Abosar

তস্কর

মহুয়া চৌধুরী

অফিস থেকে ফিরতে দেরি হল আজও। ঘড়ির কাঁটা আটটা পেরিয়ে এগিয়ে গিয়েছে অনেক দূর।

লিফট থেকে নেমে বেল বাজাল নিশা। তমালী দরজা খুললেন। গাঢ় নীল নাইটি পরনে। পঁয়ষট্টি পেরিয়েছেন। শিথিল হয়ে গিয়েছে গাল ও চিবুক। কপালে বলিরেখা। মাথায় এখনও অনেক চুল।  নিয়মিত পার্লারে গিয়ে ডাই করেন। বড্ড বেশি কালো। মনে হয় জরাগ্রস্ত মুখের উপর একটা বেমানান উইগ বসিয়ে দিয়েছে কেউ। চোখে, ঠোঁটের কোণে চিরস্থায়ী তিক্ততা। 

“আটটা বাজল কি না বাজল অমনি, ব্যাগ ঝুলিয়ে  হাঁটা দিলেন তিনি,”মেয়ে বাড়ি ঢোকা মাত্র  মায়ের প্রথম সংলাপ।

“কেন? আগে থেকেই তো ও বলে রেখেছিল। দূরে বাড়ি। দেরি করতে পারবে না,” ভাবলেশহীন মুখে বলল নিশা।

বাড়ি ফিরে আগেই ফ্রিজ খুলে ঢকঢক করে ঠান্ডা জল গলায় ঢালে সে। তমালী চেয়ার টেনে ডাইনিং টেবিলের সামনে এসে বসলেন, “এক্কেবারে চোর। আমি বুঝে গিয়েছি।” বরাবরই তমালীর প্রিয় বক্তব্য বিষয় ‘চৌর্যবৃত্তি’। চোরে ঠাসা তাঁর দুনিয়া। নিশার মাঝে মাঝে মনে হয়, সেই চোর-তালিকায়, হয়তো তার নামও রসুনের রস দিয়ে লিখে রেখেছে মা। আপাত দৃশ্যমান নয়, কিন্তু সামান্য তাপ পেলেই ফুটে উঠবে।

অতএব কোনও পরিচারিকাই বেশি দিন টেকে না। আগের জন লাগাতার অভিযোগে অতিষ্ঠ হয়ে,  আচমকা ‘রিজাইন’ করল! অফিস আর বাড়ি একসঙ্গে সামলাতে গিয়ে, পুরো সপ্তাহটা চোখে সর্ষেফুল দেখেছে নিশা। আয়া সেন্টারের মালকিন আজ সকালেই সুলেখা নামের এই নতুন মহিলাকে পাঠিয়েছে।

“সারা দিনে গন্ডা গন্ডা কাপ চায়ের শ্রাদ্ধ হল। হাতার পর হাতা দুধ ঢালছে তো ঢালছেই। আর ওই চিনির কৌটো খুলে... একেবারে চোখের সামনে... আমাকে গ্রাহ্যই করছে না যেন...” বলে চলেন তমালী। নিশা জানে, ক্রনিক ‘অতিশয়োক্তি’ রোগে ভোগেন তিনি।  

“তা হলে আর চুরি বলছ কেন? লুকিয়ে তো খায়নি। ও নিয়ে মাথা খারাপ কোরো না তো,” নিশা বিরক্ত গলায় তমালীকে থামিয়ে দেয়।

নিশার বাবা এক নামী কোম্পানির উঁচু পদে ছিলেন। পার্টি ও পার্লারে যাওয়া ছিল মায়ের নিয়মিত রুটিন। এ ছাড়া কালো গাড়ি চেপে শপিং! রাশি রাশি জিনিস কিনে আলমারিতে থরে থরে গুছিয়ে রাখা। ‘শপাহলিক’ শব্দটা তখন শোনেনি নিশা। এখন মাঝে মাঝে ভাবে, কী অসম্ভব এক অপচয়ের জীবন কাটিয়েছে তার মা।

এখনও মায়ের আলমারি জিনিসে ঠাসা। আর ইদানীং তাঁর একমাত্র কাজ— থেকে থেকে সেগুলো গোছানো। ছেলেবেলা থেকেই নিশা দেখে আসছে, আলমারি গোছানোর সময় মা ঘরের দরজা বন্ধ রাখে। এর কারণ, কাজের লোকেদের প্রতি অবিশ্বাস।

“আমি বলছি তোমায়, চোরের গুষ্টি ও, সাজগোজ দেখোনি? ব্যাগ, চটির বাহার? নিজের পয়সায় কিনেছে ভাবছ? সেই যে গত বছর ক’দিন ধরে কাগজে বেরচ্ছিল না, বিডন স্ট্রিটে একটা বাড়িতে আয়া  কাজ করতে এসে আলমারি ফাঁক করে একেবারে হাওয়া! সে চুরির তো কিনারাই হল না। মনে আছে?”

“কাগজে অমন হাজারখানা খবর বেরোয় মা। কে মনে রাখছে?” ঝাঁজিয়ে বলে ক্লান্ত নিশা।

এ বার গোয়েন্দাগিরির গর্বে ঝিলিক মারে তাঁর প্রৌঢ় চোখ। “ওরই সম্পর্কে মামি ছিল সেই আয়া, বুঝলে...”    

“তুমি জানলে কী করে?”  

“ও-ই বলল কথায় কথায়। আবার বলে কী, সে মামি ওই ঘটনার আগেই ওর মামাকে ছেড়ে চলে গেছে অন্য একটা লোকের সঙ্গে। কোনও সম্পর্ক নেই। নিশ্চয়ই বাজে কথা বলছে।” তমালী হঠাৎ খুব উৎসাহিত হয়ে একটি অভিনব পরিকল্পনা পেশ করেন। ‘‘আচ্ছা, পুলিশ-টুলিশ ডেকে এনে, এখন ওর ওপর চাপ দিলে কিছু হদিশ পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু আমার তো মনে হয়...”

“পরোপকার প্রবৃত্তিটা একটু সামলে রাখো মা। হাতজোড় করছি,” দাঁতে দাঁত চেপে, আগুন-চোখে তাকিয়ে বলে নিশা।

মেয়ের মেজাজ বুঝে থেমে যান তমালী। শরীরের ক্ষয় টের পাচ্ছেন। ভিতরে নিরাপত্তাহীনতার বোধ মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে। আগেকার তীব্রতা খানিক কমেছে।

নিভে যাওয়া গলায় শুধু বললেন, ‘‘তুমি রাগ করছ বটে, কিন্তু এই বা আর কত ভাল হবে? ওই রক্তই তো বইছে শরীরে।”

মামির রক্ত কী ভাবে কারও শরীরে প্রবাহিত হতে পারে! সেই বিচিত্র বিতর্কের মধ্যে ঢুকতে ইচ্ছে করে না নিশার।

“না পোষালে ছাড়িয়ে দাও। তার পর সোজা কুমোরটুলিতে চলে যাও। মেড টু অর্ডার কাজের লোক সাপ্লাই দিতে পারে যদি,” নিজের ঘরের দিকে এগিয়ে যায় সে।

রোজকার মতো আকাশ নিশার মোবাইলে ভিডিয়ো কল করল। প্রতি রাতেই এক-দেড় ঘণ্টা ধরে কথা বলে ওরা। আজকাল তার বেশিটাই তর্ক বিতর্ক। ওদের সম্পর্কটা তিন বছর হয়ে গেল। নিশা চৌত্রিশ। আকাশ সাঁইত্রিশ। কিন্তু এখনও সমাজের খিড়কি-দোর পথেই ওদের ঘনিষ্ঠতা।

আকাশ ক্রমে অধৈর্য হয়ে উঠছে। “তুমি কি উনিশ শতকের ট্র্যাশ নভেলের পাতা থেকে উঠে এসেছ? মায়ের পারমিশন না পেলে বিয়ে করতে পারবে না! এ দিকে আমার ওয়ান থার্ড দাড়ি পেকে খড়বিচুলি হয়ে গেল। এর পর বাচ্চা হলে লোকে বলবে, কি, দাদু-নাতি বুঝি?”  

ও দিকে তমালী খুব নিশ্চিত, যে আকাশ একটি পাক্কা মাছ শিকারি। চট করে বড় মাছ গেঁথে ফেলতে পেরেছে তাই! নিশা একমাত্র সন্তান। তার বাবা যথেষ্ট টাকাকড়ি রেখে গিয়েছেন। হাজরা রোডের উপরে এই পনেরোশো স্কোয়্যার ফিট ফ্ল্যাটের দাম বছর বছর বাড়ছে! এ সব অঙ্ক তো গোল্লা পাওয়া ছাত্রও বোঝে!

“ঘিলু বলতে কিছু আছে মগজে?” মেয়েকে ধিক্কার দেন তমালী। তিনি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছেন, আকাশ নামের ওই ধান্দাবাজ ছোকরা জামার হাতার ৩২ তলায় সিঁদকাঠি লুকিয়ে এগিয়ে আসছে ক্রমশ তাঁর পরিবারটিকে লক্ষ্য করে। হাবা মেয়েটার মাথায় হাত বুলিয়ে আস্তে আস্তে সর্বস্ব গাপ করবেই একদিন। এই ফ্ল্যাট, যাবতীয় ব্যাঙ্ক ইনভেস্টমেন্ট, কোম্পানির ফিকসড ডিপজিট, মিউচুয়াল ফান্ড, এত বছর ধরে গড়ানো সোনার গয়না! সব!

তমালী বলে দিয়েছেন মেয়েকে, ‘‘শুনে রাখো। যদি ওই চিটিংবাজ লোকটাকে বিয়ে করে বেরিয়ে যেতে চাও, তবে আমার মরা শরীরটাকে মাড়িয়ে যেতে হবে। আমি বিষ খাব সে দিন।” নিশা জানে, সমস্তটাই নাটক। তবুও ভয়ানক দোটানায় পাগল-পাগল লাগে তার।  

 

রবিবার সকালটা নিশা বেলা অবধি বিছানায় গড়ায়। আধো ঘুমে শুনতে পাচ্ছিল মা আর সুলেখার কথা কাটাকাটি। সুলেখা বাড়ি ঢোকার আগেই নিজের আলমারির চাবি খাটের গদির তলায় লুকিয়ে রাখে মা। থেকে থেকে তদন্ত করে আসে রান্নাঘরে তেল, চিনির কৌটো। বারবার গুণে আলু-পেঁয়াজের হিসেব রাখে! তবু তার সঙ্গে অবান্তর কথা বলারও কমতি নেই মায়ের। তার হাঁড়ির খবর জানতে চাইবে প্রশ্ন করে করে। আবার তাই থেকে কথায় কথায় অশান্তি বাধবে। নিশা ক’দিনেই বুঝে নিয়েছে, মা যাই বলুক, সুলেখা পরিশ্রমী, সৎ মেয়ে। খুব লড়াকু। ঢিল খেলে তক্ষুনি পাটকেলটি ছুড়বেই ছুড়বে। ঘুমের রেশ ফেটে চৌপাট। বন্ধ দরজার ও পার থেকে নিশা শুনল মায়ের উত্তেজিত গলা। “য্যাঃ অমন আবার করে কেউ! কী যে বলো না আজেবাজে...”

“মিছে বলছি? সেই থেকে আমরা রাস্তার ভিখিরি। কোন ফাঁকে কে তুলে নিয়েছে। নিজের বেখেয়ালের দাম চুকোতে হোল আমার মা’কে। চাকরি গেল। তার ওপর বদনাম। অমন বড়লোকদের মুখে ঝাঁটার বাড়ি মারতে হয়,” সুলেখাও ছেড়ে কথা বলার পাত্রী নয়। 

একটু পরে নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে মা’কে দেখতে পায় না নিশা। সুলেখা চা, বিস্কুট এনে সামনে রাখে। মুখের ভাবে রাগ। নিশা মিষ্টি কথায় বিশ্বাসী। বাঁধাধরা পাওনার বাইরে এটা-ওটা দেয় প্রায়ই। তাই তার উপর এক ধরনের টান তৈরি হয়েছে সুলেখার।

“তুমি চা খেয়েছ?” নরম সুরে বলে নিশা।

“এই মাসিমার নামকেত্তন সারা হল দিদি। এ বার খাব। ওনার জম্মের সময়ে কেউ মধু দেয়নি গো মুখে। একটা মিষ্টি কথা শুনিনি এত দিনে।”

ভয়ে নিশার বুক কাঁপে। চলে যায় যদি! মুখে তক্ষুনি বিষাদের ছায়া ফোটায়। মাখন-মাখন খোশামোদ মেশায়। গপ্পো বানিয়ে রাখাই আছে। “আসলে, আমার বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে, এই রকম। মাথার ঠিক নেই। একটু মানিয়ে নিয়ো। বুড়ো মানুষ তো।”

মোবাইল এই সময়ে টিং করে ওঠে। দুটো ফিক্সড ডিপোজিট ম্যাচিয়োর হওয়ার খবর মনে করাল। উঠে পড়ে নিশা। কত রকম যে কাজ ছুটির দিনেও! ব্যাঙ্কের ফাইলগুলো মায়ের আলমারিতে রাখতে দিয়েছিল ফ্ল্যাট রং করার সময়ে।

দরজায় টোকা দেয়। খোলে না। ভিতর থেকে বন্ধ। চেঁচিয়ে ডাকে তখন, “খোলো। দরকার আছে।”

খানিক পরে দরজা ফাঁক করে বিরক্ত মুখ বাড়ান তমালী, “কী হল?” যেন ঘরের ভিতরে নিশার প্রবেশ নিষিদ্ধ। গা জ্বলে যায় নিশার। “সরো, ঢুকতে দাও। ব্যাঙ্কের ফাইল লাগবে।” শক্ত গলায় বলে সে।

“তা নিজের কাছে রেখে দিলেই তো হয় সে সব। নিরিবিলিতে একটা কাজ করব। তা না যখন তখন...” কথা শেষ না করে সরে দাঁড়ান তমালী। সে ঘরে ঢুকতে নিচু গলায় আবার শুরু করেন, ‘‘যত্ত মিথ্যে কথা এদের।”

নিশা বলে, “ফাইলগুলো দাও।”

তমালী যেন শুনতেই পান না। “জানো, বলছে ওর মা নাকি গড়িয়াহাটের ওই ‘স্বপ্নসুন্দরী’ দোকানে কাজ করত। সেলস গার্ল! পুজোর আগে ভিড় হয়, সেই সুযোগে কারা বুঝি দামি শাড়ি তুলে নিয়ে সরে পড়েছে! বললেই হল! ও রকম হয় কখনও?”

“কেন হবে না? কাগজে পড়ো না শপলিফটিংয়ের কথা? সে দিনই তো কোথায় যেন সিসিটিভি ক্যামেরায় ধরা পড়ল,’’ উত্যক্ত স্বরে নিশা বলে ওঠে।

“সব বানিয়ে বলছে। ডোন্ট ইউ সি দে হেট আস? নামকরা পুরনো দোকান, কত বড় বড় ঘরের মেয়েরা যায় ওখানে। তারা অমন হাঘরের মতো কাজ করবে? আমি বলছি,ওর মা-ই আসলে নিজে চুরি করে...” 

“আশ্চর্য তো!” চেঁচিয়ে ওঠে নিশা। “হাওয়ার সঙ্গে লড়াই করছ যে। মাথাটা পুরোপুরি গেছে দেখছি তোমার!”

বলতে বলতে বিছানার দিকে নজর পড়ে নিশার। সারা চাদর জুড়ে অজস্র কুচি কুচি গোলাপি সুতোর রোঁয়া ছড়িয়ে আছে। বালিশের পাশে একটা বড় কাঁচি। “কী এ সব? কী করছিলে তুমি?” ভুরু কুঁচকে বলে সে।

“যা করছি, করছি। সব কিছু তোমায় কৈফিয়ত দিতে হবে নাকি?” ভীষণ আক্রোশে হাঁপাতে থাকেন তমালী।

নিশা কথা বাড়ায় না। আলমারির পাল্লাদু’টো ভেজানো রয়েছে। রাগী মুখে সে দিকে এগোতেই তমালী হাঁ-হাঁ করে ওঠেন। সে তাতে কান না দিয়ে টেনে খোলে। থপ করে কী সব নীচে পড়ে যায়। নিশা দেখে, একটা গোলাপি রঙের কাপড়ের গোলা। অর্ধেক কাটা একটা কাঞ্চিপুরম শাড়ি। শাড়িটা পুরনো। জমিতে দাগ ধরে গিয়েছে। কিন্তু ব্যবহার হয়নি। শাড়ির এক দিকে প্রাইস ট্যাগ আটকানো। “ছাড়ো, ঘাঁটবে না বলছি,” তমালী হিংস্র ভাবে কেড়ে নেন সেটা মেয়ের হাত থেকে। গুঁজে গুঁজে ঢুকিয়ে দিতে থাকেন, আলমারির অনেক ভিতরে। তাঁর বিস্ফারিত চোখের চাউনিতে হতভম্ব নিশা এ বারে আতঙ্ক দেখতে পায়।

ছেলেবেলায় চট করে জিগস’ পাজল মিলিয়ে দিতে পারত সে। হঠাৎ জেগে ওঠে সেই অনভ্যাসে ঘুমিয়ে থাকা ক্ষমতা। তমালীর জীবন জোড়া সন্দেহ, অবিশ্বাসের সঙ্গে, আজ নিশা খাপে খাপে মিলিয়ে দিতে পারল, এই গোপন ভয়কে।  

অমনি ভয়ানক যন্ত্রণায়, লজ্জায় আর্তনাদ করে ওঠে নিশার শরীরে বয়ে যাওয়া রক্তস্রোত। নিজের মায়ের মুখে এ কাকে দেখল? প্রমাণ লোপের চেষ্টায় যে এখন সে মরিয়া!