Abosar

তালগাছ

উল্লাস মল্লিক

আমি এক জন ভূত। হ্যাঁ, ঠিকই শুনেছেন— ভূত। ইংরিজিতে যাকে বলে গোস্ট, সংস্কৃতে প্রেতাত্মা, কন্নড় তেলুগু স্প্যানিশেও কিছু একটা টার্ম আছে, ঠিক জানি না। আপাতত জানার দরকার নেই, কারণ অন্য একটা সমস্যায় জর্জরিত আমি।

হ্যাঁ সমস্যাই। এবং গুরুতর সমস্যা। যারা ভাবে ভূতেদের কোনও সমস্যা নেই, তারা ভুল ভাবে। অবশ্য তাদের দোষ দেওয়া যায় না, জ্যান্ত অবস্থায় আমিও তা-ই ভাবতাম— ভূত আর ভগবান সব সমস্যার ঊর্ধ্বে। সব সময় বিন্দাস থাকে। খিদে তেষ্টা নেই, প্রেশার সুগার গ্যাস অম্বল গেঁটেবাত নেই, চাঁদার জুলুম নেই, বসের দাঁতখিঁচুনি নেই, তা হলে আর সমস্যা কোথায়? ঠিকই, এগুলো হয়তো নেই, কিন্তু ভূতেদের অদ্ভুত সব সমস্যায় পড়তে হয়। অন্তত আমাকে হয়েছে। ভগবানের কথা অবশ্য বলতে পারব না। বেঁচে থাকতে তাঁর দেখা পাইনি কোনও দিন, আর মরার পর এখনও পর্যন্ত মোলাকাত হয়নি।

ওহ্‌, দেখেছেন, নামটা এখনও বলা হয়নি আমার। রণজয়। হ্যাঁ, এটাই আমার পূর্বাশ্রমের, মানে জ্যান্তবেলার নাম। পিতৃদেব রেখেছিলেন। কী ভেবে রেখেছিলেন জানি না, কিন্তু জীবদ্দশায় কোনও রণই জয় করতে পারিনি আমি। সর্বক্ষেত্রেই আমি ছিলাম এক জন হেরো মানুষ, গো-হারান হেরে গেছি সব জায়গায়।

খুব ছোটবেলায়, বয়স যখন বছর পাঁচেক, বাবা চোখ বোজেন। বেসরকারি সংস্থায় নগণ্য কেরানি ছিলেন তিনি, সঞ্চয় কিছু রেখে যেতে পারেননি। ফলে আমাকে নিয়ে মা এক প্রকার অকূল পাথারে পড়ে। মায়ের স্বপ্ন ছিল, প্রচুর লেখাপড়া করব আমি, তুখড় রেজাল্ট হবে, বিশাল চাকরি-বাকরি পাব। মা তাই ঠোঙা তৈরি, সেলাই-ফোঁড়, রিফু-টিফু করে টানতে থাকে সংসার। একটাই স্বপ্ন, আমি এক দিন সব দুঃখ দূর করে দেব। বাংলা সিনেমার আদর্শ চিত্রনাট্য। শ্রীজিৎ, কুমারজিৎ বা মানস পালের বাবারা এ ভাবেই সংসার ভাসিয়ে পরপারে চলে যায় আর চরম দারিদ্র-লাঞ্ছনা সহ্য করে নায়কের মা মানুষ করতে থাকে নায়ককে। কুমারজিৎ বা মানস পালেরা অসাধারণ মেধাবী ছাত্র হয়, বইখাতা নেই, তবু বছর বছর পরীক্ষায় ফার্স্ট। অংকে একশোয় একশো।

আমার গপ্পটা কিন্তু সেই খাতে বইল না। কারণ, মেধার ‘ম’টুকুও ছিল না আমার। দশ ক্লাসের বোর্ডের পরীক্ষায় টেনেটুনে সেকেন্ড ডিভিশন। আশায় বাঁচে চাষা-র মতো আমার মা’ও আশা করেছিল, ছেলে এর পরেও দৈববলে কিছু একটা কাণ্ড ঘটাতে পারে। তাই হায়ার সেকেন্ডারিতে ভর্তি করেছিল। আর এগারো ক্লাসে পড়ার সময়ই সেই রোগে পড়লাম আমি— গরিবের ঘোড়ারোগ। খেয়াল করলে দেখবেন, গরিবের এই ব্যাধিটা খুব হয় এবং জ্বর, সর্দি বা হাঁপানির চেয়ে বেশিই হয়। আর যখন হয়, তখন স্বাভাবিক বোধবুদ্ধি লোপ পায়। আমারও পেল। শিপ্রা নাম্নী জনৈকা সহপাঠিনীর প্রেমে পড়লাম আমি। শিপ্রা দেখতে ছিমছিমে, স্বভাবে ছলবলে। উলটো দিকে আমার কাঠামো কঙ্কালবৎ, ঈষৎ কোলকুঁজো, গাত্রবর্ণ বেগুনসম। বদনখানা এমনই বদখত যে অন্যমনস্ক অবস্থায় আয়নার সামনে দাঁড়ালে নিজেই আঁতকে উঠি। তার ওপর সামান্য টেনশনে হাত-পা ঘামে, কথা জড়িয়ে যায়।

ঘোড়ারোগাক্রান্ত আমি এই ফঙ্গবেনে বায়োডাটার কথা বিবেচনা না করেই শিপ্রার ভূগোল বইয়ের মধ্যে একটা হস্তলিখিত অ্যাপ্লিকেশন গুঁজে দিলাম। এবং পত্রপাঠ তা ডিসমিস হয়ে গেল। এই পর্যন্ত ঠিক ছিল, কিন্তু চিঠির কথাটা ভাইরাল হয়ে গেল ক্লাসে। পাবলিক মুফতে মুরগি পেয়ে গেল কিছু দিনের জন্য।

বারো ক্লাসের পরীক্ষায় কান ঘেঁষে থার্ড ডিভিশন। উচ্চশিক্ষায় আমার ভবিষ্যৎ যে অমাবস্যার মতো ঘুটঘুটে, তা রোদ-ঝলমলে দিনের মতো পরিষ্কার হয়ে যায়। দিবারাত্র পরিশ্রমে মায়ের শরীর ভেঙে গেছে তত দিনে। খুঁড়িয়ে চলা সংসার রাস্তার ধারে উবু হয়ে বসে হাঁপটানের রুগির মতো খাবি খাচ্ছে। গরিবদের আর কিছু না থাকুক, বিস্তর শুভানুধ্যায়ী থাকে এবং তারা আর কিছু না দিক, এন্তার সদুপদেশ দেয়। সেই রকমই আমার শুভাকাঙ্ক্ষীরা আমাকে ধরে পরামর্শ দিল, বাপু, লেখাপড়া যথেষ্ট হয়েছে, এ বার রোজগারের ধান্দা দেখ। বয়েস থাকতে হাতের কাজকর্ম শেখ কিছু।

পাড়ায় ইলেকট্রিকের কাজ করত নকুলদা। তার সঙ্গে জুতে গেলাম। লোকের বাড়ি ঘুরে ঘুরে কাজ। হাতখরচা আর টিফিন পেতাম। নকুলদা বলত, মন দিয়ে কাজ শেখ, কাজ শিখে গেলে এ লাইনে কাজের অভাব হবে না। তা মন দিয়েই কাজ শিখছিলাম। কিন্তু ‘মন’ শালা খুব সুবিধের লোক নয়, পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতির বিচার না করে, মাঝেমধ্যেই উৎপটাং কাজকর্ম করে ফেলে। নকুলদার মেয়ে ছিল একটা। কনক। নকুলদার বাড়ি গেলে তার সঙ্গে চোখাচুখি হত। শরীর ভরন্ত, দৃষ্টি কিছুটা বিষণ্ণ। বিষণ্ণতার কারণ আছে। বিয়ে হয়েছিল কনকের, কিন্তু স্বামীর ঘর করতে পারেনি। স্বামী নাকি মদ্যপ ও লম্পট। তা কনকের সঙ্গে চোখাচুখি থেকে হাসাহাসি, তার পর কাছাকাছি। আমার ঘোড়ারোগ আবার চাগাড় দিয়ে উঠল। এক দিন ফাঁকতালে মনের কথা বলতে গেলাম তাকে। বলতে গিয়ে যথারীতি হোঁচট খেলাম— আমি তোমাকে ভা... ভা... ভা... ইলেকট্রিক মিস্তিরির মেয়ে দ্রুত আমার এই লুজ কানেকশন মেরামত করে দিল। একটু হেসে বলল, জানি তো, আমিও। শুনে বুকের মধ্যে যেন ভেপার ল্যাম্প জ্বলে উঠল। কোনও রকমে বললাম, সত্যি!

নকুলদা বাড়ি নেই জেনেও নকুলদাকে খুঁজতে চলে যেতাম। আর আমাকে নিয়ে কনক চলে যেত ছাদের ঘরে। শরীরের যে এত রহস্যময় সুইচ প্লাগ হোল্ডার স্টার্টার থাকতে পারে এবং নেগেটিভ-পজিটিভের ঠিকমত কানেকশন হলে কী বিপুল তড়িৎতরঙ্গ প্রবাহিত হয়, তা খুব যত্ন করে শেখাচ্ছিল কনক। খুব মনোযোগী শিক্ষানবিশের মতো শিখছিলাম আমি। যত শিখছিলাম, তত বিস্মিত এবং পুলকিত হচ্ছিলাম।

বিয়ে করব আমরা, স্থির করেছিলাম। কাজ শিখে কিছু দিনের মধ্যেই ফুল মিস্তিরি হয়ে যাব এবং তখনই বিয়ে করব কনককে। কিন্তু আমার ফুল মিস্তিরি হয়ে ওঠার আগেই কনকের সেই মদ্যপ এবং লম্পট স্বামী কী করে কে জানে হঠাৎ চরিত্রবান হয়ে উঠল। সেই সঙ্গে অনুতপ্তও। সুবোধ বালক হয়ে থাকার প্রতিশ্রুতি দিয়ে কনককে ফিরিয়ে নিয়ে গেল সে। ফিউজ কেটে যেন অন্ধকার হয়ে গেল আমার ভেতরটা।

তবে যাওয়ার আগে আড়ালে ডেকে চোখের জল ফেলেছিল কনক। ধরা গলায় বলেছিল, রণজয়, যাচ্ছি বটে, কিন্তু ও যদি একটা দিনের জন্যেও বেইমানি করে, সোজা চলে আসব তোমার কাছে। কাজ শেখা চালিয়ে যাও। এসেই তোমাকে বিয়ে করে ফেলতে পারি যেন।

কনক চলে গেল। ওর স্বামীর পদস্খলনের প্রত্যাশায় থেকে মন দিয়ে কাজ শিখতে লাগলাম। কিছু দিন পর মা চোখ বুজল। আমি একেবারে একা হয়ে গেলাম। কনকের স্বামীর পদস্খলন হল না বটে, কিন্তু আমি কাজ শিখে পাকাপোক্ত মিস্তিরি হয়ে গেলাম। রোজগার যা করতাম, একটা পেট চলে যাবার পক্ষে যথেষ্ট। এমনকী হিসেব করে দেখতাম, এই রোজগারে দুজনেরও দিব্যি চলে যায়। কনক এলে অসুবিধে হবে না কিছু। কিন্তু সবই নির্ভর করছে ওর স্বামীর ওপর। তার চরিত্র টাল না খেলে তো কিচ্ছু হওয়ার নয়।

এই সময় ঘটল সেই ঘটনা। যেটা থেকে আমার ঝামেলার সূত্রপাত।

বিকেলে কাজ থেকে ফিরে নন্টুদার চায়ের দোকানে চা খাচ্ছি, পাশে এসে বসল তোচন লাহা। তোচন লাহার কাঁধে ঝোলা ব্যাগ।

হাতে ‘লটারি সমাচার’। তোচন লাহা লটারির টিকিট বিক্রি করে বেড়ায়। তোচন প্রথমে আমার শরীর-স্বাস্থ্য এবং কাজকর্মের খোঁজ নিল। বলল, একটা বিবাহের আশু প্রয়োজন আমার, এই অভিভাবকহীন অবস্থায় এতটা বয়েস পর্যন্ত আইবুড়ো থাকাটা মোটেই উচিত কাজ নয়। তার পর জানাল, আমার মতো যোগ্য পাত্রের উপযুক্ত এক পাত্রীর সন্ধান তার আছে, আমি সম্মতি দিলেই... তার পর ফিসফিস করে জানাল, ভাগ্যলক্ষ্মী বাম্পারের একটা টিকিট আছে, কুড়ি টাকা দাম, ফার্স্ট প্রাইজ এক কোটি এক লাখ টাকা, বলা যায় না কার ভাগ্যে কী আছে, লেগে গেলে একেবারে রাতারাতি রাজা!

লটারির টিকিট কখনও কাটিনি আমি। কয়েক বার প্রস্তাব অবশ্য পেয়েছি। একটা জিনিস লক্ষ করেছি, টিকিট বিক্রেতারা টিকিট কেনার প্রস্তাব সব সময় চাপা গলায় ফিসফিস করে দেয়। যেন গভীর কোনও ষড়যন্ত্রের কথা বলছে। তোচন লাহা তেমনই চাপা গলায় বারবার অনুরোধ করতে লাগল। একটা ম্যারেজ-হল ওয়্যারিংয়ের বড় কাজ পেয়েছি কিছু দিন হল। পকেটে টাকা ছিল কিছু। অনুরোধ ঠেলতে না পেরে কিনেই ফেললাম টিকিটটা।

পর দিন সেই ম্যারেজ-হলেই কাজ করতে করতে কনকের কথা ভাবছিলাম। আর ভাবছিলাম আমার পাথরচাপা কপালের কথা। এমনই কপাল, কেমন তাল বুঝে দুশ্চরিত্র মানুষ চরিত্রবান হয়ে গেল। ভাবতে ভাবতে অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলাম, খোলা তারে হাত পড়ে গেল। জোর কারেন্ট খেলাম, এবং অক্কা।

শরীর থেকে বেরিয়ে এসে দেখি, বেশ ফুরফুরে লাগছে। পাড়ার ছেলেরাই দেখলাম, চাঁদাটাঁদা তুলে হাসপাতাল-মর্গ থানা-পুলিশ সব সামলাল। কোমরে গামছা বেঁধে শ্মশানে নিয়ে গিয়ে আমার বডি পুড়িয়েও এল। কথাবার্তায় বুঝলাম, আমার টিনের চালের বাড়িটা ভেঙে ওরা ক্লাবঘর বানাতে চায়। শুনে ভালই লাগল। আমার তিন কুলে কেউ নেই, শেষ কাজকর্ম ওরাই করল, ওদের কাজে লাগলে মন্দ কী! জায়গাজমি টাকাকড়ি নিয়ে এখন আর কী হবে আমার! কোনও একটা তালগাছটাছ দেখে নেব, দিব্যি থাকা যাবে। ঠিক তখনই টিকিটের কথাটা মনে পড়ে গেল। ভাগ্যলক্ষ্মী বাম্পার। হিসেব কষে দেখলাম, গত কাল খেলা হয়ে গেছে, মানে আজ রেজাল্ট পাওয়া যাবে। কত টাকা যেন ফার্স্ট প্রাইজ? এক কোটি এক লাখ!

খুব কৌতূহল হল। ভূত হয়েও দেখলাম, কৌতূহল জিনিসটা থেকেই গেছে। আমার ঘরে যে চৌকিটা, তার তোশকের নীচে রাখা আছে টিকিটটা। আর তোচন লাহার ব্যাগেই থাকে ‘লটারি সমাচার’। ভূত হয়ে মিলিয়ে নেওয়া কী আর এমন ব্যাপার!

একটা মানুষ দু’বার মরে না তাই রক্ষে। না হলে টিকিট মেলাতে গিয়ে যা দেখলাম, হার্ট ফেল অনিবার্য ছিল। আমার টিকিটে ফার্স্ট প্রাইজ লেগেছে।

 

ভেবেছিলাম কনক ভয় পাবে খুব। আঁতকে উঠে চিৎকার করবে। কিন্তু তেমনটা হল না। ভূত হয়েছি শুনে ভয় পেল না একটুও।

আসলে যখন দেখলাম আমি কোটি টাকার মালিক, পুরনো প্রেমটা চাগাড় দিয়ে উঠল। প্রবল হয়ে উঠল বিয়ের বাই। ভূত হয়ে শুধু কৌতূহল নয়, বিয়ের শখও থেকে যায়। বারবার কনকের কথা মনে হচ্ছিল, তাই ওর শ্বশুরবাড়ি চলে গেলাম। দুপুরবেলা। কনক মুগডালের খিচুড়ি রান্না করছিল। গন্ধ ছেড়েছিল চমৎকার। কনককে গোটা ঘটনা বললাম। খুব স্বাভাবিক গলাতেই কনক বলল, সবই বুঝলাম, কিন্তু তুমি কী চাও?

বলতে লজ্জা করছিল খুব, তবু বললাম, তোমার স্বামী কি নেশা-অত্যেচার করছে আগের মতো?

কনক বলল, না, ও এখন খুব ভাল হয়ে গেছে। মদ খায় না, অন্য মেয়েমানুষের কাছে যায় না, আমাকে খুব ভালবাসে।

শুনে একটু হতাশ হয়ে গেলাম আমি। বললাম, তা হলে তো আর কিছু করার নেই। তবে কোনও দিন যদি ও-সব কাণ্ড করে, তুমি আমার কথা ভাবতে পারো, আমি অপেক্ষা করব তোমার জন্যে।

কনক বলল, তা কেন! ও কবে আবার মদ ধরবে, অন্য মেয়েমানুষের কাছে যাবে, তত দিন অপেক্ষা করব! তুমি ভূত হয়ে গেছ, তোমার নাহয় বয়েস বাড়বে না। কিন্তু আমার বয়স তো আর বসে থাকবে না। শখ-আহ্লাদ কবে মেটাব! আমি এখনই ওকে ছেড়ে তোমাকে বিয়ে করব।

আমি বললাম, কিন্তু ও যদি তোমাকে ছাড়তে রাজি না হয়?

কনক বলল, তা হলে অন্য রাস্তা নেব, ওর খাবারে বিষ মিশিয়ে দেব। ব্যস, রাস্তা পরিষ্কার।

শুনে আঁতকে উঠলাম। বললাম, না না, এটা করতে যেয়ো না।

কনক বলল, তুমি থামো তো! তোমাকে তো কিছু করতে হচ্ছে না, যা করার আমি করব। তুমি শুধু বিয়ের পর আমাকে একটা বমকাই শাড়ি আর একটা সোনার ঝুমকো দুল দেবে, আমার অনেক দিনের শখ। তোমার তো এখন অনেক টাকা।

আমি বললাম, ঠিক আছে, আমি একটু ভাবি। তুমি ফট করে কিছু করতে যেয়ো না যেন!

চলে এলাম কনকের কাছ থেকে। মনটা খিঁচড়ে গেল। বিষ মেশানোর পরিকল্পনাটা কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলাম না। যত ভাবছিলাম, মন তত বিরূপ হচ্ছিল কনকের প্রতি। প্রেম-প্রেম ভাবটা কেটে যাচ্ছিল।

তখনই শিপ্রার কথা মনে পড়ল। কেমন আছে এখন ও? খুঁজে খুঁজে শিপ্রাদের বাড়ি চলে গেলাম। ওকেও সব বলে বললাম, তুমি আমাকে বিয়ে করবে শিপ্রা? আমার প্রথম প্রেম তুমি, তোমাকে সত্যিই খুব ভালবাসতাম।

শিপ্রা বলল, কিন্তু আমার যে বিয়ে! কলেজে পড়ার সময় গৌরব বলে একটা ছেলের সঙ্গে প্রেম হয় আমার। ওর সঙ্গেই সামনের মাসের সাত তারিখে বিয়ে। কেটারারকে বলা হয়ে গেছে, কেনাকাটা শেষ, নেমম্তন্নও কমপ্লিট। শুনে মন খারাপ হয়ে গেল আমার। ‘ঠিক আছে আসছি,’ বলে চলে এলাম।

সন্ধেবেলা ঘরেই ছিলাম। পাড়ার ছেলেরা যত দিন না দখল নিচ্ছে, তত দিন এখানেই থাকব ঠিক করেছি। হঠাৎ দেখি, শিপ্রা এসেছে আমার ঘরে। বলছে, রণজয়, আছ নাকি?

আছি, বললাম আমি।

শিপ্রা বলল, গৌরবকে নয়,  আমি তোমাকেই বিয়ে করব।

আমি খুব অবাক হয়ে বললাম, সে কী, তুমি যে বললে সাত তারিখে বিয়ে, নেমন্তন্ন কমপ্লিট!

তাতে কী! শিপ্রা বলল, সাত তারিখেই হবে বিয়ে। নিমন্ত্রিতরা যেমন আসার আসবে, খাবে, গিফ্‌ট দেবে, চলে যাবে! শুধু গৌরবের জায়গায় বর হবে তুমি। গেটে ‘শিপ্রা ওয়েড্‌স গৌরব’ লেখাটা বদলে ‘শিপ্রা ওয়েড্‌স রণজয়’ হয়ে যাবে শুধু। বাবা-মা’কে বলেছি, ওরাও রাজি। আসলে গৌরবের ব্যাপারে ওদের খুঁতখুঁতানি ছিল। প্রাইভেট ফার্মে চাকরি, মাইনে খুবই কম। আমি আবার বাবা-মা’র একটাই মেয়ে, আদরে মানুষ। তাই তোমার কথা ভেবে ওরা খুব খুশি!

গৌরব নামে প্রাইভেট ফার্মে কর্মরত সামান্য বেতনের এক কর্মচারীর কথা ভেবে মনটা একটু খারাপ হয়ে গেল। শিপ্রাকে বললাম, ঠিক আছে, একটু ভাবি।

শিপ্রা বলল, আচ্ছা ভাবো, রাতটুকু আজ ভাবো। কাল সকালেই আমি আসব কিন্তু।

শিপ্রা চলে গেল। কিন্তু পর দিন সকালে শিপ্রা আসার আগে অন্য এক জন এল। হালদারবাড়ির রিম্পা।

হালদাররা বিশাল বড়লোক। রিম্পা মারকাটারি সুন্দরী। স্বভাবতই আমার মতো ছেলেদের দিকে এমন ভাবে তাকাত, যেন কীটপতঙ্গ।

রিম্পা এসে ডাকল, রণজয়।

আমি বললাম, কী?

আমাদের বিয়েটা তা হলে কবে হচ্ছে?

থতমত খেয়ে বললাম, মানে!

ঢং! রিম্পা বলল, জানে না যেন কিছু! সেই কবে থেকে আমি তোমাকে... আর আমি জানি, তুমিও আমাকে মনে মনে... এই শোনো না, বিয়ের পর কোথায় হনিমুনে যাব গো আমরা? দিঘা বা পুরী নয় কিন্তু, ও তো সবাই যায়। আমরা গোয়া বা পাটায়া যাব। ফ্লাইটের টিকিট কেটে রাখবে কিন্তু। আর শোনো, এগজিকিউটিভ ক্লাস কাটবে, তোমার তো অনেক টাকা, সমস্যা হবে না।

আমি অবাক হয়ে বললাম, তুমি কী করে জানলে? ‘ও মা, এ তো সবাই জানে। শোনো, এখন অনেকেই তোমাকে বিয়ে করতে চাইবে। মিথ্যে মিথ্যে ভালবাসার কথা বলবে। একদম বিশ্বাস করবে না।’

সত্যি দেখলাম, সবাই জানে। কারণ রিম্পার পর পর্ণা এল, তার পর চিত্রা, তার পর কুহেলি। পর্ণা এক গোছা চিঠি দেখিয়ে দাবি করল, এই সব প্রেমপত্র আমিই তাকে দিয়েছি, চিত্রা কিছু এসএমএস দেখাল, কুহেলি গায়ের জামা খুলে বুকে গলায় কিছু দাগ দেখিয়ে বলল, এ সব লাভ বাইট আমারই।

খুব দিশেহারা লাগছে আমার। কনক শিপ্রাও চলে এসেছে। আরও কয়েক জনকে দেখলাম। ভয় পেয়ে কাছাকাছি একটা তালগাছে উঠে বসলাম। কিন্তু ওরা ঠিক টের পেয়ে গেল। সবাই চলে এল গাছটার নীচে। ছোট গাছ। কেউ মই এনেছে, কেউ টুলের ওপর টুল বসাচ্ছে, এক জনকে দেখলাম আমার বাড়ি থেকেই উঁচু ঘরাঞ্চিটা ঘাড়ে করে নিয়ে আসছে। ছোট গাছ, যে কোনও সময় নাগাল পেয়ে যাবে আমার।

আমি অসহায় চোখে এদিক-ওদিক তাকিয়ে খুব উঁচু একটা তালগাছের খোঁজ করতে থাকি।