Abosar


<h1 align=center>জীবে প্রেম</h1>

অদিতি সরকার


কুকুরে সাংঘাতিক ভয় দীপাঞ্জনের। প্রাচীন ও কঠিন সে ভয়ের বীজ প্রায় প্রাগৈতিহাসিক কালে রোপিত হয়েছিল। ইতিহাসটি নিম্নরূপ…

দশ বছর বয়সে এক বার সায়ন্তনীদের বাড়িতে ভো-কাট্টা ঘুড়ি ধরতে ঢুকেছিল দীপাঞ্জন। তখন অবশ্য সায়ন্তনী নামক বিন্দুটি দীপাঞ্জনের রেডারের সুদূরতম কোণেও ছিল না। থাকার কথাও নয়। আজকের সায়ন্তনী তখন লেসের ঝালর-ঝালর জামা পরা ফর্সা টুকটুকে গুবলু পুচকু। সে দিন কে-ই বা জানিত, দীপাঞ্জনকে বধিবে যে…ইত্যাদি ইত্যাদি।

প্রাক্তন কর্নেলের বাড়িতে যে দু-দুটো বাঘের মতো ডোবারম্যান সারা দিন ছাড়া ঘুরে বেড়ায় সেটা সে দিন ঘুড়ির পিছনে ছোটার উত্তেজনায় মনেই ছিল না। না না, তারা অত্যন্ত সুশিক্ষিত সারমেয়, কামড়ায়নি এক জনও। কিন্তু খুব ভদ্র ভাবে যা করেছিল, সেটাই দীপাঞ্জনের প্রাণে আজীবন কুকুর-ভীতি বুনে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। নিঃশব্দ সাঁড়াশি আক্রমণে এক জন সামনে থেকে দীপাঞ্জনের দু’কাঁধে থাবা তুলে চোখে চোখ রেখে উঠে দাঁড়িয়েছিল, অন্য জন পিছন থেকে দীপাঞ্জনের হাফপ্যান্টটা খুবই স্ট্র্যাটেজিক পয়েন্টে কামড়ে ধরে রেখেছিল। হয়তো আজীবন ওরা ওই ভাবেই দাঁড়িয়ে থাকত, কারণ দীপাঞ্জনের তখন চিৎকার করে কাউকে ডাকারও ক্ষমতা লোপ পেয়েছিল। সামনে শুধু চকচকে মার্বেলের মতো স্থির ঠান্ডা দুটো চোখ আর দু’সারি ধবধবে তীক্ষ্ণ দাঁতের মাঝখানে ঝুলে-থাকা লম্বা লাল জিভ। নেহাত সায়ন্তনীর মা তখন কী একটা কাজে ঘর থেকে বাইরে এসেছিলেন বলে রক্ষে।

কুকুরে কামড়ালে জলাতঙ্ক। কিন্তু না কামড়াতেই দীপাঞ্জনের সারমেয়াতঙ্ক, সে দিন থেকেই।

এমনিতে দীপাঞ্জন যথেষ্ট সাহসী, ভাল অ্যাথলিট। কিন্তু কুকুরের ছায়া দেখলেই তার পাল্‌স রেট বেড়ে যায়, বুক ধড়ফড় করে, গলা শুকিয়ে সাহারা মরুভূমি, হাঁটুতে ঠকাঠক। কুকুর দেখলে সে ফুটপাত বদলায়। এমনকি, বোধহয় তাকে তাচ্ছিল্য করেই, কুকুরেরাও আজকাল ফুটপাত বদলে নেয়।

তবে তাতে দীপাঞ্জনের মুশকিল কমেনি। কোনও এক গূঢ় কেমিস্ট্রিতে আজকাল সায়ন্তনীকে দেখলেও দীপাঞ্জনের পাল্‌স বুক গলা হাঁটু… ওই-ওই-ওই!

দুঃখের কথা দীপাঞ্জন কাকেই বা বলে। সায়ন্তনী যে দীপাঞ্জনকে মানুষ বলেই গণ্য করে না। কারণ? কারণ আবার সেই কুকুরই।

সায়ন্তনীদের বাড়িতে সেই ডোবারম্যান দুটো এখন আর নেই, তাদের জায়গায় এসেছে দুটো আদেখলে আহ্লাদিপানা ল্যাব। সায়ন্তনীও গুবলু-পুচকু স্টেজ কাটিয়ে, এখন রীতিমতো চাবুক। অবশ্য নিজের চেহারা নিয়ে সে মেয়ে আদৌ মাথা ঘামায় না। তার মাথা ঘামানোর বস্তু পৃথিবীতে যদি কিছু থাকে, তা হল কুকুর। যেখানে যত ঠ্যাং-ভাঙা, কান-কাটা, খেতে-না-পাওয়া কুকুর আছে, তাদের নিয়ে সায়ন্তনীর চিন্তা। শুধু চিন্তাই নয়, কাজও। পড়াশোনা সামলেও অন্য সময়ে অ্যানিম্যাল ক্রুয়েলটি আর ওয়েলফেয়ার নিয়ে কী সব কাজকর্ম করে মেয়েটা। কোনও একটা এনজিও-র সঙ্গেও যুক্ত, শুনেছিল যেন দীপাঞ্জন। অ্যানিম্যাল ওয়েলফেয়ারের কাজের সূত্রে প্রায়ই এখানে-ওখানে যায়, মাঝে মাঝেই বেশ রাত হয় ফিরতে— এই নিয়ে কাকিমার একটু চিন্তাও আছে। এক্স-মিলিটারিম্যান কাকু অবশ্য খুবই উৎসাহ দেন মেয়ের এ সব কর্মকাণ্ডে।

কিন্তু দীপাঞ্জনের কী হবে? যে ছেলে কুকুরের ছায়া দেখলে অজ্ঞান হয়ে যায়, সে সাক্ষাৎ টম ক্রুজ় হলেও তাকে সায়ন্তনী পাত্তা দেবে না। এটা বোঝার জন্য আইনস্টাইন হওয়ার দরকার হয় না।

“কী দীপুদা, ভাল আছিস?”—এর বেশি আর কথা নেই। দীপাঞ্জন যত ক্ষণে একটা জুতসই জবাব ভেবে বের করে, তত ক্ষণে সায়ন্তনীর গোলাপি স্কুটি মোড় পার।

আজ কিন্তু ব্যাপারটা একটু অন্য রকম হয়ে গেল।

অফিসের এক সহকর্মীর বিয়ে ছিল আজ। সেখান থেকে ফিরতে বেশ দেরি। রাত হয়ে গেলে চেনা রাস্তাও যে এমন অচেনা লাগে, দীপাঞ্জনের জানা ছিল না। অন্য ভয়ডর কিছু নেই তার। প্রশ্ন একটাই। কুকুরগুলোর অবৈতনিক পাড়া-পাহারাদারি ডিউটির টাইম কি শুরু হয়ে গেছে?

দীপাঞ্জন খুব সজাগ দৃষ্টি আর সতর্ক কান রেখে হাঁটছিল। বোধহয় অত সতর্ক থাকার জন্যই হালকা কান্নার মতো শব্দটা কানে গেল।

বিশ্বাসদের পুরনো বাড়িটার পাশে একটা ফাঁকা মতো জায়গা আছে। কয়েক মাস হল টিন দিয়ে ঘিরে সেখানে প্রচুর ইট-বালি রাখা শুরু হয়েছে। আট তলা ফ্ল্যাট উঠবে নাকি ওখানে। কান্নার শব্দটা ওখানেই আর একটু জোরালো শোনাল। রাত-বেরাতে কী না কী শব্দ, দীপাঞ্জন অগ্রাহ্য করতেই চেয়েছিল, কিন্তু পারল না।

কুকুর! একটা কালো-সাদা ছোপ-ছোপ কুকুর একেবারে দীপাঞ্জনের সামনে। কোথা থেকে যে তিরের মতো ছুটে এল কে জানে। ঠিক সময় খেয়াল না করলে নিজেরই পায়ে-পা জড়িয়ে পড়ে যেত হয়তো দীপাঞ্জন। যথারীতি কুকুর দেখলে যা-যা হয় তার সব ক’টাই শুরু হতে চলেছিল, তাও ফাস্ট ফরোয়ার্ডে, কিন্তু এই কুকুরটার ব্যবহার এমন পিকিউলিয়ার, যে দীপাঞ্জন ভয় পেতেও ভুলে গেল।

টিংটিঙে রোগা একটা বিশুদ্ধ রোডেশিয়ান। এক বার ছুটে-ছুটে ঘেরা জায়গাটার দিকে যায়, আবার ছুটে দীপাঞ্জনের সামনে আসে। দীপাঞ্জনের দিকে তাকিয়ে চোখ দিয়ে, লেজ দিয়ে, বলতে গেলে সারা শরীর দিয়েই কী যেন বোঝাতে চেষ্টা করে। আচ্ছা, কুকুরটা কি মানুষের ভাষায় কমিউনিকেশন শিখতে চাইছে, না সাইন ল্যাঙ্গোয়েজ? কিন্তু এই মাঝরাতে দীপাঞ্জন ছাড়া আর কাউকে পেল না প্র্যাকটিস করার জন্য?

বেচারা কুকুরটা এত ক্ষণের চেষ্টায় হাঁপিয়ে গিয়েছে। দীপাঞ্জনের ঠিক সামনে কী রকম একটা আধা-বিপন্ন আধা-লজ্জিত এক্সপ্রেশন ঝুলিয়ে একেবারে থেবড়ে বসে পড়ল। এক বার দীপাঞ্জনের দিকে তাকায়, আবার এক বার মাথা ঘুরিয়ে ঘেরা জায়গাটার দিকে দেখে।

“চল তো, দেখেই আসি!” দীপাঞ্জন অত্যন্ত আশ্চর্য হয়ে শুনল এই কথাগুলো তার মুখ দিয়েই বেরোচ্ছে এবং তার পা-জোড়া কুকুরটাকে অনুসরণ করছে!

যত ওরা টিনের পাঁচিলের কাছাকাছি যায়, তত আওয়াজটা আরও জোরালো হয়। আন্দাজে হাঁটতে হাঁটতে দীপাঞ্জন আর একটু হলেই পা ফসকে একটা চৌবাচ্চা-গোছের গর্তের মধ্যে পড়ে যাচ্ছিল। একটা বেশ বড় চৌকোমতো গহ্বর। চৌবাচ্চা-টাইপ। দেড়-দু’ ফুট মতো গভীর কিন্তু অনেকখানি জায়গা জুড়ে রয়েছে। ওটারই পাশে একটা উঠে থাকা ইটের কোণে হোঁচট খেয়ে দীপাঞ্জনের ডান পায়ে খুবই ব্যথা লাগলেও, মুখ থুবড়ে পড়াটা যা হোক আটকে গেল।

এক পায়ে লাফাতে-লাফাতে দীপাঞ্জন দেখল, কুকুরটা ওখানেই দাঁড়িয়ে পড়েছে। সরু লেজটা এত জোরে নড়ছে যে, ওর অর্ধেকটা শরীরও সেই সঙ্গে নড়ে যাচ্ছে মনে হচ্ছে। কাঁচুমাচু চোখ যথারীতি দীপাঞ্জনের দিকে।

অন্ধকার, কিছুই পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে না। শব্দটা এখন আরও কাছে। দীপাঞ্জনের মনে হল ঠিক ওর পায়ের তলা থেকেই আসছে আওয়াজটা, ভাল করে দেখার জন্য সে উবু হয়ে চৌবাচ্চার ধারে বসেই পড়ল। কুকুরটাও তার পাশে বসল ঠিক একই ভাবে।

আধো আলোছায়ায় মিনিটখানেক একদৃষ্টে তাকিয়ে থেকে দীপাঞ্জনের মনে হল, অন্ধকার চৌবাচ্চার মধ্যে আরও অন্ধকার মতো কী যেন নড়াচড়া করছে। হাঁচোড়-পাঁচোড় করে বার বার চৌবাচ্চার ধার বেয়ে উঠতে চেষ্টা করছে কিন্তু পারছে না। একটু উঠেই আবার ধুপ করে পড়ে যাচ্ছে। কান্নার আওয়াজও ওই অন্ধকার থেকেই আসছে।

এটা আবার কী ব্যাপার? দীপাঞ্জনের সঙ্গীটিও এখন ওই কুঁইকুঁইয়ের সঙ্গে গলা মিলিয়েছে। মোবাইলটা পকেট থেকে বের করে জ্বালাতেই চক্ষুস্থির। হাফ ডজন সাইজ়-জিরো কুকুরছানা! যাঃ বাবা! চৌবাচ্চায় ক্রন্দনরত ছয়-বাচ্চা! কী করে এল? দীপাঞ্জনের গাইডও মুখ বাড়িয়ে ওদের দিকেই তাকিয়ে আছে। হুম, ওরই ছানাপোনা নির্ঘাত। কোনও রকমে ভিতরে পড়ে গিয়ে আর উঠতে পারছে না। বাঃ বাঃ, সাধে কী বলে কুকুর! উদ্ধার করার আর লোক খুঁজে পেল না, শেষ পর্যন্ত দীপাঞ্জন!

যা থাকে কপালে, বলে দীপাঞ্জন ছোট্ট একটা লাফ দিয়ে গর্তটার মধ্যে নেমেই পড়ল। আর নামতেই…

“দীপুদা তুই?”

দীপাঞ্জনের হাত থেকে মোবাইলটা পড়ে গেল। অন্ধকার গাড্ডায় কুকুরের কোরাসের মধ্যে এ কার সোলো আওয়াজ? স্বপ্ন না কি?

নাঃ, স্বপ্ন নয়, সত্যিই সায়ন্তনী! কুকুরদের উল্টো দিকে কী রকম একটা পুঁটলিমতো হয়ে বসে আছে!

“দেখ না, কী কাণ্ড! এমন বিপদে পড়েছি না! ভাগ্যিস তুই এলি। প্রথমে পায়ের আওয়াজ পেয়ে ভাবলাম কে এল আবার! সরে গিয়ে বোঝার চেষ্টা করছি, অমনি এমন আলো ফেললি চোখ ধাঁধিয়ে গেল, তার পর এখন বুঝলাম তুই।”

“এত রাত্তিরে তুই এখানে গর্তের মধ্যে কী করছিস?” দীপাঞ্জন শুকনো গলা ঢোঁক গিলে ভিজিয়ে প্রশ্নটা করেই ফেলে।

“আর বলিস না। আচমকা পড়ে গেছি। পায়ে এমন লেগেছে যে, দাঁড়াতে পারছি না… সেই থেকে মশার কামড়ে…”

“এখানে এলি কী করে? তোর স্কুটি কই, দেখলাম না তো? মোবাইলে একটা ফোন করতে পারতিস তো কাকুকে?”

“স্কুটি মন্টুদার দোকানের সামনে রে। মোবাইল… স্কুটির বাস্কেটেই। মন্টুদার দোকানেই এসেছিলাম পেনের রিফিল কিনতে। দোকান বন্ধ। ওই কুকুরটা এসে পায়ের কাছে এমন গড়াগড়ি দিতে লাগল, বুঝলাম কিছু একটা গোলমাল। ওকে ফলো করতে গিয়ে অন্ধকারে গর্ত খেয়াল করিনি, এমন পড়েছি না দীপুদা, পা-টা বোধহয় ভেঙেই গেছে। দেখ না, উঠে দাঁড়াতেই পারছি না।”

চমৎকার! এই না হলে দীপাঞ্জনের কপাল?

এখন এগুলোকে এবং সায়ন্তনীকে এখান থেকে তোলার তো একটা ব্যবস্থা করতে হয়। ধাড়ি এবং খুদে, চারপেয়ে এবং দুপেয়ে, সকলেই যখন দীপাঞ্জনকেই তাদের শেষ আশা বলে ধরে নিয়েছে, তখন কিছু একটা না করলে শেষে সায়ন্তনী কেন, কুকুরদের কাছেও দীপাঞ্জনের মুখ দেখানোর উপায় থাকবে না।

কিন্তু তুলবে কী দিয়ে? শেষটায় কি রোডেশিয়ানের ছানাদের হাত দিয়ে ধরতে হবে? দীপাঞ্জন মনে মনে একটু শিউরে ওঠে। বেশি ভাবতে গেলেই বিপদ। অতএব দীপাঞ্জন চোখ বুজে পায়ের কাছে জড়াজড়ি করে থাকা কুকুরছানার তালের মধ্যে হাত চালিয়ে দেয় এবং একেবারে আন্দাজে খপ করে একটার ঘেঁটি ধরে ফেলে।

একে একে ছ’টি কিলবিলে হাড়-জিরজিরে মিনি-রোডেশিয়ানকেই তাদের উদ্বিগ্ন গার্জিয়ানের কাছে নিরাপদে তুলে দেওয়া গেল। প্রথমটার বেলায় ঘেঁটি ধরতে গিয়ে যতটা গা শিরশির করেছিল, ছ’নম্বরটার পালা আসতে আসতে অবশ্য আর ততটা করেনি। অভ্যাসে কী না হয়!

সবচেয়ে সাহসের কাজটা এ বার… “দাঁড়াতে পারছিস?” দীপাঞ্জন সায়ন্তনীর দিকে হাত বাড়ায়। হ্যাঁ, ওই কুকুরছানার ঘেঁটি-ধরা হাতটাই, “আস্তে আস্তে চেষ্টা কর, আমার হাত ধর…” সায়ন্তনী একটু ককিয়ে ওঠে। তার পর এক পায়ে ভর দিয়ে টলমল করে দাঁড়ায়।

“এই পায়ে জোরই দিতে পারছি না রে দীপুদা!”

এর পরে দীপাঞ্জন যেটা করল, সেটা করার কথা স্বপ্নেও কোনও দিন ভাবলে বোধহয় দীপাঞ্জন ঘুমের মধ্যেই অজ্ঞান হয়ে যেত। স্মার্টলি সায়ন্তনীকে পাঁজাকোলা করে তুলে গর্তটার ধারে নিয়ে এল, মেয়েটা কিছু বুঝে ওঠার আগেই, “আমার গলাটা জড়িয়ে ধর ভাল করে।”

হালকা ঘাম আর লবঙ্গ মেশানো একটা গন্ধ তাকে একটু মুশকিলে ফেলছিল, কিন্তু দীপাঞ্জন জোর করে নিজের মনকে চোখ রাঙায়। এখন অন্য কোনও দিকে মন দিতে নেই, এখন সায়ন্তনীর বিপদ।

পরের কাহিনি সংক্ষিপ্ত। মন্টুদার দোকানের সামনে থেকে উদ্ধার করা গোলাপি স্কুটিকে প্রায় রকেটের মতো বাড়ির দিকে উড়িয়ে দিয়েছিল দীপাঞ্জন। অবশ্যই সায়ন্তনীকে পিছনে বসিয়ে। হ্যাঁ, আবারও কোলে তুলতে হয়েছিল তো বটেই। এবং, প্রায় সেই ভাবেই নামানো…

সায়ন্তনী খুঁড়িয়ে-খুঁড়িয়ে বাড়ির ভেতরে ঢুকতে-ঢুকতে যে কৃতজ্ঞ হাসিটুকু পিছন ফিরে হাওয়ায় ভাসিয়ে দিয়ে গিয়েছিল তাতে ডুবতে ডুবতে কাকিমার ধন্যবাদ, কাকুর এক গাদা প্রশ্ন কিচ্ছু কানে ঢোকেনি দীপাঞ্জনের।

এই ঘটনার পরে কেউ ভেবে না বসে যে, দীপাঞ্জনের সঙ্গে কুকুরদের এত বছরের সম্পর্ক এক লহমায় পাল্টে গেল। দীপাঞ্জন যথারীতি কুকুর দেখলে ফুটপাত বদলায় এখনও। শুধু একটা রোগা, কালো সাদা ছোপ-ছোপ কুকুর আর তার হাফ ডজন রোগা-রোগা ছানা দীপাঞ্জনকে দেখলেই টুক টুক করে লেজ নাড়ে। তবে অন্য ফুটপাত থেকেই।

আর, গোড়ালিতে ক্রেপ-ব্যান্ডেজ-বাঁধা সায়ন্তনীর স্কুটি দীপাঞ্জনকে দেখলে আজকাল একটু স্লো হয়। সে দিন ওর পা ভাঙেনি, মচকেছিল শুধু। একটু হাসি, আর একটু হাত নাড়াও উড়ে আসে। দীপাঞ্জনের পেট যথারীতি খালি-খালি লাগে।

গল্পটা এখানেই শেষ হয়ে যেতে পারত। কিন্তু হল না।

মাসখানেক পরে আবারও এক দিন, অফিস থেকে ফিরতে বেমক্কা দেরি। দীপাঞ্জন একটু অন্যমনস্কই ছিল। কানের পাশে চ্যাঁ করে স্কুটির হর্নে চমকে গেল একেবারে। সায়ন্তনী! হেলমেটের তলায় হাসি-হাসি বিচ্ছু চোখ।

“কী রে, এত রাতে তুই?”

“ওই একটা রেসকিউ ছিল, দেরি হয়ে গেল।”

“এত রাত করে ফিরিস, তোর ভয়ডর নেই?”

“দূর, কী হবে? নিজেদেরই তো পাড়া,” সায়ন্তনী তাচ্ছিল্যে গোলাপি ঠোঁট উল্টে দেয়৷ দীপাঞ্জনের পেটে আবার গুড়গুড়।

“দেরি হল বলেই না কেমন তোর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল দীপুদা। বেশ গল্প করতে করতে চলে যাব।”

“আমার শ্রীচরণ আর তোর স্কুটি। গল্পটা হবে কী করে? এত রাতে রাস্তার মধ্যে আর গল্প করে না, তাড়াতাড়ি বাড়ি চলে যা।”

“ধ্যাত! রাত কোথায়? তুই বরং উঠে বোস না পেছনে, হুশ করে পৌঁছে যাব বেশ।”

“ওটাই বাকি আছে এ বার। ধুর…”

সায়ন্তনী আবারও একটু ঠোঁট ফোলায়, তার পরে একটা ভেংচি কেটে এগিয়েই যায়। বুক খালি করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে দীপাঞ্জন। সোনার প্রস্তাব ছিল… আর কি কখনও কবে…

সায়ন্তনীর স্কুটি চোখের আড়াল হয়েছে কি হয়নি, ঝপ করে লাইট চলে গেল। চার দিক নিঝুম অন্ধকার। এই রাত্তির এগারোটার সময় ত্রিসীমানায় কেউ কোত্থাও নেই। আচমকা দীপাঞ্জনের মনে হল, মাটি ফুঁড়ে কয়েকটা ছায়া যেন তাকে ঘিরে ফেলেছে। মুখচোখ বোঝা যাচ্ছে না।

নিজের বিপদের কথা নয়, প্রথমেই দীপাঞ্জনের মনে হল, ভাগ্যিস সায়ন্তনী বেরিয়ে গেছে!

“মোবাইলটা বার কর। ঘড়ি খোল…” একটা কর্কশ গলা, “চালাকি করলে এখানেই লাশ হয়ে যাবি।”

ঘড়িটা অন্ধকারে হাত থেকে খুলতে একটু দেরি হচ্ছিল দীপাঞ্জনের, হঠাৎ একটা বীভৎস আর্তনাদে তার একেবারে ভেতর পর্যন্ত কেঁপে গেল। আওয়াজটা ওই ছায়াদেরই কারও গলা থেকে বেরিয়েছে এটা ঠিক, কিন্তু আচমকা এ রকম বিকট চিৎকার করল কেন লোকটা? আর্তনাদ তত ক্ষণে গোঙানিতে পাল্টে গেছে, আর তার সঙ্গে যোগ হয়েছে একটা রক্ত হিম করা গরগরানি। তার পরেই ধুপধাপ পালানোর শব্দ।

যেমন ঝপ করে আলো চলে গিয়েছিল, তেমনি দপ করেই আবার জ্বলে উঠল। হঠাৎ আলোর ঝলকানিতে দীপাঞ্জনের ধাঁধিয়ে যাওয়া চোখে যে দৃশ্যটা পড়ল সেটা প্রায় অবিশ্বাস্য!

রাস্তায় চিত হয়ে পড়ে একটা লম্বা রোগাটে ছেলে, আর তার বুকের ওপর সামনের দু’পা রেখে হুমড়ি খেয়ে আছে একটা কালো সাদা ছোপছোপ মাদি কুকুর— যার গলা থেকে বেরোচ্ছে একটা হিংস্র গরগর আওয়াজ, আর যার দাঁতগুলো গভীর ভাবে চেপে বসেছে ছেলেটার কাঁধে! ছেলেটা কাতরাচ্ছে, কিন্তু সে ভাবে নড়াচড়া করতে পারছে না, কারণ তার সারা শরীরে সমানে আঁচড়ে-কামড়ে চলেছে একটু ছোট সাইজ়ের আরও ছ’জন। সাইজ়ে ছোট, বিক্রমে নয়।

আর ও দিকে নিশুতি পাড়া জাগিয়ে উল্টো দিক থেকে ধেয়ে আসছে সায়ন্তনীর স্কুটি। পিছনের সিটে বসে প্রবল হুঙ্কাররত এক্স-মিলিটারিকাকু!

আজকাল দীপাঞ্জন রাস্তা দিয়ে হেঁটে গেলে পাড়ার কুকুরেরা আর ফুটপাত পাল্টায় না। ছ’টা ছানা আর একটা কালো সাদা ছোপ-ছোপ মা-কুকুর আজকাল সারা দিন দীপাঞ্জনদের বাড়ির সামনের রাস্তাতেই খায়দায়, খেলে, ঘুমোয়।

ও হ্যাঁ, সায়ন্তনীর স্কুটির পিছনের সিটে আজকাল প্রায়ই দীপাঞ্জনকে দেখা যায়… তবে সে অন্য গল্প।