Abosar

চুলোচুলি

রজতশুভ্র মজুমদার

ভাত-ডাল-আলুসেদ্ধ! এটুকুই যে আজ ঠিক মতো করতে পারবেন তিনি, কেউ ভেবেছিল? রামতনুবাবু নিজেও কি ভেবেছিলেন? এমনিতেই তাঁর বয়স হয়েছে। সামনের অক্টোবরে রিটায়ারমেন্ট। কিন্তু আসল বয়স তো সত্তর ছুঁই-ছুঁই! সে-আমলে আট-দশ বছর জল লোকে হামেশাই মেশাত। এত বছর টানা সার্ভিস দিয়ে এসেছেন। এখন ক্লান্তি ভর করেছে তাঁকে। রামতনু গড়াই তো আর অফিসার-প্রফেসর নন, দৌড়ঝাঁপের কাজ তাঁর। ফাইল হাতে নিয়ে এ টেবিল থেকে সে টেবিল, এ ঘর থেকে ও ঘর, এ আপিস থেকে ও আপিস! হাঁটু গিয়েছে, কোমরও তাই। তবু মনে শান্তিটুকু থাকলে, তিনি সব কিছু পারেন। কিন্তু শান্তি? কোথায় সে সোনার হরিণ? উফ! সকাল থেকে কী কাণ্ডটাই না শুরু হয়েছে! যেন বঙ্গোপসাগর থেকে ধেয়ে আসা প্রবল নিম্নচাপ তাঁর বাড়িতেই আছড়ে পড়েছে ঝড় হয়ে!

কারণে-অকারণে মলিনা তাঁর উপর যতই ঝাঁপিয়ে পড়ুন না কেন, তাঁকে ভালও তো বাসেন! এই সংসার মেয়ে আর স্বামী ছাড়া মলিনা কিছুই চেনেন না। সেই মলিনা পাথরের মতো শুয়ে, চোখের জল গড়িয়ে পড়ছে বিছানায়— এই দৃশ্য কি সহ্য করা যায়? সকাল থেকে বহু সাধাসাধি করেও, কিচ্ছু খাওয়াতে পারেননি রামতনুবাবু। শেষমেশ অনেক চেষ্টায় শর্তসাপেক্ষে রাজি করিয়েছেন দুপুরে একটু ডালভাত খেতে। সেই রান্না সবেমাত্র নামিয়েছেন রামতনুবাবু। স্বাভাবিক ভাবেই মনে অদ্ভুত রকমের আনন্দের অনুভূতি!

গত পরশু বিকেলে মেয়ে-জামাই এল কোনও রকম পূর্বাভাস ছাড়াই। তখন থেকেই রামতনুবাবুর উপর চাপটা বেড়ে গিয়েছে বেশ কয়েকগুণ। শারীরিক চাপটা যদি বা হজম করা যায়, অর্থনৈতিকটা 
তো অসম্ভব! 

‘‘মাছ আনো, মাংস আনো, পনির আনো, ডিম আনো...’’ আরে বাবা! এই হাঁটু নিয়েও গোটা গ্রাম চক্কর মেরে আসা যায় যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ, কিন্তু মাছ-মাংস-ডিম-পনির তো ততক্ষণই আসবে, যতক্ষণ পকেটে আছেন মা লক্ষ্মী! তবু ধারধোর করে রামতনুবাবু ম্যানেজ করেছেন সবটাই! মলিনার মন রাখতে মেয়ে-জামাইয়ের আদরযত্নের কসুর করেননি তিনি।
সবই ঠিক ছিল আজ সকাল ন’টা পর্যন্ত! মেয়ে-জামাই সাতটার ট্রেন ধরে দূরের মফস্সল শহরে গিয়েছে জরুরি কাজে, ফিরবে সন্ধের পর। জামাইকে লিকার আর ফ্লেভারের কড়া চা খাইয়ে, দু’জনকে পাড়ার মোড় থেকে রিকশা ধরিয়ে, ঘরে ফিরে জিরিয়ে নিচ্ছিলেন রামতনুবাবু। তখনও কি ভাবতে পেরেছিলেন সকাল সাড়ে দশটা নাগাদ বড়বাবুকে ফোন করে জানাতে হবে, ‘‘স্যর, আজ আমি যেতে পারছি না কিছুতেই!’’

‘‘মানে? আজ তো অফিসে আর্জেন্ট মিটিং! নীল ফাইলের আলমারির চাবি তো তোমার কাছে!’’
‘‘জানি স্যর, কিন্তু বড় বিপদ হয়ে গিয়েছে বাড়িতে।’’
‘‘বিপদ? কী বিপদ?’’

বিপদ বলে বিপদ! দেরি করে ঘুম থেকে ওঠা মলিনার চিরকেলে অভ্যেস। অন্যান্য দিনের মতোই আজও সকাল ন’টার আশপাশেই উঠেছেন তিনি। ওঠার কিছু ক্ষণের মধ্যেই এমন আর্তনাদ ছেড়েছেন যে, রামতনুবাবু তো কোন ছার, পাশের বাড়ি, তস্য পাশের বাড়ির শাশুড়ি সমেত বউটাও চলে এসেছে এখানে!

‘‘আমার সর্বনাশ হয়ে গিয়েছে গো,’’ মলিনার চোখেমুখ জুড়ে আতঙ্কের ছাপ।

‘‘কী হয়েছে তোমার? বলো মলিনা, বলো!’’ রামতনুবাবু ঘটনার আকস্মিকতায় দিশেহারা তখন। হবেন না-ই বা কেন, এ রকম ঘটনা তো কস্মিনকালেও শোনেননি! বাথরুম থেকে ফিরে ঘোমটা সরিয়ে চুলটা ঠিক করতে গিয়ে মলিনা দেখেন, গোছা গোছা চুল চলে আসছে তাঁর হাতে! সত্যিই তো! মলিনার দু’হাত ভর্তি চুল! মুঠো-মুঠো চুল! মাথা প্রায় ফাঁকা! ভয়ে আর্তনাদ করতে করতে প্রায় আছড়ে পড়লেন মেঝেতে! কিছু ক্ষণের মধ্যেই সংজ্ঞাহীন। রামতনুবাবুর বুকের ভিতর রোলার চলছে যেন! পাড়া-প্রতিবেশীরাই যা হোক ব্যবস্থা করে নিয়ে গিয়েছিলেন হাসপাতালে। ডাক্তারবাবু তো সব শুনে থ! তিনি কিছু ক্ষণ অবজ়ার্ভেশনে রাখার পরামর্শ দিলেন। মলিনার জন্য একটা স্পেশ্যাল বেডের ব্যবস্থা হল। কিছু ক্ষণের মধ্যেই জ্ঞান ফিরলে মলিনা গড়াই ড্যাবড্যাব করে চেয়ে রইলেন স্বামীর দিকে, ‘‘ওগো আমি ভাল হব তো? আমি বাড়ি ফিরতে চাই।”

‘‘আপনি ভাল হয়ে গিয়েছেন তো! দুশ্চিন্তার কিছু নেই,’’ ডাক্তারবাবু সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করলেন।

রামতনুবাবু কিছুটা বল পেলেন ডাক্তারবাবুর কথায়, ‘‘তা হলে কি ওকে বাড়ি নিয়ে যেতে পারি?’’
‘‘পারেন,’’ ডাক্তারবাবু মাথা চুলকে বললেন, ‘‘প্রেশার বেশ লো। কয়েকটা ওষুধ দিলাম, খাবার ঠিক করে খেতে হবে।’’
মলিনাকে নিয়ে রামতনুবাবু যখন বাড়ি ফিরলেন, চতুর্দিকে থিকথিক করছে লোক। তাঁদের কৌতূহলের শেষ নেই। তাঁরা আলোচনা করছেন, উত্তরপ্রদেশ আর ঝাড়খণ্ডে নাকি মহিলাদের অজান্তেই তাঁদের চুল কেটে নেওয়া হচ্ছে। আর চুল কেটে নেওয়ার আগে এক অদ্ভুত ছায়ামূর্তি দেখা যাচ্ছে। কিন্তু কে এই ছায়ামূর্তি? কোনও ছদ্মবেশী মানুষ, না ভূত? তবে কি পশ্চিমবঙ্গেও ঢুকে পড়ল চুল কেটে নেওয়া ভূত? 

এক ভদ্রলোক বললেন, ‘‘উত্তরপ্রদেশ ঝাড়খণ্ডের থেকে পশ্চিমবঙ্গের ঘটনা আলাদা। ওই দু’টি রাজ্যে চুল কেটে নেওয়ার ঘটনা ঘটেছে রাতের অন্ধকারে, কিন্তু রামতনুবাবুর বাড়িতে ভূত ঢুকেছিল সকালবেলা, দিনের আলোয়।’’
মলিনার শোওয়ার ঘরে তত ক্ষণে ঢুকে পড়েছে বাড়ির কাজের মেয়েটা। সে ভয়ে কাঁপছে ঠকঠক করে,  ‘‘আমি আর কাজ করতে পারবনি মাসিমা, আমাকে খ্যামা দিয়ো...’’ মলিনার মুখের কাছে গিয়ে ফিসফিস করে কথাগুলো বলতে-বলতে চুলটা খুব ভাল করে পরখ করে নিল সে। মলিনার অমন সাধের চুল সত্যি-সত্যিই তবে ভূতে খেয়ে নিল? চুল নিয়ে মলিনার যথেষ্ট আদিখ্যেতা ছিল। খোঁপা খুলে দিয়ে ঘন চুলের ঢালে মলিনা যখন তেল লাগাতেন, কিংবা শ্যাম্পু করে বাদামি তোয়ালেটায় চুল ঘষতে ঘষতে আয়নার সামনে দাঁড়াতেন কায়দা করে, তখন তাঁকে সত্যিই বেশ সুন্দর দেখাত। এ কথা যে শুধু বাড়ির ঝি আর তিনি নিজে জানতেন তা নয়, রামতনুবাবুও ওই চুলের গুণগান করে বেড়াতেন আড়ালে আবডালে। সে কথা মলিনার অজানা ছিল না। সেই চুল আজ কোথায়? মাথা তো ফাঁকা, দু’-একটা জায়গায় চকচকে টাক।

বিছানার একপাশে বসে থাকা চিন্তাগ্রস্ত রামতনুবাবুর দিকে এগিয়ে গেল কাজের মেয়েটা, ‘‘জানো গো মেসো, উতুরপাড়ার চাটুজ্যেগিন্নিরও চুল তুলে নিয়েচে ভূতে!’’
‘‘সে কী রে! কবে হয়েছে এমন?’’
‘‘আমি শুনেচি দিন দুই আগে। কিন্তু তখন বিশ্বেস হয়নি গো। আজ বুজতে পারচি...’’ গোলাপি চোখ গোল-গোল করে বলল, ‘‘মাসিমাকে ভূতে পেয়েচে গো মেসো, তুমি তাড়াতাড়ি ওঝা ডেকে আনো। ভূত নামাতি হবে।’’
‘‘আচ্ছা গোলাপি, ওই যে চ্যাটার্জিগিন্নি, ওঁর কেমন করে চুল কাটা পড়ল জানিস?’’
গোলাপি গড়গড় করে জানিয়ে দিল, চ্যাটার্জিগিন্নির মাথার ব্যামো শুরু হয়েছিল, ছেলেকে মাথা টিপে দিতে বলেছিলেন। ছেলে মহিলার মাথায় হাত দিতেই নাকি প্রায় সব চুল খসে পড়েছিল মাথা থেকে। তা দেখেই অজ্ঞান হয়ে পড়েন তিনিও।
মলিনা এত ক্ষণ চুপ করে ছিলেন। কথা বলার মতো মানসিক অবস্থা তাঁর নেই। কোনও রকমে তিনি রামতনুবাবুকে কাছে ডাকলেন, ‘‘এ দিকে শোনো।’’
‘‘তুমি এতটা ভেঙে পোড়ো না মলিনা,’’ মলিনার কাছ ঘেঁষে বসলেন রামতনুবাবু।
‘‘তুমি ওঝা ডাকো।’’
‘‘ওঝা?’’ রামতনুবাবুর হাঁ বন্ধ হল না।
অন্য সময় হলে নির্ঘাত ঝাঁঝিয়ে উঠতেন। কিন্তু এখন মলিনা চুপসে যাওয়া বেলুন। মিউমিউ করে বললেন, ‘‘তা ছাড়া বাঁচার কোনও উপায় নেই গো! দেখছ তো, গোলাপি কী বলছে!’’ মলিনা কেঁদেই চলেছেন বিরামহীন।
‘‘তুমি কিছু খাও। ডাক্তারবাবু ভাল-মন্দ খেতে বলেছেন।’’
‘‘আমি কিচ্ছু খাব না।’’
‘‘না খেলে তো শরীর ঠিক 
হবে না।’’
‘‘খেলে বুঝি আমার চুল ফিরে আসবে?’’
‘‘তুমি যেমন শুয়ে আছ, তেমনই থাকো, আমি একটু দই-চিঁড়ে এনে খাইয়ে দিই,’’ রামতনুবাবু কাকুতি-মিনতি করলেন। কিন্তু কাজ হল না। শেষমেশ একটি শর্তে মলিনা অনশন ভাঙতে রাজি হলেন। রামতনুবাবু যদি এক্ষুনি পাশের গ্রামের নরেশ ওঝার কাছে যান, তবেই তিনি দুপুরে এক মুঠো ভাত খেতে পারেন। নরেশ ওঝা নাকি সাক্ষাৎ ভগবান। তিনি বহু মানুষের ঘাড় থেকে ভূত নামিয়েছেন। নরেশ ওঝাই এখন বাঁচাতে পারেন মলিনা গড়াইকে।

রামতনুবাবুর ওঝায় যতটা অভক্তি, তার থেকে ঢের বেশি ভক্তি বৌয়ে। তা ছাড়া স্ত্রীর কথা তিনি অমান্য করেন না। মলিনাকে খাওয়ানোটাও খুব জরুরি এখন। এই সব সাতপাঁচ ভেবে তিনি রাজি 
হয়ে গেলেন।
তত ক্ষণে আপিসের বড়বাবু ফোন করেছেন রামতনুবাবুকে, ‘‘স্ত্রী কেমন আছেন?’’
‘‘একই রকম, স্যর। বড্ড খারাপ লাগছে, আমি আজ যেতে পারলাম না।’’
‘‘না-না, ও নিয়ে চিন্তা করতে হবে না তোমায়। নীল ফাইলের ব্যবস্থা আমি করে ফেলেছি,’’ বড়বাবু কিছু ক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, ‘‘এক কাজ করো দেখি, তুমি তোমার 
স্ত্রীর মাথার ছবি তুলে আমাকে পাঠাতে পারবে?’’
‘‘কোনও উপায় ভেবেছেন স্যর?’’ চোখ চকচক করে ওঠে রামতনুবাবুর।
‘‘ভেবেছি বলেই তো বললাম,’’ ও প্রান্ত থেকে গম্ভীর উত্তর এল।
‘‘কিন্তু স্যর, আমি না জানি ছবি তুলতে, না পাঠাতে। তা ছাড়া আমার মোবাইলটা তো খুব সাধারণ, শুধু কথা বলা যায়।’’
‘‘দেখো যদি আশপাশের কারও ফোন থেকে পাঠানো যায়। বলবে, আমার ফোন নম্বরেই আমার হোয়াটসঅ্যাপ আছে।’’
কিছু ক্ষণের মধ্যেই পাড়ার হরিচরণ তলাপাত্র তার স্মার্টফোনে মলিনার টাকযুক্ত গোটা মাথার ছবি তুলে বড়বাবুকে হোয়াটসঅ্যাপ করে দিল। রামতনুবাবু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে ঢাউস ছাতা বাগিয়ে এই গ্রীষ্মের খর রোদে হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে গেলেন নরেশ ওঝার খোঁজে। বেরনোর সময় দেখলেন বাড়ির সদর দরজার সামনে গোবর, নিমপাতা আর রসুন লাগিয়ে দিয়েছেন কোনও সহৃদয় ব্যক্তি। ভূত তাড়াতে বড় কাজে লাগে এগুলো। সত্যি, বিপদের দিনে উপকারী লোকের অভাব 
হয় না।

রাস্তায় যেতে যেতে রামতনুবাবু শুনলেন, সর্বত্র তাঁর স্ত্রীকে নিয়েই আলোচনা। মোড়ে মোড়ে জটলা। ঘরের মেয়েদের স্কুলে পাঠানোর উপর নিষেধাজ্ঞা জারি হয়ে গিয়েছে এ-তল্লাটে। কাল থেকে বেশির ভাগ মেয়েই আর স্কুলে যাবে না। এক জন হোমরা-চোমরা গোছের লোক তো রামতনুবাবুকে ছাড়তেই চাইছিলেন না, তাঁর দাবি, ‘‘রামদা, তুমি পুলিশে যাচ্ছ না কেন ?’’
‘‘ইয়ে মানে...’’ রামতনুবাবু আমতা আমতা করতে লাগলেন।
‘‘আমি বলি কী, তুমি সোজা থানায় চলে যাও। সেখানে একটা জিডি করে এস। আজ তোমার ঘরে হয়েছে, কাল যে আর কারও ঘরে হবে না, তার ঠিক কি!’’
‘‘কিন্তু অভিযোগটা করব কার বিরুদ্ধে?’’ মোক্ষম উত্তর দিলেন রামতনুবাবু।
হোমরা-চোমরা কথা খুঁজে না পেয়ে হাল ছেড়ে দিলেন। 

রামতনুবাবু কার্যসাধনে অক্ষম হয়ে ফিরে এসেছেন বাড়ি। নরেশ ওঝা বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে ঘুরতে গিয়েছেন বাইরে। এ হপ্তায় ফিরবেন না। এ কথাটা অবিশ্যি মলিনাকে বলেননি তিনি, বললে হয়তো ফের মূর্ছা যাবেন স্ত্রী। বেশ কৌশল করে রামতনুবাবু বলেছেন, ‘‘নরেশ ওঝা বাড়ি নেই, বাইরে। বিকেলে ফিরবেন। বাড়ির লোককে বলে এসেছি ফিরলেই পাঠিয়ে দিতে।’’
‘‘ভাল করে বলেছ তো তুমি?’’ মলিনার গলার স্বর খাদে।
‘‘বলেছি গো, বলেছি। ঠিক আসবেন, তুমি দেখে নিয়ো। এখন আমি রান্না চড়াই। তোমাকে তো 
কিছু মুখে দিতে হবে নাকি? বেলা তো পড়ে এল...”
বেলা সাড়ে তিনটেয় রামতনুবাবু ডাল আর আলুসেদ্ধ দিয়ে ভাত মেখে এনেছেন মলিনার বিছানায়। ওঠার শক্তি নেই মলিনার। তাঁকে ওই অবস্থাতেই খাইয়ে দিচ্ছেন রামতনুবাবু। পাশের বাড়ির জানলা থেকে কেউ এক জন চেঁচিয়ে বলল, ‘‘ও কাকু, কাকিমাকে দেখাচ্ছে টিভিতে!’’
‘‘সে কী! টিভিতে দেখাচ্ছে? মানে?’’
‘‘টিভিটা চালাও, দেখতে পাবে।’’
টিভি খুলতেই চমকে উঠলেন রামতনুবাবু। এ কী, আপিসের বড়বাবুকে পাঠানো মলিনার মাথার ছবি টিভির গোটা পর্দা জুড়ে! সেখানে জোর কদমে আলোচনা চলছে চুল নিয়ে! কোথায় গেল মলিনা গড়াইয়ের চুল? কে চুল ছিঁড়ে নিল? সে কি সত্যিই ভূত? না কোনও মানুষ? ভূত যদি হয়, কেন সে মলিনা দেবীকেই বেছে নিল? আর মানুষ যদি হয়, কী তার উদ্দেশ্য? ভূতের ছদ্মবেশে সে কি আতঙ্ক ছড়াতে চাইছে বাংলার বুকে? নষ্ট করতে চাইছে পশ্চিমবঙ্গের সুস্থ সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল? এর পিছনে কি কোনও রাজনৈতিক চক্রান্ত আছে? না কি নিছকই বিকৃতমস্তিস্ক মানুষের কাজ এই চুল ছিঁড়ে নেওয়া? মনস্তত্ত্ববিদ, সমাজতত্ত্ববিদ, গবেষক, লেখক, সাংবাদিক... সকলে তাঁদের অমূল্য মতামত অকাতরে বিলিয়ে দিচ্ছেন চ্যানেলের মাধ্যমে। 

সন্ধের আগেই মেয়ে-জামাই ঘরে ফিরে এল। তাদের চোখেমুখে একরাশ উৎকণ্ঠা। বাবার মুখোমুখি হতেই মেয়ে উত্তেজিত গলায় প্রশ্ন করল, ‘‘এ সব কী শুনছি?’’
‘‘তুই কোথায় শুনলি? তোদের কাজ হয়েছে? এত তাড়াতাড়ি ফিরে এলি যে...’’
‘‘কোথায় শুনলাম মানে? বলি শুনতে আর কারও বাকি আছে না কি? পৃথিবীসুদ্ধ লোক ঘটনাটা জেনে গিয়েছে বাবা। ফেসবুকে খবরটা ভাইরাল হয়ে গিয়েছে, বুঝলে?’’
বাবা কোনও কথা বলতে পারছেন না। তিনি পাথরের মতো স্থির হয়ে আছেন। মলিনা মেয়েকে হাতের ইশারায় কাছে ডাকলেন। মেয়েই তাঁর সবচেয়ে বড় অবলম্বন। অনেক সঙ্কটের সময়ে এই মেয়ের উপদেশ-পরামর্শেই বিপদ থেকে উদ্ধার পেয়েছেন তিনি। মনে অবুঝ আশা, মেয়েই উদ্ধার করবে এ বারও! 
মাকে বোঝানোর নানা চেষ্টা করে বিফল হয়ে পাশের ঘরে গেল মেয়ে। একটু পরেই রাগে গরগর করতে করতে সে প্রায় ছুটে ফিরে এল। তার হাতে একটা আধখালি কৌটো। সম্ভবত কোনও কসমেটিক্সের। চিলচিৎকার করে উঠল, ‘‘এটা কে ইউজ় করেছে?’’
‘‘ওটা তো মাথার তেল! আমি কাল রাতে চুলে দিয়েছিলাম তোর ব্যাগ থেকে নিয়ে...’’ মেয়ের রণরঙ্গিণী মূর্তি দেখে মলিনার গলা চায়ে ভেজা বিস্কুটের মতো ন্যাতপেতে।
‘‘জান এটা কী? কোনও আইডিয়া আছে তোমার?’’ মেয়ের গলা সপ্তমে।
‘‘কী ওটা?’’ রামতনুবাবুর চোখ কপালে।
‘‘এটা একটা দামি ব্র্যান্ডের হেয়ার রিমুভিং অয়েল বাবা, পিঁপড়ের ডিম দিয়ে তৈরি। মা এটা ব্যবহার করার আগে আমাকে জিজ্ঞেস করারও প্রয়োজন বোধ করেনি!’’