজের সন্তানের পক্ষেও সব সময় তা সম্ভব হয় না। সুবলের দূর সম্পর্কের আত্মীয় সঞ্জিতের সঙ্গে দীনুর বড় মেয়ে চিত্রার বিয়ের সম্বন্ধ করেছিল। কথাও এগিয়েছিল অনেক দূর। ছেলের ফুড কর্পোরেশনে পিওনের চাকরি, তবুও সরকারি তো। মাস গেলে বাঁধা মাইনে। মেয়েও ওদের পছন্দ। তবে ছেলের বাপের টাকার খাঁই বড়। পুরো এক লাখ নগদ, পাঁচ ভরি সোনা আর মোটর সাইকেল চেয়ে বসে আছে। যদিও এত কিছু দেওয়া দীনুর সামর্থ্যের বাইরে, তবু মেয়েটাকে সুখী দেখতে প্রাণপণ চেষ্টা করছিল ও।

কিন্তু তার পরেই ঘটে গেল দুর্ঘটনাটা। বিয়েটা যে আর সম্ভব নয়, সেটা দিনের আলোর মতোই স্পষ্ট। তবুও শুধু কর্তব্যের খাতিরেই এত ছোটাছুটি করছে ছেলেটা। তা না হলে অশক্ত, অসমর্থ দীনুর পক্ষে এ সব কিছু সম্ভবই হত না।

‘দরখাস্তটাতে একটা টিপ সই করতে হত,’ সঞ্জিতের কথায় ভাবনায় ছেদ পড়ল।

‘অ, তা যাচ্চি,’ হাতের লাঠিতে ভর দিয়ে উঠতে গিয়েও টলে গেল শরীরটা। ওরা এগিয়ে এসে সামলাল কোনও রকমে। সুবল বলল, ‘সঞ্জু, তুই কাগজখানা নিয়ে আয়। ও বেচারাকে আর কষ্ট করতে হবে না।’

‘ঠিকাচে,’ ভিতরে গেল সঞ্জিত।

পাকা রাস্তার ধারে মন্টুর চায়ের দোকানে বসেছিল দীনু। হঠাৎই মুখুজ্যেমশাই দাঁড়িয়ে পড়লেন ওর সামনে, ‘কেমন আছ দীনু?’ এমনিতে মুখুজ্যেমশাই দীনুর মতো মানুষের সঙ্গে গল্প করেন তা নয়, তবে এখন পরিস্থিতি একটু আলাদা। পর পর কয়েকটা দুর্ঘটনায় দীনু বেসামাল। তাই সহানুভূতির মলম দেওয়া। 

‘একন একটু ভাল আচি কাকা। বেড়াতে বেড়িয়েচেন না কি?’

‘ওই আর কী। বেড়ানো, দু’পাঁচটা লোকজনের সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ, সবই হয়। তা ওষুধ ঠিক মতো খাচ্ছ?’ ঘাড় নেড়ে হ্যাঁ বলে দীনু।

‘ওটাই আসল, ওটাতে যেন ফাঁকি দিও না,’ কথাটা বলেই প্রসঙ্গ পালটে বললেন, ‌‘আর ওই ব্যাপারটা কী করলে? এত সহজে ছেড়ে দিলে ব্যাপারটা? থানায় গেলে পারতে!’

প্রসঙ্গটা উঠতেই রক্তক্ষরণ শুরু হল দীনুর বুকে। সারা পৃথিবী যেন ষড়যন্ত্রে মেতেছে ওর বিরুদ্ধে। যতই ও ভুলতে চায়, ততই মনে করিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হয়।

দুর্ঘটনার দিন জমিতে কাজ করছিল দীনু। হঠাৎ ছোট মেয়ে সুমিকে ছুটে আসতে দেখেই বুঝেছিল, বিপদ কিছু একটা ঘটেছে। তার পর যখন শুনল, হরির মালিক ফোন করেছে, তখন কী একটা আশঙ্কায় উদ্বিগ্ন হয়ে ছুটল বাড়ির দিকে। হরির মালিক জানাল, গ্যাস সিলিন্ডার ফেটে পুড়ে মারা গিয়েছে দীনুর ছেলে। খবরটা শুনে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল দীনু। ওর মনের মধ্যে যে পোড়া ক্ষত সে দিন তৈরি হল, তার নিরাময় এখনও হয়নি।

‘কী হবে থানায় যেয়ে? যা হওয়ার তা তো হয়েই গ্যাচে। আর থানা-পুলিশ করে কী হবে?’ তিক্ত স্বর দীনুর।

‘তাও এক বার যেতে পারতে। ক্ষতি তো কিছু নেই,’ মুখুজ্যেমশাই বললেন।

কে যেন বলল, ‘ওইটুকু একটা ছেলেকে অত দূরে শহরে কাজ করতে না পাটালে বোদায় এ সব ঘটত না।’

পাশ থেকে বৃদ্ধ খোকন কবিরাজ বলে উঠলেন, ‘ও সব তোমাদের ভুল ভাবনা। সাবধানের যেমন বিনাশ নেই, বিনাশের তেমনি সাবধান নেই!’

ঠোঁটকাটা চক্রবর্তী পাশেই ছিল। ফস করে বলে ফেলল, ‘থানাপুলিশ করে কাঁচকলা হবে। পুলিশ টাকা খায়। গরিবের আবার সুবিচার!’

‘না না চক্কোত্তি, ওটা ঠিক নয়। পুলিশে ঘুষ খায় বটে, তবে অপরাধীকে ওরাই ধরে,’ মুখুজ্যেমশায়ের জামাই চাকরি করে পুলিশে, চক্রবর্তীর খোঁচায় তাই কিছু না বলে পারলেন না।

উপস্থিত চার-পাঁচ জনের মধ্যে তখন পুলিশের ঘুষ খাওয়া, গরিবের সুবিচার পাওয়া ইত্যাদি বিষয় নিয়ে জোর আলোচনা শুরু হল।

দীনুর ভাল লাগছিল না এ সব। অশক্ত শরীরে লাঠিটা ধরে কোনও রকমে কাঁপতে কাঁপতে বাড়ির পথ ধরল সে। কানের কাছে একটাই শব্দ যেন বারবার শুনতে পাচ্ছিল, ‘অপরাধী।’ নাহ্‌, এ অবিচারের একটা বিহিত চাই। বুকের মধ্যে হঠাৎ দপ করে জ্বলে উঠল আগুন।

সম্বিত ফিরতেই দীনু দেখল, সঞ্জিত কখন এসে দাঁড়িয়েছে।

সঞ্জিতের হাত থেকে দরখাস্তটা নিয়ে, নির্দিষ্ট জায়গায় টিপছাপ দিল দীনু। আর ঠিক তখনই পুলিশের ভ্যান থেকে কোমরে দড়ি বাঁধা যে লোকটা নামল, দীনু তার মুখের দিকে তাকিয়েই চিনতে পারল। ও আর কেউ নয়, হরির মালিক, শিশির দত্ত। উত্তেজনায়, আবেগে চোখে জল এল দীনুর।

‘এ বার আর শিশির দত্তর নিস্তার নেই,’ সঞ্জিত বলে উঠল
পাশ থেকে।

দীনু পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে, শিশির দত্তকে প্রথমে কাঠগড়ায় তোলা হল। জজসাহেব সব শুনে প্রচণ্ড রেগে বলছেন, ‘কয়েকটা টাকার বিনিময়ে একটা বাচ্চাকে দিয়ে এমন একটা কাজ করালেন? আপনার তো ফাঁসি হওয়া উচিত!’

এক জন পুলিশ আর এক ধুতি-পাঞ্জাবি পরা ভদ্রলোক ওদের সামনে এসে দাঁড়াতেই ভাবনার সুতোটা ছিঁড়ে গেল। পুলিশটি দীনুকে জিজ্ঞেস করল, ‘দীনু মণ্ডল কে? তুমিই তো?’ দীনু ‘হ্যাঁ’ বলতেই পুলিশটি অন্য ভদ্রলোকটিকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘যাদের কথা বলছিলাম।’ তার পর চলে গেল ভিতরে।

ওরা আগাগোড়া কিছুই বুঝতে না পেরে একে অন্যের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল ফ্যালফ্যাল করে। ভদ্রলোক নিজের পরিচয় দিয়ে বললেন, ‘তোমাদের কেসটা আমি শুনেছি। খুবই মর্মান্তিক।’

ছেলের প্রসঙ্গ উঠতেই আবার পোড়া গন্ধটা টের পেল দীনু। চোখ দিয়ে দু’ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল, চাদরের খুঁট দিয়ে মুছে নিল সেটুকু।

পাশ থেকে সুবল বলল, ‘দুদের ছেলডার যারা এমোন সব্বোনাস করল, তারা যেন শাস্তি পায়।’

‘ঠিক, শাস্তি তাদের পেতেই হবে। এই সব অপরাধীদের ছেড়ে দিলে চলবে না,’ ভদ্রলোক গম্ভীর ভাবে বললেন।

দীনু কিছু না বললেও মনে মনে ভরসা পেল একটু।

ভদ্রলোক তাদের মধ্যাহ্ণভোজন করানোর প্রস্তাব দিলেন। ‘সকাল থেকে তো কিছুই খাওয়া হয়নি? চলো, একটু কিছু খেয়ে নেবে।’

আপত্তি জানাল ওরা, ‘না না, কাজটা না মিটিয়ে যাওয়া ঠিক হবে না।’ কিন্তু ভদ্রলোক সব কিছুকেই অগ্রাহ্য করে বললেন, ‘আমি যখন এসে গিয়েছি, সব কিছু আমার উপর ছেড়ে তোমরা নিশ্চিন্তে থাকো। বাকি ফর্মালিটি সব আমিই সামলে নেব। আমরা সরকারি লোক, আমাদের উপর ভরসা করে দেখো, ঠকবে না।’

গরম ভাতের টান অনেক সময়ই ভুলিয়ে দেয় সমস্ত যুক্তি। ওরা ভাবল, সকাল থেকে পেটে দানাপানি পড়েনি। বাকি দিনটাতেও জুটবে না কিছুই। বেশি ওজর-আপত্তিতে সাধা ভাত ফসকে না যায়! তড়িঘড়ি তাই রাজি হয়ে গেল সবাই।

কাছের একটি হোটেলে নিয়ে যাওয়া হল ওদের।

ভরপেট খাওয়ার পর তৃপ্তির উদ্গার ছেড়ে সঞ্জিত বলল, ‘লোকটার মতলবটা ঠিক বুজা যাচ্চে না।’ সুবলও সায় দিল ওর কথায়। শুধু দীনু কিছু বলল না।

খাওয়াদাওয়ার পাট চুকলে দীনুকে এক সময় আড়ালে ডেকে নেন ভদ্রলোক। চেয়ে নিলেন দরখাস্তটা। তার পর সেটাতে এক বার চোখ বুলিয়ে নিয়ে বললেন, ‘বাহ্‌, বেশ হয়েছে।’ তার পর সেটাকে ভাঁজ করে নিজের ফাইলে রাখতে রাখতে বললেন, ‘এটা বরং আমার কাছেই থাক। আর যা-যা করার, আমি নিজেই করে নেব।’

দীনু যেন ভরসা পায়। কৃতজ্ঞতায় চোখে জল এসে যায় তার। জোড়হাত করে বলল, ‘বাবু, ওরা শাস্তি পাবে তো?’
ভদ্রলোক আশ্বাস দেওয়ার ভঙ্গিতে বললেন, ‘বললাম না? তোমরা নিশ্চিন্তে থাকো।’

 নিশ্চিন্তে চোখদুটো বুজে এলো দীনুর।

‘আপনার তো ফাঁসি হওয়া উচিত,’ শিশির দত্তকে ধমকে বললেন ভদ্রলোক। ভয়ে কুঁকড়ে গেল শিশির দত্ত। মিনমিন করে কিছু বলতে যাচ্ছিল সে, ভদ্রলোকের ধমক খেয়ে চুপ করে গেল।

‘তোমরা যাতে সঠিক বিচার পাও, সেটা দেখার জন্যই আমি এখানে এসেছি।  তোমার ফ্যামিলির অবস্থাও আমার অজানা নয়। দু-দুটো মেয়ের বিয়ে হয়নি এখনও, তার ওপর তোমারও আর কাজ করার মতো অবস্থা নেই।’

কয়েক মুহূর্তের জন্য থামলেন ভদ্রলোক। দীনু অভিভূত হয়ে শুনছিল ওর কথা। ব্যাগ থেকে একটা বোতল বের করে দু’ঢোক জল খেয়ে দীনুকে একটু আড়ালে নিয়ে গেলেন তিনি। বললেন, ‘আমি ব্যক্তিগত ভাবে ওই পাষণ্ড শিশির দত্তর শাস্তি চাই। কিন্তু ও শাস্তি পেলেই তো আর তোমার ভাতের জোগাড় হয়ে যাবে না। কি, তাই তো?’ দীনুর মুখের দিকে তাকালেন ভদ্রলোক। বিহ্বল দীনু হাঁ করে তাকিয়ে ছিল ভদ্রলোকের মুখের দিকে। কয়েক মুহূর্ত অপেক্ষা করে, দীনুর উত্তর না পেয়ে নিজেই বললেন, ‘তা ছাড়া, ওদের পয়সা আছে। তার জোরেই যে ওরা ছাড় পেয়ে যাবে না, তার নিশ্চয়তা কী? তাই বলছিলাম, সব দিক বিবেচনা করে ব্যাপারটা আপসে মিটিয়ে ফেলাই ভাল। আমার সঙ্গে কথা হয়েছে শিশির দত্তর, ওরা কিছু টাকা দেবে ক্ষতিপূরণ বাবদ। যদিও কোনও কিছু দিয়েই তোমার এই ক্ষতি পূরণ হওয়ার নয়।’

থামলেন ভদ্রলোক। দীনু বসে পড়ল ধপ করে। সারা শরীর যেন ভরহীন মনে হচ্ছে ওর। মাথার ভিতরটা যেন ফাঁকা। শুধু একটা তীব্র যন্ত্রণা ছড়িয়ে পড়েছে শরীরের প্রতিটি রোমকূপে। চোখের জলে ঝাপসা হয়ে গেল দৃষ্টি।

আর তখনই দীনু স্পষ্ট দেখতে পেল, সামনের দোকানটা, যেটাকে এত ক্ষণ শাড়ির দোকান ভাবছিল, আসলে সেখানে বিবাহযোগ্যা মেয়েদের নিয়ে পসরা সাজিয়েছে এক জন। এক এক জন ঢুকছে আর বেছে নিচ্ছে নিজেদের পছন্দের পাত্রী। হঠাৎ সেখানে ঢুকল সঞ্জিতের বাবা। দীনু সামনে এগিয়ে দিল চিত্রাকে। ‘আমার ছেলে ফুড করপোরেশনে চাকরি করে। মাস গেলে মাইনে পায়। তোমার মেয়েকে নিয়ে যেতে হলে টাকা দিতে হবে। টাকা আচে?’

তখন পোড়া কাঠের মতো একটা বাচ্চা ছেলে কোথা থেকে এসে বলল, ‘টাকা চাই? টাকা  তো অাচে আমার কাচে। আর দেরি না করে বাবুর কোমরের দড়িটা খুলে দাও। চিত্রার বিয়াটা দিয়া দাও।’

দীনু এত দূর থেকে ঠিক ঠাহর করতে পারল না, ওই ছেলেটিই হরি কি না!

 

 

 

‘রবিবাসরীয়’ বিভাগে ছোটগল্প পাঠান, অনধিক ১৫০০ শব্দে।
ইমেল: rabibasariya@abp.in সাবজেক্ট: rabibasariya galpa

ডাকে পাঠানোর ঠিকানা:

‘রবিবাসরীয় গল্প’,

আনন্দবাজার পত্রিকা,

৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট,

কলকাতা ৭০০০০১

যে কোনও একটি মাধ্যমে গল্প  পাঠান। একই গল্প ডাকে ও ইমেলে পাঠাবেন না। পাণ্ডুলিপিতে ফোন নম্বর বা ইমেল আইডি জানাবেন। ইউনিকোড ব্যবহার করা বাঞ্ছনীয়।