বহু দিন পর আবার সন্ময়কে দেখে মনের মধ্যে একটুও ভাল লাগা জন্মাল না। বরং একটা বিরক্তি দানা বাঁধতে শুরু করল। পুরনো প্রেমিককে দেখলে, মনে একটা পুলক জাগে কারও কারও। আমার জাগল না কারণ সন্ময় অসম্ভব জ্বালিয়েছিল আমায় অনেক দিন ধরে। তাই ওকে দেখেই মনে হল, ও আজও বডি-স্প্রে না ছড়িয়েই ঘেমো শার্ট পরে চলে এসেছে আর সেই দুর্গন্ধ গোটা হোটেলে ছড়িয়ে পড়বে।
আমার মনের ভিতর কী চলছে তা জানা সন্ময়ের পক্ষে সম্ভব নয় বলেই হয়তো ও আমার সামনে এসে জিজ্ঞেস করল, ‘‘ভাল তো?’’
ওর দিকে তাকিয়ে আখরোটের থেকেও শুকনো একটা হাসি হাসলাম। কোনও কথা বললাম না।
সন্ময় আধ মিনিট মতো দাঁড়িয়ে সরে গেল সামনে থেকে।
এখানে আমাকে খেটে খেতে হয়। দশ থেকে এগারো ঘণ্টা থাকতে হয়। তার বিনিময়ে উনিশ হাজার টাকা মাইনে পাই। পারফরম্যান্সের উপর ভিত্তি করে মাঝেসাঝে কিছু ইনসেনটিভও মেলে। রিসেপশনে কাজ বলে টিপস পাওয়ার সুযোগ নেই, যারা দিতে চায় তাদের ধান্দা খারাপ থাকে। সাবধানে কেবল নিজেকে বাঁচাবার জন্যই থাকতে হয় না, পান থেকে চুন খসলেই চাকরি চলে যাবে, সেটাও মাথায় রাখতে হয়। কিন্তু মাথায় যেটা ঢুকছে না, সেটা হল, এই ফোর-স্টার হোটেলে সন্ময়ের হঠাৎ আগমনের উদ্দেশ্যটা কী? কে নিয়ে এল ওকে এখানে? ওই রংচটা জিন্স আর ফেডেড শার্ট পরে দ্রুত উঠে যেতে থাকা চুলে হাত বুলিয়ে সামনের লোক দুটোকে কী বোঝাচ্ছে ও, এই সকালবেলা?
রিসেপশন থেকে কয়েক পা এগিয়ে একটু ডান দিকে ঘুরলেই যে লাউঞ্জটা সেখানে গিয়ে বসল সন্ময় আর আমি আমার পাশে দাঁড়ানো বিনীত সাক্সেনাকে চোখের ইশারায় জিজ্ঞেস করলাম, সন্ময় আর ওর সামনের লোকগুলোর বিষয়ে।
বিনীত অবাঙালি হলেও কলকাতায় বর্ন অ্যান্ড ব্রট আপ। স্মার্ট এবং চৌকস বলে আশপাশের সমস্ত বিষয়টাই ভাল বোঝে। ইশারার উত্তরে আমাকে বলল, তুমি জানো না? এরা দুর্গাপুজোর জাজ হয়েছে। ধ্রুবতারা টিভি চ্যানেলের। ঠাকুর দেখতে বেরোবার আগে কমপ্লিমেন্টারি ডিনার পেয়েছে। ফিরে আসার পর কমপ্লিমেন্টারি ব্রেকফাস্টের ব্যবস্থা আছে। তবে, শুধু খাওয়া। নো ড্রিঙ্কস।
আমি ঘাড় নেড়ে সামনের ফাইলের দিকে তাকালাম। চোখের সামনে ভেসে উঠল, তিনটে শব্দ, “সন্ময় জাজ হয়েছে”। প্রতিমা, প্যান্ডাল, আলোকসজ্জার বিচার করে নম্বর দেবে সন্ময়? যে লোকটা একটা মেয়েকে সংসারের ভিতর রাখতে হয় কী ভাবে তাই জানে না, সে ঠাকুর কী ভাবে আটচালার ভিতর থাকে, বুঝবে? যে সময়টা ওকে ভালবাসতাম, জীবনের প্রত্যেকটা স্বপ্ন ওকে কেন্দ্র করে গড়ে তুলতে চাইছিলাম, সেই সময়টা এত উত্ত্যক্ত করল আমাকে যে ছেড়ে আসতে বাধ্য হলাম। উফ, ভাগ্যিস রেজিস্ট্রি করিনি লোকটার সঙ্গে!
শ্রীতমার জন্মদিনের পার্টিতে সন্ময়ের সঙ্গে পরিচয়। তখন ওর আবৃত্তি, ওর ওই মুহুর্মুহু যে কোনও হিন্দি গানের বাংলা প্যারোডি করে গেয়ে দিতে পারার ক্ষমতা, আমায় চুম্বকের মতো টেনেছিল। ফেসবুক তখনও এতটা কাছের হয়ে ওঠেনি লোকজনের। হলে হয়তো ওর আসল চেহারাটা চেনা আর একটু সুবিধে হতো। নাট্যসমালোচকের জোব্বাটা গায়ে চাপিয়ে ও যে আসলে একে-তাকে ধরে প্রায় যেচেই রিভিউ করে আর মিষ্টি-মিষ্টি কথা লেখার দাম হিসেবে মদ-মাংস খেয়ে বেড়ায়, সেই রক্তচোষা বৃত্তিটা অজানা ছিল আমার। কিন্তু সেটা জানার পরও কি ওকে ছেড়ে আসতাম আমি? না হয়তো, যদি না আমার, রক্ত-মাংস-মজ্জা এমনকি আত্মা পর্যন্ত শুষে নিঃস্ব করে দেওয়ার খেলায় না নামত ও। নোংরা লোক একটা। নইলে নিজের বাগদত্তাকে একটা লাল-চোখো কর্পোরেট বসের ঘরে বসিয়ে কেটে পড়তে পারে কেউ? আসলে সন্ময় কোনও প্রেম চাইছিল না। সন্ময় একটা কাঁধ চাইছিল, যার উপরে জীবন নামের বন্দুকটা রাখা যায়। একটা প্লাটফর্ম চাইছিল যেখানে ছুটে ট্রেন ধরতে হয় না, শুয়ে থাকলে ট্রেন আপনিই এসে তুলে নেয় ভিতরে। এক কথায় আরাম চাইছিল নিজের প্রেম ভাঙিয়ে। আমি সেটা ওকে দিতে চাইনি। দিতে গেলে রং মেখে রাস্তায় দাঁড়াতে যে মেয়েটা বাধ্য, তার সঙ্গে আমার কোনও তফাত থাকত না।
কেন সেই জায়গায় নিজেকে নামাব আমি? কার জন্য নামাব? যে লোকটা আমি মাসতুতো দিদির বিয়েতে সাত দিনের জন্য দিল্লি গেলে, হালকা একটা প্রেম করে নেয় ডাক্তার রাজন্যা দাসের সঙ্গে? রাজন্যার সঙ্গে প্রেমটা হয়ে গেলে, আমাকে লেঙ্গি মেরে সারা জীবন ডাক্তারের ফি-এর পয়সায় খাওয়ার চেষ্টা করত ও। পারেনি বলে আবার ফিরে এসেছিল আমার কাছে। আন্দাজ করতে পারেনি যে রাজন্যার এক বন্ধু মারফত আমি খবরটা পেয়ে যাব। তার পরেও ক্ষমা করে দিয়েছিলাম। কিন্তু রিলিনার সঙ্গে গলা জড়াজড়ি করে মাল্টিপ্লেক্স থেকে বেরচ্ছে, এটা দেখার পর আর থাকতে পারিনি সম্পর্কটায়। রিলিনা নাকি ওর কাজ পাওয়ার ব্যবস্থা করে দিচ্ছিল। যে ছেলেকে কাজ পাওয়ার জন্য মেয়েদের গলা জড়িয়ে জিভের লালা ফেলতে হয়, তার সঙ্গে কোন মেয়ে থাকতে চাইবে?
কিন্তু এই লোকগুলো এঁটুলি পোকার মতো; কিছুতেই ছাড়ানো যায় না গা থেকে। কেঁদেকেটে, মরে যাওয়ার ভয় দেখিয়ে সঙ্গে লেগে থাকতে চায়। এক বার জড়িয়ে গেলে ছেড়ে বেরিয়ে আসাটা দুঃসাধ্য হয়ে যায়। আমারও হয়েছিল। ছোটকাকু পুলিশে চাকরি করত, রামধাতানি দিয়ে ফোন করেছিল সন্ময়কে, নয়তো আমাকেও ছাড়ত কি না সন্দেহ। লোভীর পাশাপাশি ভিতুও হয় বলে, সেই ফোন পাওয়ার পর থেকে আর আমাকে বিরক্ত করেনি শয়তানটা। মাঝেমাঝে একে-ওকে দিয়ে খবর পাঠাত, ওর জীবন কত ভাল চলছে, কত ফ্যান ওর। তা, তাদেরই একটায় ঝুলে পড়তে পারলি না?
না, আমার জীবনও যে খুব মসৃণ হয়েছে, তা নয়। বাড়ি থেকেই সম্বন্ধ করে যেখানে বিয়ে হয়েছিল, তারা আরও বড় হাঙর। প্রতিনিয়ত টাকা দাবি করত আর না পেলেই অত্যাচার শুরু হত। ওখানে থাকলে আত্মহত্যা করতে বাধ্য হতাম বা পাগল হয়ে যেতাম। আমি দুটোর কিছু না করেই বেরিয়ে এসেছি। বেশ খানিকটা লড়াইয়ের পরে ডিভোর্স পেয়েছি। তিতিবিরক্ত হয়ে গেছি সম্পর্ক কিংবা ভালবাসায়। এখন নিজের জীবনটা একটু শান্তিতে বাঁচতে চাই। একটা খুব ছোট্ট বন্ধুদের গ্রুপ আছে, তাদের সঙ্গে নতুন সিনেমা দেখতে কিংবা রেস্তরাঁয় খেতে যাই সপ্তাহের একটা ছুটির দিনে। অন্য দিনগুলো বিছানায় পড়ার পর আর হুঁশ থাকে না।
দাদা চাকরিসূত্রে দিল্লিতে, বাবা নেই গত চার বছর। মা মারা গেলে কে আমাকে দেখবে? এই প্রশ্ন প্রায় দিনই তোলে মা, কিন্তু আমি জবাব না দিয়ে চুপ করে যাই। দুনিয়ায় কে-ই বা কাকে দেখে? আমি একা বাঁচতে চাই। নিজেকে ভালবাসার নেশায় নিজে ডুবতে চাই। অন্যকে ভালবাসতে গেলেই ঝঞ্ঝাট। কী দরকার যেচে সেই ঝঞ্ঝাট জীবনে নিয়ে?
লাউঞ্জে বসেও খানাপিনা করা যায় এই হোটেলে। এক ধারে সেই ব্যবস্থা আছে। জরুরি কয়েকটা টেলিফোন সেরে ওই দিকে চোখ পড়তেই দেখলাম, সন্ময় আয়েশ করে গ্লাসে চুমুক দিচ্ছে।
বিনীত তীক্ষ্ণ চোখে খানিক ক্ষণ ওই দিকে তাকিয়ে বলল, ‘‘হি ইজ় ড্রিঙ্কিং শ্যাম্পেন।’’
‘‘কিন্তু তুমি যে বললে, শুধু খাওয়ার বন্দোবস্ত করা হয়েছে বিচারকদের জন্য?’’
‘‘সে রকমই তো শুনেছিলাম। অবশ্য হতে পারে কেউ স্পনসর করেছে ড্রিঙ্কটা। কিংবা, লোকটা নিজের পয়সায় খাচ্ছে হয়তো। কিন্তু সকালবেলা শ্যাম্পেন!’’
‘‘কী রকম দাম হবে, এক বোতলের? বারো-চোদ্দোর কম না নিশ্চয়ই?’’
‘‘মিনিমাম কুড়ি-বাইশ।’’
আমি বিষম খেলাম প্রথমে। তার পর হেসে ফেললাম। খালাসিটোলায় নিজের পয়সায় আশি টাকার বাংলা খেয়েছিল বলে পুরো একটা সন্ধে গজগজ করেছিল সন্ময়। সে কি না অর্ডার করবে, বাইশ হাজার টাকার শ্যাম্পেন! নির্ঘাত সঙ্গের লোকগুলোর কোনও একটাকে মুরগি করেছে।
‘‘ব্যাপারটা কী রকম গোলমেলে ঠেকছে,’’ বিনীত জিভ দিয়ে একটা আওয়াজ করল।
আমি কিছু বললাম না উত্তরে। সন্ময় কিংবা ওর কোনও গোলমালে থাকার এতটুকু ইচ্ছে আমার নেই। ও দিকে আবার ব্যাক-অফিস থেকে ডাক এসেছে। রিসেপশনের পাঠানো কোন ডেটায় কী একটা প্রবলেম আছে। বিনীতকে পুরোটা দেখতে বলে আমি ডেস্ক থেকে বেরিয়ে লিফটের দিকে এগিয়ে গেলাম। যেতে যেতে আড়চোখে দেখলাম, সন্ময় পৃথিবীর শেষ শাহেনশাহর মতো এ দিক-ও দিক তাকাচ্ছে।
ফিরে যখন আসব তখন যেন আর ওর মুখটা দেখতে না হয়। শয়তানটা যেন বিদেয় হয়ে যায় তত ক্ষণে।
আমি অনেক দিন বাদে প্রার্থনা করলাম।
******
চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ মিনিট লেগে গেল ফিরতে। রিসেপশনে আমার নির্দিষ্ট জায়গায় যাওয়ার আগেই টের পেলাম যে একটা ঝামেলা শুরু হয়ে গেছে লাউঞ্জে। বিনীত ঠিকই বলেছিল। সন্ময়দের শুধু ডিনার আর ব্রেকফাস্টই কমপ্লিমেন্টারি ছিল।
কিন্তু হতভাগা শ্যাম্পেন খেয়ে বসে আছে এক বোতল। এ বার তার দাম মেটাবে কে?
ফুড অ্যান্ড বেভারেজেস-এর ময়ূখ উত্তেজিত গলায় বলছিল, ‘‘পয়সা যখন নেই তখন অর্ডার করেছিলেন কেন? চেহারা দেখে তো ভদ্রলোক বলেই মনে হয়।’’
‘‘মাইন্ড ইয়োর ল্যাংগোয়েজ। আপনি এক জন সেলেব্রিটিকে এই ভাবে...’’
ময়ূখ, সন্ময়ের কথার ভিতরেই হেসে উঠল, ‘‘ফুটুন তো মশাই। আপনার মতো সেলেব্রিটি অনেক দেখেছি। এখন টাকাটা মানে-মানে দিয়ে, কেটে পড়ুন।’’
‘‘আমি টাকা কোত্থেকে পাব? আমাকে যারা নিয়ে এসেছে এখানে, তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করুন। আর নইলে ভাবুন যে আমায় ট্রিট দিয়েছেন,’’ সন্ময় একটা ব্যঙ্গের
হাসি হাসল।
হাসিটা ফুরোবার আগেই ময়ূখ এগিয়ে গিয়ে ওর কলারটা ধরে জোরে ঝাঁকুনি দিল দু-তিন বার। তার পরে বলল, ‘‘এক্ষুনি পুলিশ ডেকে হাজতে ভরে দেব। পিছনে যখন পুলিশের রড ঢুকবে তখন বুঝতে পারবি, ‘ট্রিট’ কাকে বলে।’’
ঝাঁকুনিটা খেয়ে সন্ময়ের চোখে সামান্য ভয় খেলে গেল ঠিকই, কিন্তু সর্বনাশ যা হওয়ার আমার হল। আমি ডেস্কে না ফিরে গন্ডগোলের কেন্দ্রে চলে এলাম। চাপা গলায় বললাম, ‘‘ময়ূখ, এ ভাবে রিঅ্যাক্ট কোরো না। মিডিয়া কভার করলে মুশকিলে পড়ে যাব আমরা।’’
ময়ূখ আমার দিকে তাকিয়ে হতাশা আর বিরক্তি মেশানো একটা গলায় বলে উঠল, ‘‘আর কী ভাবে রিঅ্যাক্ট করব বলো তো?
দেড়-দু’হাজার হলে ম্যানেজ করা যায়, ছাব্বিশ হাজার সাতশো টাকা বিল হয়েছে শ্যাম্পেনের। এ রকম অবিবেচকের মতো কাজ করে কেউ?’’
ময়ূখের কথাটা শেষ হওয়ার আগেই আমার পায়ের উপর প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ল সন্ময়, ‘‘বাঁচাও, প্লিজ় বাঁচাও আমাকে। তুমি জানো তো আমি ইতালির ফ্যান, সেই বাজ্জিও পেনাল্টি মিস করার রাত থেকে। কাল ইতালির আঙুরবাগানের আদলে একটা পুজো-প্যান্ডাল করেছিল, সেটার কথা ভাবতে ভাবতে ভুল করে অর্ডার দিয়ে ফেলেছি। অর্গানাইজ়াররা দেবে না জানলে কখনও দিতাম না।’’
গায়ে আরশোলা পড়লে যত দ্রুত ঝেড়ে ফেলে মেয়েরা, তার চেয়েও জলদি আমি সরে আসার চেষ্টা করলাম সন্ময়ের কাছ থেকে। কিন্তু ও আমার পায়ের দুটো আঙুল ধরে রেখেছিল নিজের হাত দিয়ে।
‘‘কী হচ্ছেটা কী? ছাড়ো!’’ আমি চেঁচিয়ে উঠলাম।
‘‘তুমি চেনো নাকি লোকটাকে?’’ খানিকটা অবাক হয়ে ময়ূখ জিজ্ঞেস করল আমাকে।
‘‘দাদার বন্ধু ছিল এক সময়। সেই সূত্রেই...’’ আমি শেষ করলাম না কথাটা।
সন্ময় যদি কথাটাকে নস্যাৎ করে আমার পক্ষে ক্ষতিকারক কিছু বলত, আমি ওকে যাচ্ছেতাই কিছু একটা বলে, সরে আসতাম। কিন্তু ও প্রায় একটা গাধার মতো জলে-ভরা চোখে তাকিয়ে রইল আমার দিকে। কোনও সম্মান বা স্বীকৃতি চাইছিল না ওর দৃষ্টি, বাঁচতে চাইছিল কেবল।
সেই অসহায়তার সামনেই গলে গেলাম আমি। যে দিন ওর সঙ্গে সব সম্পর্ক ছিন্ন করে চলে আসছিলাম, সে দিন রাস্তায় দাঁড়িয়ে কাঁদছিল সন্ময়। আমি সেই কান্নাটাকে অভিনয় বলে অগ্রাহ্য করতে পেরেছিলাম কারণ ও তো রাস্তায় দাঁড়িয়ে ছিল। আজ সরে গেলে, লক-আপে গিয়ে থাকতে হবে ওকে। খুব খারাপ লোক সন্ময়, কিন্তু ওর ওই অসহায়তা কেন যে আমার ভিতরে একটা তোলপাড়ের জন্ম দিল, জানি না আমি।
নিজের প্রতি মানুষের যে স্বাভাবিক ভালবাসা সেটা হারিয়ে ফেলার নামই বোধহয় প্রেম। আমি কি আবার প্রেমে পড়ছিলাম, ওই মিথ্যেবাদী, ফুটানিবাজ, স্কাউন্ড্রেলটার? অসম্ভব। ওকে ঘিরে সব স্বপ্ন মরে গিয়েছিল আমার। কিন্তু কেনই বা তবে “এক্ষুনি পুলিশ ডেকো না প্লিজ়” বলতে গেলাম ময়ূখকে? কেন, এই হোটেলে আমার মুশকিল-আসান রাজুর কাছে গিয়ে, একটা উপকার করে দেওয়ার আর্জি জানালাম?
আমার চোখে জল দেখে রাজু অবাক, ‘‘কী হয়েছে দিদি?’’
ডিভোর্সের পর অন্বয়কে আর সব ফিরিয়ে দিলেও গলার এই চেনটা শুধু দিইনি। এমন ভাবে শরীরের অংশ হয়ে উঠেছিল চেনটা যে মনেই হয়নি ফেরত দেওয়ার কথা। অন্বয়ও চায়নি। হয়তো বুঝতে পেরেছিল যে সব কিছুর থেকে সবাইকে আলাদা করা যায় না। কিংবা কে জানে, প্রথম বিবাহবার্ষিকীতে উপহার দেওয়া হারটা চক্ষুলজ্জার খাতিরেই ফেরত চাইতে পারেনি হয়তো। আজ চাকরির সব নিয়মকানুন ভুলে, আমাকে
নিয়ে গসিপ হওয়ার সমস্ত সম্ভাবনা ভুলে, সেই চেনটাই একটানে গলা থেকে খুলে রাজুর হাতে ধরিয়ে দিলাম। সঙ্গে নিজের ব্যাগে থাকা প্যান কার্ডটাও। এটিএম কার্ডও দিতাম, কিন্তু আমার অ্যাকাউন্টে কুড়িয়ে-বাড়িয়ে সতেরো-আঠেরো হাজার পড়ে আছে। লাভ কী হত?
******
অতটা লোকসান কেন করলাম নিজের, বলতে পারব না। কিংবা কে জানে, আদৌ লোকসান করলাম কি না? ‘‘মেট্রোর সিঁড়ি বেয়ে উঠে আসার সময় একটা হ্যাঁচকা টান লাগল মনে হল, কিন্তু হারটা যে গচ্চা গেছে, টের পেলাম বাড়ির সামনে রিকশা থেকে নেমে।’’ মাকে বললাম রাতে খেতে খেতে।
মা যতটা উত্তেজিত হবে ভেবেছিলাম, তার এক ফোঁটাও হল না। শান্ত গলায় বলল, ‘‘সোনা হারানো খারাপ, কিন্তু পচা বিয়ের পচা চিহ্ন খোয়া গেছে সে এক রকম ভালই হল।’’
ঘুম আসছিল না কিছুতেই। খালি মনে পড়ছিল, আধ ঘণ্টার ভিতর রাজুর ওই বত্রিশ হাজার টাকা আমাকে এনে দেওয়া আর তার ভিতর কড়কড়ে সাতাশ হাজার টাকা কাউন্টারে গিয়ে জমা দেওয়ার দৃশ্যটা। এত দিন ওখানে দাঁড়িয়ে টাকা জমাই নিয়েছি শুধু, এই প্রথম টাকা জমা দেওয়ার সময় কেমন একটা শিরশিরানি হচ্ছিল।
‘‘কার জন্য করছ এত কিছু? লোকটা আসলে কে?’’ বিনীত খুব আলতো করে জিজ্ঞেস করেছিল মাথা না তুলে। জবাব দিতে পারিনি। আসলে, কে যে কী, আমিই কি ছাই জানি? বেরিয়ে যাওয়ার আগে, সন্ময় এক মুহূর্ত থেমে গেল আমার সামনে এসে।
‘‘আর যেন জীবনে কখনও এই হোটেলের ত্রিসীমানায় না দেখি,’’ দাঁতে দাঁত চেপে বললাম আমি।
সন্ময় যেন কথাটা শুনতেই পায়নি এমন ভাবে বলল, ‘‘তোমার এই ধার শুধু এ জীবনে কেন, কোনও জীবনেই ফিরিয়ে দেওয়ার স্পর্ধা আমার হবে না। মানুষ সমুদ্র নয়, সে সব কিছু ফিরিয়ে দিতে পারে না।’’
******
ওই কথাটাই মাথার এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে চরকির মতো ঘুরতে থাকল রাতে। ঘুরতে ঘুরতে হালকা একটা ধুনকি জাগিয়ে তুলল আমার মধ্যে। পচা বিয়ে, পচা হার, পচা আমি, পচা সন্ময়। পচা ভালবাসা, পচা স্মৃতি, পচা দুনিয়া, পচা এই জীবন। আর যা পচা, তার ভিতরেই তো নেশা জন্মায়।