Abosar

ন্যাচারাল ডেথ

সায়ন্তনী ভট্টাচার্য

পা ছড়িয়ে বসে পড়ল হিটলার। গরমে তেতেপুড়ে আছে চার দিক। রোদ্দুর যেন জ্যান্ত পুড়িয়ে মারবে। পৃথিবীর রং কেমন হলুদ হলুদ। হিটলারের গা জুড়ে ঘামাচি। বুকের ঘামাচিগুলো টিপে টিপে মারে। লুঙ্গি গুটিয়ে উরুর কাছে তুলে নেয়। একটা হুট্টাই পাখি ডাকছে। হিটলার পাখিটার খোঁজে এ-দিক ও-দিক তাকায়। সত্যি সত্যিই নাম হুট্টাই নয়, অন্য নাম আছে। হিটলার অন্য নামের খোঁজ রাখে না, পাখির ডাক শুনে যা নাম রাখতে ইচ্ছে করে তা-ই বলে ডাকে।

সামনে জনা তিরিশেক বেটাছেলে  আর মেয়েমানুষ কিচিরমিচির করছে। রেশন দোকান এখনও খোলেনি। আজ কেরোসিন তেল দেবে। বাসন্তী বলে দিয়েছে, কেরোসিন তেল না নিয়ে হিটলার যেন বাড়ি না ফেরে। এ সব জটিল ভাবনার মধ্যেই লাল পিঁপড়ে কামড়াল পুটুস করে পায়ের পাতার ওপর। হিটলারও সঙ্গে সঙ্গে পুটুস করে টিপে দিল পিঁপড়েটাকে, ভবলীলা সাঙ্গ হল। মনের মধ্যে অদ্ভুত আরাম হচ্ছে। পান্তায় শুকনো লঙ্কাভাজা, গন্ধলেবু আর এক খাবলা নুন ফেলে মুখে তুলে দিলে যেমন
মজা হয়, তেমন মজা। জীবন রোজ টিপে মারছে হিটলারকে, পিঁপড়েকে মেরে যেন তারই প্রতিশোধ নিল। এ দিকে চ়চ্চড় করে রোদ্দুর চচ্চড়ি হয়ে উঠছে, হিটলারকে জ্বালাতে চাইছে। এখন যেন সে জ্বালাও তেমন গায়ে লাগছে না।

সামনে খড়খড়ে চামড়া নিয়ে চিনুরানি মণ্ডল রং-ওঠা ছাপাশাড়িটার আঁচল কোমরে আরও খানিকটা পেঁচিয়ে নিয়ে বলল, খোল খোল বাপ, রেশন দোকান তাড়াতাড়ি খোল, আশি বছর বয়সে এত হুজ্জতি সয়?

তিরিশ জনের লাইনে সব ছেলে-মেয়েই চিনুরানি, কার্তিক, নেতাই, বাবলা, পিয়া, পম্পা এমন গোছের সহজ-সরল নাম। শুধু হিটলারের নামেরই এমন বাহার। যেন আর কোনও নাম ছিল না জগৎ সংসারে! কেন বাবা, নাড়ু, ল্যাবা, বদন এ
সব নাম কী দোষ করল? নিজের নামের মানে জানে না হিটলার। শুধোতে হবে, এক দিন না এক দিন সে শুধোবে কাউকে।

ও দিকে লাইন এগোয়। হিটলারও আশায় আশায় এগোয়। কিন্তু চিনুরানি মণ্ডল পর্যন্ত এসে কেরোসিন ফুরিয়ে যায়। দোকানের মালিক ঢুলিরাম গাঁতাইত ঈশ্বরের শপথ করে বলে, এক বিন্দুও তেল নাকি বেঁচে নেই। ঢুলিরাম কালোবাজারি করে কেরোসিন তেলের। মিটমিটে শয়তান একটা। হিটলার এক দলা থুতু ফেলে। কেরোসিন মরে গিয়েছে, মরুক। পৃথিবীটাও মরে যাক। কিন্তু বাসন্তী তো মরবে না। কেরোসিন না নিয়ে ফিরলে বাসন্তী দক্ষযজ্ঞ বাধাবে। বাসন্তী সামান্য ব্যাপারে চিৎকার জুড়ে দিয়ে এখনও যে বেঁচে আছে, তা জানান দিতে চায়। না হলে বিশ্বাসই হয় না, এ সেই বিয়ের সময়ের ফুটফুটে টুকটুকে বাসন্তী! মনে হয় এ যেন তার ভূত! হিটলার ফিকফিকিয়ে হাসে। আয়নায় নিজের মুখ দেখলে হিটলারের নিজেকেও ভূত ছাড়া আর কিচ্ছু মনে হয় না। হাড়গোড়ের ওপর সামান্য মাংস আর চামড়া চাপানো মানুষ-ভূত।

******

বাসন্তী গুমোট একফালি ঘরে এসে ঢুকল। পাখা আছে, আর আছে একটা টিউবলাইট। বাড়িওয়ালা নিজের মিটার থেকে লাইন টেনে দিয়েছে। তার জন্য ভাড়ার টাকার সঙ্গে আলাদা টাকা ধরে দেয় বাসন্তী। যদিও বাড়িওয়ালার মূল বাড়ি থেকে এই ঘরখানা আলাদা, সামনে পুঁচকে মতো উঠোনও আছে। বাথরুমটা উঠোনের অন্য পাশে। ঘরে একখানা খাট, আলনা আর শোকেস রাখা। রান্নার সরঞ্জাম যেমন স্টোভ, হাঁড়ি-কড়াই ইত্যাদি, সবজির ঝুড়ি, সব খাটের তলায়। রান্নার সময় বের করে নেয়। ঘরে কোনও জানালা নেই। দরজা বন্ধ করলে হাওয়া এ ঘরের খবর ভুলে মেরে দেয়। রাতেও দরজা হাঁ করে খোলা। হিটলারের চোখে ঘুম আসে না, বাসন্তীরও না।

বাসন্তী এখন তিন বাড়ি কাজ ধরেছে। ঘর মোছা, বাসন মাজা, জল আনা, ধুলো ঝাড়া, কুটনো কোটা, বাটনা বাটা, কাচা, বউদিদের হাতে হাতে কাজ করে দেওয়া, মানে যতটা পারা যায় নিজেকে ব্যস্ত রাখা আর কী! সবই তো বাস্তব ভুলে থাকার অভিনয় মাত্র। বাসন্তীও কষে অভিনয় করে, গ্রামে দেখা যাত্রাপালার নায়িকার মতো। মাঝে মাঝে হাসেও। কাজ সেরে ঘরে ফিরতে ফিরতে বেশ রাত। হাড় বের-করা শুকনো শরীরটা তখন কোনও রকমে যা হোক কিছু রেঁধে রাখে। হিটলার ফিরলে খাওয়াদাওয়ার পাট চুকলে বাকি ভাতে জল ঢেলে পান্তা বানায়। সকালে উঠে পান্তা খেয়ে দু’জনেই কাজে ছোটে। হিটলার নড়বড়ে রিকশা নিয়ে বেরিয়ে যায়। পচা পাতকুয়োর বিষাক্ত গ্যাসের মতো এই বেঁচে থাকার মাঝেই কখনও-সখনও হিটলার তবু শরীরে শরীর ঘষটায়, বাসন্তী নাক বন্ধ করে সে ঘষটানি সহ্য করে। হিটলারের মুখ থেকে ছাইপাঁশের গন্ধ আসে। সে গন্ধ বাসন্তীর সয় না।

আজ তিন বাড়ি থেকেই হাফবেলা কাজের পর ছুটি পেয়েছে। এক পাড়াতেই বাড়ি সব, তিনটে পরিবার মিলে কোথায় বেড়াতে যাবে। মরুক গে। বাসন্তী বেড়ানো বলতে বোঝে দক্ষিণেশ্বর কি কালীঘাট। সমুদ্র দেখার ভারী শখ ছিল, কিন্তু বিয়ের বাইশ বছর পরে এখন আর সাধই নেই! এখন দক্ষিণেশ্বর বা কালীঘাটও নেই! ঠাকুর আছে কি? বাসন্তী নিজের বুকের কথা শুনবে বলে কান পাতে। বুকের ভিতর ঈশ্বরের অস্তিত্ব টের পায় না। অথচ মেদিনীপুরের গ্রামে বাসন্তীর বাড়ি ছিল, খেতে সবুজ ধান ছিল, কথায় কথায় পুকুর ছিল, পাখি ছিল, গোল্লাছুট ছিল, বাপ-মা-ভাইরা ছিল, পৃথিবীর সব ভালতে বিশ্বাস আর সব খারাপে অবিশ্বাস ছিল।

বড্ড তাড়াতাড়ি স্কুল ছাড়িয়ে দিল মা-বাপ, কি না, ভাল সম্বন্ধ পেয়েছে। ছেলে করে কী? রিকশা চালায়! তখন বয়স অল্প, বিয়ে নিয়ে বাসন্তীর মনে অদ্ভুত এক নেশা ছিল। ‘বর’ কথাটা ভাবলেই শরীরে চিনচিন-করা আহ্লাদ। শুধু নামটা যেন কেমনধারা, হিটলার! কিন্তু নাম যেমনই হোক, বিয়ের পর প্রথম প্রথম মানুষটাকে ভালই লেগেছিল বাসন্তীর। মেদিনীপুর থেকে এক লাফে কলকাতার শহরতলি। শাশুড়ি, স্বামী ছাড়া বাড়িতে আর কেউ নেই। শাশুড়িও মাটির মানুষ। শুধু একটাই ঘ্যানঘ্যান, নাতি-নাতনির মুখ না দেখে সে নাকি মরতে পারছে না। হিটলারের তখন জোয়ান বয়স, রিকশা হুহু করে ছোটে, যেন পক্ষীরাজ! ঘরে দু’পয়সা আসে, কলকাতার হলে বাংলা সিনেমা দেখাতে নিয়ে যায় মাঝেমধ্যে। বাসন্তীর সবুজ কচি-কলাপাতা শরীর রং পায়, পুরুষ্টু হয়ে ওঠে, হিটলারের আদরে শরীরে অন্য চারা বাড়তে থাকে। শাশুড়ির আশা পূর্ণ হয়, কোল আলো করে আসে চাঁপা, তার তিন মাস বয়স হতে না হতেই শাশুড়িও ড্যাংডেঙিয়ে স্বর্গে!

আর তার পর তো শুরু হল প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ, সব একসঙ্গে। বাসন্তীর ঠিক মনে পড়ে না ছোটবেলায় বইতে কী পড়েছিল, মোটমাট ক’টা বিশ্বযুদ্ধ দেখেছে পৃথিবী? ওর শুধু মনে হতে থাকে, পৃথিবীর সব বিশ্বযুদ্ধ ওর উঠোনে এসে জড়ো হয়েছে। গোলাগুলি, অস্ত্রশস্ত্র ছাড়াও যে যুদ্ধ লড়তে হয়, সে কথা প্রথম জেনেছিল বাসন্তী। কিছু কিছু যুদ্ধ তো লড়তে হয় হার নিশ্চিত জেনেও। বাসন্তীর যুদ্ধটাও ছিল ঠিক তেমন।

******

রিকশা নিয়ে ঘুরতে থাকে হিটলার। ওর সঙ্গে পৃথিবীটাও ঘোরে ডান পাশ, বাঁ পাশ, এ গলি, সে গলি, গোল চক্কর, চৌমাথা। সওয়ারি পায় কই? টোটো আর অটোর রুট চালু হয়েছে, সস্তায় স্টেশন বাসস্ট্যান্ড পৌঁছে দিচ্ছে, বেশি ভাড়া দিয়ে রিকশায় উঠবে কেন কেউ? রোদ্দুরকে শরীরের মধ্যে বসিয়ে নিতে নিতে তবু হিটলার চেষ্টা ছাড়ে না। জনা পাঁচেক সওয়ারি জোটে, হাতে শ’খানেক টাকা আসে। মাথার মধ্যে এখনও কেরোসিন নাচছে। হিটলার স্টেশনের ধারের গুমটির দিকে রিকশা চালিয়ে দেয়। এ দিককার অন্য দোকানগুলো খুলতে খুলতে সন্ধে সাতটা। গুমটি খোলা থাকলে ওখান থেকে কেরোসিন পাওয়া যাবে, তবে চড়া দামে। হুট্টাই পাখিটা হিটলারের মাথার ওপর ঘুরে ঘুরে উড়ে চলেছে। হিটলার ভাল করে তাকিয়ে দেখে—পাখি নয়, এ তো চাঁপা! আহা, ঠিক এমনই ধলা রং ছিল চাঁপার। বাসন্তীর গায়ের রং পেয়েছিল। তার পর তো অসুখের সঙ্গে যুঝতে যুঝতে ষোলো বছরের তকতকে জীবনটা কেমন কালচে হয়ে গেল। কিডনির অসুখটা কোত্থেকে বাধালি, মা? হুট্টাইয়ের দিকে চেয়ে হিটলার প্রশ্ন করে। হুট্টাই জবাব দেয় না। হিটলারের পা চলে না, প্যাডেল থেমে যায়, রিকশা কোথাও এগোয় না, হিটলারও এগোয় কি?

গুমটির কাছে এসে গিয়েছে। কেরোসিন চাই হিটলারের, তবে তার আগে চাই চোলাই। শরীরের মধ্যে ঢুকে যে সব কিছু ভুলিয়ে দেবে। চাঁপার মৃত্যুটাও।

******

বাসন্তী স্টোভ ধরাতে পারে না, ঠায় বসে আছে। সূর্য ডুবছে আস্তে আস্তে, কেরোসিন নিয়ে এখনও ফেরেনি হিটলার। যে যায়, সে কি ফেরে? ফেরে না। চাঁপার কথা ভেবে পাঁজর ঠেলে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। কলকাতার হাসপাতাল, ডাক্তার বলল কিডনির অসুখ মেয়েটার, কী একটা চিকিৎসা করাতে হবে। মনে আছে বাসন্তীর, ডায়ালিসিস বলে একটা শব্দ আউড়েছিল ডাক্তাররা। মেয়েটাকে বাঁচাতে তখন স্বামী-স্ত্রী দিনরাত এক করে দিচ্ছে। হিটলার নাওয়া-খাওয়া ভুলে রিকশা টানে, আরও টাকা চাই, মেয়েটার আরও ভাল চিকিৎসা চাই। বাসন্তী মেয়েকে নিয়ে ডায়ালিসিস করাতে ছোটে। চাঁপার কষ্ট দু’চোখে দেখা যায় না। শরীরটা কাঠির মতো, দু’টো হাতের শিরা যেন ফুলে-ফেটে বেরিয়ে আসতে চাইছে। ব্যথায় কাতরায় মেয়েটা, অসহ্য কষ্ট। বাসন্তী মায়ের মন্দিরে পুজো দেয়। বলে আসে, মেয়েটাকে যদি সুস্থ করতে না পারো মা, তোমার কাছে টেনে নাও। যাওয়ার বেলায় ওকে আর কষ্ট দিও না। ভগবান সে কথা শোনে না। বড্ড একচোখো সে। সতেরো বছরের চাঁপা কষ্ট করে মরে। মরে গিয়ে সব ক’টা বিশ্বযুদ্ধ একলা জিতে যায়। সব হেরে বসে থাকে বাসন্তী আর হিটলার।

সেই থেকে চলছে চতুর্থ বিশ্বযুদ্ধ। যার নাম বেঁচে থাকা। সবচেয়ে কঠিন যুদ্ধ। বেঁচে থাকার ইচ্ছে নেই, কিন্তু মরার সাহসটুকুও জোটাতে পারছে না। তবু রোজ চেষ্টা করে বাসন্তী এই চতুর্থ বিশ্বযুদ্ধ জিতে যাওয়ার। জানে বাসন্তী, এক দিন না এক দিন ঠিক পারবে। ঠিক। হিটলার আর ও মিলে মরে বেঁচে যাবে, মরে জিতে যাবে।

******

টলতে টলতে ঢুকে আসে হিটলার। বাসন্তী আলো জ্বালায়নি। চাঁদের ছায়া পড়েছে বাসন্তীর গায়ে, ক্লান্ত শরীর মেলে বসে আছে। হিটলার দু’এক পা করে এগিয়ে আসে। জড়ানো গলায় বলে, কেরোসিন এনেছি বাসন্তী। বাসন্তীর চোখ চকচক করে ওঠে। কোনও কথা না বলে এগিয়ে আসে। হাত থেকে কেরোসিনের বোতলটা নেয়। হিটলার অবাক চোখে চেয়ে দেখে, বাসন্তী ঘরদোরে কেরোসিন ছেটায়, হিটলারের কোমরে গুঁজে রাখা চুল্লুর বোতল নিয়ে চুল্লু ছিটিয়ে দেয়। তার পর দেশলাই হাতে তুলে নেয়। হিটলারের মুখটা আনন্দে ভরে যায়। হুট্টাইয়ের ডাক শুনতে পায়। বাসন্তীকে জড়িয়ে ধরে। ফুলশয্যার রাতের মতো খুব জোরে চুমু খায়। আর দাউদাউ আগুন জ্বলে ওঠে।
ঘর জ্বলে, জীবন জ্বলে। চতুর্থ বিশ্বযুদ্ধ হেরে যেতে থাকে, শুধু মানুষ জিতে যায়।

ছবি: মহেশ্বর মণ্ডল

 

‘রবিবাসরীয়’ বিভাগে ছোটগল্প পাঠান, অনধিক ১৫০০ শব্দে।
ইমেল: rabibasariya@abp.in সাবজেক্ট: rabibasariya galpa

ডাকে পাঠানোর ঠিকানা:

‘রবিবাসরীয় গল্প’,

আনন্দবাজার পত্রিকা

 ৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা ৭০০০০১

যে কোনও একটি মাধ্যমে গল্প  পাঠান। একই গল্প ডাকে ও ইমেলে পাঠাবেন না।

পাণ্ডুলিপিতে ফোন নম্বর বা ইমেল আইডি জানাবেন। ইউনিকোড ব্যবহার করা বাঞ্ছনীয়।