ছেলেবেলা থেকে দেখে এসেছি মায়ের বেশির ভাগ সময় কাটত উঠোনের এক চিলতে বাগানে। সেখানে ফলাতেন মরশুমি ফুল, ফল, আনাজপাতি। বাড়িতে বাগান করার ব্যাপারে বাবার তেমন একটা আগ্রহ দেখিনি। তবে নিরুৎসাহিত করতেন না মা-কে। প্রায়ই দেখতাম মা বাবাকে বলতেন, “বেরনোর আগে আমায় একশো টাকা দিয়ে যেয়ো, রাখহরিকে দিয়ে কয়েকটা ফলের চারা আর ঢেঁড়শের বীজ আনাব?”
রাখহরি ছিল আমাদের কাজের মাসি নন্দার স্বামী। ওর মাধ্যমে মাঝে-মাঝেই ডেকে পাঠাতেন রাখহরিকে।
“নন্দা, তোর কর্তাকে এক বার আসতে বলিস তো, সামনেটা একটু খোঁড়াব। কয়েকটা বেগুনচারা লাগাব, আর রাখহরি বলছিল কোথায় ভাল লঙ্কাচারা আছে, নিয়ে আসতে বলিস। আর হ্যাঁ, ভাল লাউবীজ পেয়েছি, যাবার আগে পুঁতে দিয়ে যাস।”
মায়ের এই একটা অদ্ভুত সংস্কার ছিল। আর সব গাছ যে-ই লাগাক না কেন, লাউবীজ পোঁতাতেন নন্দামাসিকে দিয়ে। বাবা এক বার জিজ্ঞেস করেছিলেন, “নন্দার এমন কী স্পেশালিটি আছে যে, ওকে দিয়েই তুমি লাউবীজ পোঁতাও?”
“তুমি পুরুষমানুষ, সব কথা বুঝবে না।”
“কেন বুঝব না, বললেই বুঝব।”
এ বার মা গোপন কথা বলার ভঙ্গিতে বাবার কানের কাছে মুখ নামিয়ে বলেন, “বাঁজা মেয়েছেলে দিয়ে গাছের বীজ পোঁতালে ফলন ভাল হয়।”
নন্দামাসিও মায়ের কথার অন্যথা করত না। তবে তর্ক জুড়ত, “এই যে এত খেটেখুটে আনাজ লাগাও, এতে ক’পয়সা সাশ্রয় হয়! বরং তোমার পরিশ্রম আর খরচাটাই সার হয়।”
“আমি কি আর লাভের জন্য এ সব করি!”
“তবে?”
“গাছ লাগাতে ভাল লাগে। বাবা চাষি ছিলেন। মাঠ থেকে ফেরার পর বাবার গা থেকে মাটির একটা অদ্ভুত সুন্দর গন্ধ পেতাম। বাগানে কাজ করতে করতে ওই গন্ধটা আমি পাই।”
এই লাভ-লোকসানের হিসেব যে বাবা মায়ের সঙ্গে করতেন না, এমনটা নয়। সে ক্ষেত্রে মায়ের উত্তর থাকত, “বাজারের জিনিস তো সব বিষ। বিষ ছাড়া ফলন যদ্দিন পারি ফলাই। আর তা ছাড়া তুমিও বেরিয়ে যাও, ঝন্টু-মন্টুও স্কুল চলে যায়। সারা দিন ঘরে বসে একা-একা করবটাই বা কী?” এর পর আর বাবার বিশেষ কিছু বলার থাকত না।
ধীরে ধীরে বড় হয়ে উঠতে লাগলাম আমরা। বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বদলে যেতে লাগল ব্যক্তিগত পরিসর। কিন্তু মা একই রকম থেকে গেলেন। আগের মতোই সারা দিন ব্যস্ত থাকেন এক চিলতে বাগানটুকু নিয়ে। রিটায়ারমেন্টের পর বাবাকেও দলে টানতে চেয়েছিলেন। দিনদুই মায়ের সঙ্গ দেওয়ার পর বাবা বুঝে গেলেন, মায়ের মনের মতো করে বাগানচর্চা ওঁর দ্বারা সম্ভব নয়, “এ কম্ম আমার নয়, বুঝলে অতসী, এ তোমারই ভাল।”
“জানতাম তোমার দ্বারা হবে না। আসলে তোমার তো মাটির প্রতি টানটাই নেই। এ সব করতে গেলে মাটির উপর, গাছের উপর টান থাকতে হয়।”
বাবা ছেড়ে দিলেও হতোদ্যম হননি মা, আগের মতোই চালিয়ে যেতে লাগলেন। আমি বা ভাই হস্টেল থেকে বাড়ি ফিরলে খেতে দিয়ে গর্বভরে বলতেন, “ঘরের বাগানের পুনকা, তোর বাবার বাজার করা শাকে এই স্বাদ পাবি?”
আমাদের উত্তরের অপেক্ষা অবশ্য মা করতেন না। কোনও কালেই করেননি। এমনকি বাবা মারা যাবার পর যখন বলেছি, “এখানে একা একা কেন পড়ে থাকবে মা, আমার ওখানে চলো।”
“না বাবা, আমি তোর ওই খাঁচাবাড়িতে গিয়ে থাকতে পারব না। আমি এখানে ঠিক থেকে যাব।”
ভাই বুঝিয়েছে, “তোমার বয়স হচ্ছে মা, তোমার আর একা থাকা সেফ নয়।”
“একা থাকব কেন? এ দিকে আয়…” বলে বাগানে নিয়ে গেছেন, তার পর দেখিয়েছেন, “ওই যে স্থলপদ্ম গাছটা দেখছিস, এটা তোর বাবা নিজের হাতে পুঁতেছিলেন। তোর বাবার বাগানের নেশা ছিল না। কিন্তু ওঁর এক কোলিগের বাড়িতে নিমন্ত্রণ খেতে গিয়ে গাছটা আমার মনে ধরে যায়। তখন আমাকে সারপ্রাইজ় দেবার জন্য ওই গাছের ডাল এনে লাগিয়ে ছিলেন। নিমগাছটা লাগিয়েছিল তোর বড়মামা। এই রবার গাছটা এনে দিয়েছিল মাসি সুলেখা আসাম থেকে। আর তোরা দু’ভাই জন্মানোর পর পরই এই দুটো মেহগনি গাছ এখানে এসে লাগিয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন তোদের দাদু। এই লাউয়ের মাচাটা করে দিয়েছিল রাখহরি। তা হলে, আমি একা থাকি? তোরা মানিস বা না মানিস, আমি মানি, লাগিয়ে যাওয়া গাছের মধ্যেই বেঁচে থাকে মানুষ। আজ আমি ঘর ছেড়ে চলে গেলে এই গাছের যত্নআত্তি কে করবে?” এর পর আর ভাইয়ের কোনও কথা চলে না। ওকে আমি বলি, “বেশ, মা যখন ওখানেই থাকতে চাইছেন থাকুন। আমি তো কাছাকাছি রইলাম। যাব মাঝে মাঝে।”
গ্রামের বাড়িতে এলেই ফেরার সময় মা একগাদা আনাজ ফল তুলে দেন আমার হাতে, বলেন, “দিদিভাইয়ের জন্য নিয়ে যা।”
“মা, এত কী হবে! আর তা ছাড়া তুমি আতা দিচ্ছ, ও তো আতা খায় না!” বলি আমি।
“খাবে কী করে! খাইয়েছিস কখনও? জন্ম থেকে তো ডিম আর মাংস খেতে শেখাস। ফলমূল শাকসব্জি যে খেতে হয়, সেটা তো শেখাতে হবে?”
তর্ক করি না আমি। যা দেন নিয়ে চলে আসি। দু’-এক দিন ফ্রিজে জমা থাকে, তার পর বেশির ভাগটাই আমার বৌ রূপা দিয়ে দেয় কাজের মেয়েকে। এই ভাবে চলছিল, তবে চলল না বেশি দিন। হঠাৎই অসুস্থ হয়ে পড়লেন মা। সাধের বাগানবাড়ি ছেড়ে আমার খাঁচার মতো ফ্ল্যাটেই উঠতে হল মাকে। যদ্দিন বিছানায় ছিলেন, অসুবিধে ছিল না। বিপত্তি শুরু হল সুস্থ হওয়ার পর। সে দিন রবিবার, এমনিতেই দেরি করে ঘুম থেকে ওঠার দিন। তবে সকালেই ঘুম ভেঙে গেল ডোরবেলের শব্দে। দরজা খোলার পর অবাক হওয়ার পালা। দেখি দরজায় দাঁড়িয়ে নাড়ু। আমাদের ফ্ল্যাটের উল্টো দিকে ছেলেটার মুরগির দোকান। ওকে দেখে যতটা না অবাক হলাম, তার চেয়েও বেশি অবাক হলাম ওর হাতে একটা গোবরভর্তি পলিথিনের প্যাকেট দেখে। ঘুমজড়ানো গলায় জিজ্ঞেস করি, “কী ব্যাপার?”
“এই যে গোবর।”
“গোবর? কে আনতে বলেছে?”
“মাসিমা তো এই ফ্ল্যাটেরই নাম্বার দিয়েছেন।”
নাড়ুর গলা পেয়ে মা হাজির, “হ্যাঁ, আমিই বলেছিলাম গোবর আনতে।”
“গোবরে কী হবে?”
“দরকার আছে।”
“এখানে?”
“তা নয়তো আমি কি এখান থেকে গোবর নিয়ে গোপালপুর যাব? তুই এক কাজ কর তো বাবা, নাড়ুকে সাতশো টাকা দিয়ে দে। গোবরের দাম। আর ওকে কয়েকটা টবও আনতে বলেছি তার দাম।”
“কিন্তু মা…”
“কেন তোর দিতে অসুবিধে আছে? বেশ ধার দে, আমি পেনশন তুলে দিয়ে দেব।”
“মা তুমি না আশ্চর্য সব কথা বলো। আমি টাকার জন্য বলিনি, এখানে এ সব কেউ করে না।”
“তো কী হয়েছে? আমি করব। গাছ লাগানো নিশ্চয়ই খারাপ কাজ নয়!” বলে তরতর করে নাড়ুকে নিয়ে আমাদের ফ্ল্যাটবাড়ির ছাদে উঠে যান। আর সমস্যার সূত্রপাতও এখান থেকেই। অফিস থেকে ফিরে রোজই শুনতে হয়, “তোমার মা এ সব কী শুরু করেছেন বলো তো?”
“কেন? গাছ লাগানো কি খারাপ? টবে তো দু’-চারটে গাছই লাগাচ্ছেন?” মায়ের পক্ষে কথা বলি আমি।
“তা নিজে লাগাচ্ছেন লাগান, মেয়েটাকে কেন কাদা ঘাঁটাচ্ছেন? এমনিতেই ওর ঠান্ডা লাগার ধাত। রোজ দু’বেলা ইনহেলার দিতে হয়।”
‘‘তুমি ভুল করছ, রূপা। জলকাদায় বাচ্চাদের ঠান্ডা লাগে না। বরং ইমিউনিটি তৈরি হয়। সর্দি
লাগে গরমে।”
“শোনো, এই সব লেকচার তুমি তোমার কোলিগদের সামনে দেবে, বাহবা পাবে। আমাকে বলতে এস না। টুসকির ঠান্ডা লাগলে তোমাকে অফিস কামাই করতে হয় না, স্কুল ছুটি নিতে হয় আমাকে।”
মায়ের গাছ লাগানো নিয়ে রূপার সঙ্গে আমার খিটিমিটি চলতেই লাগল। তাতে অবশ্য মায়ের গাছ লাগানো আটকাল না। রূপা বা আমার কথায় গুরুত্ব না দিয়ে মা নিজের মতো করে ছাদের উপর বাগান সাজাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। আসতে লাগল ছোট-বড় বিভিন্ন সাইজ়ের টব। সেগুলো ভরে উঠতে লাগল বিভিন্ন রকমের গাছে। ছাদের উপর ফুটতে থাকা গোলাপ দেখে খুশি উছলে পড়ে টুসকির চোখে-মুখে। পাশের ফ্ল্যাটের মণ্ডলদার স্ত্রী বলেন, “পুরো ছাদের পরিবেশটাই আপনি বদলে দিয়েছেন মাসিমা। আগে ছাদে আসতে ইচ্ছে করত না, এখন এলে আর নামতে ইচ্ছে করে না।”
গাছের ফলন শুধু আমাদের বাড়িতেই আসে, এমনটা নয়। আবাসনের সব বাড়িতেই কম-বেশি পৌঁছয়। সেই দৌলতে মায়ের একটা আধিপত্য বিস্তৃত হতে থাকে আবাসন জুড়ে। তবু এখানে আর মায়ের মন টিকছিল না। খালি বলতেন, “এ বার আমায় গোপালপুরে রেখে আয়। এখন তো আমি ভালই আছি। আসলে ওখানকার গাছপালাগুলো কেমন আছে না দেখলে আর আমার মন মানছে না।”
মায়ের ইচ্ছের তীব্র বিরোধিতা করেছিল আমার মেয়ে টুসকি, “না, ঠাম্মা তুমি যেয়ো না। তুমি চলে গেলে গাছগুলোকে কে দেখবে?”
“কেন দিদিভাই, তুমি তো রয়েছ!” বলেন মা।
শুধু টুসকি নয়, ফ্ল্যাটের অন্যান্য বাসিন্দাও চায়নি মা এখান থেকে চলে যান। তাই হয়তো মায়ের আর গোপালপুরে ফেরা হল না। সন্ধ্যাবেলায় গাছে জল দিয়ে ছাদ থেকে নামছিলেন। অসাবধানতা বশত নামতে নামতে সিঁড়িতে পা হড়কে পড়ে যান। মাথায় চোট লাগে। রূপা-সহ আবাসনের বাকি বাসিন্দারা দৌড়োদৌড়ি করে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিল, কিন্তু শেষ অবধি বাঁচানো যায়নি মা-কে।
ফ্ল্যাটের ছাদে করে যাওয়া বাগান বাঁচানোর দায়িত্ব নিয়েছে আবাসনের বাসিন্দারাই। মাঝে মাঝে আমি আর রূপা ওদের সঙ্গ দিই, নতুন গাছ পোঁতার ও পরিচর্যার জন্য। এখানে করে যাওয়া মায়ের বাগান
ভাল আছে।
মাঝে মাঝে মনে হয়, গোপালপুর গিয়ে দেখে আসব মায়ের ওখানকার বাগান কেমন আছে। কিন্তু কাজের চাপে যাওয়া হয়ে ওঠে না। তবে যেতে হল। তত দিনে মায়ের মৃত্যুর চার বছর পেরিয়ে গেছে। দিল্লি থেকে ভাই মন্টুর ফোন, “বলছি, গোপালপুর থেকে কিশলয় ফোন করেছিল…” ভাইয়ের ক্লাসমেট কিশলয়। মাঝে মাঝে ওদের কথা হয় জানি।
“কী বলছিল কিশলয়?” জানতে চাই আমি।
“বলছিল, গোপালপুরের বাড়িটা এই সময় বিক্রি করলে ভাল দাম পাওয়া যাবে।”
“ওটা বিক্রি করে দিবি!”
“রেখে কী হবে? পড়ে থেকে ভূতুড়ে বাড়ি হয়ে যাচ্ছে…”
কথাটা যে কিছু ভুল বলেনি ভাই, বাড়িটাতে পা দিয়েই তা বুঝতে পারলাম। পুরো বাড়িটা আগাছায় ভর্তি। আমার পৌঁছতে পৌঁছতে সন্ধ্যা হয়ে গেল। কারেন্ট ছিল না। চেয়ার নিয়ে বারান্দায় বসে ছিলাম। ঝাঁকে-ঝাঁকে জোনাকি এসে আলো জ্বালিয়ে রাখছিল পুরো উঠোন জুড়ে। অন্ধকারে জোনাকির আলোয় আলোকিত উঠোন থেকে অদ্ভুত একটা গন্ধ পাচ্ছিলাম আমি। সামনের স্থলপদ্ম গাছ থেকে বাবার গন্ধ পাচ্ছিলাম, মেহগনিগুলো থেকে দাদুর, নিম থেকে অ্যাক্সিডেন্টে মারা যাওয়া বড়মামার। আর সেই সব গন্ধ ছাপিয়ে উঠোনময় ম-ম করছে মায়ের গায়ের গন্ধ। স্পষ্ট বুঝতে পারলাম মা কেন বাগানটাকে টিকিয়ে রাখতে চেয়েছিলেন। এই বাগানের গাছে-গাছে লেগে থাকা মানুষগুলোর স্পর্শ বাঁচিয়ে রাখতে চেয়েছিলেন মা। মা যা ধরে রাখতে চেয়েছিলেন, আমরা কী করে সেটা ধ্বংস করব! পারব না।
মন্টুকে ফোন করে বলে দেব, আমরা বিক্রি করব না এই বাড়ি, এই বাগান। ভাবতে ভাবতে চোখ যায় আকাশে। পরিষ্কার আকাশ যেন দিগন্তবিস্তৃত অন্ধকারের বাগান। সেখানে ফুলের মতো ফুটে আছে অজস্র তারা। তাদের মধ্যে কোনও একটাকে যেন আমার মা বলে মনে হয়। মনে হয় যেন সেখান থেকেই পাহারা দিচ্ছেন এই বাগানকে। পরক্ষণেই মনে হয় তা নয়, হয়তো স্বর্গের কোনও কোণ ভরিয়ে তুলছেন গাছে গাছে। এই পৃথিবীতে ছেড়ে যাওয়া বাগানের দিকে তাকিয়ে নষ্ট করার মতো সময় তাঁর নেই।