Abosar

নাটক

স্বর্ণাভ চৌধুরী

নাটকটা এই মাসের মধ্যেই চাই! তুমি যদি ঝোলাও তবে খুব খারাপ হবে। ভিডিয়োটা তোমার বৌয়ের কাছে চলে যাবে, এই বলে দিলাম! আর যদি নাটক দাও, তা হলে আমি ভিডিয়োটা ডিলিট করে দেব। জেন্টলম্যান’স ওয়ার্ড অব অনার! ভদ্দরলোকের এক কথা!’’ 

ফোনটা রাখার আগে ও পার থেকে এটাই ছিল তীর্থর শেষ কথা। শেষ কথাই বটে! শেষ করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট! ফোন রেখে কুলকুল করে ঘামছিল দিব্যেন্দু। কী কুক্ষণেই যে নাটকের ধুয়ো তুলতে গিয়েছিল সে!

শিকাগোয় এখন ভ্যাপসা গরম। বারো তলার ফ্ল্যাটের জানলা হাট করে খুলে দিয়ে স্রেফ একটা শর্টস পরে সোফায় গা এলিয়ে দেয় দিব্যেন্দু। এসির তাপমাত্রা কয়েক ডিগ্রি কমিয়ে দিয়েও স্বস্তি মেলে না। অথচ, এখন শুক্রবারের এই সন্ধেয় তার জীবনে পরিপূর্ণ শান্তি থাকার কথা। ক’দিন আগে স্ত্রী সঙ্গীতা তিন সপ্তাহের জন্য কলকাতায় বাবা-মায়ের কাছে  গিয়েছে। নিরিবিলিতে দিব্যেন্দুর সময় ভালই কাটছে। সামনের টেবিলে রাখা সিঙ্গল মল্ট স্কচ হুইস্কির বোতল। ব্যাকগ্রাউন্ডে সিম্ফনি টোয়েন্টিফাইভ। মোৎসার্ট। খোশমেজাজেই সন্ধেটা শুরু হয়েছিল। কিন্তু তীর্থর ওই ফোন সব মাটি করল।

দিব্যেন্দু প্রায় পনেরো বছর হল শিকাগোয়। কলকাতায় জৈব রসায়নে পিএইচ ডি করার পর সে পোস্টডক হিসেবে শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছিল। তার পর বহু দিন ধরে এখানে-ওখানে ঠোক্কর খেয়ে এখন সে শিকাগোরই ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়ে সহকারী অধ্যাপক। ধারে-ভারে বেড়ে উঠলেও দিব্যেন্দুর চারিত্রিক পরিবর্তন বিশেষ হয়নি। এখনও তার মধ্যে একটা ছেলেমানুষি রয়ে গিয়েছে। সে বয়স্ক লোকেদের থেকে ছেলে-ছোকরাদের সঙ্গে সময় কাটাতেই বেশি পছন্দ করে। বিশেষ করে, তীর্থর মতো যারা সদ্য দেশ থেকে শিকাগোয় পিএইচ ডি কিংবা পোস্টডক করতে আসে, তাদের আমেরিকাসম্বন্ধে পোক্ত করে তোলাটা দিব্যেন্দু নিজের কর্তব্য বলে মনে করে। এর মধ্যেই সে তীর্থ ও তার মতো ছেলে-ছোকরাদের শিকাগোর বিভিন্ন ভাল-ভাল রেস্তরাঁ, পানশালা প্রভৃতি জায়গার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে।  তীর্থ ও তার দলবলও তাদের দিব্যেন্দুদার বেশ ভক্ত। মাঝে-মাঝেই এখানে-সেখানে তাদের আসর বসে। দিব্যেন্দুর স্ত্রী সঙ্গীতাও তীর্থদের বেশ পছন্দ করে। মাঝে-মাঝেই নেমন্তন্ন করে খাওয়ায়। এখন দিব্যেন্দু বুঝতে পারছে, তীর্থদের মাথায় তোলাই তার কাল হয়েছে ।

শিকাগোর বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় প্রতি বছরই দু’-তিন জন করে বাঙালি ছাত্রছাত্রী অথবা গবেষক পড়তে কিংবা কাজ করতে আসে। সব মিলিয়ে এখানে বাঙালি যুবক-যুবতীর সংখ্যা নিতান্ত কম নয়। বছরখানেক আগে যখন শিকাগোর এই বাঙালি নবকুমার-কুমারীরা দেখল যে, তাদের সংখ্যা প্রায় পঞ্চাশে এসে ঠেকেছে, তখন তারা আর থাকতে না পেরে দুর্গাপুজো শুরু করে দিল। তীর্থ এবং তার দলবল ছিল এদের নেতৃস্থানীয়। দিব্যেন্দু প্রথম দিকে এ সব থেকে একটু দূরেই ছিল। কিন্তু ক্রমশ তীর্থদের কর্মকাণ্ড দেখে দিব্যেন্দুর মনেও কেমন একটা তেজ এসে গিয়েছিল। এক শুক্রবারের সন্ধেয় তীর্থর বাড়িতেই এক জমায়েতে সে নাটকের প্রস্তাব দিয়ে ফেলেছিল এবং সেই প্রস্তাব উপস্থিত সকলে লুফে নিয়েছিল। সত্যিই তো, পুজোয় একটা নাটক না হলে কি চলে? দিব্যেন্দুও কেমন বেসামাল হয়ে বুক ঠুকে বলেছিল, ‘‘আমি থাকতে নাটক নিয়ে ভাবতে হবে না, তিন দিনে নামিয়ে দেব!’’

বাকিরা উৎসাহে চিৎকার করে বলেছিল, ‘‘থ্রি চিয়ার্স ফর দিব্যেন্দুদা!’’

সেই ‘চিয়ার্স’ই এখন পিছনে এসে ফুটছে। তিন দিনের জায়গায় তিন মাস হতে চলল, কিছুই লেখা হয়নি। অবশ্য দিব্যেন্দু যে নেহাতই মদিরার প্রভাবে ফাঁকা আওয়াজ ছেড়েছিল, তা বলা ভুল হবে। ছোট থেকেই নাটক ছিল তার প্যাশন। কলেজে থাকতে ‘নাট্যকোম্পানি’ নামে একটি নাটকের দলও খুলেছিল সে। মৌলিক নাটক করা ছিল ওদের দলের নীতি। স্ক্রিপ্ট লেখার ব্যাপারে দিব্যেন্দুর বিশেষ মুনশিয়ানা ছিল। ‘নাট্যকোম্পানি’ বেশ কিছু দিন চলেছিল। কিন্তু তার পর এক সময়ে জীবনের স্রোতে গা ভাসিয়ে নাট্যকোম্পানির কুশীলবরা কে কোথায় চলে গেল! এখন কেউ ব্যাঙ্কের ম্যানেজার, কেউ স্কুলমাস্টার, কেউ বিজ্ঞানী। নাট্যকোম্পানি স্মৃতি হয়ে গেল । 

দিব্যেন্দু আশা করেছিল, অতীত ভাঙিয়েই সে এ বারেও কিছু একটা লিখে ফেলতে পারবে। কিন্তু তার বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ সামলে নাটকের পিছনে বেশি সময় দেওয়া সম্ভব হয়নি। এর মধ্যে যে সে নাটক লেখার চেষ্টা করেনি তা নয়, কিন্তু তার আগেকার প্রতিভায় একেবারে জং ধরে গিয়েছে। দিনকয়েকের চেষ্টাতেই দিব্যেন্দু তা হাড়ে-হাড়ে টের পেয়েছে। এখন গোটা একটা নাটক লেখা দূরে থাক, পর পর কয়েকটা ডায়ালগ পর্যন্ত মাথায় আসছে না! কিছু লিখতে গেলেই মাথা ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে। তার বর্তমান জগতে ‘লিটারেচার’ কথাটির মানে বিজ্ঞান-প্রবন্ধ। দীর্ঘশ্বাস ফেলে হুইস্কিতে চুমুক দেয় দিব্যেন্দু। এ রকম সঙ্কটেও মানুষ পড়ে! এ দিকে কোনও নতুন প্লট মাথায় আসছে না, অন্য দিকে তীর্থ শাসিয়েছে যে, এই মাসের মধ্যে নাটক হাতে না পেলে, সে একটি ভিডিয়ো সঙ্গীতার কাছে হোয়াটসঅ্যাপ করে পাঠাবে। ভিডিয়োটা ছ’মাস আগে তীর্থর বাড়িতেই এক মদের আসরে তোলা হয়েছিল। সঙ্গীতা তখন কর্মসূত্রে চার দিনের জন্য হিউস্টনে। দিব্যেন্দু সে দিন আসর মাতিয়ে রেখেছিল। তার বৌ আর শ্বশুরকে নিয়ে নানা রকম ক্যারিকেচার, রংতামাশা করতেও ছাড়েনি। এখানেই হয়েছে মুশকিল। মন খুলে কিছু করার উপায় নেই! কোনও এক হতভাগা যে ফোনে সে দিনের ভিডিয়ো তুলে রেখেছিল, সে-খেয়াল দিব্যেন্দুর ছিল না। স্মার্টফোনের যুগে এই হয়েছে ঝামেলা। মন খুলে কথা বলারও উপায় নেই। তীর্থ বলে রেখেছে যে নাটক না পেলে ওই ভিডিয়ো সঙ্গীতার কাছে পাঠিয়ে দেবে। ওই ভিডিয়ো সঙ্গীতার কাছে গেলে একেবারে লঙ্কাকাণ্ড বেঁধে যাবে! এমনিতে সব ঠিক থাকলেও, বাবার ব্যাপারে সঙ্গীতা ভীষণ সেনসিটিভ। তার উপর ক্যারিকেচার ব্যাপারটা ও পছন্দ করে না। তীর্থটা যে এত বড় শয়তান তা কে জানত! 

দেখতে-দেখতে তিনটে সপ্তাহ কেটে গেল। দিব্যেন্দুর নাটক লেখা কয়েক লাইনও এগোয়নি। নাটক লিখতে গিয়ে যে তার এ রকম শোচনীয় অবস্থা হবে, তা দিব্যেন্দু স্বপ্নেও ভাবেনি। এক বার যদি কলেজের দিনগুলোয় ফেরত যাওয়া যেত! আজই আবার সঙ্গীতার শিকাগোয় ফেরার কথা। তাকে বিমানবন্দর থেকে আনতে যেতে হবে। তীর্থর হুমকির কথা মনে করেই দিব্যেন্দু কেমন অস্বস্তি বোধ করল।

প্লেন ঠিক সময়েই এসে পৌঁছেছিল। বড়-বড় দুটো স্যুটকেস ঠেলতে-ঠেলতে সঙ্গীতা যখন বাইরে বেরল, তখন তার চোখে-মুখে খুশির ঝিলিক। সদ্য কলকাতা-ভ্রমণটা ভালই হয়েছে মনে হয়। বিমানবন্দরের বাইরে দিব্যেন্দুর সঙ্গে দেখা হতেই একগাল হেসে জিজ্ঞেস করল, ‘‘শরীর ঠিক আছে? খাওয়াদাওয়া ঠিকমতো করেছ?’’ এর পর গাড়ি করে বাড়ি ফেরার সময় দিব্যেন্দুকে কথা বলার সুযোগ না দিয়ে সঙ্গীতা তার এ বারের কলকাতা ভ্রমণের কথা বলে যেতে লাগল। দিব্যেন্দু বৌয়ের কথা কিছু শুনল, কিছু শুনল না। তার মাথায় তখনও নাটকের চিন্তা। তার মধ্যেই সে খেয়াল করল, সঙ্গীতা বলছে, ‘‘তোমার জন্য একটা সারপ্রাইজ় গিফ্‌ট আছে, বাড়ি গিয়ে দেখাব।’’ 

বাড়িতে ঢুকেই সঙ্গীতা ফ্রেশ হয়ে নিতে বাথরুমে গেল। বাথরুমে ঢোকার আগে সারপ্রাইজ় গিফ্‌টের কথা আর এক বার বলে গেল। ধুত্তোর, নিকুচি করেছে ওই সারপ্রাইজ় গিফ্‌টের! দিব্যেন্দু এ বারে রীতিমতো বিরক্ত বোধ করে। একেই তার নাটক লেখা হচ্ছে না, তার উপর সঙ্গীতা ফিরে আসায় তার মানসিক চাপ কিছুটা বেড়েছে। তীর্থর হুমকিটাকে সে পুরোপুরি উড়িয়ে দিতে পারছে না। এই সব ছেলেছোকরাদের বিশ্বাস নেই। সত্যিই যদি ভিডিয়োটা সঙ্গীতাকে পাঠিয়ে দেয়? এখন যদি আলাদিনের দৈত্য এসে একটা তৈরি নাটক ধরিয়ে দেয়, তবেই তার একটা সত্যিকারের ‘সারপ্রাইজ় গিফ্‌ট’ হয়। এ সব ভাবতে-ভাবতেই দিব্যেন্দু রাতের খাওয়ার আয়োজন করে। ভাত, ডাল, তরকারি, মাংস ফ্রিজেই ছিল। দিব্যেন্দু সব খাবার মাইক্রোওয়েভে গরম করে টেবিলে সাজিয়ে রাখল। 

স্নান সেরে সঙ্গীতা বাইরের ঘরে আসতেই দিব্যেন্দু ওকে আড়চোখে এক বার দেখে নিল। বেশ দেখাচ্ছে কিন্তু সঙ্গীতাকে। সঙ্গীতা এসেই স্যুটকেস খুলে ঘাঁটাঘাঁটি শুরু করল। 

‘‘আগে খেয়ে নিলে হয় না?’’ দিব্যেন্দু প্রশ্ন করে।

‘‘দাঁড়াও, আগে তোমার গিফ্‌টটা বের করি। কী এনেছি গেস করো!’’

‘‘পারছি না। আমার খুব জোর খিদে পেয়েছে!’’

‘‘উফফ! এই দেখো!’’

দিব্যেন্দু তাকিয়ে দেখে সঙ্গীতার বাড়ানো হাতে একটা নতুন বাঁধানো খাতা। এটাও সঙ্গীতার একটা বিদঘুটে রসিকতা মনে করে বিরক্ত হয়। কিন্তু খাতাটা হাতে নিয়ে খুলতেই সে চমকে উঠল। খাতার প্রথম পাতাটা একটু বিবর্ণ। উপরের দিকে তারই হস্তাক্ষরে ঝরনা কলমের কালিতে লেখা, ‘দিব্যেন্দু রায়, প্রেসিডেন্সি কলেজ।’ নীল কালি এখনও বিবর্ণ হয়নি!

এ কী করে সম্ভব! এটা তো তার কলেজ জীবনের খাতা। নাট্যকোম্পানি-র অনেক নাটকই তো এই খাতায় লেখা। পাতা ওল্টাতেই দিব্যেন্দু দেখতে পেল তার লেখা প্রথম নাটক, ‘শাজাহানের মৃত্যু’। তার পর ‘উথাল-পাথাল’, ‘মাঝিপুরের কথা’। ঘোরের মধ্যে পাতাগুলো ওল্টাতে থাকে দিব্যেন্দু। সারা খাতা-ভর্তি নাটকের স্ক্রিপ্ট। যার মধ্যে শেষেরটা তো কোনও দিন অভিনয় করাই হয়ে ওঠেনি! নাটকটার নাম ‘নকশি কাঁথার প্রান্তর’। দিব্যেন্দুর নিজের ধারণা, এটাই ওর লেখা শ্রেষ্ঠ নাটক। তার উপর কোনও দিন অভিনীত হয়নি। তা হলে এ বারেই হোক! উল্লাসে লাফিয়ে উঠতে গিয়েও থমকে যায় দিব্যেন্দু। এ খাতা তো বহু দিন হারিয়ে গিয়েছিল! তখন তার বিয়েও হয়নি। তা হলে এই খাতা সঙ্গীতা কোথায় পেল?

দিব্যেন্দুর মনের ভাব আন্দাজ করেই বোধ হয় সঙ্গীতা বলে উঠল, ‘‘তোমাদের বাড়ি রং হবে বলে সব সরানো হচ্ছে। তাতেই খাতাটা পাওয়া গেল। পুরনো আলমারিটার পিছনে পড়ে গিয়েছিল। তিরিশ বছর পর বাড়ি রং হচ্ছে! খাতাটা ছিঁড়ে যাচ্ছিল বলে বাঁধিয়ে এনেছি।’’

দিব্যেন্দু মুখ তুলে দেখে, সঙ্গীতার মুখে মিটমিটে হাসি। সত্যি, দারুণ দেখাচ্ছে ওকে। এখন এর থেকে ভাল উপহার কিছু হতেই পারত না। যার ভয়ে সে কাঁটা হয়ে ছিল, সে-ই এনে দিল ভয় তাড়ানোর উপায়! বুকের মধ্যে থেকে যেন পাথর নেমে যায় দিব্যেন্দুর। সামনের টেবিলে খাতাটা রেখে সঙ্গীতার দিকে এগিয়ে যায় দিব্যেন্দু। তার পর সঙ্গীতা বেশি ট্যাঁ-ফোঁ করার আগেই...

বেশ জমে উঠছিল ব্যাপারটা। হঠাৎ ওদের দু’জনকে চমকে দিয়ে দিব্যেন্দুর সেলফোনটা বেজে উঠল। 

ওহ! এই সময়েও জ্বালাতন! বিরক্ত মুখে দিব্যেন্দু ফোনটা তুলে দেখল, তীর্থ ফোন করেছে। সঙ্গীতাকে ছেড়ে ফোনটা রিসিভ করল ও। আগের কাজ আগে। ভিডিয়োটা তীর্থকে দিয়ে ডিলিট না করালে দিব্যেন্দুর শান্তি নেই।