লীলা কাপড়খানা বুকে জড়িয়ে ধরে বিছানায় শুয়ে হাঁপাচ্ছিল। জ্বরে তার গা পুড়ে যাচ্ছে। শরীর দুর্বল। কিন্তু লোকটা লীলার কোনও কথা শোনেনি। তাচ্ছিল্যের সুরে বলেছিল, “বেশ্যাদের আবার শরীর খারাপ!”
লীলা সুন্দরী। যুবতী। পল্লিতে তার কদর খুব। বিশ্রামের ফুরসত খুব কম পায় লীলা। প্যান্টের বেল্ট পরতে পরতে লোকটা বলল, “পান খাবি?”
লীলা চোখের উপর হাত রেখে শুয়েছিল। কাগজে মোড়া পান লীলার কোলের উপর ছুড়ে দিয়ে লোকটা চলে যেতে যেতে বলল, “তাড়াতাড়ি সেরে ওঠ। আবার কাল দুপুরে আসতে পারি।”
জ্বরের জন্য লীলার হাতে-পায়ে ব্যথা, তার উপর লোকটা জন্তুর মতো অত্যাচার করেছে। লীলার মাথার চুল থেকে টপটপ করে ঘাম ঝরে পড়ছে। চুল টেনে টেনে মাথায় যন্ত্রণা ধরিয়ে দিয়েছে লোকটা।
“কুত্তা!” লীলা দাঁতে দাঁত পিষে বলল, “বেশ্যার কি পাথরের শরীর নাকি রে!” কাগজ খুলে পান বের করেও কী ভেবে লীলা খেল না। জানলা দিয়ে ফেলে দিল। হাতের মুঠোয় মোড়কের কাগজটা ধরে থেকে বলল, “কাল এ রকম করে দেখ না। গলার নলি কেটে নেব!” বলতে বলতে রাগে-ঘেন্নায় লীলার দাঁত কড়মড় করে উঠল।
পানটা মোড়া ছিল একটা খবরের কাগজের ছেঁড়া পাতায়। লীলা অল্প-বিস্তর লেখাপড়া জানত। অক্ষরের প্রতি একটা স্বাভাবিক টান ছিল তার। বইয়ের ছেঁড়া পাতা থেকে খবরের কাগজের ঠোঙা, সব পড়ে নিয়ে তার পর ফেলা লীলার অভ্যেস। আজ লীলা দেখল পানের রসে ভিজে যাওয়া কাগজের ছেঁড়া টুকরোটায় কয়েকটা ছেঁড়া ছেঁড়া কথাই কোনও রকমে পড়া যাচ্ছে, ‘…তুমি বাঁকা-সোজা যে পথেই চলো, যত পাপই করে থাকো না কেন; আমার প্রতি নিষ্ঠা, আন্তরিকতা, প্রেম থাকলে তুমি আমাকে পাবেই। একথা আমি সত্য প্রতিজ্ঞা করে বলছি; কেন না তুমি আমার অত্যন্ত প্রিয়…’
কখনও কখনও অতি তুচ্ছ ঘটনাও মানুষের বিপুল গতিময় জীবনকে থমকে দাঁড় করায়। হৃদয় নানা অনুভূতির স্পর্শ পায়। লীলা তার প্রথম খদ্দেরের সঙ্গে মিলনকালে ঘৃণার স্পর্শ পেয়েছিল। আজ লেখাগুলো পড়ে লীলা আনন্দ ও বিস্ময়ের স্পর্শ পেল। লেখাটা বারবার পড়তে পড়তে লীলার চোখ আটকে যাচ্ছিল একটি বাক্যতে—‘তুমি আমার অত্যন্ত প্রিয়’। লীলা ভাবতে লাগল, ‘এ কথা কি আমার জন্যও? আমি কার এত প্রিয়? আমি বাঁকা পথে চলেছি জেনেও সে আমায় ভালবাসবে? সে কি পাপ-পুণ্যের ধার ধারে না? তার প্রতি নিষ্ঠা, প্রেম থাকলেই তাকে পাওয়া যাবে? আন্তরিকতা মানে কী?’
ভালবাসার স্বাদ লীলা পায়নি। এত দিন ধরে কতগুলো মানুষের কামনার আগুনকে তৃপ্ত করে এসেছে। তার মা তাকে একটু-আধটু ভালবাসত, লেখাপড়া শিখিয়েছিল। বাবার পরিচয় সে জানে না। লীলাকে কেউ কোনও দিন বলেনি, ‘তুমি আমার প্রিয়।’ লেখাটা বার বার পড়ে লীলার মনে হল বক্তা যেন ঠিক তাকে উদ্দেশ্য করেই কথাগুলো বলছে। এই মনে হওয়া গভীরভাবে লীলাকে দখল করে ফেলল। এই ভাবনা লীলাকে এমন আচ্ছন্ন করে ফেলল, লীলা এই চিন্তা থেকে বেরোতে পারল না।
‘বেশ্যারা কখনও কারও প্রিয় হয়?’ কথাটা মনে হতেই লীলার ঠোঁটে ফুটে উঠল তাচ্ছিল্যের হাসি। পরক্ষণেই মনে পড়ল বক্তার সত্য প্রতিজ্ঞা— ‘আমার প্রতি প্রেম থাকলেই আমাকে পাবেই।’
আর হাসতে পারল না লীলা। সে ভুরু কুঁচকে কী যেন এক ভাবনায় ডুবে গেল।
**
মালতী সেজেগুজে রাস্তার ধারে খদ্দেরের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে ছিল। পল্লিতে আসা প্রতিটি পুরুষের দিকে কামনাতুর দৃষ্টি হেনে, গাঢ় লিপস্টিক মাখানো ঠোঁটের হাসিতে কৃত্রিম মধুরতা এনে কাতর অনুরোধ জানাচ্ছিল, “এদিকে এসো। পঞ্চাশ টাকা লাগবে।”
কিন্তু কেউ ফিরে তাকাল না। এমন সময় লীলা এসে অশিক্ষিতা মালতীকে কাগজের লেখাটা পড়ে শুনিয়ে উদ্গ্রীব ভাবে জানতে চাইল, “কে এই কথাটা বলেছে জানিস?”
মালতীর দৃষ্টি পথচলতি পুরুষের উপর ঘুরপাক খাচ্ছে। সে দায়সারা উত্তর দিল, “পুরনো কোনও সিনেমার ডায়লগ হবে।”
“না রে! সিনেমার ডায়লগ নয় মনে হচ্ছে।”
“ফালতু বকাস না তো! আমি তো তোর মতো মাধুরী দীক্ষিত নই, যে দাঁড়াতে হয় না; লোক এসে দরজা ঠেলে… ” মালতী আবার পথচলতি লোকজনের দিকে ইশারা-ইঙ্গিত করায় ব্যস্ত হয়ে পড়ল।
লীলা কিন্তু দমল না। বক্তার পরিচয় জানতে সে মরিয়া। সত্যি কি সে লীলাকে ভালবাসে? লীলা বেশ্যাপল্লির সবাইকে প্রশ্ন করে বেড়াতে লাগল। কেউ হাসল, কেউ গাল দিল, আবার কেউ লীলার কপালে হাত দিয়ে চিন্তিত মুখে বলল, “জ্বরটা বাড়ছে মনে হচ্ছে। ডাক্তারখানায় যা।”
লীলা জানে জ্বর থাকলেও তার মতিভ্রম হয়নি। একমাত্র মোড়ের চা-ওয়ালা স্বপন লেখাটা দেখে অনেক ভেবেচিন্তে তাকে বলল, “এ তো কোনও নেতার ভাষণ মনে হচ্ছে। নেতারা ভোটের আগে অমন বলে, ভোটের পর সব ভুলে যায়।”
স্বপনের জবাব না-পসন্দ হওয়ায় লীলা বাজারের বইয়ের দোকানে গিয়ে কাগজের টুকরোটা দেখিয়ে বইওয়ালাকে জিজ্ঞাসা করল, “এগুলো কোন বইয়ে আছে?”
দোকানি সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে লীলার দিকে তাকাল। তার পর এক ঝলক লেখাটায় চোখ বুলিয়ে বলল, “বলতে পারছি না।”
লীলা ঘরে ফিরে বিছানায় শুয়ে পড়ল। লেখা পড়ে তার দৃঢ় ধারণা হয়েছে, এ কোনও নেতার ভাষণ নয়। স্বপনটা বোকা। ওর বিদ্যে-বুদ্ধিই
বা কতদূর!
‘যত পাপই করে থাকো না… তুমি আমার অত্যন্ত প্রিয়।’
কতটা আশ্বাস, স্নেহ, অনুরাগ প্রকাশ পাচ্ছে কথার প্রতিটি ছত্রে। এই অচেনা বক্তা পুরুষ না নারী, যুবক না বৃদ্ধ, জীবিত না মৃত, তা কিছুই জানে না লীলা। তবুও মনের নিভৃতে ভালবাসার বন্ধনে বাঁধা পড়ছে বক্তা। লীলা মনে মনে সে পুরুষকে এঁকে নিয়েছে। ধীর, স্থির, সৌম্যদর্শন এক পুরুষ। লীলা যেন শুনতে পায় তার কথা। তার কণ্ঠে ছায়ার স্নিগ্ধতা, ‘লীলা, তুমি ভাগ্যদোষে বাঁকা পথে হেঁটেছ। এখন আমাকে পেয়েছ। আমাকে ভালবাসো। তিন সত্যি করে বলছি, আমি তোমার হব আর তুমি আমার হবে।’
প্রিয়তমর বুকে মাথা রেখে পরম সুখে চোখ বুজল লীলা। মনে মনে বলল, ‘আমি শুধু তোমার…’ বালিশের নীচে কাগজটা রেখে লীলা ঘুমিয়ে পড়ল।
পরদিন জ্বর সামান্য কমলেও লীলার শরীর তখনও দুর্বল। কোনও রকমে উঠে ভাতের হাঁড়ি চাপাল। চাল, আলু ধুয়ে হাঁড়ির মধ্যে দিয়ে দিল। তার পর বিভোর হয়ে গেল হৃদয়ের নিভৃতে বসবাসকরী নতুন প্রিয়তমর চিন্তায়। সেই বক্তা যদি রক্তমাংসের হয়, যদি লীলার সামনে এসে দাঁড়ায়, তবে কেমন ভাবে তাকে বরণ করবে লীলা? হয়তো লীলা তাকে এই ঘরে ঢুকতে দিতে শঙ্কিত হবে। দাঁড়িয়ে থাকবে অধোবদনে। তখন তার প্রিয়তম মৃদু হেসে বলবে, ‘এখনও এত দ্বিধা, লীলা? আমি যে তোমার প্রেমিক।’ লীলা চোখের জলে প্রিয়তমের পা ধুইয়ে দেবে। যত রকম ভাবে পারা যায়, তার সেবা করবে। কিন্তু তার খিদে পেলে খেতে দেবে কী? এই বেশ্যাবৃত্তির উপায়ে আহরণ করা অন্ন? অজ্ঞাতপরিচয় হাজারটা পুরুষের পাপের ভাগ সে প্রিয়তমকে দেবে? লজ্জায় লীলা আকর্ণ রক্তিম হয়ে উঠল। প্রিয়তমর চিন্তায় বেহুঁশ লীলা দেখতেই পেল না হাঁড়ি থেকে ফ্যান উথলে পড়ে যাচ্ছে।
হঠাৎ বন্ধ দরজায় টোকা পড়ল। “লীলা, দরজা খোল।” সেই কালকের লোকটা।
“আমার শরীর ভাল নেই। আজ যাও।”
“দরজা খোল বেশ্যা মাগি!” কর্কশ গলায় পাগলা কুকুরের মতো খেঁকিয়ে উঠল লোকটা।
বিরক্ত লীলার চেঁচামিচি ভাল লাগল না। সে দরজা খুলে দিতেই হুড়মুড়িয়ে ঘরে ঢুকল আগন্তুক। লীলা এক পাশে সরে এল। লোকটা আকণ্ঠ মদ খেয়েছে। সেই অবস্থায় লীলাকে বিস্তর গালি দিতে দিতে খাটে শুয়ে পড়ল। লীলাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে লোকটা বিদ্রুপের হাসি হাসল, “তোকে কি পান-সুপুরি দিয়ে নেমন্তন্ন করে বিছানায় আনতে হবে?”
“আমার আজ ভাল লাগছে না।”
“আমি আর এক বার বলব। আয়!”
“যাব না,” তীব্র ঘৃণায় দাঁতে দাঁত চেপে বলল লীলা।
তড়াক করে বিছানা ছেড়ে লাফিয়ে উঠল লোকটা। তার কপালের শিরাগুলো রাগে ফুলে উঠেছে। পায়ের জুতো খুলে লীলার দিকে ছুড়ে মারল। লীলা তবুও নিশ্চল। তখন লোকটা রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে লীলাকে নির্দয়ভাবে মারতে
শুরু করল।
“গায়ে হাত দিচ্ছ কেন? আমি কিন্তু লোক ডাকব?” লীলা প্রাণপণে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করল।
“কাকে ডাকবি ডাক! তুই কি আমার বিয়ে করা বৌ নাকি!” লোকটা লীলার চুল ধরে টেনে-হিঁচড়ে বিছানায় তুলে দিল। তার পর শুরু হল পাশবিক অত্যাচার। লীলা বলির পাঁঠার মতো যন্ত্রণায় ছটফট করতে লাগল। মদের নেশায় বেহুঁশ লোকটা ভুলে গেছে যে, লীলা একটা মানুষ। কোমরের বেল্ট খুলে লীলার গলায় পেঁচিয়ে ধরে বসে রইল সে। লীলার শ্বাসরোধ হয়ে আসতে লাগল। ক্ষিপ্রবেগে পা ছুড়তে লাগল। প্রাণপণে লোকটাকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিয়ে দম নিতে লাগল লীলা। লোকটা আবার আক্রমণ করার আগেই লীলা ঘরের কোণ থেকে বঁটিটা তুলে নিয়ে লোকটার কাঁধে কোপ বসিয়ে দিল। রক্তাক্ত অবস্থায় মেঝেয় লুটিয়ে পড়ে যন্ত্রণায় ছটফট করতে লাগল লোকটা। লীলার মাথায় তখন খুন চেপেছে। নিঃশ্বাসে যেন আগুনের হলকা বেরোচ্ছে। ঠিক সময়ে পালিয়ে না গেলে লোকটার মরণ লীলার হাতেই নিশ্চিত ছিল। ঘরের বাইরে তখন লোকজনের ভিড় জমে গেছে। লীলা সজোরে দরজা-জানলা বন্ধ করে দিল।
প্রেমের স্বরূপই হল প্রতিমুহূর্তে বৃদ্ধি পাওয়া। লীলার প্রেম সমাজের চোখে লীলাকে পাগল প্রতিপন্ন করল। পতিতালয়ের অলিতে-গলিতে সবাই বলাবলি করতে লাগল, “লীলাটা বদ্ধ পাগল হয়ে গেছে।”
লীলা ঘরে ঢুকে আগল দিল। খদ্দের এলে দূর দূর করে তাড়িয়ে দেয়। কেউ অনুনয়-বিনয় করলে লীলা বলে, “দরজা খুলতে পারি একটা শর্তে। একটা লেখা পড়ে শোনাব। শুনে সেই পুরুষকে খুঁজে দিতে হবে, যে এই কথাগুলো বলেছে।”
লীলা কাগজের টুকরো থেকে লেখা পড়ে শোনায়। বন্ধ দরজার অপর প্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকা কেউই লীলার প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে না। গোবেচারা হলে বিদায় নেয়, ট্যারা-বাঁকা লোক হলে টাকার লোভ দেখিয়ে দরজা খুলতে বলে, না হলে শাসায়, গালি দেয়। তার পর লীলাকে ধারালো বঁটি হাতে বেরোতে দেখে পিঠটান দেয়।
লীলার ব্যবসা প্রায় লাটে ওঠবার উপক্রম হল। পুঁজিও প্রায় শেষ। ক্ষুধা, তৃষ্ণা, শোকে লীলার সে রূপ ধ্বসে পড়েছে। লীলার রূপের আগুনে এত দিন যারা পুড়ে মরত, তারাও মুখ ফিরিয়েছে। আর লীলা? তার মনেও স্বস্তি নেই। সে তার প্রিয়তমর বিরহে দিবারাত্রি চোখের জল ফেলে আর বলে, “তোমার জন্য বাঁকা পথ থেকে সরে এলুম। আমার দেহ-মন জুড়ে শুধু তুমি। তবুও আজ পর্যন্ত জানলুম না, তুমি কে? তুমি কি সাধু না শয়তান? মানুষ না দেবতা? জীবিত না মৃত? কে তুমি?”
***
তখন প্রায় মাঝরাত। লীলা মড়ার মতো খাটের উপর পড়ে রয়েছে। দেখলে মনে হয় যেন সে মৃত্যুপথযাত্রী। মৃত্যুর অপেক্ষায় প্রহর গুনছে। লীলা কপর্দকশূন্য। চালের একটা দানা পর্যন্ত ঘরে নেই। দুপুরে খিদের জ্বালায় পচা আলু সেদ্ধ করে খেয়ে নিয়েছিল। তার পর থেকে অসহ্য পেটের যন্ত্রণায় সে অস্থির হয়ে উঠেছে। কয়েক বার বমি হয়েছে। মৃতপ্রায় অবস্থায় পড়ে থাকতে থাকতে লীলার মনে হয়েছে যদি তার প্রেমিক অশরীরী হয়,
তবে তো মৃত্যুই তাদের মিলনের একমাত্র পথ। জগতে দুঃখ ছাড়া আর আছেই বা কী?
লীলা হাতের মুঠোয় শক্ত করে ধরে রেখেছে সেই জীর্ণ কাগজের টুকরোটা। চোখের জলে ভিজে অক্ষরগুলো মুছে গেছে প্রায়। হঠাৎ ঘরের বন্ধ দরজায় মৃদু শব্দে তিন বার ঘা পড়ল।
“কে?” কোনও রকমে ক্ষীণ কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল লীলা।
“লীলা আছো?” একটা মন্দ্র অথচ কোমল পুরুষালি কণ্ঠে প্রশ্ন ভেসে এল বাইরে থেকে।
“কে তুমি?”
“আমি অনেক দূর থেকে তোমার কাছে এসেছি। শুনেছি একটা প্রশ্নের উত্তর দিতে পারলে দরজা খুলে
দেবে তুমি?”
“ঠিকই শুনেছ।”
“আমি জানি তোমার উত্তর।”
“অনেকেই বলেছে এই একই কথা। কেউ কিছু বলতে পারেনি।”
কিছুক্ষণ নিস্তব্ধ। ফের আগন্তুকের কণ্ঠস্বর শোনা গেল, “তুমি বাঁকা-সোজা যে পথেই চলো, যত পাপ করে থাকো; আমার প্রতি নিষ্ঠা, আন্তরিকতা, প্রেম থাকলে তুমি আমাকে পাবেই। এ আমার সত্য প্রতিজ্ঞা। কারণ তুমি আমার খুবই প্রিয়… এ কথা স্বয়ং ভগবান গীতায় অর্জুনকে জানিয়েছেন।”
লীলার ভগ্ন ক্লিষ্ট মনে যেন নতুন প্রাণশক্তির সঞ্চার হল। খাট থেকে নামতে গিয়ে মুখ থুবড়ে মাটিতে পড়ে গেল সে। তবুও কোনও রকমে শরীরটাকে টেনে নিয়ে গেল দরজার সামনে, “ভগবান বলেছে এ কথা!”
“হ্যাঁ।”
“তার মানে আমাকে নয়, অর্জুনকে বলা হয়েছে কথাগুলো!” ম্রিয়মাণ গলায় বলল লীলা।
আগন্তুকের মন্দ্রমধুর কণ্ঠস্বরে সরস হাসির প্রলেপ পড়ে, “শুধু অর্জুন তো নয়। প্রতিটি মানুষের জন্যই ভগবানের এই প্রতিজ্ঞা।”
“হ্যাঁ গো, আন্তরিকতা কী?”
“তুমি এত দিন ধরে যা করে আসছ, তা-ই।”
“মানে?”
“এই যে, তাঁকে চোখে না দেখেও তাঁর প্রতি তোমার অটুট বিশ্বাস জন্মেছে যে, তিনি আছেন আর তিনি শুধুমাত্র তোমাকেই এই কথাগুলো বলছেন। বাইরের লোকের হাজারটা কথা শুনেও বা তাঁর অস্তিত্বের কোনও প্রমাণ না পেয়েও তোমার বিশ্বাসে এতটুকু চিড় ধরেনি। তাঁর জন্য কুপথ থেকে সরে এসেছ। দিনরাত শুধু তাঁর চিন্তা করেছ। তাঁকে ছাড়া অন্য কাউকে কামনা করোনি। এটাই তো আন্তরিকতা। কাগজে যা লেখা আছে তা-ই তুমি করে দেখালে লীলা!”
“কিন্তু আমি যে পাপী!” অনুশোচনায় পুড়ে যেতে লাগল লীলার ভেতরটা।
“কে বলে তুমি পাপী? তুমি যে পাঁকে ফোটা পদ্ম! তোমার নিঃস্বার্থ ভালবাসা, যে কোনও মূল্যে তাঁকে পাওয়ার চেষ্টা সমস্ত মালিন্য মুছে তোমায় শুদ্ধ করেছে। তোমার প্রেমে তোমার প্রেমিক বাঁধা পড়েছেন।”
লীলা আগন্তুককে দেখবার জন্য চঞ্চল হয়ে উঠল। এমন মানুষকে যে বরণ করে ঘরে আনতে হয়। লীলা কোনও রকমে দেওয়ালে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে দরজা খুলল। কিন্তু বাইরে কাউকে দেখা গেল না। চার দিকে শুধু জমাট নিশ্ছিদ্র অন্ধকার আর বাতাসে অপূর্ব এক সুবাস।
স্বপ্নের ঘোরে সম্মোহিতের মতো দাঁড়িয়ে থাকে লীলা। কোনও শারীরিক কষ্ট-যন্ত্রণা আর টের পায় না সে। তার পর পায়ে পায়ে এগোয় অন্ধকারের দিকে।
তার ঘর-দুয়ার খোলা পড়ে থাকে। এ মরপৃথিবীর কেউ আর তাকে দেখতে পায় না।