Abosar

চৈত্র

জয়শীলা গুহ বাগচী

কোথায় গেল? কোথায় গেল পুজোর কাঠ? এক কোমর কাদাজলে পাগলের মতো খুঁজে চলেছে সে। দু’হাত ডুবিয়ে দিল কাদায়... কিছু উঠেছে, এই তো কিছু একটা! কাদা-মাখা দু’হাতে উঠে এসেছে মাছ। বিরক্তিতে ছুড়ে ফেলল নড়তে থাকা মাছের শরীর, আবার ঠিক ওইখানে দু’হাত দিয়ে কাদা ঘাঁটতে লাগল সে, কই? নেই তো!  এইখানেই তো দেখা দেবে সেই কাঠ, প্রতি বার যেমন হয়। বার বার হাতে উঠে আসছে মাছ। ছি-ছি! এই মাসটা সে স্বপাক হবিষ্যি খায়। আমিষ স্পর্শ করে না। বিভোর হয়ে থাকে আদিনাথ শিবের ধ্যানে। সেই তাকে এ কী পরীক্ষায় ফেললেন ঠাকুর! কাঠ না পেলে পুজো বন্ধ। হায় হায়! পাঁচ পুরুষের পুজো... কী হবে এ বার? কাদার ভিতর মাথা ডুবিয়ে দেয় সে, যদি দেখা যায় ঠাকুরকে। হঠাৎ তার পা ডুবতে থাকে, কোমর, বুক, মাথা গেঁথে যেতে থাকে কাদায়, কিছু ধরার না পেয়ে কাদা আঁকড়ে ধরে, আর ডুবতে থাকে, শেষ নিঃশ্বাসও নেওয়া হয় না তার। নীচের দিকে তীব্র টানে তলিয়ে যাওয়ার আগে অসহ্য গোঙানিতে ধড়মড়িয়ে মেঝেয় পাতা বিছানায় উঠে বসে শ্যামল। 

সারা গা ঘামে ভিজে গিয়েছে তার। এ কী স্বপ্ন দেখল সে! কাল সত্যিই চড়কের কাঠ তুলতে হবে পুকুর থেকে। প্রতি বার যেমন তোলে। কাদা ঠেলে, জল ঠেলে বিশেষ দিনে বাবার কাঠ নিজেই দৃশ্যমান হয়। ঢাক বাজে একনাগাড়ে, শুদ্ধ চিত্তে সন্ন্যাসীদের নিয়ে চড়কের কাঠ মাথায় করে বয়ে আনে তারা। স্নান করিয়ে, তেল সিঁদুরে চর্চিত কাঠের পুজো শুরু হয়। 

শ্যামল উঠে বসে জল খায়। পাশের ঘর থেকে ছেলে উঠে এসেছে। সামনের বছর তার উচ্চ মাধ্যমিক। মা-হারা ছেলেটিই তার বুকের পাঁজর, শ্বাস-প্রশ্বাস। কলমিলতার মতো বেড়ে উঠেছে হঠাৎ করে। শ্যামল দেখে আর অবাক হয়। ভাবে, এ যেন তারই এক নতুন জীবন, সে আর ছেলে আলাদা নয়। কিন্তু বার বার ধাক্কা খায় এই ভাবনায়। ছেলেকে মাঝে-মাঝে কেমন অন্য রকম ঠেকে। যেন অন্য মানুষ। কিন্তু তা তো হওয়া উচিত নয়। প্রাণপণ নিজের বেঁচে থাকার অলিগলিতে টেনে আনতে চায় তাকে, পাঁচ পুরুষের পাঁচ রকম গল্প শোনায়। আদিনাথের কথা বলে, অলৌকিক রাতের গল্প করে। তবু যেন কেমনধারা অন্য রকম ভাব ছেলের চোখে-মুখে। তন্ত্র-মন্ত্রের কত জোর, সে কি জানে না? চড়কের প্রত্যেকটি খেলায় সে সফল হয় কী করে, মন্ত্রের জোরেই না! বৈজুনাথ কেমন এড়িয়ে যায়। এত মন্ত্রচর্চা করে বলেই তো এমন সুন্দর ছেলে তার! গর্বে বুক ভরে ওঠে তার। 

শিবের আর-এক নাম বৈজুনাথ। লেখাপড়ায় ভাল বলে ইশকুলে স্যর-ম্যাডামরা ওকে বাড়িতে ডেকে নানা বই পড়তে দেন। বসে-বসে হাঁপাতে থাকে শ্যামল। বৈজু বাবার গা ঘেঁষে বসে। উদ্বিগ্ন স্বরে জানতে চায় শরীরের কথা। শ্যামল আকুল হয়ে দু’টো হাত জড়িয়ে ধরে ছেলের। 

ভোররাতেই উঠে পড়ে সে। একে-একে মন্দিরে আসতে শুরু করেছে ব্রতপালনরত ছেলেরা। পুকুর থেকে তুলতে হবে বাবার কাঠ। ভোরের হাওয়া সামান্য শিরশিরে। ঢাক বেজে ওঠে। এই সময়টা প্রতি বার খুব ভাল লাগে শ্যামলের। ঢাকের বাজনার সঙ্গে-সঙ্গে ওরা হাঁটে। গ্রামের ছেলেরা গাজনের গান গায়। ঘুম ভেঙে যায় গ্রামের ছেলে-বুড়ো সবার। যখন কাঠ নিয়ে ঘোরে গোটা গ্রাম, নিজেকে আর তুচ্ছ মনে হয় না শ্যামলের। তাকে ঘিরে কত মানুষ! এই ক’টা দিন সে-ই গ্রামের মধ্যমণি। পঞ্চায়েত পর্যন্ত তার সঙ্গে দেখা করে যায়। এ কি কম কথা! আজ ছেলেরা শিব-পার্বতীর বিয়ের গান গাইছিল। কিন্তু কোনও কিছুতেই যেন মন দিতে পারছে না শ্যামল। কেন এমন স্বপ্ন দেখাল বাবা? সে তো কোনও অনাচার করেনি! অনাচার হতেও দেয় না! হবিষ্যি রাঁধে, সে আর ছেলে খায়। এই এক মাস এ ভাবেই চলে। ছেলেটার তো খাওয়ার কোনও বাধা নেই, তবু সে নিয়ম মানে। শ্যামল জানে, এ সব সে অন্তর থেকে করে না। কিছুতেই ছেলেকে বশে আনতে পারে না সে।  ভিতরটা জ্বালা করে। 

পুকুরে পৌঁছে বুকটা দুরুদুরু করে। একই ভাবে কাদায় পা রাখে। জল বেশি নেই। রুক্ষ পা ডুবে যায় জল কাদায়। দু’হাত জোড় করে প্রণাম করে মহাদেবকে। একনাগাড়ে ঢাক বাজে, ছেলেরা ধ্বনি দেয়, গানে গলা মেলায়। জল কাদা হাতড়ে চলে সে। মনে হয়, সেই স্বপ্ন যেন দ্বিতীয় বার দেখছে সে। তবু হাল ছাড়ে না। খুঁজে যায় একমনে। নিজের বিশ্বাসের জায়গা এতটুকু টলেনি তার। আশঙ্কাটুকুই ছিল, তার বেশি কিছু নয়। কিছু ক্ষণের মধ্যেই আরও জোরে বেজে উঠল ঢাক, উলুধ্বনিতে কেঁপে উঠল নরম সকাল। প্রতি বারের মতো বিজয়ীর ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়াল সে। দু’হাতে ধরা চড়কের কাঠ। ছেলেকে কত বার গল্প করেছে শ্যামল, আগে তো পুকুরে ডোবাত না সে, নদীতে রাখত। নদীর স্রোতে কোথায় ভেসে যেত সেই কাঠ, হাজার ছেলে দিয়ে খোঁজালেও তা মিলবে না। যখন সময় আসবে, মন্ত্রে নেমন্তন্ন করবে আদিনাথকে, কাঠ তখন অমনিই দেখা দেবে। ছেলে কেমন চোখে দেখে বাবাকে। মুখে কিছু বলে না। ওই দেখাটাই পছন্দ হয় না শ্যামলের। তারই রক্তমাংস, তারই গড়ে তোলা পুতুল কী ভাবে অস্বীকার করে তাকে? শ্যামল বোঝে না। তার রাগ হয়, কষ্ট হয়। গ্রামের কত ছেলে-ছোকরা তার চেলা হতে চায়! হত্যে দিয়ে 

পড়ে থাকে!

ছেলেরা জলে নামে। স্নান করায় বাবার কাঠ। তেল, সিঁদুর মাখায়। নিজেরা উল্লাসে ডুব দেয় জলে, শ্যামল নিয়মের কথা বলে যায়। কাঠ নিয়ে গোটা গ্রাম ঘোরে ওরা। পাকা রাস্তা ছেড়ে কাঁচা রাস্তায় নামে মিছিল। একুশ বাড়ি মাধুকরীর পর পুজো শুরু। এই ভিক্ষে পুজোর নিয়মের মধ্যেই পড়ে। বাণগড়ের রাজা পর্যন্ত ভিক্ষে করে পুজো করেছেন। পুত্রার্থে পুজো করেছিলেন তিনি। সেই তো চড়কের শুরু বলে জানে সে। বৈজু রাগ করে, বলে, ‘‘কেন ভিক্ষে?’’ একুশ বাড়ির তেল সিঁদুর না পেলে যে পুজো হয় না, স্বয়ং মহাদেব বলেছেন! বাবার কথা না মানলে ভয়ানক অনিষ্ট। এই যে চারটে খুলি লাগে পুজোয়, কিছু লোক শত্রুতা করে পুলিশে খবর দিয়েছিল, কিছু করতে পেরেছে? সে তো অন্যায় করেনি। পুজো করে মাত্র। যা করে সব বাবার ইচ্ছেয়। পুলিশ কী করতে পেরেছে?

একুশ বাড়ি ঘুরতে-ঘুরতে বেলা গড়িয়ে গেল। ওরা এল চড়কের মাঠে। নির্দিষ্ট জায়গায় মাটি খুঁড়ে বসানো হল কাঠ। রতনের উৎসাহ বেশি। সব কিছুতেই সামনে এগিয়ে যায়। এ বার পুজোয় ও-ই দেখাবে সব চেয়ে আকর্ষণীয় খেলাটি। 

সদাচঞ্চল ছেলেটিকে ভালই লাগে শ্যামলের। বেশি ভাবার অবসর নেই ওর। মাটি খুঁড়তে ব্যস্ত রতনের চকচকে পিঠটা দেখে সে। ব্রতপালনে আছে রতন। কত বড় পুণ্য হবে ওর! চড়ক গাছ পুঁতে দেওয়ার পর শুরু হল পুজো। মহাদেবের পুজো মানে শ্যামলের কাছে শুধু ভক্তি নয়, আনন্দের ঘটনা। এমন তো নয় যে, সব বৈদিক মন্ত্র তার জানা। সে তো শুধু নামটুকু লিখতে পারে। বাবার কাছে যেটুকু শেখা সেটুকুই। কিন্তু অন্তরের কাছে মন্তর কিছুই না, সে জানে। তবে তন্ত্রচর্চা শুরু করেছে। এ জন্য গুরুও ধরতে হয়েছে।

শিবপুজো অল্প সময়ে হয় না। মাঝে-মাঝে ভিতরটা চিনচিন করে তার। ওই এক ছেলে, বাবা পুজোয় বসলে ছেলেও কিছু মুখে তোলে না। কিন্তু নিজের জগতে ডুবে থাকে। সহ্য হয় না শ্যামলের, কেন সে ছেলের নাগাল পায় না! বাড়িতে ফিরে ভাত ফোটায় সে। 

রাতে ছেলেদের নিয়ে শ্মশানে যায় শ্যামল। শ্মশানে পুজো না করলে সম্পূর্ণ হয় না বাবার আরাধনা। শিব, পার্বতী সেজেছে যে দু’টো ছেলে, তারা বসে-বসে বিড়ি টানছিল, গল্প করছিল। ঢাক বাজছে। পুজো শেষ করেই ওদের দিকে মন্ত্রপড়া জল ছুড়ে দিল সে। হাতে ধরিয়ে দিল দা আর ত্রিশূল। ওদের ঘিরে ভিড়টা একটু সরে গেল যেন। অদ্ভুত এক পরিবর্তন ওদের ভিতরে! চিৎকার করতে-করতে বেরিয়ে গেল নদীর দিকে। ওদের পিছনে ছুটল কিছু ছেলে-ছোকরার দল। একটু আত্মপ্রসাদের হাসি খেলে গেল শ্যামলের মুখে। ওদের আর দেখা যাবে না। সময় হলে ওরা নিজেরাই এখানে ফিরে আসবে। চাঁদ ডোবার আগেই। শ্যামল বারান্দায় বসে অল্প বিশ্রাম নেয়, বাকি ছেলেরা গল্পগুজবে ব্যস্ত। 

সে তাকিয়ে থাকে আবছা অন্ধকারে। নদীর দিকটা ঝাপসা। আস্তে-আস্তে অন্ধকারের দিকে হাঁটে সে। সামনে অমাবস্যা। ক্ষীণ চাঁদ। সে ঘাটের কাছে এসে বসে। চুপ করে তাকিয়ে থাকে নদীর দিকে। আস্তে-আস্তে স্পষ্ট হয়ে কানে বাজে কত কথা। কত মানুষ কথা বলছে। কানের পাশে দু’-একটা শব্দ আলতো ছুঁয়ে চলে গেল দূরে। শিরশির করে শ্যামলের গা। ছেলেদু’টো ফেরেনি এখনও। শ্যামল কান পাতে। দূরে মন্ত্রোচ্চারণ হচ্ছে যেন। এগিয়ে যায় নদীর দিকে। কাদা লাগে পায়ে। কী যেন খুঁজছিল সে। কী যেন... হ্যাঁ, ঠিক মনে পড়েছে… বৈজু, কোথায় বৈজু? জোরে ঢাক বাজল। ছেলেদু’টো ফিরল বোধ হয়। ওদের গায়ে জল ছেটাতে হবে। তবে ওরা আগের মতো হবে। ওরা তো এখন মানুষ নেই! কত ক্ষমতা শ্যামলের!

ঘরে ফিরে অল্প বিশ্রাম নিতে হয়। নীলপুজো শুরু হলে আর বিশ্রাম পাবে না সে। চড়কের প্রত্যেকটি খেলা শ্যামলের তত্ত্বাবধানে হয়। বাবার আশীর্বাদ আছে, কোনও খেলায় সে বিফল হয় না। মানুষ অবাক হয়ে দেখে সে খোলা দায়ের উপর হেঁটে যাচ্ছে, অথবা হাঁটছে আগুনের উপর দিয়ে। যে জীবন দিয়েছেন তিনি, সে তো তাঁর লীলাখেলা! সেখানে আগুন আছে, ধারও আছে। বড় কাটে গো! এ দিক গেলে ও দিক কাটে, ও দিক গেলে এ দিক কাটে। এই খেলা আর এমন কী! এ বার চড়কে ঘুরবে রতন। বলে গিয়েছে একুশ পাক নয়, আরও অনেক পাক ঘুরবে সে। কচি বয়স, ওকে নেশা দিতে হবে, বাবার প্রসাদ দিতে হবে বেশি করে। বৈজু উঠে পড়েছে ভোর হতেই। একমাত্র এই দিনটায় ও বাবাকে পুজোয় সাহায্য করে। আরও ছেলেরা আছে, কিন্তু তবু তার প্রায় নাস্তিক ছেলে তার সঙ্গে থাকে। সে তৈরি হতে শুরু করে। হঠাৎ শোনে অনেকের উত্তেজিত কথাবার্তার শব্দ। দরজা খুলে বাইরে আসে শ্যামল। সন্ন্যাসীরা এবং গ্রামের অনেকে দাঁড়িয়ে আছে উঠোনে। প্রত্যেকেই অসম্ভব উত্তেজিত। শ্যামল অবাক হয়। কী হল, আবার কি পুলিশ এসেছে? তার তন্ত্রচর্চা অনেকেই ভাল চোখে দেখে না। তাই থানায় খবর দেয়। তেমনই কি কিছু হল? শ্যামল সহজে অধীর হয় না। ওদের শান্ত করে, জানতে চায় কী হয়েছে। ওদের কথা শুনে চমকে ওঠে সে, এমন তো কোনও দিন হয়নি। এ কী অমঙ্গল! রতনকে নাকি ভোর থেকে পাওয়া যাচ্ছে না। কী হবে এ বার? চড়কের মূল আকর্ষণ ওই বিশেষ খেলাটি। শ্যামল শান্ত স্বরে সবাইকে পুজোর আয়োজন করতে বলে। রতন ফিরে আসবে। নিজে চোখ বুজে আদিনাথকে স্মরণ করে। আজ পর্যন্ত কোনও দিন পুজোয় বিঘ্ন হয়নি। তার অশান্ত মনকে শান্ত করে সে, নিজের কাজে মন দেয়। বৈজু নীরবে তাকিয়ে আছে তার দিকে। তাকেও আশ্বস্ত করে শ্যামল। 

অন্তরের সমস্ত ভক্তি দিয়ে নীলের পুজো করে সে। চড়কের মাঠে মেলার আয়োজন শুরু হয়েছে গত কয়েকদিন ধরে। চেনা মাঠ পাল্টে গিয়েছে। কত মানুষ, কত দোকান, কত কিছু। পুজোর মাঝে ছেলেরা এসে বার বার খবর দিয়ে যায়, রতনকে বহু খুঁজেও পাওয়া যায়নি। চোখ বুজে মন্ত্র বলে সে। একমনে আদিনাথ শিবকে ডাকে। পুজো শেষ হলে উঠে দাঁড়ায়। তাকে ঘিরে ধরে ছেলেরা। শান্ত স্বরে সে ঘোষণা করে, চড়ক ঘুরবেই, পাঁচ পুরুষের চড়ক থেমে যাবে না। রতন যদি না থাকে, অন্য কেউ ঘুরবে। স্বেচ্ছায় ব্রতপালনরত যে আসবে, তাকে বরণ করে নেবে শ্যামল। এই ক’টা কথা বলে ক্লান্তিতে, উত্তেজনায় হাঁপাতে থাকে সে। নীরব হয়ে যায় পুজোর মাঠ। না, কেউ আসে না। শ্যামল যেন জানত এমনটাই হবে, এক মুহূর্ত সময় নেয় না সে। ঘোষণা করে, সে-ই ঘুরবে চড়কে। এতে অসুবিধে একটাই, তার পিঠে বঁড়শি লাগানোর কেউ যেহেতু নেই, তাই তার গুরুকে এখানে নিয়ে আসতে হবে। স্তম্ভিত হয়ে থাকে সবাই। মুহূর্তে বৈজু তিরের মতো সামনে এসে দাঁড়ায়। বাবাকে আড়াল করে দাঁড়িয়ে সে জোর গলায় বলে, বাবা নয়, চড়কে ঘুরবে সে। শ্যামল ফেটে পড়ে আবেগে। জড়িয়ে ধরে ছেলেকে। এই তো পেরেছে সে, আজ তার জিত। চিৎকার করে, হর হর মহাদেব... ঢাক বেজে ওঠে। 

মন্ত্র পড়ে বাবা চড়কের বঁড়শি ঢোকাচ্ছে ছেলের পিঠে। উত্তেজনায় ঘামছে শ্যামল। মহাদেব ফিরিয়ে দিয়েছেন ছেলেকে। তার বিশ্বাসের কাছে ছেলে মাথা নত করেছে। শুধু তার নয়, পাঁচ পুরুষের আশীর্বাদ ঝরছে, টের পায় শ্যামল। চোয়াল শক্ত করে স্থির বসে আছে বৈজু। বঁড়শি লাগানোর পনেরো মিনিটের মধ্যে শেষ করতে হয় ঘোরা। নইলে কষ্ট বাড়ে। বৈজু শূন্যে ওঠে, ছেলেরা ঘোরায় চড়ক, শ্যামল তাকিয়ে থাকে ছেলের মুখের দিকে সস্নেহ দৃষ্টিতে। তাকিয়ে আছে বৈজু, চোয়াল যন্ত্রণায় শক্ত। এক বিন্দু মাদক নেয়নি সে। বাবাকে আগলে রাখার এক অসম্ভব চেষ্টায় সে স্বীকার করছে পরিস্থিতি। স্কুলের বন্ধুরা অপেক্ষা করছে অ্যাম্বুল্যান্স নিয়ে। ছেলের চোখ দেখে শ্যামল চকিতে বুঝে নেয় সব কিছু। এ কী করল সে! আর্ত চিৎকারে ছিটকে বেরিয়ে যায়। শিশু বৈজুকে কোলে নিয়ে নিজের থেকে নিজে পালাতে থাকে। দূরে, বহু দূরে...